দৃষ্টান্তমূলক রায় by নাজমুল হক শামীম

চাঞ্চল্যকর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার মামলায় ১৬ আসামির মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড দেয়া হয়েছে। তদন্ত প্রক্রিয়ায় আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডে ১৬ জনের জড়িত থাকার তথ্য উঠে আসে। রায়ে এদের সবাইকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া হয়েছে। মাত্র ৬১ কার্য দিবসে মামলার কার্যক্রম শেষ করে দেয়া এই রায় বিচার বিভাগের জন্য একটি মাইলফলক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে রাফির পরিবার। দ্রুত রায় কার্যকর ও নিরাপত্তা দাবি করা হয়েছে তাদের পক্ষ থেকে।
হত্যাকাণ্ডের পর আসামিদের শাস্তির আওতায় আনার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকারও প্রশংসা করেন আদালত। আসামি পক্ষের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, তারা সন্তুষ্ট নন, রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করা হবে। নিয়ম অনুযায়ী সাত কার্য দিবসের মধ্যে তারা আপিল করতে পারবেন। গত ৬ই এপ্রিল আলিম পরীক্ষার হল থেকে ছাদে নিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। ১০ই এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নুসরাতের মৃত্যু হয়। হত্যাকাণ্ডের প্রায় সাত মাসের মাথায় গতকাল রায় ঘোষণার দিনে জনাকীর্ণ ছিল আদালত প্রাঙ্গণ। ভিকটিম ও আসামিদের স্বজন এবং সাধারণ মানুষ আদালতে উপস্থিত হয়েছিলেন রায় শুনতে।

কড়া নিরাপত্তার মধ্যে প্রিজনভ্যানে করে ফেনী জেলা কারাগার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে মামলার ১৬ আসামিকে আদালতে আনা হয়। আদালতে আসামিদের তোলার সময় হাসতে হাসতে বিচারকের এজলাসে প্রবেশ করেন অধ্যক্ষ সিরাজ। ১১টা ৭ মিনিটে বিচারক আদালতে প্রবেশ করেন। এ সময় ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ আলোচিত এ মামলার বিচারকাজ চলার সময় উপস্থিত আইনজীবী, পুলিশ, পিবিআই, সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ১১টা ৯ মিনিটে রায় পড়া শুরু করেন বিচারক। মূল রায়ের সারসংক্ষেপ (তিনপৃষ্ঠা) পড়ে শোনান তিনি। রায় পড়তে বিচারক সময় নেন ১২ মিনিট ৪০ সেকেন্ড।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলো: সানাগাজীর চরকৃষ্ণজয়ের কলিম উল্যাহ সওদাগার বাড়ির কলিম উল্যার ছেলে এসএম সিরাজ-উদ-দৌলা (৫৭), চরচান্দিয়া ইউনিয়নের উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের মো. আহসান উল্যাহর ছেলে ও মাদ্রাসা ছাত্রদলের কথিত সভাপতি নুর উদ্দিন (২০), চরচান্দিয়া ইউনিয়নের ভূঁইয়া বাজারে এলাকার নবাব আলী টেন্ডল বাড়ির মো. আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে ও মাদ্রাসা ছাত্রলীগের কথিক সভাপতি শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর, পৌর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (সদ্য সাবেক) ও চরগণেশ গ্রামের পাণ্ডব বাড়ির আহসান উল্যাহ ছেলে মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ আল কাউন্সিলর (৫০), উপজেলার পূর্ব তুলাতলী গ্রামের খায়েজ আহাম্মদ মোল্লা বাড়ির আবুল বাশারের সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের সৈয়দ সালেহ আহাম্মদের বাড়ির রহমত উল্যাহ ছেলে জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ (১৯), সফরপুর গ্রামের খান বাড়ির আবুল কাশেমের ছেলে হাফেজ আব্দুল কাদের (২৫), সোনাগাজীর ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক ও উত্তর চারচান্দিয়া গ্রামের সওদাগর বাড়ির ইবাদুল হকের ছেলে আবছার উদ্দিন (৩৩), চরগণেশ গ্রামের আজিজ বিডিআর বাড়ির আব্দুল আজিজের (পালক বাবা) মেয়ে কামরুন নাহার মনি (১৯), লক্ষ্মীপুর গ্রামের সফর আলী সর্দার বাড়ির শহিদুল ইসলামের মেয়ে ও মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ-উদ-দৌলার ভাগ্নি উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে শম্পা ওরফে চম্পা (১৯), পূর্ব চরচান্দিয়া গ্রামের সোজা মিয়া চৌকিদার বাড়ির আব্দুল শুক্কুরের ছেলে আব্দুর রহিম শরীফ (২০), চরগণেশ গ্রামের হাজি ইমান আলীর বাড়ি ওরফে মালশা বাড়ির জামাল উদ্দিন জামালের ছেলে ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), চরগণেশ গ্রামের এনামুল হকের নতুন বাড়ির এনামুল হক ওরফে মফিজুল হকের ছেলে ইমরান হোসেন ওরফে মামুন (২২), তুলাতলী গ্রামের আলী জমাদ্দার বাড়ির সফি উল্যাহ ছেলে মোহাম্মদ শামীম (২০), সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চরচান্দিয়া গ্রামের ভূঁইয়া বাজার এলাকার কোরবান আলী বাড়ির কোরবান আলীর ছেলে রুহুল আমিন (৫৫), উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের বোর্ড অফিস সংলগ্ন রুহুল আমিনের নতুন বাড়ির মো. রুহুল আমিনের ছেলে মহিউদ্দিন শাকিল (২০)।

