‘আমি এখন এক আফগান’: আগ্রাসন চালানোর পর আর দেশে ফিরে যাননি যে সোভিয়েত সেনা

উত্তরাঞ্চলীয় আফগান নগরী কন্দুজে ১৯৮৪ সালের এক তারাভরা রাত। ১৮ বছর বয়সী তরুণ সেনা গেন্নেদি সেভমা চুপিসারে মাতাল ও ঘুমে ঢুলতে থাকা সেনাদের মাঝ থেকে উঠে গেলেন। ক্যাম্পের উপর নজর রাখার দায়িত্ব ছিলো এসব সেনার।
সেভমা’র ভাষায়, ‘সোভিয়েত আর্মির নির্যাতন’ থেকে পালাবো বলে ঠিক করেছিলাম। সামনে কি আছে জানি না।
ঘাঁটি ত্যাগ করার পর ইউক্রেনের সেনাটি সোজা মুজাহিদিনদের তাবুতে গিয়ে ঢোকেন। তখন সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়ছিলো এসব মার্কিন সহায়তাপুষ্ট মুজাহিদ।
১৯৮৯ সালে সেনা প্রত্যাহারের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন নিশ্চিত ছিলো যে তাদের সব সেনা আফগানিস্তান ছেড়ে এসেছে। কিন্তু না, সেভমার মতো আরো ২২৬ জন পক্ষত্যাগকারী সেনা পেছনে থেকে যায়।
১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত প্রায় এক দশক ধরে চলা ওই যুদ্ধে দুই মিলিয়ন আফগান নাগরিক ও ১৫,০০০ সোভিয়েত সেনা প্রাণ হারায়। সেভমা বেঁচে যান। শুধু তা-ই নয়, নিজের অতীত জীবন কবরস্থ করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
এক সময়ের নাস্তিক, ইউক্রেনের দনবাস এলাকা থেকে আসা সেভমার বয়স এখন ৫৫ বছর। তিনি এখন নিজেকে নিক মোহাম্মদ নামে পরিচয় দেন। তিনি চার সন্তানের জনক, দারি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন। এটি ফার্সি মিশ্রিত আফগান উপভাষা। তিনি এখন একনিষ্ঠ মুসলমান।
নিজের বাড়িতে ঘরের বাইরে একটি খাটিয়ায় বসে তার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন তার দুই নাতী অদূরেই খেলা করছে এবং তার মনযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছিলো।
দারি ভাষাতে তিনি বলেন, আমি এখানেই জীবন সাজিয়ে নিয়েছি, আমি এখন আফগান।
তার ভাষায় কোই ইউক্রেনিয় টান নেই।
মাঝে মধ্যে ঠাণ্ডা বিয়ার ছাড়া এখানে আর কিছুর টান তিনি অনুভব করেন না বলে জানান।
সাবেক সোভিয়েত সেনা গেন্নেদি সেভমা এখন মোহাম্মদ আলী। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন এই দারিভাষী আফগান
১৯৮৪ সালের যে রাতে তিনি পালিয়েছিলেন সে রাতেই মুজাহিদিনদের সঙ্গে তার দেখা হয় এবং যুদ্ধবন্দী হিসেবে আটক হন। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে তাকে মুজাহিদিন হিসেবে দলে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়।
তিনি বলেন, তারা আমাকে ভাষা ও নামাজ শেখানোর জন্য একজন শিক্ষক দেয়। আমার স্ত্রী হিসেবে বিবি হাওয়াকে ঠিক করে। তখন তার বয়স ছিলো ১৪ বছর।
তিনি সাত বছর মুজাহিদিন দলে ছিলেন। পরে লরি চালকের কাজ নেন।
তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছে। তাই আর ইউক্রেনে ফিরে যাওয়ার চিন্তা করেনি মোহাম্মদ। রুশ দূতাবাস থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে ২,০০০ ডলার ভাতাও দেয়া হয়েছে কিন্তু তিনি রাজি হননি।
তিনি স্মরণ করেন, ‘আমার ভয় হয়েছিলো, তাছাড়া তখন আফগানিস্তানে আমার পরিবার ছিলো।’
আট বছর আগে তিনি তার আফগান পাসপোর্ট নিয়ে দনবাস ঘুরে এসেছেন। এখন তার আফগান সরকারের আইডি কার্ড বা ‘তাসকিরা’ রয়েছে। সেটাই ছিলো তার প্রথম ও শেষ যাওয়া।
নিক মোহাম্মদ বলেন, আমার পিতামাতা গত হয়েছে। আমি আমার ভাই ও তার পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাত করি। আবেগঘন পরিবেশ ছিলো সেটা। আমরা জড়াজড়ি করে কান্নাকাটি করেছিলাম।
