আল মাহমুদের কবিতা : সত্তার ভারমুক্ততার ভাষ্য by মহীবুল আজিজ
সিক্স
মেমোজ ফর দ্য নেঙট মিলেনিয়াম-সিরিজের বক্তৃতায় ইতালো ক্যালভিনো লিখেছিলেন,
চার দশককালের লেখালেখির প্রেক্ষাপটে একটা কাজই তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে
মনে হয়েছে – সত্তার ভারমুক্তি। মানবসত্তার আয়তন প্রভূত ভারে আক্রান্ত। তার
সেই ভারাক্রান্ত অবস্থান থেকে, তার সামগ্রিক পরিপার্শ্ব থেকে, এমনকি হয়তো
তাকে নিয়ে গড়া সাহিত্যের কাঠামো এবং ভাষা থেকেও ভার সরিয়ে নেওয়ার কাজটাই
তিনি করতে চেয়েছেন। ক্যালভিনোর কথার সূত্র ধরে বলা যায়, হয়তো মানবের সত্তায়
প্রলিপ্ত থাকা উদ্বেগ, আশংকা, স্বপ্নহীনতা কিংবা দুঃস্বপ্নের চাপ থেকে
মুক্তির আকাঙ্ক্ষা লেখক তাঁর চরিত্র ভাব দর্শন এসবের মধ্যে প্রকাশ করেন।
‘লিখেছিলেন’ কথাটা বলতে হয় এজন্যে, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘চার্লস
এলিয়ট নর্টন পোয়েট্রি লেকচার্সে’র জন্যে ছয়টি বক্তৃতা রচনা সমাপ্ত করে,
প্রদানের আগেই ক্যালভিনো মৃত্যুবরণ করেছিলেন। পরে, সেই বক্তৃতামালা তাঁর
স্ত্রী এস্থার ক্যালভিনোর সৌজন্যে প্রকাশিত হয় গ্রন্থাকারে। কথাশিল্পী
ক্যালভিনোর উপর্যুক্ত বক্তব্য বৃহত্তর দৃষ্টিতে সৃজনশীল সাহিত্যক্ষেত্রে
নিবেদিত যে-কোনো সাহিত্য-রচনার অভিমুখ হিসেবে বিবেচ্য হতে পারে। এমনকি হতে
পারে দুর্বোধ্য-দূরান্বয়ী রূপক-প্রতীকে মোড়ানো কাব্যভুবনের ক্ষেত্রেও।
চকিতে আমাদের মনে পড়ে যায় পুশকিন, লেরমেন্তভ, আখমাতোভা, ইয়েভতুশেংকু, পোপা,
হোলুব, মিয়োজ, ওসিপ মানডেলস্টাম, জর্জ ফালুদি, গিন্সবার্গ, হিনি এরকম সব
বোধ্য-দুর্বোধ্য কাব্যরচয়িতাদের নাম। সেদিক থেকে আল মাহমুদের কবিতা অনেক
বেশি স্পষ্ট এবং লক্ষ্যসচেতন।
দ্রম্নতধাবমান তরঙ্গ হয়ে ছুটতে থাকে কবিতা, অজস্র কবিতা – আল মাহমুদকে তাঁর প্রয়াণের পরে মনে করতেই কতকাল আগেকার সেসব কবিতা ভিড় করে। কবিতারা জ্বলে আর নেভে কিন্তু একেবারে নির্বাপিত হয় না। বরং কবিতাগুলো উপলক্ষের অপেক্ষাতেই থেকে যায় ফের জেগে ওঠার জন্য। দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুঃসময়’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’, জীবনানন্দ দাশের ‘আবার আসিব ফিরে’, অমিয় চক্রবর্তীর ‘চিরদিন’, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘যযাতি’, বুদ্ধদেব বসুর ‘ধৃতরাষ্ট্রের বিলাপ’, বিষ্ণু দে-র ‘ঘোড়সওয়ার’, দিনেশ দাশের ‘কাস্তে’, জসীম উদ্দীনের ‘কবর’, ফররুখ আহমদের ‘ডাহুক’, আহসান হাবীবের ‘আমি কোনো আগন্তুক নই’, আবদুল গনি হাজারীর ‘কতিপয় আমলার স্ত্রী’, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘মে-দিনের কবিতা’, শামসুর রাহমানের ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, শঙ্খ ঘোষের ‘বাবরের প্রার্থনা’, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভালোবাসা ছাড়া’, শহীদ কাদরীর ‘উত্তরাধিকার’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কেউ কথা রাখে নি’, রফিক আজাদের ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’, মোহাম্মদ রফিকের ‘সারা বিষ্ণুপুর জুড়ে’, মহাদেব সাহার ‘চিঠি দিও’, নির্মলেন্দু গুণের ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসি নি’, হুমায়ুন আজাদের ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’, আবুল হাসানের ‘উদিত দুঃখের দেশ’, হুমায়ুন কবিরের ‘এ কেমন শহর’, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘আমি কিংবদমত্মীর কথা বলছি’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘নৈশভোজে রক্তপাত’ এসব কবিতার সঙ্গে একজোটে ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি করছে আল মাহমুদের ‘কালের কলস’, ‘রবীন্দ্রনাথ’, ‘ভারতবর্ষ’। হ্যাঁ, ক্যালভিনো যেমনটি বলেছিলেন, কবি আল মাহমুদ সত্তাকে ভারমুক্ত করার প্রচেষ্টায় আকুল –
লোকালয় থেকে দূরে, ধোঁয়া অগ্নি মশলার গন্ধ থেকে দূরে
এই দলকলসের ঝোপে আমার কাফন পরে আমি কতকাল
কাত হয়ে শুয়ে থেকে দেখে যাবো সোনার কলস আর বৃষের বিবাদ।
(‘কালের কলস’, কালের কলস)
একদিক থেকে বিবেচনা করলে কবিতা এক বিশেষ ধরনের ভাষিকতা, যেখানে বিন্যাস আর সজ্জার সীমানায় স্বয়ং কবি অধীশ্বরের মতো বিরাজমান। একমাত্র কবিতাতেই ঘটতে পারে রচয়িতা ‘আমি’র আত্মম্ভর প্রক্ষেপ। কিন্তু কবিতা কেবল ভাষা নয়, নয় কেবল আঙ্গিকও। কবিতা সংস্কৃতিও বটে। কবিতা সেই সংস্কৃতি যেটির অভ্যন্তরে বয়ে চলে এক জীবনপ্রবাহ। সেখানে থাকে মানুষ, প্রকৃতি, সময়, সমকাল, ইতিহাস এবং এসবের অতিরেক বহু কিছু। কবির সুচয়নে সেই জীবনের প্রবাহ স্ফূর্ততা পায়। কবিতা-অভ্যন্তরীণ এসব উপাদানের মধ্যে কোন কোন উপাদান কবির সংবেদনা ও মনোযোগের কেন্দ্র সেটা অনুভব করা যায় কবিকে পাঠ করলে। এসব উপাদানকে অবলম্বন করে কবি হয়ে ওঠেন এক জীবন-প্রতিনিধি এবং তাঁর শব্দজগৎও তখন সংযোগ রক্ষাকারী সেতু হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি সেই জগতের কবি যদি হন তথাকথিত সভ্যতার মানদ–র অক্ষরজ্ঞানবিহীন কোনো বেদুইন তবু তাঁর উচ্চারণ অর্থপূর্ণ। লেখা নয়, শুধু শব্দের উচ্চারণই তাঁর পৃথিবীকে করে তোলে প্রতিনিধিত্বপূর্ণ। লায়লা আবু-লুঘোড তাঁর বেদুইন সমাজবিষয়ক গ্রন্থে তাই জানান, বেদুইনদের কবিতা গোত্রসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক, দূরত্ব, ঐতিহ্য, বর্তমান সবকিছুকে প্রকাশ করে। অথচ, বেদুইনদের সেসব কবিতা লিখিত হয়নি, হয়েছে গীত। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে রচিত কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে থাকে চিন্তা, পরিকল্পনা এবং দর্শনের সুস্পষ্ট স্বাক্ষর। আর সেই কবিতা যদি হয় আল মাহমুদের ক্ষীণকায় একটি নমুনা তবু তার মুকুরে ঘটে নির্বিশেষের প্রতিফলন – ‘ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!/ শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে/ দুয়োর বেঁধে রাখ।/ কেন বাঁধবো দোর জানালা/ তুলবো কেন খিল?/ আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে/ ফিরবে সে মিছিল।/ ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!/ ট্রাকের মুখে আগুন দিতে/ মতিয়ুরকে ডাক।/ কোথায় পাবো মতিয়ুরকে/ ঘুমিয়ে আছে সে!/ তোরাই তবে সোনামাণিক/ আগুন জ্বেলে দে।’ (‘উনসত্তরের ছড়া-১’, পাখির কাছে ফুলের কাছে)। কবি আল মাহমুদ এখানে একই সঙ্গে সমকাল, ইতিহাস, দেশ ও জাতির প্রতিনিধি। কিংবা আরো স্পষ্টভাবে বললে এক ঐতিহাসিক জীবনপ্রবাহের প্রতিনিধি। দীর্ঘকালীন কাব্যিক পর্যটনের পটভূমিতে আল মাহমুদের কবিতা জাগিয়ে তোলে নানামাত্রিক বিচিত্রতা ও দ্বান্দ্বিকতার আভাস।
