প্রিয়তীর যৌন হেনস্তার ফিরিস্তি -‘প্রিয়তির আয়না’ বই থেকে
মাকসুদা
আক্তার প্রিয়তী। বাংলাদেশী মেয়ে। বড় হয়েছেন ঢাকায়। পড়াশোনার জন্য পাড়ি
জমান আয়ারল্যান্ডে। পড়াশোনার সঙ্গে জড়ান মডেলিং-এ। নিজের চেষ্টা আর সাধনায়
অর্জন করেন মিস আয়ারল্যান্ড হওয়ার গৌরব। নিজের চেষ্টায়ই বিমান চালনা
শিখেছেন। ঘর সংসার পেতেছেন আয়ারল্যান্ডেই।
নানা উত্থান পতন আর ঝড় বয়ে গেছে। নিজের বেড়ে উঠা, প্রেম, বিবাহ বিচ্ছেদ, মডেলিং, ক্যারিয়ার, প্রতারণা সব মিলিয়ে টালমাটাল এক পথ। প্রিয়তি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়ার নানা বিষয় নিয়ে প্রকাশ করেছেন আত্মজীবনী-‘প্রিয়তীর আয়না’। বইটি প্রকাশ করেছে দেশ পাবলিকেশন্সের পক্ষে অচিন্ত্য চয়ন। বইটিতে প্রিয়তি খোলামেলাভাবে নিজের বেড়ে ওঠা আর বেঁচে থাকার লড়াইয়ের নানা দিক তুলে ধরেছেন। এ বইয়ের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো মানবজমিন এর সৌজন্যে। আজ থাকছে শেষ পর্ব-
যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি। যেহেতু বিশাল পরিবার, বাবার ওপর ছিল গুরু দায়িত্ব আর মায়ের দায়িত্ব ছিল এই বিশাল পরিবারকে সামলানো। সামলানো বলতে আমরা কি বুঝি? একটা পরিবারের তিন বেলা রান্নাবান্না, ঘর গোছানো, পরিষ্কার রাখা, ধোয়া ইত্যাদি। কিন্তু কম নয় একটা সংসার সামলানো। মা’র সারাটা দিন চলে যায় রান্না ঘরেই, এর মধ্যে মেহমানদারি তো আছেই। এটি বাংলাদেশের সব ঘরেই চিত্র। মা কিন্তু খুব ভালোভাবে বা একান্ত সময় কাটাতে পারেননি আমার সাথে বা সর্বক্ষণ যে চোখে রাখা সেই কাজটি তার পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। তিনি জানতেন না আমাদের আশপাশের বিশ্বস্ত মানুষগুলো এত বিষাক্ত।
আমার শৈশব স্মৃতি থেকে ভয়ঙ্কর স্মৃতির ভান্ডার বেশি। মস্তিষ্কের ওই স্মৃতির ফোল্ডারগুলো পার্মানেন্টলি বসবাস করছে। চোখ বন্ধ করলেই একে একে চোখের ওপর ভাসে। শৈশবে যখন বুঝতাম না যে, শিশু যৌন নির্যাতন কী তখনই হয়তো ভাল ছিল। যখন বোঝা শুরু করি তখন থেকে সাপের দংশনের মতো ছোবল মারতে থাকে ওই স্মৃতিগুলো আমার মগজে। বুঝতে শুরু করি কালো পৃথিবীতে আমাদের বসবাস।
