পাটকেলঘাটা গণহত্যা সাগরদাঁড়ি রাজাকার ঘাঁটির পতন by সৈয়দ দীদার বখ্ত
মোহর আলী ও শহর আলী যমজ ভাই। সুদর্শন, সুন্দর সুঠাম দেহ সৌষ্ঠব। একই রকম দেখতে। আলাদা করে চেনা যায় না। দুজনই অত্যন্ত সাহসী নির্ভীক। পারিবারিক ভাবে ওরা আমাদের পরিবারের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করে। দুই ভাই একদিন এসে আমাকে ও কামেলকে বললো যে, তারা যুদ্ধে যাবে। বড় ভাই মোহর একটু নির্ঝঞ্ঝাট প্রকৃতির, ৫ মিনিট পরে জন্মানো ছোট ভাই শহর দুরন্ত, দুর্দান্ত ও ডানপিটে ধরনের। আমরা সানন্দে ওদের মুক্তিযুদ্ধে টেনে নিলাম। শহর আলী একদিন বললো- সে সাতক্ষীরায় যেতে চায় তার কিছু কেনাকাটা করতে হবে। আমি বললাম তোমরা এখন পরিচিত মুখ। সাতক্ষীরা শহরে মিলিটারি ঘাঁটি গেড়েছে। ওখানে অরক্ষিতভাবে যাওয়া চলবে না। ও শুনলো না। সাতক্ষীরা কলেজের ছাত্র সে- বললো, সাতক্ষীরার অলিগলি সে চেনে। তাকে মিলিটারিরা ধরতে পারবে না। সে কিছু কেনাকাটা করার জন্য সাতক্ষীরায় গেল। কেনাকাটা করে বাসে করে ফেরার পথে মিলিটারি চেকপোস্টে ধরা পড়লো। তাকে বাস থেকে নামিয়ে কোথায় নিয়ে গেল তার আর হদিস পাওয়া গেল না। যতদূর শুনেছি তাকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায় এবং অকথ্য নির্যাতন করে মেরে ফেলে। এমন ভাবে আওয়ামী লীগের তালা থানার সভাপতি আলী আহমেদকে বিনেরপোতা চেকপোস্ট থেকে ধরে নিয়ে যায়। তাকে আর পাওয়া যায় নি।
এই রকমভাবে মনতাজকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। মনতাজ ফিরে এসেছিল বিধ্বস্ত অবস্থায়। মনতাজের ভাষ্যমতে, ওদের যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে একটি গাড়ি করে কোনো এক বধ্যভূমিতে নিয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল পাক আর্মি। মাঝপথে গাড়ি বিকল হওয়ায় মনতাজ কোনো এক ফাঁকে গাড়ি থেকে নেমে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। সে দুদিন পর তালাতে ফিরে আসে। সে এখনো বেঁচে আছে। ওহাব বিশ্বাস একজন সাহসী
মুক্তিযোদ্ধা। শান্তি কমিটির লোকজন তাকে রাতের অন্ধকারে একা পেয়ে মেরে ফেলে। এভাবে একের পর এক মুক্তিযোদ্ধাদের একা পেলেই শান্তি কমিটির নেতারা ধরে নিয়ে মেরে ফেলতে থাকে। এর জন্য আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম দিনের বেলায় এককভাবে কেউ চলাফেরা করবে না।
তালা থানার পাশেই কেশবপুর থানা। কেশবপুরের সাগরদাঁড়িতে মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়িতে রাজাকাররা শক্ত ঘাঁটি তৈরি করেছে। ওখান থেকে রাজাকাররা কপোতাক্ষ নদ পার হয়ে কাশীপুরে হামলা করেছে। মুক্তিযোদ্ধারা পাটকেলঘাটা পুলিশ ফাঁড়ি থেকে রাইফেল ছিনিয়ে নেয়ার প্রতিশোধ নেবার জন্য তারা কাশিপুরে মিলিটারিদের সহায়তায় অভিযান চালায়। মিলিটারিরা ২৫/৩০ জনকে ধরে নিয়ে নদীর পাড়ে হাত-পা বেঁধে দাঁড় করে গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের পুণ্যভূমি সাগরদাঁড়িতে রাজাকারদের এই ঘাঁটি থেকে প্রায় প্রতিদিন