বাংলাদেশের সাহিত্যে পূর্ববঙ্গ-সচেতনতার দুই সার্থক রূপকার সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ এবং আল মাহমুদ। একজন কথাসাহিত্যে এবং অন্যজন কবিতায় প্রয়োগ ঘটান সেই সচেতনতার। মানিক-তারাশঙ্কর-বিভূতিভূষণের সূত্রে বাংলা কথাসাহিত্য জনজীবনের গভীর প্রদেশসঞ্চারী হলেও বাংলাদেশের এই পূর্ব প্রান্তিকতায় যেখানে জাতিত্ব প্রতিষ্ঠার মতো বিশাল সংগ্রামে মানুষ একদিন জোটবদ্ধ হবে, সেই জনপদের স্পন্দন থেকে যায় অশ্রম্নত। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র উপন্যাসে উঠে এলো পূর্ব প্রামেত্মর সমষ্টিবদ্ধ মানুষের কাহিনি, যে-মানুষেরা একেবারে মৃত্তিকাসংলগ্ন এবং যাদের দিনানুদিনের বাস্তবতার প্রতি নজর ছিল না কারো। ওয়ালীউল্লাহ্ তাদের রোজকার জীবনের কাহিনিই শুধু উপস্থাপন করলেন না, অনুসন্ধান করলেন তাদের বর্তমানতার নেপথ্যে থাকা সুদীর্ঘ পরম্পরার ঐতিহাসিক বাস্তবতা। পরবর্তীকালে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র অনুসন্ধান সমষ্টি থেকে ক্রমে ব্যক্তিসত্তার সামাজিক চৈতন্যের দিকে কেন্দ্রীভূত হয়। সেটা করতে গিয়ে তিনি অস্তিত্ববাদ এবং চৈতন্যপ্রবাহরীতির আশ্রয় নেন। তবে সমষ্টিবদ্ধ জীবনের আয়তনটিকে তিনি কখনো ছেড়ে যান না। বাংলা কাব্যভুবন তিরিশের পাঁচ কবির পদচারণায় জাগিয়েছিল এক নতুন মুখরতা। তাঁদের কাব্যচেতনা পরিস্নাত হয়েছিল ইউরোপীয় নান্দনিকতার প্রেক্ষণাভিজ্ঞতায়। যদিও জীবনানন্দ দাশ (এবং খানিকটা বিষ্ণু দে) তাঁদের কাব্যে পূর্ব প্রান্তিকতায় থাকা মানুষদের সমষ্টিবদ্ধ জীবনকে স্পর্শ করতে চেয়েছিলেন। জীবনানন্দ দাশকে বাদ দিলে বাংলা কাব্যে নিম্নবঙ্গের দৈশিক চেতনার উপস্থিতি খুব ঝাপসা আর অস্পষ্ট। সেই ঝাপসা আর অস্পষ্ট আভাস উজ্জ্বলতা পেতে শুরু করল যখন একে-একে প্রকাশিত হতে লাগল লোক লোকান্তর, কালের কলস ও সোনালি কাবিন। অবশ্য আল মাহমুদই আবার তাঁর উপর্যুক্ত ত্রয়ী-কাব্যের সামষ্টিকতার চেতনা ছেড়ে কালক্রমে যাত্রা করবেন এক ব্যক্তিক-দার্শনিক অনুসন্ধানের দিকে। এমনকি তাঁর কাব্যচেতনা যে তাঁরই সচেতন কবিতাকর্মের পরিণতিতে ক্ষেত্রবিশেষে প্রসারণের পরিবর্তে গ্রহণ করবে সংকোচনকে, সেই দর্পিত স্বাক্ষরও তিনি রেখে যান তাঁর পাঠকদের জন্য।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ যেমন তাঁর সৃষ্ট মহববতনগর গ্রামের অবলম্বনে মৃত্তিকাসংলগ্ন মানবম-লীর জীবনকে ধারণ করেন, তেমনি কবি আল মাহমুদ সেই জীবনকে ধারণ করেন তাঁর তিতাস-বিধৌত পরিক্রমায়। মহববতনগর একমাত্র ওয়ালীউল্লাহ্রই এবং তিতাস আল মাহমুদের। (অদ্বৈতর তিতাসকে আমরা ভুলি না – সেই তিতাস কাব্যের নয়, কথাসাহিত্যের।) বাংলাদেশের মানুষ, প্রকৃতি এবং ঘটনাপুঞ্জ আল মাহমুদের কাব্যবিশ্বের মৌল উপাদান। অন্তত তাঁর প্রথম তিনটি কাব্যগ্রন্থের। প্রকৃতি তাঁর কাব্যে আরো পূর্ববঙ্গময় হয়ে উঠেছে নদীর মুহুর্মুহু আবির্ভাবে। এবং প্রথম থেকেই
প্রকৃতি-আঁকিয়ে কবি শক্তিমান এবং অতুলনীয়। তাঁর তিতাসের সক্রিয়তা তাঁর কবিতাকে করে সজীব, নবপলিময় ও গতিগৌরবী। তাঁর ‘তিতাস’ (লোক লোকান্তর) শিরোনামের কবিতা থেকে কবির অসাধারণ সেই জীবনোপলব্ধির দেখা মেলে – ‘এ আমার শৈশবের নদী এই জলের প্রহার/ সারাদিন তীর ভাঙে, পাক খায় ঘোলা স্রোত টানে/ যৌবনের প্রতীকের মতো অসংখ্য নৌকার পালে/ গতির প্রবাহ টানে। মাটির কলসে জল ভরে/ ঘরে ফিরে সলিমের বউ তার ভিজে দুটি পায়।/ অদূরের বিল থেকে পানকৌড়ি, মাছরাঙা, বক/ পাখায় জলের ফোঁটা ফেলে দিয়ে উড়ে যায় দূরে;/ জনপদে কি অধীর কোলাহল মায়াবী এ নদী/ এনেছে স্রোতের মতো, আমি তার খুঁজিনি কিছুই।’ অনন্তর এই তিতাস নামে-বেনামে বয়েই যেতে থাকে তাঁর কবিতার জনপদ ধরে। আল মাহমুদের এই নদীই স্বতন্ত্র এক চরিত্র হয়ে ওঠে এবং তা ‘বাংলাদেশের কবিতা’চিহ্নিত মানচিত্রে। দিনেশ দাশের কাস্তে যেমন তেভাগার স্থানিকতার মাত্রা ছাড়িয়ে সর্বজনীনতায় উত্তীর্ণ হয়, তেমনি আল মাহমুদের তিতাস বাংলা কাব্যের নদীমাতৃকতায় এর স্থানীয়তাকে সংযুক্ত করে চিরন্তনতার স্রোতে। এমনকি আল মাহমুদের নদী-প্রকৃতিকে ইংরেজ কবি টিএস এলিয়টের নদীর কাব্যিক সন্দর্শনের চাইতেও অনেক বেশি বাঙ্ময় মনে হয়। এলিয়টের যেমন টেমস আল মাহমুদের তেমনই তিতাস। এলিয়টের ওয়েস্ট ল্যান্ড কাব্যে ঘুরেফিরে আসে টেমস নদী। মধুর সুরের রিফ্রেনে (‘মধুর টেমস, ধীরে বয়ে যায়, যতক্ষণ আমি গেয়ে যাই গান’) টেমস দেখা দেয়। দেখাই দেয় কেবল এবং কবিও অবলোকন করতে থাকেন সেই নদীকে; কিন্তু তা আল মাহমুদের তিতাসবহতার মতো স্পন্দিত হয় না। তিতাস বয়ে চলে যেন কবির সত্তার মধ্য দিয়ে, সুদূর অতীত থেকে বর্তমান হয়ে হয়তো অনাগত কালের দিকে। আর সেই বহমানতায় একা কবি নন, স্পৃষ্ট হতে থাকে এক বিপুল জীবনজঙ্গমতা।
