বঙ্গবাজারের বহুভাষী গাইডদের দিন কি ফুরিয়ে আসছে? by শফিক রহমান
বঙ্গবাজারে বিদেশী ক্রেতা |
“আমাদের খারাপ সময় যাচ্ছে। আগের মতো বিদেশী ক্রেতারা এখানে আর আসছে না।”
সাক্ষাতের শুরুতে এভাবেই নিজেদের হাল-চাল জানাচ্ছিলেন ঢাকার বঙ্গবাজারের বিদেশি ক্রেতাদের গাইড মিরাজুল আলম। যে কিনা কখনও স্কুলে যায়নি। কিন্তু দখল আছে একাধিক দেশের ভাষায়। যা দিয়ে দক্ষতার সঙ্গেই নানা ভাষা-ভাষী ক্রেতাদের সঙ্গে কাজ করছেন গাইড হিসেবে।
ঢাকার ব্যস্ততম গুলিস্তান এলাকার বঙ্গবাজারকেন্দ্রীক আশপাশের মার্কেটগুলোতে বিক্রেতারা যখন স্থানীয় ক্রেতাদের নিয়ে সরব। তখন বঙ্গবাজারের পাশেই গড়ে ওঠা এনেক্সকো টাওয়ারের সিঁড়িতে বসে বিদেশি ক্রেতাদের অপেক্ষায় অলস সময় পার করছেন মিরাজুল আলম। সঙ্গে সুজন, ফাতেমা, আকলিমা, পারভীন ইসলাম ও ইসমাইল। এঁদের প্রত্যেকে ইংরেজিভাষী ক্রেতাদের সঙ্গ দেয়া ক্ষেত্রে দক্ষ। তবে কারো কারো আবার বিশেষ দক্ষতা একেক দেশের ভাষায়।
মিরাজুলের দখল ২২টি ভাষায়। হাতের আঙ্গুল গুনে গুনে মিরাজুল বলছিলেন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়শিয়া, ফ্রান্স, ফিলিপাইন, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরইন….। একটু থেমে আবার চোখে-মুখে হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে মিরাজুল বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ভাষার প্রতি আমার একটু টান। ওখানের সব দেশের ভাষা আরবি হলেও দেশ ভেদে ফারাক আছে। আমি ওই ফারাকটা বুঝি।’
একইভাবে ফাতেমার প্রিয় ফিলিপাইনের ভাষা, পারভীন ইসলামের ফ্রেন্স, আকলিমার রাশান এবং মালদ্বীপের ভাষা। তাদের প্রত্যেকের বক্তব্য একই- আগে বঙ্গবাজারে ইয়োরোপ ও আমেরিকার ক্রেতাদের একচেটিয়া আসা-যাওয়া থাকলেও গত কয়েক বছর ধরে তাদের সংখ্যা কমছে। এখন সংখ্যায় কম হলেও আসছে অন্যান্য দেশের ক্রেতারা। ফলে সুজন, ফাতেমা ও আকলিমাদের মতো বিদেশী ভাষায় দখল থাকা তরুণ-তরুণীদের তালিকাও দীর্ঘ হচ্ছে।
মিরাজুল জানালো, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ক্রেতা বেড়েছে। অতি সম্প্রতি এর সঙ্গে আরও যুক্ত হয়েছেন আফ্রিকান ক্রেতা বিশেষ করে নাইজেরিয়ানরা।
সমস্যা হচ্ছে, চীন, জাপান, কোরিয়া ও রাশিয়ার ক্রেতাদের নিয়ে। তাদের ভাষা রপ্ত হচ্ছেনা বঙ্গবাজারকেন্দ্রীক ওই গাইডদের। আবার গাইডদের অভিযোগ ওসব দেশের ক্রেতারা ইংরেজি ভাষাটা কম বুঝেন। তবে এর সমাধান এনে দিয়েছে বিশেষ ‘অনুবাদ সফটওয়ার’। মিরাজুল বলেন, ‘ওসব ক্রেতাদের সঙ্গে আমরা ইংরেজিতেই বলি। মোবাইলের সফটওয়ার থেকে শুনে ওরা মিলিয়ে নেন।’
