ডাকটিকিটের কূটনীতি by শফিক রহমান

ডাকটিকিট প্রদর্শনীতে দর্শক
ঠিকানাটা হিন্দিতে লেখা। ইনভেলপের কর্নারে রানী ভিক্টোরিয়ার ছবি। তার ওপর দেয়া সিলের গোল রেখা বরাবর অস্পস্ট অক্ষরে লেখা ডাকঘর-বিকানী, তারিখ-১২ আগস্ট, ১৮৮৪। ডেলিভারি ডাকঘর-হায়দ্রাবাদ। তারিখ-১৮ আগস্ট।

ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ার পোস্টাল স্টেশনারির মধ্যে আরেকটি ১৮৯৪ সালের। ওই বছরের ৪ এপ্রিল কলকাতার শিয়ালদহ ডাকঘর থেকে ছাড়া হয়, ১৬ এপ্রিল পৌঁছে কাসিমবাজারে। ইনভেলপটির প্রেরকের অংশে লেখা-শ্রী ত্রৈলোক্যনাথ বরাট, মোক্তার, কলিকাতা। আর অপর অংশে লেখা-‘প্রবল প্রতাপান্বিতা শ্রীল শ্রীযুক্তা মহারানী স্বর্ণাময়ী, ক্রাউন অব ইণ্ডিয়া, মহোদয়া প্রবল প্রতাপেষু’। দুর্লভ এমন সব খাম, উদ্বোধনী খাম, ডাকটিকিটসহ নানা ডাক সামগ্রীর প্রদর্শনী হয়ে গেল রাজধানী ঢাকায়।

গত ২৯ জুলাই ছিল জাতীয় ডাকটিকিট দিবস। দিবসটি উপলক্ষে ২৭ জুলাই থেকে ২৯ জুলাই শাহাবাগের জাতীয় জাদুঘরের গ্যালারিতে জাতীয় এই ডাকটিকিট প্রদর্শনীটির আয়োজন করে বাংলাদেশ ফিলাটেলিক ফেডারেশন (বিপিএফ)। এতে অংশ নেন ৫৮ জন সংগ্রাহক। ১২৫টি ফ্রেমে প্রদর্শিত হয় অসংখ্য আইটেম। তিন দিনই দেখা ও কেনায় সমানভাবে আগ্রহ ছিল নানা শ্রেণি, পেশা ও বয়সের দর্শকদের। যাকে ইতিবাচক ঘটনা হিসেবে দেখছেন দেশের প্রবীণ ফিলাটেলিস্টরা। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের সখের তালিকা থেকে যখন ডাকটিকিট সংগ্রহের কাজটি বাদ গেছে এবং তাদের আগ্রহ যখন অন্যখানে।

ফিলাটেলিস্ট এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (পিএবি) সাধারণ সম্পাদক এ টি এম আনোয়ারুল কাদির বলেন, কমন একটা অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়- মোবাইল ইন্টারনেটের যুগে এখন আর কেউ চিঠি লেখে না। ডাকটিকিটের চাহিদা নেই। আসলে তারা সার্ভিস স্ট্যাম্পের সঙ্গে স্ট্যাম্প সংগ্রহকে গুলিয়ে ফেলছেন। ফিলাটেলিস্টদের কাছে ডাকটিকিটের চাহিদা কখনও কমেনি।

তিনি আরও বলেন, ডাকটিকিট আসলে একটা ‘টুকরা কাগজ’ নয়। এগুলো এক একটা দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক। এর সঙ্গে যুক্ত থাকে রাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি। যারা এর চর্চা করেন তারাই এর মজাটা বুঝেন। এ জন্যই ডাকটিকিট সংগ্রহকে বলা হয় ‘সখের রাজা এবং রাজার সখ’।