আল মাহমুদের কবিতার এই জীবনজঙ্গমতার অঙ্গীকার সময়ের খাতে বিবর্তিত হতে থাকে। জনজীবনের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ কবির আত্মতায় ছাপ পড়ে সময়ের ও সমকালের। সেই ছাপ রূপান্তরিত হয় তাঁর কাব্যাভিজ্ঞতায়। লোকজীবনের বার্তাবাহক কবি তাঁর সময়, সমকাল এবং পরিপার্শ্বকে পর্যবেক্ষণ করেন এক দর্শনোত্তীর্ণ অবস্থান থেকে। প্রথমদিককার কাব্যালোকনে যা ছিল দর্শন বা দেখা, বিশেষ করে সমষ্টির জীবনকে দেখা, পরের দিককার কাব্যালোকনে তা হয়ে উঠল জীবনদর্শন বা তাঁর নিজের জীবনের অবস্থান থেকে দেখা। এখানে প্রসঙ্গত তাঁরই এক কাব্য-সহযাত্রী শামসুর রাহমানের সঙ্গে তুলনা করলে দেখব, রাহমান তাঁর প্রথমদিককার আধেয়বদ্ধতাকে অতিক্রম করে যেতে থাকেন ক্রমপ্রসারণের মাধ্যমে। সেই প্রসারণে আল মাহমুদের বিপরীত ধরনে শামসুর রাহমান তাঁর নগরাবদ্ধ জীবনচেতনা থেকে ছড়িয়ে পড়তে থাকেন বৃহত্তর জনচেতনা, হয়তোবা জাতিগত চেতনার দিকে। তাঁর সেই কাব্যপরিক্রমায় বিশেষ ভূমিকা রাখে তাঁর কাব্যে সমকালীন জীবনোদ্যাপন। সমকালীন জীবনপ্রবাহের বিচিত্র সব ঘটনা কাব্যিক উপাদানে পরিণত হয়ে শামসুর রাহমানের কবিতাবিশ্বকে দেয় আশ্চর্য এক সম্প্রসারণ। সেখানে থাকে মানুষের সংগ্রাম, লড়াই, প্রতিরোধ যার একটি বিশাল চিত্রণ ঘটে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাধারার মধ্য দিয়ে। ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ এবং সেই প্রেক্ষাপট ছাড়িয়ে অনন্তর বাঙালির স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলন, গণতন্ত্রের লড়াই এসব বিষয়ের কাব্যিক নির্মাণ শামসুর রাহমানের কবিতাভুবনকে বাঙালির ইতিহাসের সমান্তরাল সৃজনকল্পে পৌঁছে দেয়। শুধু শব্দের মাধ্যমে একজন কবির পক্ষেও যে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর হয়ে লড়াই করা সম্ভব শামসুর রাহমানের অসংখ্য কবিতা তার প্রমাণ। সমকালীন ঘটনার প্রতিক্রিয়াজাত কাব্যনির্মাণের দিক থেকে শামসুর রাহমান কেবল আল মাহমুদ নন, ছাড়িয়ে যান তাঁর সমকালীন অন্য অনেক কবিকেও।
সমকালীন ঘটনার প্রতিফলনজাত কাব্যনির্মাণই কাব্যবিচারে উৎকৃষ্টতার মাপকাঠি নয়। একই সমকালীন দুজন কবির পারস্পরিক অবস্থানের বাস্তবতা বোঝানোর জন্যেই সে-প্রসঙ্গের অবতারণা। কবিতা নিশ্চয়ই এক নিতান্ত ব্যক্তিগত কর্মকা- কিন্তু কবি কখনোই এমন কোনো অমত্মঃপুরবাসী নন যেটি সমস্ত রকম সামাজিকতার স্পর্শশূন্য। বরং কবিদের ‘মানব জাতির আইনসংগত প্রতিনিধি’ বলে অভিহিত করেন কবি মিলটন। যে-ব্যক্তি একটি জাতিত্বের প্রতিনিধি হয়ে তাঁর কর্মতৎপরতা চালাবেন তা যতই নিভৃতচারী হোক না কেন তার থাকে বৃহত্তর চেতনামুখী আত্মপ্রকাশ। এটি হয়তো শেষ পর্যন্ত তর্ক-প্রতর্কেরও বিষয়। মার্কিন লেখক টনি মরিসন বলেছেন, কল্পনার ব্যক্তিগত অনুশীলন বলে কিছু নেই, লেখা ব্যাপারটাই হলো রাজনৈতিক। মরিসন দেখান যে, আত্মজৈবনিক রচনার রীতিও প্রবলভাবে সামাজিক চেতনার পরিবাহী হতে পারে। মরিসনের দৃষ্টিতে মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ লেখকদের অনেক রচনাই আত্মজৈবনিক ধরনের; কিন্তু আত্মজৈবনিক সেসব রচনাই হয়ে উঠেছে বহুস্বর-‘প্রতিনিধিত্বপূর্ণ’। এসব রচনায় প্রতিফলিত ব্যক্তির জীবন একই সঙ্গে নিজস্ব নির্জনতা এবং পরস্ব প্রতিবেশিতায় খচিত। বলা যায় মার্কিন কবি অ্যালেন্স গিন্সবার্গের কথা, যাঁর কাব্যের শিরোনামই (হাউল) তাঁর ধরন বলে দেয়। প্যারিস রিভিউকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি ব্রিটিশ কবিদের কাব্যভঙ্গিকে ‘কাপুরুষোচিত ভঙ্গি’ বলে অভিহিত করেন। বস্ত্তত ব্রিটিশ কবিদের ‘আপারটোন’ ‘হাই ক্লাস’ ধরনের স্বর তাঁর অপছন্দ ছিল। বৈরী প্রতিপক্ষতাকে একমাত্র উচ্চকণ্ঠ ভঙ্গিতেই প্রকাশ করা যায় – গিন্সবার্গ তাঁর কাব্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে আক্রমণ করবার জন্যে প্রচুর খিস্তিখেউড়-শব্দ ব্যবহার করেন যেগুলোকে ‘গালাগাল’ আখ্যা দেওয়া যায়। শামসুর রাহমানের অনেক কবিতা আছে যেগুলোর বিষয়বস্ত্ত আন্দোলন-সংগ্রাম এবং যেগুলো স্বভাবত উচ্চকণ্ঠ বা ঘোষণাধর্মী। আবার, আল মাহমুদের তেমন কবিতা প্রায় দুর্লভ, যদিও তিনি ‘শুয়োরমুখো’র মতো খিস্তি-শব্দের দারুণ ব্যবহৃতি দেখিয়েছেন।
তবে ঘোষণাধর্মী কবিতা আল মাহমুদও লিখেছেন এবং সেই কবিতার সূত্র ধরে প্রথমে খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে তারপর আবার সামনের দিকে আসা যেতে পারে। এক অর্থে গোটা বিশ্বই কবির বিষয়। কবি তাঁর স্থানগত সীমাবদ্ধতাকে পেরিয়ে যান তাঁর অভিজ্ঞতার আয়তন দিয়ে। ফলে, প্যালেস্টাইনে, আফ্রিকায়, মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশে কিংবা বিশ্বের যেখানেই মানুষের বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় তা-ই অনুপ্রেরণা জোগায় কবিকে। অচেনা, একেবারে সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতার বিষয়বস্ত্তও হতে পারে কবির উপজীব্যতার লক্ষ্য। সুইডেনের কবি টমাস ট্রান্সটোমার যখন ইজমির, সাংহাই কিংবা আফ্রিকা নিয়ে কবিতা লেখেন অথবা হাঙ্গেরীয় কবি জর্জ ফালুদি লেখেন তাঞ্জিয়ের ভ্রমণের অভিজ্ঞতাজাত তাঁর ‘কসবাহ্’ নামক কবিতা, তখন কবির বিষয়বস্ত্তর অসীমতাই প্রমাণিত হয়। এমনকি অদেখা উপাদানও অভিজ্ঞতার বিষয়ে পরিণত হতে পারে। গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডার জেলেদের বলতেন, মাছেদের সম্পর্কে কোনো বিশেষ আকর্ষণীয় বা বিবেচনাযোগ্য কিছু লক্ষ করলে তারা যেন তা অ্যারিস্টটলকে জানায়। শামসুর রাহমান যখন আগামেমনন বা ইলেক্ট্রার প্রতীকে কাব্য রচনা করেন তখন তাঁর সেই গ্রিসমুখিতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করে না। কেননা, কবিরা এক সম্প্রসারিত বিশ্বের নাগরিক। বেঞ্জামিন মলয়ঁসের ফাঁসি হলে কি কেন্ সারউইয়ার মৃত্যুদ- হলে বাঙালি কবির কাব্যিক সাড়া প্রাসঙ্গিকতা পায়। তুরস্কের কামাল আতাতুর্ককে বাংলা কবিতায় অমর করে রাখেন কাজী নজরুল ইসলাম। বিষয় ছাড়াও বলা যায়, সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটের কাব্যাঙ্গিক বা কাব্যভাবনাও হতে পারে কবির সৃজনশীলতার অনুপ্রেরণা। ইংরেজ কবি টিএস এলিয়ট বলেছিলেন, এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ডের রুবাইয়াৎ পাঠই ছিল তাঁর চার পঙ্ক্তির ‘কোয়ার্টেট’ (‘ফোর কোয়ার্টেট’) কবিতা রচনার অনুপ্রেরণা। কবি এজরা পাউন্ড জানান, চৈনিক দার্শনিক কনফুশিয়াসের