আদালতের বক্তব্য: রায় ঘোষণার সময় আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘সোনাগাজী ইসলিামিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসা ফেনী জেলার অন্যতম বৃহৎ বিদ্যাপীঠ। দুই হাজারেরও অধিক ছাত্র-ছাত্রী তথায় অধ্যয়নরত। এলাকার শিক্ষা সম্প্রসারণে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার আলোকোজ্জ্বল ভূমিকায় কালিমালিপ্তকারী এ ঘটনা বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছে। নারীত্বের মর্যাদা রক্ষায় ভিকটিম নুসরাত জাহার রাফি তেজদীপ্ত আত্মত্যাগ তাকে ইতিমধ্যে অমরত্ব দিয়েছে। তার এ অমরত্ব চিরকালে অনুপ্রেরণা। পাশাপাশি আসামিদের ঔদ্ধত্য কালান্তরে মানবতাকে লজ্জিত করবে নিশ্চয়। বিধায়, দৃষ্টান্তমূলক কঠোরতম শাস্তিই আসামিদের প্রাপ্য। এরই প্রেক্ষিতে বিচার্য বিষয়ত্রয়ে রাষ্ট্রপক্ষের অনুকূলে সিদ্ধান্ত গ্রহণপূর্বক, আসামিবৃন্দকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে অত্র মামলায় ভিকটিম নুসরাত জাহান রাফিকে বিগত ০৬/০৪/২০১৯ সকাল ৯.৪৫-৯.৫০ মিনিটের মধ্যে ফেনীস্থ সোনাগাজী ইসলিামিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার সাইক্লোন শেল্টারের ৩য় তলার ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের ওড়না দিয়ে হাত-পা বেঁধে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে তাকে পুড়িয়ে হত্যা করায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত/০৩) এর ৪ (১)/৩০ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে সকল আসামিকে সর্বোচ্চ সাজা প্রদান করা হয়েছে।

রায়ে আরো বলা হয়, দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা ও জরিমানার অর্থ আইন মোতাবেক আদায় করে ভিকটিমের বাবা-মা বরাবরে প্রদান করতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ফেনীকে নির্দেশ প্রদান করা হয়। মামলার জব্দকৃত সকল আলামত রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। আলামত হিসেবে জব্দকৃত জেলখানার দর্শনার্থী রেজিস্ট্রার ফেনী জেলখানায় প্রেরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়। জব্দকৃত আলামত ছাই বিধি মোতাবেক ধ্বংস করা হোক। মৃত্যুদণ্ডাদেশের অনুমোদনের জন্য মামলার যাবতীয় কার্যক্রম হাইকোর্ট বিভাগে সত্বর প্রেরণ কার নির্দেশ দেয়া হয়। আসামিদের সাজা পরোয়ানা ইস্যু করার পাশাপাশি রায়ের অনুলিপি চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেল সুপারকে প্রেরণ করার জন্য বলা হয়েছে।

রায় পরবর্তী প্রতিক্রিয়া: রায় ঘোষণা শেষে ১১টা ৩০ মিনিট থেকে একে একে আসামিদের এজলাস থেকে বের করা হয়। এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়ে আসামিরা। কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করে। ১১টা ৪৫ মিনিট সকল আসামিকে প্রিজনভ্যানে তুলে কারাগারে দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে প্রিজনভ্যান। এ সময় ভ্যানের দু’পাশে আসামিদের স্বজনরা কথা বলার চেষ্টা করে। অনেক স্বজনকে ভ্যানের পাশে ঝুলতেও দেখা যায়। একপর্যায়ে প্রিজনভ্যানটি চলা শুরু করলে আসামির স্বজনরা ভ্যানের পেছন পেছন ছুটতে থাকে।