জানা গেছে, ‘ডাকটিকিট: রাজনীতি এবং কূটনীতির’ বাস্তব একটি ঘটনা ঘটে ১৯৮৫ সালে। সার্কের প্রস্তাবক দেশ হিসেবে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম অঞ্চলিক জোটের শীর্ষ সম্মেলন। সে উপলক্ষে ৭ দেশের (বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা ও মালদ্বীপ) ডাকটিকিট নিয়ে ‘সার্ক ডাকটিকিট প্রদর্শনীর’ আয়োজন করে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী জানিয়ে দিলেন ‘না’ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে তিনি যোগ দিচ্ছেন না। কারণ, ডাকটিকিট প্রদর্শনীতে পাকিস্তান এমন একটি ডাকটিকিট নিয়ে এসেছে যেখানে উল্লেখ রয়েছে- ‘আযাদ কাশ্মীর’। বিপদ আঁচ করতে পারলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। ভারত যোগ না দিলে সার্ক সম্মেলনই হচ্ছে না। দ্রুত যোগাযোগ করলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টোর সঙ্গে। তিনি বিষয়টি বুঝার জন্য সময় নিলেন। পরে ফরেন অফিসকে জানিয়ে দিলেন ডাকটিকিটটি সরিয়ে নিতে। সব উত্তেজনা প্রশমিত হলো, অনুষ্ঠিত হলো প্রথম সার্ক সম্মেলন।

এর আগে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য ৮টি ডাকটিকিটের একটি সেট প্রকাশ করে বাংলাদেশ সরকার। ওই বছরের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্ধনাথতলায় প্রতিষ্ঠিত হয় মুজিবনগর সরকার। জানা গেছে ওই সময়ই ৩৮টি ফিল্ড অফিস নিয়ে কেন্দ্রীয় ডাক অফিস খোলা হয়। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ (বর্তমানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য) ছিলেন প্রথম পোস্টমাস্টার জেনারেল। এছাড়া শিল্পী কামরুল হাসান, নিতুন কুণ্ড, আশরাফ আলী চৌধুরী এবং ভারতীয় প্রতিনিধি এলএন মিশ্রকে নিয়ে একটি কমিটিও গঠন করা হয় ওই সময়। কমিটির সদস্যরা, মুজিবনগর সরকার এবং ব্রিটিশ এমপি জন স্টোনহাউস মিলে সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্বপক্ষে সমর্থন আদায়ে জন্য ডাকটিকিট প্রকাশের। ২৯ জুলাই, ১৯৭১ প্রকাশ হয় ৮টি ডাকটিকিটের একটি সেট। লিথোগ্রাফি প্রিন্টিং প্রোসেসে ছাপা ডাকটিকিটগুলোর ডিজাইনার ছিলেন বিমান মল্লিক এবং ছাপা হয় যুক্তরাজ্যের সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসে।

বলা হয় ওই ৮টি ডাকটিকিট শুরুতেই স্বাধীনতার স্বপক্ষে বাংলাদেশকে জোড়ালো ভাবে তুলে ধরে ব্রিটিশ হাউজ অব কমন্সে। বিশেষ করে জন স্টোনহাউজ এবং বিচারপতি আবু সায়ীদ চৌধুরী যখন সেখানে বাংলাদেশকে স্বীকৃতির দাবি তোলেন।

মুক্তিযুদ্ধ শেষে প্রথম স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ হয় ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শহীদেদের স্মরনে শহীদ মিনারের ছবিসহ ডাকটিকিটটি প্রকাশ করা হয়। ফটোগ্রেভার প্রিন্টিং প্রোসেসে ছাপা এই ডাকটিকিটটির ডিজাইনার ছিলেন বি পি চিতোনিশ এবং ছাপা হয় ভারতের নাসিক সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস থেকে।

এর পরে প্রথম স্বাধীনতা দিবসে (২৬ মার্চ, ১৯৭২) ২০ পয়সা, ৬০ পয়সা এবং ৭৫ পয়সা মূল্যমানের তিনটি ডাকটিকিটি প্রকাশ করা হয়। যার ডিজাইনার ছিলেন নিতুন কুন্ড এবং ছাপা হয় ভারতের নাসিক সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস থেকে। প্রথম বিজয় দিবসেও (১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭২) ২০ পয়সা, ৬০ পয়সা এবং ৭৫ পয়সা মূল্যমানের তিনটি ডাকটিকিটি প্রকাশ করা হয়। লিথোগ্রাফি প্রিন্টিং প্রোসেসে ছাপা তিন রঙের ডাকটিকিটটির ডিজাইনার ছিলেন কে জি মুস্তাফা। যা ছাপা হয় লন্ডনের ব্রাডবারি উইলকিনসন থেকে।