চিন্তা-দর্শনের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে তিনি তাঁর ক্যান্টোজ-কবিতাবলি রচনা করেছিলেন। কাজী নজরুল ইসলামের পরে কবি ফররুখ আহমদ এবং সৈয়দ আলী আহসানের কথা বলা যায়, যাঁদের কবিতায় আরবি-ফারসি বিষয় ও আঙ্গিকের প্রভাব উল্লেখযোগ্য। পৃথিবীর নানান দেশের বিষয়বস্ত্ত আল মাহমুদের কবিতাতেও উপজীব্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সক্রেটিস, গোর্কি, হজরত মুহাম্মদ, বখতিয়ার, বেঞ্জামিন মোলয়েসি, ঈশপ, ইকবাল, বেদুইন, লায়লা – এইসব বিষয় নিয়ে কবিতা লিখেছেন তিনি। অর্থাৎ বিশ্বদৃষ্টির আয়ত অন্বেষণে ব্যাপৃত থেকে আল মাহমুদ তাঁর কাব্য-উপাদান সংগ্রহ করেছেন। তা সত্ত্বেও অনুসন্ধিৎসু পাঠকের কাব্যপাঠের অভিজ্ঞতা ঘটাতে পারে ভিন্ন আলোকসম্পাত।
১৯৮০ সালে প্রকাশিত হয় আল মাহমুদের পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না। এ-গ্রন্থের একটি কবিতা ‘ইহুদিরা’। পঁচিশ পঙ্ক্তির কবিতাটির দশটি পঙ্ক্তির উদ্ধৃতি অনুসরণ করি –
অনিষ্টকর অন্ধকারে যখন পৃথিবী
আচ্ছন্ন হয়ে যায়। চারদিকে ডাইনীদের
ফুৎকারের মতো হাওয়ার ফিসফাস,
আর পাখিরা গুপ্ত সাপের আতঙ্কে
আশ্রয় ছেড়ে অন্ধকারে ঝাঁপ দেয়
ঠিক তখুনি, ইহুদিরা হেসে ওঠে। …
ইহুদিরা হাসুক,
তবু সম্পদের সুষম বণ্টন অনিবার্য।
ইহুদিরা নাচুক, তবু
ধনতন্ত্রের পতন আসন্ন।
কবিতার সর্বশেষ পঙ্ক্তি ‘মানুষ মানুষের ভাই’ হলেও কবি আল মাহমুদের উপর্যুক্ত কাব্যিক স্বীকারোক্তি থেকে নিশ্চিতভাবে বলা যাবে তিনি সমগ্র মানবজাতির প্রতিনিধি নন। কেননা, কবিতাটিতে মূল প্রতিপক্ষ ‘ইহুদিরা’ আর ধনতন্ত্র এবং ‘ইহুদিরা’ হয়ে পড়ে সমার্থক। এমনও মনে হওয়াটা স্বাভাবিক, বিশ্বে সম্পদের সুষম বণ্টন হওয়ার পথে বাধা ইহুদিরাই। এমন অভিজ্ঞতা আমাদের নতুন নয়। গবেষক অ্যান্থনি জুলিয়াস তাঁর কবি টিএস এলিয়ট বিষয়ক গবেষণাকর্মে (১৯৯৫ সালে প্রকাশিত) দেখান, এলিয়টের কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে স্পষ্ট জাতিবিদ্বেষ। তাঁর অনেক কবিতায় এলিয়ট প্রত্যক্ষভাবে ইহুদিদের প্রতি ঘৃণা-অশ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন। ‘বারব্যাংক উইথ আ ব্যাডেকার : বস্ন্যাইস্টাইন উইথ আ সিগার’, ‘সুইনি অ্যামাং দ্য নাইটিংগেইলস্’ কিংবা ‘আ কুকিং এগ’ প্রভৃতি কবিতার বিশেস্নষণে এলিয়টের জাতিবিদ্বেষ ধরা পড়ে। কবির ধর্মাশ্রয় বা ধর্মাশ্রিত ভাবধারানির্ভর কবিতারচনা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। স্বয়ং এলিয়টই বলেছেন (প্যারিস রিভিউ পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে), বাইবেলের কাব্যিকতা ধর্মীয় অভিজ্ঞতার সমান্তরালে আসাটা স্বাভাবিক। বিশেষ করে, এলিয়টের মতে, বাইবেলের ‘সাম’ কিংবা ‘ইসাইয়াহ্’ অংশ তেমন অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়। এলিয়ট অবশ্য এমনও বলেন যে, বাইবেলকে সাহিত্য হিসেবে বিবেচনা না করে বরং সেটিকে শব্দের অভিজ্ঞতা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। কিন্তু বাইবেলের অভিজ্ঞতাকে জাতিবিদ্বেষের লক্ষ্যে পরিচালনা করাটা সৃজনশীল কবিস্বভাবের জন্যে বেমানান। গবেষক অ্যান্থনি জুলিয়াসের গবেষণাকর্ম সেরকম ধারণাই দেয় আমাদের। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয় আল মাহমুদের ষষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ বখতিয়ারের ঘোড়া। গ্রন্থের একটি কবিতায় (‘হত্যাকারীদের মানচিত্র’) কবি জানান, ‘আফগানিস্তান আমার দেশ আমার/ ভালোবাসা …/ আফগানিস্তান আজ কার দেশ নয়? আফগানিস্তান/ সব স্বাধীন মানুষের অপহৃত মাতৃভূমি।’ কবিতাটিতে তখনকার আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপস্থিতি ‘সাম্রাজ্যবাদ’ হিসেবে চিহ্নিত এবং তখন এমন কবিতা বাংলা ভাষা ছাড়াও বিশ্বের বহু ভাষার কবিরা রচনা করেছিলেন। আবার ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত আল মাহমুদের একাদশ কাব্যগ্রন্থের ‘রাফাতের লাশের ওপর জুঁইফুল’ কবিতাটি পাঠ করলে দেখব কবি ভাবছেন ‘ইসলামকে কবর দিতে’ হত্যা করা হয়েছে ‘রাফাত মাহমুদ ও তার উনত্রিশ সহযাত্রী’কে। এই কবিতাটাই এক সরব ঘোষণা হয়ে দাঁড়ায় অন্তিমে যখন কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে –
খুঁড়ে ফ্যালো গোটা আফ্রিকা কালো মহাদেশ। কায়রোর
কবরখানায় পবিত্র কোরআনকে পুঁতে ফেলে
যারা হোটেলগুলোতে মদের গস্নাস হাতে উদর নৃত্যে মশগুল
এখন পশ্চিম আফ্রিকা তাদের বিভীষিকা দেখাচ্ছে।
মহাদেশের মাটি চৌচির করে আলজেরিয়ায় বেরিয়ে এসেছে
আল্লার এই অদ্ভুত কিতাব।
আপন বিশ্বাসে স্থির আল মাহমুদকে আমরা সবশেষে এমন নির্দ্বান্দ্বিকভাবে পাই।
আল মাহমুদের কবিতা পাঠ করি। একদা ১৯৬৩ সালে তিনি প্রত্ন-মহেঞ্জোদারোর মৃৎপাত্রে গাঁথা অক্ষরের দিকে দৃষ্টিপাত করেছিলেন। যদিও ‘মানুষের শিল্প’কে তাঁর কাছে ‘নির্বোধের নিত্য কারিগরি’ মনে হয়েছে, তবু শব্দশিল্পের গায়ে তিনি তাঁর স্বাক্ষর রেখে যান। তিতাস নদী বেয়ে চলে তাঁর ‘সোনার বৈঠার ঘায়ে পবনের নাও’। কিন্তু আসে দুর্দিন আর খরাগ্রস্ততা, তাই তাঁর ‘সমস্ত গন্তব্যে একটি একটি তালা’ ঝোলে। কবির অন্তরের সর্বত্র বাসা বাঁধে প্রবল অবিশ্বাস। সেটা ছিল প্রত্যাশিতই। পাকিস্তানি সামরিক শাসনামলের বন্ধ্যত্বকে তিনি বিদ্ধ করেছিলেন দারুণ করণ-কুশলতায় – ‘শুনুন, রবীন্দ্রনাথ আপনার সমস্ত কবিতা/ আমি যদি পুঁতে রেখে দিনরাত পানি ঢালতে থাকি/ নিশ্চিত বিশ্বাস এই, একটিও উদ্ভিদ হবে না/ আপনার বাংলাদেশ এ রকম নিষ্ফলা, ঠাকুর!’ আবার, দেশ মুক্ত-স্বাধীন হলেও কবি আল মাহমুদ দেখতে পান ‘বন্দুকের নল’ তাঁর ‘মাথার দিকেই তাক করা’। এবং ১৯৮৫ সালে বাঙালি কবি আল মাহমুদের সোৎসাহী কণ্ঠে ধ্বনিত হয় নতুন এক প্রণোদনা এবং কবিকে তখন সেই উৎসাহ প্রকাশ করার জন্য আশ্রয় নিতে হয় বাংলার পরিবর্তে বিদেশি ভাষার –
আজ আবার হৃদয়ে কেবল যুদ্ধের দামামা
মনে হয় রক্তেই ফয়সালা।
বারুদই বিচারক। আর
স্বপ্নের ভেতর জেহাদ জেহাদ বলে জেগে ওঠা।
(‘বখতিয়ারের ঘোড়া’, বখতিয়ারের ঘোড়া)
উপর্যুক্ত উচ্চারণে আমরা সংশয়ে পড়ি – এ-কবির বিশ্বাস নাকি অবিশ্বাসের প্রকাশ!