অত্যাচার, নির্যাতন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি সম্পর্কে নানা সংবাদ আমাদের গোচরে আসতে লাগলো। এই ঘাঁটি উচ্ছেদের প্রয়োজন। নইলে নিরীহ গ্রামবাসী নির্মমভাবে অত্যাচারিত হতে থাকবে। সংবাদ নিয়ে জানলাম ঘাঁটিতে ৩০/৪০ জন রাজাকারদের একটি দল অবস্থান করছে। এই রকম একটি সুরক্ষিত ঘাঁটির পতন ঘটাতে হলে সাঁড়াশি আক্রমণ প্রয়োজন। সম্মুখভাগ- (কভারিং ফায়ার) এবং দু’পাশ থেকে আক্রমণ- এ ভাবে আক্রমণ রচনা করতে পারলেই এ ধরনের সুরক্ষিত ঘাঁটির পতন ঘটানো সম্ভব। কিন্তু আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের এত শক্তি নেই। আমার অভিমত এ ধরনের অভিযান স্রেফ আত্মহত্যার শামিল। কামেল এবং অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা আমার যুক্তি মানলো না। তাদের অভিমত- রাজাকাররা ভীতু। ওরা অর্থের বিনিময়ে লুটপাটের জন্য ধর্ষণ এবং অপকর্মের জন্য রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। আসলে নৈতিকভাবে তারা দুর্বল। ওদের সামনে কোনো আদর্শ বা নীতি নেই। মানসিক ভাবে দুর্বলরা কখনও যুদ্ধ করতে পারে না। আক্রমণ করলেই ওরা পালাবে। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্প্রসারিত করার জন্য আমি খুলনার মংলা এলাকায় যাই। কয়েকদিন পর ফিরে এসে জানতে পারি মুক্তিযোদ্ধারা সাগরদাঁড়ি রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণ করেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের দৃঢ় মনোবল এবং প্রত্যয়ে সেদিন সাগরদাঁড়ি রাজাকার ঘাঁটির পতন হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের থেকে জানলাম তারা সাগরদাঁড়িতে আক্রমণ করার সঙ্গে সঙ্গে রাজাকার ঘাঁটি থেকে বৃষ্টির মতো এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু হয়। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের মুখে ওরা ভয়ে ভীতু হয়ে ঘাঁটি পরিত্যাগ করে পালাতে থাকে। পরে জানলাম, পলায়নপর রাজাকাররা তাদের রাইফেল পুকুর, খানা-খন্দকের মধ্যে ফেলে পালিয়ে যায়। ঐ সময়ে পুকুর এবং খানা-খন্দক থেকে ১৮/২০টি রাইফেল মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামবাসীদের সহায়তায় সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিল।
এই ঘটনার কয়েক দিন পর পাক আর্মির একটি বিশালবহর নদীপথে তালাতে উপস্থিত হয়। সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা আমার তেঁতুলিয়া বাড়ি ঘিরে ফেলে। আমি তখন গ্রামের অভ্যন্তরেই। ছোটবেলার খেলার সাথী ছোটবাবুর শেল্টারে ছিলাম। মিলিটারিরা যখন তেঁতুলিয়াতে অভিযান চালায় আমি তখন গ্রামের অভ্যন্তরে ঐ বাড়িতে গভীর রাতে এসে ঘুমিয়ে ছিলাম। অতর্কিতভাবে মিলিটারি অভিযানে ভীতু হয়ে গ্রামের লোকজন পালাতে থাকে। এ সময়ে আমি যে বাড়িতে ছিলাম তার পাশের বাড়ির মেয়ে সাহানা বানু দৌড়াতে দৌড়াতে এসে আমাকে ঘুম থেকে তুলে জানালো মিলিটারিরা বাড়ি ঘিরে ফেলেছে- শিগগির পালান।