রাষ্ট্রপক্ষের জ্যেষ্ঠ কৌঁসুলি ও যুক্তিতর্কের বিজ্ঞ আইনজীবী আকরামুজ্জামন জানান, রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে, আসামিরা নুসরাতকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। সবমিলিয়ে আসামিদের অপরাধ প্রমাণ হওয়ায় সাজা হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ এ রায়ে সন্তোশ প্রকাশ করছে।

তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বাদীপক্ষের কৌঁসুলি এম শাহজাহান সাজু রায়কে দৃষ্টান্তমূলক উল্লেখ করে বলেন, ৬২ কার্যদিবস শুনানির পর এই রায় দেয়া হয়েছে, যাকে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘নজিরবিহীন’ বলেছেন।
নুসরাতের ভাই মামলার বাদী মাহমুদুল হাসান নোমান বলেন, আসামিরা আদালত চত্বরে প্রকাশ্যে আমাদের হুমকি দিয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন মাধ্যমে তারা আমাদের হুমকি দিচ্ছে। অতীতের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেন তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে সেই দাবিও জানান নোমান। এদিকে রায় ঘোষণার সময় কিংবা রায় ঘোষণার পরও আদালত প্রাঙ্গণে দেখা যায়নি মামলার প্রধান আসামি অধ্যক্ষ সিরাজের পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী ফরিদ উদ্দিন খাঁন নয়নকে।

আসামিদের কার কী ভূমিকা :

১. সোনাগাজীর ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ না নিলেও, তার চেয়েও বেশি করেছেন। নুসরাতের যৌন হয়রানির মামলা তুলে নিতে চাপ প্রয়োগ, তাতে কাজ না হওয়ায় ভয়ভীতি দেখানো এবং পরে নুসরাতকে হত্যার জন্য সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেয়ার অভিযোগ আনা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে।

২. নূর উদ্দিন নুসরাত হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিল। নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়ার আগে রেকি করা ছিল তার দায়িত্ব। আর ভবনের ছাদে আগুন দেয়ার সময় নিচে থেকে পুরো ঘটনার তদারকি করা ছিল তার দায়িত্ব।

৩. শাহাদাত হোসেন শামীম নুসরাতকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। সেজন্য ছিল তার ক্ষোভ। হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নে কার কী ভূমিকা হবে সেই পরিকল্পনা সাজান শামীম। কাউন্সিলর মাকসুদের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে তিনি তার বোরখা ও কেরোসিন কেনার ব্যবস্থা করেন। নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়ার সময় তিনি হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরেন। তার জবানবন্দির ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত বোরখা ও কেরোসিন ঢালতে ব্যবহৃত গ্লাসটি উদ্ধার করে পিবিআই।

৪. সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলম অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা গ্রেপ্তার হলে ২৮শে মার্চ তার মুক্তির দাবিতে মানববন্ধনে অংশ নেন। বোরখা ও কেরোসিন কেনার জন্য তিনিই ১০ হাজার টাকা দেন। পিবিআই বলছে, পুরো ঘটনার আগাগোড়াই তিনি জানতেন।

৫. সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের বোরখা ও হাতমোজা পরে সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় জোবায়ের। নুসরাতের ওড়না ছিঁড়ে দুই ভাগ করে পা বাঁধা এবং কেরোসিন ঢালার পর ম্যাচ দিয়ে আগুন ধরানোর কাজটি সে করে।

৬. জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ বোরখা পরে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয়। পা বাঁধা হলে পলিথিন থেকে কেরোসিন গ্লাসে ঢেলে সে নুসরাতের গায়ে ছিটিয়ে দেয়। সব কাজ শেষে বোরখা খুলে পরীক্ষার হলে ঢুকে যায়।

৭. হাফেজ আব্দুল কাদের নুসরাতের ভাই নোমানের বন্ধু কাদের সেদিন মাদ্রাসার মূল ফটকে পাহারায় ছিল। নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়া হলে দুই মিনিট পরে সে ফোন করে নোমানকে বলে, তার বোন গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।