বয়স তখন চার কি পাঁচ, কাজের মেয়ের কাছে আমাকে রেখে সবাই যেন কোথায় গিয়েছিল। সবাই ঘুমাচ্ছিল কিনা ঠিক মনে নেই। মনে আছে আমাদের বাসার মাঝ রুমের দরজাটা আটকানো। আমি আর আমাদের কাজের মেয়েটি। দিনের বেলা পর্দা টানানো থাকার কারণে রুমটা বেশ অন্ধকার ছিল। আমাকে বলেছিল লুকোচুরি খেলবে। কিন্তু হঠাৎ দেখি মেয়েটি আমার সামনে... এখন প্রায়ই মনে প্রশ্ন আসে, কেন মা’কে কখনো বলা হয়নি। উত্তর খুঁজতে গিয়ে উপলব্দি করলাম, মায়ের সাথে তো আমার শৈশবে একান্ত সময় কখনো কাটেনি। বাবা-মা আমরা দুই বোন এক খাটে ঘুমাতাম। ঘুমাতে যেতাম কখন, যখন আমরা সবাই ক্লান্ত। ঘরের কাজ শেষে ঘুমাতে গেলে মা’কে আর পাব কোথায় আমার মতন করে। তখন কি আর এসব বোঝার বা যোগ-বিয়োগ করার বয়স বা উপলব্দি হয়েছিল? অবশ্যই না।
নানা উত্থান পতন আর ঝড় বয়ে গেছে। নিজের বেড়ে উঠা, প্রেম, বিবাহ বিচ্ছেদ, মডেলিং, ক্যারিয়ার, প্রতারণা সব মিলিয়ে টালমাটাল এক পথ। প্রিয়তি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়ার নানা বিষয় নিয়ে প্রকাশ করেছেন আত্মজীবনী-‘প্রিয়তীর আয়না’। বইটি প্রকাশ করেছে দেশ পাবলিকেশন্সের পক্ষে অচিন্ত্য চয়ন। বইটিতে প্রিয়তি খোলামেলাভাবে নিজের বেড়ে ওঠা আর বেঁচে থাকার লড়াইয়ের নানা দিক তুলে ধরেছেন। এ বইয়ের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো মানবজমিন এর সৌজন্যে। আজ থাকছে শেষ পর্ব-
যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি। যেহেতু বিশাল পরিবার, বাবার ওপর ছিল গুরু দায়িত্ব আর মায়ের দায়িত্ব ছিল এই বিশাল পরিবারকে সামলানো। সামলানো বলতে আমরা কি বুঝি? একটা পরিবারের তিন বেলা রান্নাবান্না, ঘর গোছানো, পরিষ্কার রাখা, ধোয়া ইত্যাদি। কিন্তু কম নয় একটা সংসার সামলানো। মা’র সারাটা দিন চলে যায় রান্না ঘরেই, এর মধ্যে মেহমানদারি তো আছেই। এটি বাংলাদেশের সব ঘরেই চিত্র। মা কিন্তু খুব ভালোভাবে বা একান্ত সময় কাটাতে পারেননি আমার সাথে বা সর্বক্ষণ যে চোখে রাখা সেই কাজটি তার পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। তিনি জানতেন না আমাদের আশপাশের বিশ্বস্ত মানুষগুলো এত বিষাক্ত।
আমার শৈশব স্মৃতি থেকে ভয়ঙ্কর স্মৃতির ভান্ডার বেশি। মস্তিষ্কের ওই স্মৃতির ফোল্ডারগুলো পার্মানেন্টলি বসবাস করছে। চোখ বন্ধ করলেই একে একে চোখের ওপর ভাসে। শৈশবে যখন বুঝতাম না যে, শিশু যৌন নির্যাতন কী তখনই হয়তো ভাল ছিল। যখন বোঝা শুরু করি তখন থেকে সাপের দংশনের মতো ছোবল মারতে থাকে ওই স্মৃতিগুলো আমার মগজে। বুঝতে শুরু করি কালো পৃথিবীতে আমাদের বসবাস।