কিন্তু দিন শেষে হিসেব মিলছেনা ফাতেমা-আকলিমাদের। নির্ধারিত কিছু বিদেশি ক্রেতা আসা যাওয়া করছেন। তাতে কোন দিন আয় হয় ৫০০টাকা, কোন দিন ১০০০টাকা। আবার কোন দিন একেবারেই ক্রেতা শূন্য। তাতে মাসের অর্ধেক সময়ই থাকতে হচ্ছে ক্রেতা শূন্য। অথচ, আগে দিনে প্রত্যেকে একাধিক বিদেশি ক্রেতা পেতেন। যেদিন ওঁদের সঙ্গে কথা হয় সেদিনও সন্ধ্যা অবধি কোন ক্রেতা জোটেনি। সিঁড়িতে বসে এরও হিসাব মিলাচ্ছেন, কেন এবং কখন থেকে বঙ্গবাজারে বিদেশি ক্রেতা কমতে শুরু করেছে। কারো যুক্তি হোটেল শেরাটন বন্ধ ছিল দীর্ঘ দিন, রেডিসন, লা মেরিডিয়ান, রিজেন্সি বিমানবন্দর এলাকায়। ফলে যানজট ঠেলে ক্রেতারা আসছেন না। কারো যুক্তি গুলশান হলি আর্টিজান হামলা এবং নিরাপত্তা। কেউ বলছেন শহরের অন্যান্য এলাকার মার্কেটগুলোতেও পাওয়া যাচ্ছে এক্সপোর্ট কোয়ালিটির শার্ট-প্যান্ট, গেঞ্জি-টি শার্ট।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকার নিউমার্কেট এলাকার নূরজাহান মার্কেটে গত কয়েক বছর ধরে নতুন করে বিদেশি ক্রেতা যাওয়া শুরু করেছেন। সেখানে ওইসব ক্রেতাদের সঙ্গে গাইড হিসেবে কাজ করছেন সুমি, সোহেল ও সোহাগ। এঁদের মধ্যে সুমির বিশেষ দখল আরবি ভাষায়।
এই দুই মার্কেটে সব মিলিয়ে গাইড হিসেবে কাজ করছেন ১০ জন। কয়েক বছর আগেও এঁদের সংখ্যা ছিল প্রায় দ্বিগুণ। আর এ কাজের পাইয়োনিয়ার ছিলেন জালাল। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয়েছিল জালালের। রোগা, লিকলিকে চেহারার জালাল সেদিন ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে জানিয়েছিলেন পেশা শুরুর নাটকিয়তা। জানালেন, আশির দশকের শুরুর দিকে শাহবাগ সিগনালে ফূল বিক্রি করতেন জালাল। বিদেশিরা এসে ‘শপিং’ বললেই বুঝে ফেলতেন কেনা-কাটা করতে চান। তাদেরকে নিয়ে যেতেন নিউমার্কেটে। এছাড়াও লালবাগ কেল্লাসহ আরো অনেক জায়গায়। এভাবেই বিদেশিদের সঙ্গে থাকতে থাকতে ইংরেজি ভাষাটা মোটামুটি আয়ত্ব হয়ে যায় জালালের। এরই মধ্যে আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন বঙ্গবাজার তৈরি হলো এবং বিদেশি ক্রেতাদের আনাগোনাও বাড়তে লাগল জালালও নিউমার্কেট রেখে কাজ শুরু করে বঙ্গবাজারে।”
ওই দিন একটু কৌতুহলী হয়ে প্রশংসার ছলে জালালকে বলা হয়েছিল, “আপনিতো বেশ ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন।” উত্তরে সে বলে উঠল, “এসকিউস মি স্যার, নটঅনলি ইংলিশ, আই অলসো ক্যান স্কিপিক ইন রাশিয়ান, ফ্রান্স, জাপানিজ, ইরানী, অ্যারাবিক, মালায়ন, থাই, চীনা, ফিলিপিনি এটসেট্রা, এটসেট্রা।” হাতের আগুলগুলো গুনে গুনে এভাবেই বলছিলেন জালাল। তারপর আবার ডান হাতটি বুকের ওপর রেখে ইংরেজীতেই বললেন, “ডিউ টু আওয়ার প্রোফেশন, উই নিডেড টু নো দিজ ল্যাঙ্গুয়েজ।”
শুরুর দিকে জালালের সঙ্গে বঙ্গবাজারে তখন আরও যুক্ত হয়েছিল জাভেদ ও শহীদ। শহীদ বেশি দিন পেশায় টিকে থাকতে পারেননি। জাভেদের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে জালাল বলেছিলেন, “জাবেদ অলরেডি ডেড।”