৮. আবছার উদ্দিন ঘটনার সময় গেটে পাহারায় ছিল। মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়াও তার দায়িত্ব ছিল।

৯. কামরুন নাহার মনি আসামি শামীমের দূর সম্পর্কের ভাগ্নি। মনি ২ হাজার টাকা নিয়ে দুটি বোরকা ও হাতমোজা কেনে। হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয়। ছাদের ওপর নুসরাতের হাত বাঁধা হলে তাকে শুইয়ে ফেলে বুকের ওপর চেপে ধরে মনি। আগুন দেয়া হলে নিচে নেমে এসে আলিম পরীক্ষায় বসে।

১০. উম্মে সুলতানা ওরফে পপি অধ্যক্ষ সিরাজের ভাগ্নি। সেদিন নুসরাতকে ডেকে ছাদে নিয়ে যায়। পরে মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়। তাতে রাজি না হওয়ায় নুসরাতের ওড়না দিয়ে তার হাত পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে। নুসরাতকে ছাদে শুইয়ে চেপে ধরেন পা। নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়া হয়ে গেলে পপিও নিচে নেমে পরীক্ষার হলে বসে।

১১. আবদুর রহিম শরীফ ঘটনার সময় মাদ্রাসার ফটকে পাহারায় ছিল। পরে ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে প্রচার চালায়।

১২. ইফতেখার উদ্দিন রানা মাদ্রাসার মূল গেটের পাশে পাহারায় ছিল।

১৩. ইমরান হোসেন ওরফে মামুন  মাদ্রাসার মূল গেটের পাশে পাহারায় ছিলো।

১৪. মোহাম্মদ শামীম সাইক্লোন সেন্টারের সিঁড়ির সামনে পাহারায় ছিল।

১৫. মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সহ-সভাপতি রুহুল আমীন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা।  রুহুল আমীন শুরু থেকেই এ হত্যা পরিকল্পনায় ছিল। ঘটনার পর পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সে। ঘটনার পর শামীমের সঙ্গে তার ফোনে কথা হয়। ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টাতেও তার ভূমিকা ছিল।

১৬. মহিউদ্দিন শাকিল ঘটনার সময় সাইক্লোন সেন্টারের সিঁড়ির সামনে পাহারায় ছিল।

সেদিন যা ঘটেছিল: অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, নুসরাতের শ্লীলতাহানির মামলায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ গ্রেপ্তার হলে তার অনুগত লোকজন ক্ষিপ্ত হয়। ১লা এপ্রিল শাহাদাত হোসেন শামীম, নূরু উদ্দিন, ইমরান, হাফেজ আবদুল কাদের ও রানা জেলখানায় গিয়ে সিরাজের সঙ্গে দেখা করে। তখনই অধ্যক্ষ সিরাজ তার মুক্তির চেষ্টা চালাতে এবং মামলা তুলে নিতে নুসরাতের পরিবারকে চাপ দিতে বলে।

হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের পরও মামলা না তোলায় আসামিরা আলোচনা করে ‘প্রয়োজনে যে কোনো কিছু’ করার পরিকল্পনা করে। কাউন্সিলর মাকসুদ এ কাজে শাহাদাত হোসেনকে ১০ হাজার টাকা দেয়। এর মধ্যে দুই হাজার টাকা দিয়ে মনি দুটি বোরকা ও চার জোড়া হাতমোজা কেনে।

৩রা এপ্রিল শামীম, নূর উদ্দিন, আবদুল কাদেরসহ কয়েকজন কারাগারে গিয়ে অধ্যক্ষ সিরাজের সঙ্গে দেখা করে। সিরাজ তখন নুসরাতকে ভয়ভীতি দেখানো এবং প্রয়োজনে পুড়িয়ে হত্যার নির্দেশ দেয় এবং ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে চালানোর নির্দেশ দেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩রা এপ্রিল বিকালে মাদ্রাসার পাশে টিনশেড কক্ষে শাহাদাত হোসেন শামীম, নূর উদ্দিন, জোবায়ের, জাবেদ, পপি ও মনিসহ কয়েকজন বৈঠক করে। সেখানে নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।