বয়স তখন চার কি পাঁচ, কাজের মেয়ের কাছে আমাকে রেখে সবাই যেন কোথায় গিয়েছিল। সবাই ঘুমাচ্ছিল কিনা ঠিক মনে নেই। মনে আছে আমাদের বাসার মাঝ রুমের দরজাটা আটকানো। আমি আর আমাদের কাজের মেয়েটি। দিনের বেলা পর্দা টানানো থাকার কারণে রুমটা বেশ অন্ধকার ছিল। আমাকে বলেছিল লুকোচুরি খেলবে। কিন্তু হঠাৎ দেখি মেয়েটি আমার সামনে... এখন প্রায়ই মনে প্রশ্ন আসে, কেন মা’কে কখনো বলা হয়নি। উত্তর খুঁজতে গিয়ে উপলব্দি করলাম, মায়ের সাথে তো আমার শৈশবে একান্ত সময় কখনো কাটেনি। বাবা-মা আমরা দুই বোন এক খাটে ঘুমাতাম। ঘুমাতে যেতাম কখন, যখন আমরা সবাই ক্লান্ত। ঘরের কাজ শেষে ঘুমাতে গেলে মা’কে আর পাব কোথায় আমার মতন করে। তখন কি আর এসব বোঝার বা যোগ-বিয়োগ করার বয়স বা উপলব্দি হয়েছিল? অবশ্যই না।
আমার সমবয়সী ছোট-বড় পাড়ার অনেক ছেলে-মেয়ে ছিল। প্রতিদিন বিকেলে বের হতাম খেলার জন্য। বউ-ছি, ছোঁয়াছুঁয়ি, লুকোচুরি, সব বাচ্চাদের মতো আমারও পছন্দের খেলা ছিল। আমার বয়স ৫/৬ বছর হবে, তখন পাশের বাসায় একজন ডাক্তার থাকতেন এবং তার বাসায় অনেক রোগী আসতেন। তার একটি ছেলে ছিল, নাম সানু। বয়স হয়তো দশ/বারো বছর হবে। আমার চেয়ে বড় ছিল। লুকোচুরি খেলতে গিয়ে প্রায়ই সে আমাকে দরজার আড়ালে নিয়ে যেত...খুব জোরাজুরি করত...আমাদের সমাজ, শিক্ষা, পরিবার যখন সেক্স এডুকেশন নিয়ে কথা বলতে দ্বিধাবোধ করে, লজ্জা পায়, সংকোচ করে তখন এমন সমাজে দশ-বারো বছরের ছেলের কাছে পাঁচ-ছয় বছরের মেয়েদেরই বলিদান দিতে হয়। সামান্য সেক্সুয়াল প্লেজারের জন্য, আনন্দের জন্য তখনই ধীরে ধীরে এই সমাজে নোংরা অসুস্থ মস্তিষ্কের জন্ম নিতে থাকে এবং আমাদের মাঝেই ওরা বেড়ে ওঠে আর তখন ধীরে ধীরে তাদের মাঝ থেকেই হয়ে ওঠে এক-একজন ধর্ষক। এর মধ্যেই ওই বাসার এক রোগীর সাথে আসা এক ছেলে আমাকে ওই একই জিনিস করতে বলে। খেলাধুলা সব শিশুরই বা সব বাচ্চার একটা নেশা থাকে।
আমাদের জন্য তো আর আলাদা করে খেলার পার্ক বা খেলার মাঠ ছিল না। এই বাসা ওই বাসা যাওয়া বা দৌড়াদৌড়ি করাই আমাদের খেলার জায়গা ছিল। আবারো বিকেল বেলা খেলতে গিয়েছি, সেদিন সানুদের বাসায় রোগী আগেই এসে অপেক্ষা করতে থাকে। সানুর বাবা তখনও বাসায় আসেননি, চেম্বার তখন ফাঁকা। বারান্দায় ওরা অপেক্ষা করছে আর চেম্বারের রুমটা খোলা। কিন্তু লাইট অফ থাকায় অন্ধকার। আমাকে দেখে বলে এই মিষ্টি মেয়ে তুমি ম্যাজিক খেলা পছন্দ করো? আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালে আমাকে বলে আমার কাছে একটা ম্যাজিক আছে। তুমি একটা জিনিসে হাত দিবা...এরপর আর মনে নেই আমার...তাদের কী পরিমাণ বীভৎস আত্মা, তা কি আপনারা বুঝতে পারেন?