সেদিন জালালের খোঁজ নেয়া হলে প্রায় একই উত্তর মিরাজুলের। তিনি বলেন, “জালাল মামা হ্যাস ডায়েড।”
সাক্ষাতের শুরুতে এভাবেই নিজেদের হাল-চাল জানাচ্ছিলেন ঢাকার বঙ্গবাজারের বিদেশি ক্রেতাদের গাইড মিরাজুল আলম। যে কিনা কখনও স্কুলে যায়নি। কিন্তু দখল আছে একাধিক দেশের ভাষায়। যা দিয়ে দক্ষতার সঙ্গেই নানা ভাষা-ভাষী ক্রেতাদের সঙ্গে কাজ করছেন গাইড হিসেবে।
ঢাকার ব্যস্ততম গুলিস্তান এলাকার বঙ্গবাজারকেন্দ্রীক আশপাশের মার্কেটগুলোতে বিক্রেতারা যখন স্থানীয় ক্রেতাদের নিয়ে সরব। তখন বঙ্গবাজারের পাশেই গড়ে ওঠা এনেক্সকো টাওয়ারের সিঁড়িতে বসে বিদেশি ক্রেতাদের অপেক্ষায় অলস সময় পার করছেন মিরাজুল আলম। সঙ্গে সুজন, ফাতেমা, আকলিমা, পারভীন ইসলাম ও ইসমাইল। এঁদের প্রত্যেকে ইংরেজিভাষী ক্রেতাদের সঙ্গ দেয়া ক্ষেত্রে দক্ষ। তবে কারো কারো আবার বিশেষ দক্ষতা একেক দেশের ভাষায়।
মিরাজুলের দখল ২২টি ভাষায়। হাতের আঙ্গুল গুনে গুনে মিরাজুল বলছিলেন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়শিয়া, ফ্রান্স, ফিলিপাইন, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, ওমান, বাহরইন….। একটু থেমে আবার চোখে-মুখে হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে মিরাজুল বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ভাষার প্রতি আমার একটু টান। ওখানের সব দেশের ভাষা আরবি হলেও দেশ ভেদে ফারাক আছে। আমি ওই ফারাকটা বুঝি।’
একইভাবে ফাতেমার প্রিয় ফিলিপাইনের ভাষা, পারভীন ইসলামের ফ্রেন্স, আকলিমার রাশান এবং মালদ্বীপের ভাষা। তাদের প্রত্যেকের বক্তব্য একই- আগে বঙ্গবাজারে ইয়োরোপ ও আমেরিকার ক্রেতাদের একচেটিয়া আসা-যাওয়া থাকলেও গত কয়েক বছর ধরে তাদের সংখ্যা কমছে। এখন সংখ্যায় কম হলেও আসছে অন্যান্য দেশের ক্রেতারা। ফলে সুজন, ফাতেমা ও আকলিমাদের মতো বিদেশী ভাষায় দখল থাকা তরুণ-তরুণীদের তালিকাও দীর্ঘ হচ্ছে।
মিরাজুল জানালো, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ক্রেতা বেড়েছে। অতি সম্প্রতি এর সঙ্গে আরও যুক্ত হয়েছেন আফ্রিকান ক্রেতা বিশেষ করে নাইজেরিয়ানরা।
সমস্যা হচ্ছে, চীন, জাপান, কোরিয়া ও রাশিয়ার ক্রেতাদের নিয়ে। তাদের ভাষা রপ্ত হচ্ছেনা বঙ্গবাজারকেন্দ্রীক ওই গাইডদের। আবার গাইডদের অভিযোগ ওসব দেশের ক্রেতারা ইংরেজি ভাষাটা কম বুঝেন। তবে এর সমাধান এনে দিয়েছে বিশেষ ‘অনুবাদ সফটওয়ার’। মিরাজুল বলেন, ‘ওসব ক্রেতাদের সঙ্গে আমরা ইংরেজিতেই বলি। মোবাইলের সফটওয়ার থেকে শুনে ওরা মিলিয়ে নেন।’