আমি ঘটনার গুরুত্ব অনুভব করে ওখান থেকে দ্রুত পালালাম। ঐ বাড়ির পাশেই খাল। খাল সাঁতরিয়ে আমি মদনপুর গ্রামে এসে পৌঁছালাম। ওখানে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সহযোদ্ধা আনছার মাহমুদের বাড়িতে আশ্রয় নেই। আমার পায়ের একটি আঙুল কেটে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। আনছার মাহমুদ ভাইয়ের স্ত্রী অবস্থার গুরুত্ব অনুভব করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে আমাকে ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে পাহারায় নিজে বসে থাকলেন। আমার পায়ের মারাত্মক জখম দেখে তিনি নিজে গাছগাছড়ার একটি ওষুধ তৈরি করে পা ব্যান্ডেজ করে দিলেন। বললেন- দু’দিনেই সেরে যাবে। আনছার মাহমুদ আমার বড় ভাইয়ের মতো। বর্তমানে তার বড় ছেলে আলিম মাহমুদ রংপুরের মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার (ডি.আই.জি)।
মাহমুদ ভাইয়ের বাড়ি থেকে লোক পাঠিয়ে তেঁতুলিয়ায় খবর নিলাম। জানলাম সাহানা বানু আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে পালাতে সাহায্য করেছে ঠিকই কিন্তু সে নিজে পাক হানাদার বাহিনীর সেপাইদের হাতে নির্যাতিত হয়েছে। সে এবং আরো একটি মেয়ে নাম “মানু” দুজন সেপাইয়ের দ্বারা নির্যাতিত। তারা দুজনেই চিকিৎসাধীন। গ্রামের এই দুটি মেয়ের বলিদান আমি ব্যক্তিগতভাবে এবং সার্বিকভাবে আমার প্রিয় মাতৃভূমি কখনো পরিশোধ করতে পারবো কিনা জানি না। এর মধ্যে মানু মারা গেছে- সাহানা এখনো ধুঁকে ধুঁকে জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। আরো জানলাম পাক আর্মিরা আমাকে না পেয়ে আমাদের বাড়িটা তৃতীয়বারের মতো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। যথারীতি গ্রামের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা গ্রামবাসীরা দ্রুত এসে আগুন নেভায়।
আমি আনছার মাহমুদ ভাইয়ের বাসায় নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পারিনি। ভাবিকে বললাম- আমি সন্ধ্যার পর পর অন্য জায়গায় আশ্রয় নেব। এখানে থাকলে আপনাদের সকলের বিপদ। আমাকে কিছুতেই যেতে দেবেন না তিনি আমার পায়ের অবস্থা বিবেচনা করে। মাহমুদ ভাইকে বললাম আমাকে একটি গামবুট জোগাড় করে দিন। আমি ঠিকই যেতে পারবো। আমি এখানে থাকলে আপনাদের বিপদ আরো বাড়বে। মাহমুদ ভাই জুতা যোগাড় করে দিলেন। আমি সন্ধ্যার পর পরই ভাবীর সকল বাধা পেরিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
এই ঘটনার দুইদিন পর পাক আর্মির একটি বাহিনী মাহমুদ ভাইয়ের বাড়ি আক্রমণ করে। এবং আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়, লুটপাট করে। আমাকে যারা এভাবে আশ্রয় এবং সেবা করেছেন তাদের ঋণ কখনও শোধ করতে পারবো না। ওখান থেকে বেরিয়ে আমি ঐ রাত্রে হাত বাঁশের মাধ্যমে মাহতাব মোড়লের বাড়িতে আশ্রয় নেই। ওরা আমাকে দুদিন সেবা শুশ্রূষা করে সারিয়ে তোলে। এভাবেই আমরা আমাদের প্রিয় জন্মভূমিকে হানাদার মুক্ত করার জন্য প্রাণবাজি রেখে দেশমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছি। জানি জয় আমাদের হবেই- আল্লাহ আমাদের সহায়।
No comments