এই বীভৎস আত্মাগুলো যেন আমার পেছন ছাড়ে না। নিজ ঘরেই যেন তাদের বসবাস। বাবা নিয়ে গেলেন গ্রামের বাড়িতে শীতের ছুটিতে। গ্রামের বাড়িতে গেলে সব বাচ্চাকে একসাথে শোয়ার ব্যবস্থা করতেন মুরুব্বীরা, অর্থাৎ চাচারা। চাচাতো ভাই-বোন ছিল কাছাকাছি বয়সের কিন্তু আমার থেকে কয়েক বছরের বড়। রাতে শুয়েছি আমরা সবাই কাজিনরা। আমার পাশে শুয়েছে আমার চাচাতো ভাই। শীতের রাতে লেপের নিচে শুয়ে আছি। আমি কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। হঠাৎ টের পেলাম... সে আমার মুখ চেপে ফিসফিস করে বলছে, কিচ্ছু হবেনা চুপ কর নইলে কিন্তু কাল দোলনা বানিয়ে দিব না। আমি তারপর আবার ঘুমিয়ে যাই। সে আবার চেষ্টা করে, আমি কুকাতে থাকি...ছোট মানুষ ক্লান্ত ছিলাম, ঘুমের মধ্যে ছিলাম। আমার বয়স তখন সাত-আট বছরের বেশি হবে না। তখন আমার বাবা বেঁচে ছিলেন।
আপনারা কি ভাবছেন সুড়সুড়ি দেয়ার জন্য এই গল্প বলছি? নাকি আমার বই বিক্রি হওয়ার জন্য এ গল্প বলছি? যেভাবেই আপনারা নেন না কেন, আমার বলার একটাই কারণ, যাতে আপনাদের সন্তানেরা সুরক্ষায় থাকে। যাতে আপনারা সাবধান হোন যে, কত কাছ থেকে কত সহজ উপায়ে প্রতিদিন শিশু বাচ্চারা যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। প্লিজ ট্রাস্ট নো ওয়ান।
আর এই যৌন নিপীড়নতা ও অসুস্থ মস্তিষ্কের সংখ্যা অশিক্ষিত সমাজের চেয়ে শিক্ষিত সমাজে বেশি। এবার শুনুন এক ডাক্তারের গল্প।
আমার বাতজ্বরের সমস্যা ছিল। তার জন্য রেগুলার এক ডাক্তারের কাছ যেতে হতো। আমার ভাই আমাকে খুব আদর করতেন। যেমন শাসন, তেমন আদর করতেন। আমাকে তিনি একদিন ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। আমার তখন সবে বক্ষ উঠা শুরু করে, ওই সময় মেয়েদের প্রচ- ব্যথা থাকে। একটু আলতো ছোঁয়াতেই অনেক ব্যথা। টেবিলের অপর পাশে বসা আমার ভাই। আমাকে ডাক্তার কাছে আসতে বললেন, তিনি চেকআপ করবেন। ডাক্তারের দিকে আমাকে ফিরিয়ে ঝঃবঃযড়ংপঢ়ঢ়ব দিয়ে আমার হার্ট চেক করার কথা বলে ইচ্ছামত আমার বক্ষে তার হাত দিয়ে চাপ দিচ্ছিল। ব্যথায় আমার চোখে পানি ছল ছল করছিল, চেষ্টা করছিলাম চোখ থেকে যেন টপ করে পানি পড়ে না যায়। আমার পিছনে তার দুই হাতে ধরা। টেবিলের ওপাশে আমার ভাই বসা, লজ্জায় আমার মুখ কোথায় যে লুকাই হুঁশ পাচ্ছিলাম না...বয়স তার ৩০-৩২ হবে হয়তো। আমি তার চোখগুলো কেন বলতে পারিনি, কেন কারো সাথে শেয়ার করতে পারিনি। আমি কি তখন বুঝতাম না যে, এগুলো যৌন হেনস্তা? মা’কে পর্যন্ত বলিনি কিন্তু যন্ত্রণাগুলো এখনো ঘুরেফিরে বেড়ায়।
>>>‘প্রিয়তির আয়না’ বই থেকে
No comments