৪ঠা এপ্রিল রাতে মাদ্রাসার ছাত্র হোস্টেলে বসে আবারো পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করে আসামিরা। পরদিন ভূঁইয়া বাজার থেকে এক লিটার কেরোসিন কিনে নিজের কাছে রেখে দেয় শাহাদাত হোসেন শামীম।
৬ই এপ্রিল সকাল ৭টার পর মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে চলে যায় শাহাদাত হোসেন শামীম, নূর উদ্দিন ও হাফেজ আবদুল কাদের। সোয়া ৯টার মধ্যে আসামিরা পরিকল্পনা অনুযায়ী যার যার অবস্থানে চলে যায়। শাহাদাত হোসেন শামীম পলিথিনে করে আনা কেরোসিন অধ্যক্ষের কক্ষের সামনে থেকে একটি কাচের গ্লাস নিয়ে ছাদের বাথরুমের পাশে রেখে দেয়। মনির কেনা দুটি এবং বাড়ি থেকে নিয়ে আসা একটি বোরকা এবং চার জোড়া হাতমোজা নিয়ে সাইক্লোন সেন্টারের তৃতীয় তলায় রাখা হয়। শাহাদাত হোসেন শামীম, জাবেদ ও জোবায়ের সাড়ে ৯টার দিকে বোরকা ও হাতমোজা পরে তৃতীয় তলায় অবস্থান নেয়। নুসরাত পরীক্ষা দিতে এলে পরিকল্পনা অনুযায়ী উম্মে সুলতানা পপি তাকে মিথ্যা কথা বলে ছাদে নিয়ে আসে। নুসরাত ছাদে যাওয়ার সময় পপি তাকে ‘হুজুরের’ বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়। নুসরাত তাতে রাজি না হয়ে ছাদে উঠে যায়। মনি, শাহাদাত হোসেন শামীম, জোবায়ের, ও জাবেদও তখন নুসরাতের পিছু পিছু ছাদে যায়।

ছাদে তারা নুসরাতকে মামলা তুলে নিতে হুমকি দেয় এবং কয়েকটি কাগজে স্বাক্ষর দিতে বলে। নুসরাত স্বাক্ষর দিতে অস্বীকৃতি জানালে শামীম বাঁ হাত দিয়ে নুসরাতের মুখ চেপে ধরে এবং ডান হাত দিয়ে নুসরাতের হাত পেছনে নিয়ে আসে। উম্মে সুলতানা পপি তখন নুসরাতের ওড়না খুলে জোবায়েরকে দেন। জোবায়ের ওড়না দুই ভাগ করে ফেলে। পপি ও মনি এক অংশ দিয়ে নুসরাতের হাত পেছন দিকে বেঁধে ফেলে। অন্য অংশ দিয়ে নুসরাতের পা বেঁধে ফেলে জোবায়ের। জাবেদ পায়ে গিঁট দেয়। সবাই মিলে নুসরাতকে ছাদের ওপর শুইয়ে ফেলে। শাহাদাত তখন নুসরাতের মুখ ও গলা চেপে রাখে। নুসরাতের বুকের ওপর চাপ দিয়ে ধরে মনি। পপি ও জোবায়ের পা চেপে ধরে। জাবেদ বাথরুমে লুকানো গ্লাস নিয়ে এসে কেরোসিন ঢেলে দেয় নুসরাতের গায়ে। শাহাদাতের ইশারায় জোবায়ের ম্যাচ জ্বেলে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন ধরানোর পর প্রথমে ছাদ থেকে নামে জোবায়ের। এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী মনি ‘ওরফে চম্পা/শম্পা’ বলে ডেকে পপিকে নিচে নিয়ে যায়। তারা নিচে নেমে পরীক্ষার হলে ঢুকে যায়। জাবেদ ও শাহাদাত হোসেন শামীম সাইক্লোন সেন্টারের তৃতীয় তলায় গিয়ে বোরকা খুলে ফেলে। তারপর জাবেদও পরীক্ষার হলে ঢুকে যায়। শাহাদাত হোসেন শামীম তার বোরকা ফেলে দেয় মাদ্রাসার পুকুরে। জোবায়ের মাদ্রাসার মূল গেট দিয়ে বের হয়ে যায় এবং বোরকা ও হাতমোজা ফেলে দেয় সোনাগাজী কলেজের ডাঙ্গি খালে।

এদিকে অগ্নিদগ্ধ নুসরাত জীবন বাঁচাতে দৌড়ে নিচে নেমে এলে কর্তব্যরত পুলিশ কনস্টেবল ও নাইটগার্ড তার গায়ের আগুন নেভায়। নূর উদ্দিনও ওই সময় নুসরাতের গায়ে পানি দেয়। আর হাফেজ আবদুল কাদের ফোন করে নুসরাতের ভাই নোমানকে বলে, তার বোন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতাল পরে ঢাকা মেডিকেলে আনা হয়। সেখানে চার দিন চিকিৎসা নিয়ে ১০ই এপ্রিল মারা যান নুসরাত। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুকালীন জবানবন্দি দেন নুসরাত। সেখানেও গায়ে আগুন দেয়ার ঘটনা তিনি একইভাবে বর্ণনা করেন বলে অভিযোগপত্রে তুলে ধরা হয়েছে।