এর ধারাবাহিকতায় ব্যক্তিত্ব, ইতিহাস-ঐতিহ্য, পরিবেশ-প্রকৃতি, সংস্কৃতি, খেলাধুলা, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক দিবসসহ মোট ৭৩২টি সিরিজের ডকটিকিটি এবং ২৮টি সুভ্যেনির প্রকাশ করেছে ডাক বিভাগ।

জোট, আঞ্চলিক জোট কিংবা প্রতিষ্ঠানও যুক্ত হয়েছে ওই তালিকায়। সার্কের এক দশক এবং দুই দশক পূর্তিতে শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করে বাংলাদেশ। সে উপলক্ষ্যে ডাক বিভাগ প্রকাশ করেছে ডাকটিকিট ও উদ্বোধনী খাম।

স্থাপত্য রীতিতে মৌলিকত্বের কারণে তোপখানা রোডের ‘চামেলি হাউজ’ অনেকের কাছেই আকর্ষণীয়। এছাড়া মিলনায়তনের জন্য বিশেষ করে সেমিনার কিংবা রাউন্ড টেবিল আয়োজনের জন্যও অনেকের কাছে পরিচিত ‘সিরডাপ মিলনায়তন’। আসলে এটি এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কেন্দ্র (সিআইআরডিএপি বা সিরডাপ)-এর সদরদপ্তর। ১৯৭৯ সালের ৬ জুলাই গঠিত এই সংগঠনটির এক দশক পূর্তিতে ১৯৮৯ সালে ডাক বিভাগ প্রকাশ করেছে ডাকটিকিট ও উদ্বোধনী খাম।

কলোম্বো প্লান এর ২৫ বছর পূর্তিতে ১৯৭৬ সালে প্রকাশ হয় ডাকটিকিট ও উদ্বোধনী খাম।

এছাড়া আন্তর্জাতিক সংস্থা, সংগঠন যেমন জাতিসংঘ, স্কাউটস, রোটারিক্লাব, লায়ন্সক্লাবসহ নানা প্রতিষ্ঠানের অর্ধশত কিংবা শতবর্ষ পূর্তিতে ডাকটিকিটি প্রকাশ করেছে।

ব্যক্তিত্বের তালিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মহাকবি কায়কোবাদ, জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, নারী জাগরণের নেত্রী বেগম রোকেয়া, ক্ষুদ্রঋণের প্রবক্তা এবং নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও শিল্পাচার্য্য জয়নুল আবেদীনসহ অনেকে রয়েছেন।

বিদেশি ব্যক্তিত্বের তালিকায় রয়েছেন রানী এলিজাবেথ, প্রিন্সেস ডায়না, কামাল আতাতুর্ক, নেলসেন ম্যান্ডেলা, মহাত্মা গান্ধী, মাদার তেরেসাসহ আরও অনেক।

তবে বাংলাদেশের এসব ডাকটিকিট ও উদ্বোধনী খামের ডিজাইন মান নিয়ে অভিযোগ ফিলাটেলিস্টদের। আর এক্ষেত্রে তুলনার জন্য প্রায়শই তারা তুলে আনেন ভুটানের প্রসঙ্গ। ফিলাটেলিস্ট সাঈদ বিন সালাম তুহিন বলেন, অমাদের এই অঞ্চলেরই দেশ ভুটান সেই ষাটের দশকেই কাপড়ের স্ট্যাম্প করেছে, রেকর্ড স্ট্যাম্প করেছে। পরে তারা সিডি স্ট্যাম্প করেছে।