দ্রম্নতধাবমান তরঙ্গ হয়ে ছুটতে থাকে কবিতা, অজস্র কবিতা – আল মাহমুদকে তাঁর প্রয়াণের পরে মনে করতেই কতকাল আগেকার সেসব কবিতা ভিড় করে। কবিতারা জ্বলে আর নেভে কিন্তু একেবারে নির্বাপিত হয় না। বরং কবিতাগুলো উপলক্ষের অপেক্ষাতেই থেকে যায় ফের জেগে ওঠার জন্য। দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুঃসময়’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’, জীবনানন্দ দাশের ‘আবার আসিব ফিরে’, অমিয় চক্রবর্তীর ‘চিরদিন’, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘যযাতি’, বুদ্ধদেব বসুর ‘ধৃতরাষ্ট্রের বিলাপ’, বিষ্ণু দে-র ‘ঘোড়সওয়ার’, দিনেশ দাশের ‘কাস্তে’, জসীম উদ্দীনের ‘কবর’, ফররুখ আহমদের ‘ডাহুক’, আহসান হাবীবের ‘আমি কোনো আগন্তুক নই’, আবদুল গনি হাজারীর ‘কতিপয় আমলার স্ত্রী’, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘মে-দিনের কবিতা’, শামসুর রাহমানের ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, শঙ্খ ঘোষের ‘বাবরের প্রার্থনা’, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভালোবাসা ছাড়া’, শহীদ কাদরীর ‘উত্তরাধিকার’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কেউ কথা রাখে নি’, রফিক আজাদের ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’, মোহাম্মদ রফিকের ‘সারা বিষ্ণুপুর জুড়ে’, মহাদেব সাহার ‘চিঠি দিও’, নির্মলেন্দু গুণের ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসি নি’, হুমায়ুন আজাদের ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’, আবুল হাসানের ‘উদিত দুঃখের দেশ’, হুমায়ুন কবিরের ‘এ কেমন শহর’, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘আমি কিংবদমত্মীর কথা বলছি’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘নৈশভোজে রক্তপাত’ এসব কবিতার সঙ্গে একজোটে ঘূর্ণাবর্ত সৃষ্টি করছে আল মাহমুদের ‘কালের কলস’, ‘রবীন্দ্রনাথ’, ‘ভারতবর্ষ’। হ্যাঁ, ক্যালভিনো যেমনটি বলেছিলেন, কবি আল মাহমুদ সত্তাকে ভারমুক্ত করার প্রচেষ্টায় আকুল –
লোকালয় থেকে দূরে, ধোঁয়া অগ্নি মশলার গন্ধ থেকে দূরে
এই দলকলসের ঝোপে আমার কাফন পরে আমি কতকাল
কাত হয়ে শুয়ে থেকে দেখে যাবো সোনার কলস আর বৃষের বিবাদ।
(‘কালের কলস’, কালের কলস)
একদিক থেকে বিবেচনা করলে কবিতা এক বিশেষ ধরনের ভাষিকতা, যেখানে বিন্যাস আর সজ্জার সীমানায় স্বয়ং কবি অধীশ্বরের মতো বিরাজমান। একমাত্র কবিতাতেই ঘটতে পারে রচয়িতা ‘আমি’র আত্মম্ভর প্রক্ষেপ। কিন্তু কবিতা কেবল ভাষা নয়, নয় কেবল আঙ্গিকও। কবিতা সংস্কৃতিও বটে। কবিতা সেই সংস্কৃতি যেটির অভ্যন্তরে বয়ে চলে এক জীবনপ্রবাহ। সেখানে থাকে মানুষ, প্রকৃতি, সময়, সমকাল, ইতিহাস এবং এসবের অতিরেক বহু কিছু। কবির সুচয়নে সেই জীবনের প্রবাহ স্ফূর্ততা পায়। কবিতা-অভ্যন্তরীণ এসব উপাদানের মধ্যে কোন কোন উপাদান কবির সংবেদনা ও মনোযোগের কেন্দ্র সেটা অনুভব করা যায় কবিকে পাঠ করলে। এসব উপাদানকে অবলম্বন করে কবি হয়ে ওঠেন এক জীবন-প্রতিনিধি এবং তাঁর শব্দজগৎও তখন সংযোগ রক্ষাকারী সেতু হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি সেই জগতের কবি যদি হন তথাকথিত সভ্যতার মানদ–র অক্ষরজ্ঞানবিহীন কোনো বেদুইন তবু তাঁর উচ্চারণ অর্থপূর্ণ। লেখা নয়, শুধু শব্দের উচ্চারণই তাঁর পৃথিবীকে করে তোলে প্রতিনিধিত্বপূর্ণ। লায়লা আবু-লুঘোড তাঁর বেদুইন সমাজবিষয়ক গ্রন্থে তাই জানান, বেদুইনদের কবিতা গোত্রসমূহের পারস্পরিক সম্পর্ক, দূরত্ব, ঐতিহ্য, বর্তমান সবকিছুকে প্রকাশ করে। অথচ, বেদুইনদের সেসব কবিতা লিখিত হয়নি, হয়েছে গীত। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে রচিত কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে থাকে চিন্তা, পরিকল্পনা এবং দর্শনের সুস্পষ্ট স্বাক্ষর। আর সেই কবিতা যদি হয় আল মাহমুদের ক্ষীণকায় একটি নমুনা তবু তার মুকুরে ঘটে নির্বিশেষের প্রতিফলন – ‘ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!/ শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে/ দুয়োর বেঁধে রাখ।/ কেন বাঁধবো দোর জানালা/ তুলবো কেন খিল?/ আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে/ ফিরবে সে মিছিল।/ ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!/ ট্রাকের মুখে আগুন দিতে/ মতিয়ুরকে ডাক।/ কোথায় পাবো মতিয়ুরকে/ ঘুমিয়ে আছে সে!/ তোরাই তবে সোনামাণিক/ আগুন জ্বেলে দে।’ (‘উনসত্তরের ছড়া-১’, পাখির কাছে ফুলের কাছে)। কবি আল মাহমুদ এখানে একই সঙ্গে সমকাল, ইতিহাস, দেশ ও জাতির প্রতিনিধি। কিংবা আরো স্পষ্টভাবে বললে এক ঐতিহাসিক জীবনপ্রবাহের প্রতিনিধি। দীর্ঘকালীন কাব্যিক পর্যটনের পটভূমিতে আল মাহমুদের কবিতা জাগিয়ে তোলে নানামাত্রিক বিচিত্রতা ও দ্বান্দ্বিকতার আভাস।