কিন্তু দিন শেষে হিসেব মিলছেনা ফাতেমা-আকলিমাদের। নির্ধারিত কিছু বিদেশি ক্রেতা আসা যাওয়া করছেন। তাতে কোন দিন আয় হয় ৫০০টাকা, কোন দিন ১০০০টাকা। আবার কোন দিন একেবারেই ক্রেতা শূন্য। তাতে মাসের অর্ধেক সময়ই থাকতে হচ্ছে ক্রেতা শূন্য। অথচ, আগে দিনে প্রত্যেকে একাধিক বিদেশি ক্রেতা পেতেন। যেদিন ওঁদের সঙ্গে কথা হয় সেদিনও সন্ধ্যা অবধি কোন ক্রেতা জোটেনি। সিঁড়িতে বসে এরও হিসাব মিলাচ্ছেন, কেন এবং কখন থেকে বঙ্গবাজারে বিদেশি ক্রেতা কমতে শুরু করেছে। কারো যুক্তি হোটেল শেরাটন বন্ধ ছিল দীর্ঘ দিন, রেডিসন, লা মেরিডিয়ান, রিজেন্সি বিমানবন্দর এলাকায়। ফলে যানজট ঠেলে ক্রেতারা আসছেন না। কারো যুক্তি গুলশান হলি আর্টিজান হামলা এবং নিরাপত্তা। কেউ বলছেন শহরের অন্যান্য এলাকার মার্কেটগুলোতেও পাওয়া যাচ্ছে এক্সপোর্ট কোয়ালিটির শার্ট-প্যান্ট, গেঞ্জি-টি শার্ট।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকার নিউমার্কেট এলাকার নূরজাহান মার্কেটে গত কয়েক বছর ধরে নতুন করে বিদেশি ক্রেতা যাওয়া শুরু করেছেন। সেখানে ওইসব ক্রেতাদের সঙ্গে গাইড হিসেবে কাজ করছেন সুমি, সোহেল ও সোহাগ। এঁদের মধ্যে সুমির বিশেষ দখল আরবি ভাষায়।
এই দুই মার্কেটে সব মিলিয়ে গাইড হিসেবে কাজ করছেন ১০ জন। কয়েক বছর আগেও এঁদের সংখ্যা ছিল প্রায় দ্বিগুণ। আর এ কাজের পাইয়োনিয়ার ছিলেন জালাল। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয়েছিল জালালের। রোগা, লিকলিকে চেহারার জালাল সেদিন ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে জানিয়েছিলেন পেশা শুরুর নাটকিয়তা। জানালেন, আশির দশকের শুরুর দিকে শাহবাগ সিগনালে ফূল বিক্রি করতেন জালাল। বিদেশিরা এসে ‘শপিং’ বললেই বুঝে ফেলতেন কেনা-কাটা করতে চান। তাদেরকে নিয়ে যেতেন নিউমার্কেটে। এছাড়াও লালবাগ কেল্লাসহ আরো অনেক জায়গায়। এভাবেই বিদেশিদের সঙ্গে থাকতে থাকতে ইংরেজি ভাষাটা মোটামুটি আয়ত্ব হয়ে যায় জালালের। এরই মধ্যে আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন বঙ্গবাজার তৈরি হলো এবং বিদেশি ক্রেতাদের আনাগোনাও বাড়তে লাগল জালালও নিউমার্কেট রেখে কাজ শুরু করে বঙ্গবাজারে।”
ওই দিন একটু কৌতুহলী হয়ে প্রশংসার ছলে জালালকে বলা হয়েছিল, “আপনিতো বেশ ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন।” উত্তরে সে বলে উঠল, “এসকিউস মি স্যার, নটঅনলি ইংলিশ, আই অলসো ক্যান স্কিপিক ইন রাশিয়ান, ফ্রান্স, জাপানিজ, ইরানী, অ্যারাবিক, মালায়ন, থাই, চীনা, ফিলিপিনি এটসেট্রা, এটসেট্রা।” হাতের আগুলগুলো গুনে গুনে এভাবেই বলছিলেন জালাল। তারপর আবার ডান হাতটি বুকের ওপর রেখে ইংরেজীতেই বললেন, “ডিউ টু আওয়ার প্রোফেশন, উই নিডেড টু নো দিজ ল্যাঙ্গুয়েজ।”
শুরুর দিকে জালালের সঙ্গে বঙ্গবাজারে তখন আরও যুক্ত হয়েছিল জাভেদ ও শহীদ। শহীদ বেশি দিন পেশায় টিকে থাকতে পারেননি। জাভেদের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে জালাল বলেছিলেন, “জাবেদ অলরেডি ডেড।”
সেদিন জালালের খোঁজ নেয়া হলে প্রায় একই উত্তর মিরাজুলের। তিনি বলেন, “জালাল মামা হ্যাস ডায়েড।”
No comments