তিনি আরও বলেন, এসব করতে গিয়ে তাদেরকে ঝুঁকিতেও পরতে হয়েছে। ইউনিভার্সেল পোস্টাল ইউনিয়ন তাদেরকে কালোতালিকাভুক্ত করেছিল। অভিযোগ ছিল-ভুটান ডাকটিকিটকে বাণিজ্যিকিকরণ করে ফেলছে। কিন্তু মজার বিষয় হলো, বিশ্বের অধিকাংশ দেশই এখন ওই কাজটিই করছে। আর আমরা এখনও আটকে আছি বৈচিত্রহীন, গতানুগতিক সেই ডিজাইন নিয়ে। সেখানেও যে ভালো কিছু করতে পারছি তাও নয়।

জানা গেছে, ডাকটিকিটের জগতে ভুটানের ওই ব্যতিক্রমী আয়োজনের পেছনেও ছিল রাজনীতি ও অর্থনীতির কূটকালচার। বিশেষ করে ষাটের দশকের শেষের দিকে দেশটি অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে ঋণ চায়। কিন্তু বিশ্বব্যাংক তাতে সাড়া না দিয়ে ফিরিয়ে দিলে তহবিল গঠনের জন্য ‘স্ট্যাম্প প্রোগ্রাম’ হাতে নেয় ভুটান। আর এতে সরাসরি যিনি সহযোগিতা করেন তিনি হলেন আমেরিকার ব্যবসায়ি বুর্ট কের টোড। তিনিই ডাকটিকিটে থ্রীডি প্রিন্টিং ধারণা যুক্ত করেন, প্রকাশ করেন সিল্ক কাপড় ও স্টিট ফয়েলের স্ট্যাম্প। এছাড়া বিখ্যাত সেই রেকর্ড স্ট্যাম্প যা রেকর্ড প্লেয়ারে বাজত।

বুর্ট কের টোড (১৯২৪-২০০৬) ভুটানে যান ১৯৫১ সালে এবং দেশটির সরকারের উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। তার দায়িত্বেই আন্তর্জাতিক বাজারে ভুটানের ডাকটিকিট বিক্রি হতে শুরু করে। ১৯৬৯ সালে ইউনিভার্সেল পোস্টাল ইউনিয়নের সদস্য হয় ভুটান। এর আগে দেশটির আন্তর্জাতিক চিঠিপত্র দ্বিপাক্ষিক চুক্তির আওতায় ভারত হয়ে আদান-প্রদান হতো।

তবে ভুটানের মতো ব্যতিক্রমী আয়োজন দূরে থাক, বাংলাদেশের ডাকটিকিট ডিজাইনের চলমান ধারায়ও যে বিচ্যুতি ঘটেছে তা নিয়ে আক্ষেপ কে জি মুস্তাফারও। ‍যিনি শুধু ডাকটিকিটই নয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ব্যাংক নোট ও কয়েনেরও ডিজাইনার। এর আগে তিনি যুক্ত ছিলেন করাচি সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসের সঙ্গে। তিনি বলেন, বড় ক্যানভাসে ছবি আঁকা এবং মিনিয়েচার ফর্মে একটি বিষয়কে ফুটিয়ে তোলার মধ্যে পার্থক্যতো একটা আছেই। কিন্তু কথা হচ্ছে সেই ছোট ক্যানভাসে কাজ করার দক্ষতা সবার আছে কিনা। শুরুর দিকে আমরা যে কাজগুলো করেছি সেগুলো প্রকৃত অর্থেই ছিল আর্ট ওয়ার্ক। কারণ, পুরোটাই হাতে করা হতো। কিন্তু এখন যারা করছেন তারা করছেন কম্পিউটারে (ডিটিপি)। একটা ছবি বসিয়ে করে ফেলছেন। সেখানে কোন মৌলিকত্ব থাকছে না। আর যেখানে মৌলিকত্ব নেই তার মূল্যও থাকার কথা নয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিট। ৮টি ডাকটিকিটের এই সেটটি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ সরকার।

No comments

Powered by Blogger.