বাংলাদেশের সাহিত্যে পূর্ববঙ্গ-সচেতনতার দুই সার্থক রূপকার সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ এবং আল মাহমুদ। একজন কথাসাহিত্যে এবং অন্যজন কবিতায় প্রয়োগ ঘটান সেই সচেতনতার। মানিক-তারাশঙ্কর-বিভূতিভূষণের সূত্রে বাংলা কথাসাহিত্য জনজীবনের গভীর প্রদেশসঞ্চারী হলেও বাংলাদেশের এই পূর্ব প্রান্তিকতায় যেখানে জাতিত্ব প্রতিষ্ঠার মতো বিশাল সংগ্রামে মানুষ একদিন জোটবদ্ধ হবে, সেই জনপদের স্পন্দন থেকে যায় অশ্রম্নত। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র উপন্যাসে উঠে এলো পূর্ব প্রামেত্মর সমষ্টিবদ্ধ মানুষের কাহিনি, যে-মানুষেরা একেবারে মৃত্তিকাসংলগ্ন এবং যাদের দিনানুদিনের বাস্তবতার প্রতি নজর ছিল না কারো। ওয়ালীউল্লাহ্ তাদের রোজকার জীবনের কাহিনিই শুধু উপস্থাপন করলেন না, অনুসন্ধান করলেন তাদের বর্তমানতার নেপথ্যে থাকা সুদীর্ঘ পরম্পরার ঐতিহাসিক বাস্তবতা। পরবর্তীকালে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র অনুসন্ধান সমষ্টি থেকে ক্রমে ব্যক্তিসত্তার সামাজিক চৈতন্যের দিকে কেন্দ্রীভূত হয়। সেটা করতে গিয়ে তিনি অস্তিত্ববাদ এবং চৈতন্যপ্রবাহরীতির আশ্রয় নেন। তবে সমষ্টিবদ্ধ জীবনের আয়তনটিকে তিনি কখনো ছেড়ে যান না। বাংলা কাব্যভুবন তিরিশের পাঁচ কবির পদচারণায় জাগিয়েছিল এক নতুন মুখরতা। তাঁদের কাব্যচেতনা পরিস্নাত হয়েছিল ইউরোপীয় নান্দনিকতার প্রেক্ষণাভিজ্ঞতায়। যদিও জীবনানন্দ দাশ (এবং খানিকটা বিষ্ণু দে) তাঁদের কাব্যে পূর্ব প্রান্তিকতায় থাকা মানুষদের সমষ্টিবদ্ধ জীবনকে স্পর্শ করতে চেয়েছিলেন। জীবনানন্দ দাশকে বাদ দিলে বাংলা কাব্যে নিম্নবঙ্গের দৈশিক চেতনার উপস্থিতি খুব ঝাপসা আর অস্পষ্ট। সেই ঝাপসা আর অস্পষ্ট আভাস উজ্জ্বলতা পেতে শুরু করল যখন একে-একে প্রকাশিত হতে লাগল লোক লোকান্তর, কালের কলস ও সোনালি কাবিন। অবশ্য আল মাহমুদই আবার তাঁর উপর্যুক্ত ত্রয়ী-কাব্যের সামষ্টিকতার চেতনা ছেড়ে কালক্রমে যাত্রা করবেন এক ব্যক্তিক-দার্শনিক অনুসন্ধানের দিকে। এমনকি তাঁর কাব্যচেতনা যে তাঁরই সচেতন কবিতাকর্মের পরিণতিতে ক্ষেত্রবিশেষে প্রসারণের পরিবর্তে গ্রহণ করবে সংকোচনকে, সেই দর্পিত স্বাক্ষরও তিনি রেখে যান তাঁর পাঠকদের জন্য।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ যেমন তাঁর সৃষ্ট মহববতনগর গ্রামের অবলম্বনে মৃত্তিকাসংলগ্ন মানবম-লীর জীবনকে ধারণ করেন, তেমনি কবি আল মাহমুদ সেই জীবনকে ধারণ করেন তাঁর তিতাস-বিধৌত পরিক্রমায়। মহববতনগর একমাত্র ওয়ালীউল্লাহ্রই এবং তিতাস আল মাহমুদের। (অদ্বৈতর তিতাসকে আমরা ভুলি না – সেই তিতাস কাব্যের নয়, কথাসাহিত্যের।) বাংলাদেশের মানুষ, প্রকৃতি এবং ঘটনাপুঞ্জ আল মাহমুদের কাব্যবিশ্বের মৌল উপাদান। অন্তত তাঁর প্রথম তিনটি কাব্যগ্রন্থের। প্রকৃতি তাঁর কাব্যে আরো পূর্ববঙ্গময় হয়ে উঠেছে নদীর মুহুর্মুহু আবির্ভাবে। এবং প্রথম থেকেই
প্রকৃতি-আঁকিয়ে কবি শক্তিমান এবং অতুলনীয়। তাঁর তিতাসের সক্রিয়তা তাঁর কবিতাকে করে সজীব, নবপলিময় ও গতিগৌরবী। তাঁর ‘তিতাস’ (লোক লোকান্তর) শিরোনামের কবিতা থেকে কবির অসাধারণ সেই জীবনোপলব্ধির দেখা মেলে – ‘এ আমার শৈশবের নদী এই জলের প্রহার/ সারাদিন তীর ভাঙে, পাক খায় ঘোলা স্রোত টানে/ যৌবনের প্রতীকের মতো অসংখ্য নৌকার পালে/ গতির প্রবাহ টানে। মাটির কলসে জল ভরে/ ঘরে ফিরে সলিমের বউ তার ভিজে দুটি পায়।/ অদূরের বিল থেকে পানকৌড়ি, মাছরাঙা, বক/ পাখায় জলের ফোঁটা ফেলে দিয়ে উড়ে যায় দূরে;/ জনপদে কি অধীর কোলাহল মায়াবী এ নদী/ এনেছে স্রোতের মতো, আমি তার খুঁজিনি কিছুই।’ অনন্তর এই তিতাস নামে-বেনামে বয়েই যেতে থাকে তাঁর কবিতার জনপদ ধরে। আল মাহমুদের এই নদীই স্বতন্ত্র এক চরিত্র হয়ে ওঠে এবং তা ‘বাংলাদেশের কবিতা’চিহ্নিত মানচিত্রে। দিনেশ দাশের কাস্তে যেমন তেভাগার স্থানিকতার মাত্রা ছাড়িয়ে সর্বজনীনতায় উত্তীর্ণ হয়, তেমনি আল মাহমুদের তিতাস বাংলা কাব্যের নদীমাতৃকতায় এর স্থানীয়তাকে সংযুক্ত করে চিরন্তনতার স্রোতে। এমনকি আল মাহমুদের নদী-প্রকৃতিকে ইংরেজ কবি টিএস এলিয়টের নদীর কাব্যিক সন্দর্শনের চাইতেও অনেক বেশি বাঙ্ময় মনে হয়। এলিয়টের যেমন টেমস আল মাহমুদের তেমনই তিতাস। এলিয়টের ওয়েস্ট ল্যান্ড কাব্যে ঘুরেফিরে আসে টেমস নদী। মধুর সুরের রিফ্রেনে (‘মধুর টেমস, ধীরে বয়ে যায়, যতক্ষণ আমি গেয়ে যাই গান’) টেমস দেখা দেয়। দেখাই দেয় কেবল এবং কবিও অবলোকন করতে থাকেন সেই নদীকে; কিন্তু তা আল মাহমুদের তিতাসবহতার মতো স্পন্দিত হয় না। তিতাস বয়ে চলে যেন কবির সত্তার মধ্য দিয়ে, সুদূর অতীত থেকে বর্তমান হয়ে হয়তো অনাগত কালের দিকে। আর সেই বহমানতায় একা কবি নন, স্পৃষ্ট হতে থাকে এক বিপুল জীবনজঙ্গমতা।
আল মাহমুদের কবিতার এই জীবনজঙ্গমতার অঙ্গীকার সময়ের খাতে বিবর্তিত হতে থাকে। জনজীবনের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ কবির আত্মতায় ছাপ পড়ে সময়ের ও সমকালের। সেই ছাপ রূপান্তরিত হয় তাঁর কাব্যাভিজ্ঞতায়। লোকজীবনের বার্তাবাহক কবি তাঁর সময়, সমকাল এবং পরিপার্শ্বকে পর্যবেক্ষণ করেন এক দর্শনোত্তীর্ণ অবস্থান থেকে। প্রথমদিককার কাব্যালোকনে যা ছিল দর্শন বা দেখা, বিশেষ করে সমষ্টির জীবনকে দেখা, পরের দিককার কাব্যালোকনে তা হয়ে উঠল জীবনদর্শন বা তাঁর নিজের জীবনের অবস্থান থেকে দেখা। এখানে প্রসঙ্গত তাঁরই এক কাব্য-সহযাত্রী শামসুর রাহমানের সঙ্গে তুলনা করলে দেখব, রাহমান তাঁর প্রথমদিককার আধেয়বদ্ধতাকে অতিক্রম করে যেতে থাকেন ক্রমপ্রসারণের মাধ্যমে। সেই প্রসারণে আল মাহমুদের বিপরীত ধরনে শামসুর রাহমান তাঁর নগরাবদ্ধ জীবনচেতনা থেকে ছড়িয়ে পড়তে থাকেন বৃহত্তর জনচেতনা, হয়তোবা জাতিগত চেতনার দিকে। তাঁর সেই কাব্যপরিক্রমায় বিশেষ ভূমিকা রাখে তাঁর কাব্যে সমকালীন জীবনোদ্যাপন। সমকালীন জীবনপ্রবাহের বিচিত্র সব ঘটনা কাব্যিক উপাদানে পরিণত হয়ে শামসুর রাহমানের কবিতাবিশ্বকে দেয় আশ্চর্য এক সম্প্রসারণ। সেখানে থাকে মানুষের সংগ্রাম, লড়াই, প্রতিরোধ যার একটি বিশাল চিত্রণ ঘটে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাধারার মধ্য দিয়ে। ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ এবং সেই প্রেক্ষাপট ছাড়িয়ে অনন্তর বাঙালির স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলন, গণতন্ত্রের লড়াই এসব বিষয়ের কাব্যিক নির্মাণ শামসুর রাহমানের কবিতাভুবনকে বাঙালির ইতিহাসের সমান্তরাল সৃজনকল্পে পৌঁছে দেয়। শুধু শব্দের মাধ্যমে একজন কবির পক্ষেও যে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর হয়ে লড়াই করা সম্ভব শামসুর রাহমানের অসংখ্য কবিতা তার প্রমাণ। সমকালীন ঘটনার প্রতিক্রিয়াজাত কাব্যনির্মাণের দিক থেকে শামসুর রাহমান কেবল আল মাহমুদ নন, ছাড়িয়ে যান তাঁর সমকালীন অন্য অনেক কবিকেও।