নুসরাত হত্যা হামলার কার্যক্রম: গত ৮ই এপ্রিল নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ৪-৫ জনকে আসামি করে হত্যাচেষ্টার মামলা করেন। নুসরাতের মৃত্যুর পর এটি হত্যা মামলায় পরিণত নেয়। এর আগে গত ৭ই এপ্রিল দগ্ধ নুসরাত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসকদের কাছে মৃত্যুকালীন জবানবন্দি (ডায়িং ডিক্লেরেশন) দেন। নুসরাত হত্যার মামলাটি তদন্ত প্রথমে করছিলেন সোনাগাজী থানার পরিদর্শক কামাল হোসেন। কিন্তু ওই থানার ওসিসহ পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নুসরাত হত্যাকাণ্ডের সময় গাফিলতির অভিযোগ উঠলে তদন্তভার আসে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ওপর। ১০ই এপ্রিল মামলাটির তদন্তভার পিবিআই গ্রহণ করে। ঘটনার পর সোনাগাজী মডেল থানা পুলিশ ও দায়িত্ব পাওয়ার পর পিবিআই বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মামলায় এজাহার নামীয় ৮ জনসহ ২১ জনকে গ্রেপ্তার করে।

পিবিআই মামলা তদন্তের দায়িত্ব নেয়ার ৩৩ কার্যদিবস শেষে (মোট ৫০ দিনের মধ্যে) গত ২৯শে মে ফেনীর সিনিয়র বিচারিক হাকিম (আমলী আদালত সোনাগাজী) মো. জাকির হোসেনের আদালতে মোট ১৬ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআই পরিদর্শক মো. শাহ আলম। ৮০৮ পৃষ্ঠার ওই অভিযোগপত্রে ‘হুকুমদাতা’ হিসেবে সোনাগাজীর ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে ১ নম্বর আসামি করা হয়। অভিযুক্ত ১৬ জন আসামির মধ্যে ১২ জন আসামি আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিল। অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হয় ৯২ জনকে। এদের মধ্যে কার্যবিধির ১৬১ ধারায় ৬৯ জনকে সাক্ষী করা হয়। ৭ জন সাক্ষী ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিমূলক সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্রের সারমর্ম বিচারকের কাছে তুলে ধরেন। একই সঙ্গে হত্যার পরিকল্পনা, প্রস্তুতি, হত্যার সময়কালীন ঘটনার ডিজিটাল স্কেচও আদালতে তুলে ধরেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। পিবিআই অভিযোগপত্রে ১৬ আসামির সবার সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড চাওয়া হয়েছিল।

গত ৩০শে মে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। গত ১০ই জুন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ আলোচিত এ মামলার অভিযোগপত্র গ্রহণ করে চার্জগঠনের জন্য ২০শে জুন ধার্য করে। অভিযোগপত্রে নাম না থাকায় ওই সময় গ্রেপ্তার পাঁচজনকে অব্যাহতি দেয়া হয়। নুসরাত হত্যা মামলার ৭২ দিনের মধ্যে গত ২০শে জুন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালত ১৬ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন (চার্জগঠন) করে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ২৭শে জুন নির্ধারণ করে। গত ২৭শে জুন মামলার বাদী নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমানের সাক্ষ্য নেয়ার মধ্যে দিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর পর টানা ৩৭ কর্মদিবসে নুসরাত হত্যা মামলায় ৯২ সাক্ষীর মধ্যে আদালতে বাদীসহ ৮৭ জন সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করে। গত ২৭শে আগস্ট সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষ হলে গত ১১ই সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় যুক্তিতর্ক। রাষ্ট্রপক্ষ, আসামিপক্ষ ও বাদী পক্ষের যুক্তি তর্ক শেষে গত ৩০শে সেপ্টেম্বর বিচারক রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য করে। এদিকে, অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে প্রথম মামলায় নুসরাতের জবানবন্দি নেয়ার ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ায় সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ঢাকার বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালে আলাদা মামলা হয়েছে। এ মামলায় তিনি কারাগারে আছেন। এ ছাড়া ফেনীর তৎকালীন পুলিশ সুপারসহ আরো দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.