মোহাম্মদ দুই সপ্তাহ পর আফগানিস্তানে তার পরিবারের কাছে ফিরে আসেন। তাদেরকে সফরের ছবি দেখান, সন্তানদের কাছে গল্প বলেন। তিনি আর ইউক্রেনের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি। তবে মাঝে মধ্যে টিভি চ্যানেল ঘুরিয়ে ইউক্রেনের সংবাদ জানার চেষ্টা করেন।
২০১৪ সালে দনবাসে ইউক্রেনিয়ান বাহিনী ও সোভিয়েতপন্থী মিলিশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ তাকে ব্যথিত করে। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন আর কখনো ইউক্রেন ফিরবেন না।
মোহাম্মদের ছেলে ফাইজালের বয়স ২৬ বছর। তার ইউক্রেন দেখার সখ থাকলেও অনেক দূরের পথ। তাছাড়া সে ইউক্রেনিয় শব্দও তেমন বোঝে না।
কন্দুজের একটি বড় মহল্লায় এই পরিবারের বাস। মাসে ৭,০০০ আফগানি ভাড়া গুণতে হয়। মোহাম্মদ এখন বাড়ির আঙ্গিনায় বসে বেড়ে ওঠা বাগান পরিচর্যা করে সময় কাটান। এখনো বিস্ফোরণের শব্দ অথবা আমেরিকান, আফগান বিমান হামলার শব্দে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়।
দশকের পর দশক যুদ্ধে এই লোকটির উপর অনেক ধকল গেছে। প্রকৃত বয়সের চেয়ে তাকে অনেক বুড়ো দেখায়। তালেবানরা কাছাকাছি চলে আসায় কন্দুজে যুদ্ধের ঘনঘটা বেড়ে গেছে। ২০১৫ সালে দুই সপ্তাহের জন্য নগরটি দখল করেছিলো তালেবান। পরে তারা চলে যায়।
পুরনো ইতিহাস মনে করিয়ে দেয় ধ্বংসপ্রাপ্ত সোভিয়েত ট্যাংক
আফগান প্রতিরক্ষামন্ত্রণালয়ের দাবি যে সেনাবাহিনী এখন রক্ষণাত্মক থেকে আক্রমনাত্মক অবস্থানে যাচ্ছে। মার্কিন বাহিনী বিমান হামলার পরিমাণ ২০% বাড়িয়েছে।
তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে মোহাম্মদ বলেন, আমি এখানে একটি যুদ্ধে লড়তে এসেছিলাম কিন্তু এখন যুদ্ধই আমার সঙ্গে লড়াই করছে।
থেকে যাওয়া সোভিয়েত সেনাদের মধ্যে আরেক ইউক্রেনিয় হাজি আহমেদ ছাড়া আর কাউকে মোহাম্মদ চেনেন না বলে জানিয়েছেন। মোহাম্মদের মতো একই বছর সেও পালায়। এখন সে ট্রাক চালিয়ে কন্দুজে মালামাল আনা নেয়ার কাজ করে।
আমাদের দেখা হলে আমরা দারিতেই বাতচিত করি, বললেন মোহাম্মদ। আহমেদের আসল নাম ছিলো আলেক্সান্ডার উরিভিচ। তিনিও পালিয়ে মুজাহিদিন দলে যোগ দেন। আহমেদ কখনো আর ইউক্রেন যাননি। তার সফর করার মতো সামর্থ্য নেই বলে জানান। এর বদলে তিনি টাকা জমিয়ে ছয় বছর আগে হজ্ব করে এসেছেন। আরেকবার হজ্বে যাওয়ার টাকা জমাচ্ছেন তিনি। এবার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার আশা করছেন। তিনি যেখানে থাকেন সেই হযরত সুলতান গ্রামটি তালেবানের নিয়ন্ত্রণে। তবে তালেবানরা তাকে সম্মান করে বলে আহমেদ জানিয়েছেন।
মোহাম্মদের মতো আহমদেকে একটি রাশিয়ান প্রতিনিধি দল ইউক্রেনে ফিরে যাওয়ার জন্য আর্থিক সহায়তা দিয়েছিলো। তবে তিনি ওই অর্থ অন্য কাজে খরচ করেন।
আহমেদ জানান যে ইউক্রেন ফিরে যাওয়ার মতো তেমন কোন কারণ তার নেই। তার পিতামাতা ও ভাইবোন গত হয়েছেন। তিনিও অন্য আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেননি।
নতুন যাত্রী নিয়ে পরের গন্তব্যে রওয়ানা হওয়ার আগে আহমেদ বলেন, আমি ইউক্রেনকে মিস করবো না। আফগানিস্তানই আমার বাড়ি, এটাই আমার সংস্কৃতি। এখানে আমি খারাপ নেই, আমি সুখী।
আলেক্সান্ডার উরিভিচ এখন হাজি আহমেদ (৫৪), সাবেক এ সোভিয়েত সেনা এখন কন্দুজ শহরে ট্যাক্সি চালান

No comments

Powered by Blogger.