সমকালীন ঘটনার প্রতিফলনজাত কাব্যনির্মাণই কাব্যবিচারে উৎকৃষ্টতার মাপকাঠি নয়। একই সমকালীন দুজন কবির পারস্পরিক অবস্থানের বাস্তবতা বোঝানোর জন্যেই সে-প্রসঙ্গের অবতারণা। কবিতা নিশ্চয়ই এক নিতান্ত ব্যক্তিগত কর্মকা- কিন্তু কবি কখনোই এমন কোনো অমত্মঃপুরবাসী নন যেটি সমস্ত রকম সামাজিকতার স্পর্শশূন্য। বরং কবিদের ‘মানব জাতির আইনসংগত প্রতিনিধি’ বলে অভিহিত করেন কবি মিলটন। যে-ব্যক্তি একটি জাতিত্বের প্রতিনিধি হয়ে তাঁর কর্মতৎপরতা চালাবেন তা যতই নিভৃতচারী হোক না কেন তার থাকে বৃহত্তর চেতনামুখী আত্মপ্রকাশ। এটি হয়তো শেষ পর্যন্ত তর্ক-প্রতর্কেরও বিষয়। মার্কিন লেখক টনি মরিসন বলেছেন, কল্পনার ব্যক্তিগত অনুশীলন বলে কিছু নেই, লেখা ব্যাপারটাই হলো রাজনৈতিক। মরিসন দেখান যে, আত্মজৈবনিক রচনার রীতিও প্রবলভাবে সামাজিক চেতনার পরিবাহী হতে পারে। মরিসনের দৃষ্টিতে মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ লেখকদের অনেক রচনাই আত্মজৈবনিক ধরনের; কিন্তু আত্মজৈবনিক সেসব রচনাই হয়ে উঠেছে বহুস্বর-‘প্রতিনিধিত্বপূর্ণ’। এসব রচনায় প্রতিফলিত ব্যক্তির জীবন একই সঙ্গে নিজস্ব নির্জনতা এবং পরস্ব প্রতিবেশিতায় খচিত। বলা যায় মার্কিন কবি অ্যালেন্স গিন্সবার্গের কথা, যাঁর কাব্যের শিরোনামই (হাউল) তাঁর ধরন বলে দেয়। প্যারিস রিভিউকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি ব্রিটিশ কবিদের কাব্যভঙ্গিকে ‘কাপুরুষোচিত ভঙ্গি’ বলে অভিহিত করেন। বস্ত্তত ব্রিটিশ কবিদের ‘আপারটোন’ ‘হাই ক্লাস’ ধরনের স্বর তাঁর অপছন্দ ছিল। বৈরী প্রতিপক্ষতাকে একমাত্র উচ্চকণ্ঠ ভঙ্গিতেই প্রকাশ করা যায় – গিন্সবার্গ তাঁর কাব্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে আক্রমণ করবার জন্যে প্রচুর খিস্তিখেউড়-শব্দ ব্যবহার করেন যেগুলোকে ‘গালাগাল’ আখ্যা দেওয়া যায়। শামসুর রাহমানের অনেক কবিতা আছে যেগুলোর বিষয়বস্ত্ত আন্দোলন-সংগ্রাম এবং যেগুলো স্বভাবত উচ্চকণ্ঠ বা ঘোষণাধর্মী। আবার, আল মাহমুদের তেমন কবিতা প্রায় দুর্লভ, যদিও তিনি ‘শুয়োরমুখো’র মতো খিস্তি-শব্দের দারুণ ব্যবহৃতি দেখিয়েছেন।
তবে ঘোষণাধর্মী কবিতা আল মাহমুদও লিখেছেন এবং সেই কবিতার সূত্র ধরে প্রথমে খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে তারপর আবার সামনের দিকে আসা যেতে পারে। এক অর্থে গোটা বিশ্বই কবির বিষয়। কবি তাঁর স্থানগত সীমাবদ্ধতাকে পেরিয়ে যান তাঁর অভিজ্ঞতার আয়তন দিয়ে। ফলে, প্যালেস্টাইনে, আফ্রিকায়, মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশে কিংবা বিশ্বের যেখানেই মানুষের বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় তা-ই অনুপ্রেরণা জোগায় কবিকে। অচেনা, একেবারে সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতার বিষয়বস্ত্তও হতে পারে কবির উপজীব্যতার লক্ষ্য। সুইডেনের কবি টমাস ট্রান্সটোমার যখন ইজমির, সাংহাই কিংবা আফ্রিকা নিয়ে কবিতা লেখেন অথবা হাঙ্গেরীয় কবি জর্জ ফালুদি লেখেন তাঞ্জিয়ের ভ্রমণের অভিজ্ঞতাজাত তাঁর ‘কসবাহ্’ নামক কবিতা, তখন কবির বিষয়বস্ত্তর অসীমতাই প্রমাণিত হয়। এমনকি অদেখা উপাদানও অভিজ্ঞতার বিষয়ে পরিণত হতে পারে। গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডার জেলেদের বলতেন, মাছেদের সম্পর্কে কোনো বিশেষ আকর্ষণীয় বা বিবেচনাযোগ্য কিছু লক্ষ করলে তারা যেন তা অ্যারিস্টটলকে জানায়। শামসুর রাহমান যখন আগামেমনন বা ইলেক্ট্রার প্রতীকে কাব্য রচনা করেন তখন তাঁর সেই গ্রিসমুখিতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করে না। কেননা, কবিরা এক সম্প্রসারিত বিশ্বের নাগরিক। বেঞ্জামিন মলয়ঁসের ফাঁসি হলে কি কেন্ সারউইয়ার মৃত্যুদ- হলে বাঙালি কবির কাব্যিক সাড়া প্রাসঙ্গিকতা পায়। তুরস্কের কামাল আতাতুর্ককে বাংলা কবিতায় অমর করে রাখেন কাজী নজরুল ইসলাম। বিষয় ছাড়াও বলা যায়, সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটের কাব্যাঙ্গিক বা কাব্যভাবনাও হতে পারে কবির সৃজনশীলতার অনুপ্রেরণা। ইংরেজ কবি টিএস এলিয়ট বলেছিলেন, এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ডের রুবাইয়াৎ পাঠই ছিল তাঁর চার পঙ্ক্তির ‘কোয়ার্টেট’ (‘ফোর কোয়ার্টেট’) কবিতা রচনার অনুপ্রেরণা। কবি এজরা পাউন্ড জানান, চৈনিক দার্শনিক কনফুশিয়াসের
চিন্তা-দর্শনের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে তিনি তাঁর ক্যান্টোজ-কবিতাবলি রচনা করেছিলেন। কাজী নজরুল ইসলামের পরে কবি ফররুখ আহমদ এবং সৈয়দ আলী আহসানের কথা বলা যায়, যাঁদের কবিতায় আরবি-ফারসি বিষয় ও আঙ্গিকের প্রভাব উল্লেখযোগ্য। পৃথিবীর নানান দেশের বিষয়বস্ত্ত আল মাহমুদের কবিতাতেও উপজীব্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সক্রেটিস, গোর্কি, হজরত মুহাম্মদ, বখতিয়ার, বেঞ্জামিন মোলয়েসি, ঈশপ, ইকবাল, বেদুইন, লায়লা – এইসব বিষয় নিয়ে কবিতা লিখেছেন তিনি। অর্থাৎ বিশ্বদৃষ্টির আয়ত অন্বেষণে ব্যাপৃত থেকে আল মাহমুদ তাঁর কাব্য-উপাদান সংগ্রহ করেছেন। তা সত্ত্বেও অনুসন্ধিৎসু পাঠকের কাব্যপাঠের অভিজ্ঞতা ঘটাতে পারে ভিন্ন আলোকসম্পাত।
১৯৮০ সালে প্রকাশিত হয় আল মাহমুদের পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না। এ-গ্রন্থের একটি কবিতা ‘ইহুদিরা’। পঁচিশ পঙ্ক্তির কবিতাটির দশটি পঙ্ক্তির উদ্ধৃতি অনুসরণ করি –
অনিষ্টকর অন্ধকারে যখন পৃথিবী
আচ্ছন্ন হয়ে যায়। চারদিকে ডাইনীদের
ফুৎকারের মতো হাওয়ার ফিসফাস,
আর পাখিরা গুপ্ত সাপের আতঙ্কে
আশ্রয় ছেড়ে অন্ধকারে ঝাঁপ দেয়
ঠিক তখুনি, ইহুদিরা হেসে ওঠে। …
ইহুদিরা হাসুক,
তবু সম্পদের সুষম বণ্টন অনিবার্য।
ইহুদিরা নাচুক, তবু
ধনতন্ত্রের পতন আসন্ন।
কবিতার সর্বশেষ পঙ্ক্তি ‘মানুষ মানুষের ভাই’ হলেও কবি আল মাহমুদের উপর্যুক্ত কাব্যিক স্বীকারোক্তি থেকে নিশ্চিতভাবে বলা যাবে তিনি সমগ্র মানবজাতির প্রতিনিধি নন। কেননা, কবিতাটিতে মূল প্রতিপক্ষ ‘ইহুদিরা’ আর ধনতন্ত্র এবং ‘ইহুদিরা’ হয়ে পড়ে সমার্থক। এমনও মনে হওয়াটা স্বাভাবিক, বিশ্বে সম্পদের সুষম বণ্টন হওয়ার পথে বাধা ইহুদিরাই। এমন অভিজ্ঞতা আমাদের নতুন নয়। গবেষক অ্যান্থনি জুলিয়াস তাঁর কবি টিএস এলিয়ট বিষয়ক গবেষণাকর্মে (১৯৯৫ সালে প্রকাশিত) দেখান, এলিয়টের কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে স্পষ্ট জাতিবিদ্বেষ। তাঁর অনেক কবিতায় এলিয়ট প্রত্যক্ষভাবে ইহুদিদের প্রতি ঘৃণা-অশ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন। ‘বারব্যাংক উইথ আ ব্যাডেকার : বস্ন্যাইস্টাইন উইথ আ সিগার’, ‘সুইনি অ্যামাং দ্য নাইটিংগেইলস্’ কিংবা ‘আ কুকিং এগ’ প্রভৃতি কবিতার বিশেস্নষণে এলিয়টের জাতিবিদ্বেষ ধরা পড়ে। কবির ধর্মাশ্রয় বা ধর্মাশ্রিত ভাবধারানির্ভর কবিতারচনা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। স্বয়ং এলিয়টই বলেছেন (প্যারিস রিভিউ পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে), বাইবেলের কাব্যিকতা ধর্মীয় অভিজ্ঞতার সমান্তরালে আসাটা স্বাভাবিক। বিশেষ করে, এলিয়টের মতে, বাইবেলের ‘সাম’ কিংবা ‘ইসাইয়াহ্’ অংশ তেমন অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়। এলিয়ট অবশ্য এমনও বলেন যে, বাইবেলকে সাহিত্য হিসেবে বিবেচনা না করে বরং সেটিকে শব্দের অভিজ্ঞতা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। কিন্তু বাইবেলের অভিজ্ঞতাকে জাতিবিদ্বেষের লক্ষ্যে পরিচালনা করাটা সৃজনশীল কবিস্বভাবের জন্যে বেমানান। গবেষক অ্যান্থনি জুলিয়াসের গবেষণাকর্ম সেরকম ধারণাই দেয় আমাদের। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয় আল মাহমুদের ষষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ বখতিয়ারের ঘোড়া। গ্রন্থের একটি কবিতায় (‘হত্যাকারীদের মানচিত্র’) কবি জানান, ‘আফগানিস্তান আমার দেশ আমার/ ভালোবাসা …/ আফগানিস্তান আজ কার দেশ নয়? আফগানিস্তান/ সব স্বাধীন মানুষের অপহৃত মাতৃভূমি।’ কবিতাটিতে তখনকার আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপস্থিতি ‘সাম্রাজ্যবাদ’ হিসেবে চিহ্নিত এবং তখন এমন কবিতা বাংলা ভাষা ছাড়াও বিশ্বের বহু ভাষার কবিরা রচনা করেছিলেন। আবার ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত আল মাহমুদের একাদশ কাব্যগ্রন্থের ‘রাফাতের লাশের ওপর জুঁইফুল’ কবিতাটি পাঠ করলে দেখব কবি ভাবছেন ‘ইসলামকে কবর দিতে’ হত্যা করা হয়েছে ‘রাফাত মাহমুদ ও তার উনত্রিশ সহযাত্রী’কে। এই কবিতাটাই এক সরব ঘোষণা হয়ে দাঁড়ায় অন্তিমে যখন কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে –
খুঁড়ে ফ্যালো গোটা আফ্রিকা কালো মহাদেশ। কায়রোর
কবরখানায় পবিত্র কোরআনকে পুঁতে ফেলে
যারা হোটেলগুলোতে মদের গস্নাস হাতে উদর নৃত্যে মশগুল
এখন পশ্চিম আফ্রিকা তাদের বিভীষিকা দেখাচ্ছে।
মহাদেশের মাটি চৌচির করে আলজেরিয়ায় বেরিয়ে এসেছে
আল্লার এই অদ্ভুত কিতাব।
আপন বিশ্বাসে স্থির আল মাহমুদকে আমরা সবশেষে এমন নির্দ্বান্দ্বিকভাবে পাই।
আল মাহমুদের কবিতা পাঠ করি। একদা ১৯৬৩ সালে তিনি প্রত্ন-মহেঞ্জোদারোর মৃৎপাত্রে গাঁথা অক্ষরের দিকে দৃষ্টিপাত করেছিলেন। যদিও ‘মানুষের শিল্প’কে তাঁর কাছে ‘নির্বোধের নিত্য কারিগরি’ মনে হয়েছে, তবু শব্দশিল্পের গায়ে তিনি তাঁর স্বাক্ষর রেখে যান। তিতাস নদী বেয়ে চলে তাঁর ‘সোনার বৈঠার ঘায়ে পবনের নাও’। কিন্তু আসে দুর্দিন আর খরাগ্রস্ততা, তাই তাঁর ‘সমস্ত গন্তব্যে একটি একটি তালা’ ঝোলে। কবির অন্তরের সর্বত্র বাসা বাঁধে প্রবল অবিশ্বাস। সেটা ছিল প্রত্যাশিতই। পাকিস্তানি সামরিক শাসনামলের বন্ধ্যত্বকে তিনি বিদ্ধ করেছিলেন দারুণ করণ-কুশলতায় – ‘শুনুন, রবীন্দ্রনাথ আপনার সমস্ত কবিতা/ আমি যদি পুঁতে রেখে দিনরাত পানি ঢালতে থাকি/ নিশ্চিত বিশ্বাস এই, একটিও উদ্ভিদ হবে না/ আপনার বাংলাদেশ এ রকম নিষ্ফলা, ঠাকুর!’ আবার, দেশ মুক্ত-স্বাধীন হলেও কবি আল মাহমুদ দেখতে পান ‘বন্দুকের নল’ তাঁর ‘মাথার দিকেই তাক করা’। এবং ১৯৮৫ সালে বাঙালি কবি আল মাহমুদের সোৎসাহী কণ্ঠে ধ্বনিত হয় নতুন এক প্রণোদনা এবং কবিকে তখন সেই উৎসাহ প্রকাশ করার জন্য আশ্রয় নিতে হয় বাংলার পরিবর্তে বিদেশি ভাষার –
আজ আবার হৃদয়ে কেবল যুদ্ধের দামামা
মনে হয় রক্তেই ফয়সালা।
বারুদই বিচারক। আর
স্বপ্নের ভেতর জেহাদ জেহাদ বলে জেগে ওঠা।
(‘বখতিয়ারের ঘোড়া’, বখতিয়ারের ঘোড়া)
উপর্যুক্ত উচ্চারণে আমরা সংশয়ে পড়ি – এ-কবির বিশ্বাস নাকি অবিশ্বাসের প্রকাশ!
No comments