স্বাস্থ্যের কুমিরদের এত টাকা! by মারুফ কিবরিয়া
তাদের
কেউ তৃতীয় কেউ চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। বেতনের টাকায় যাদের কোনোমতে জীবন
ধারণের কথা। অথচ তারা একেক জন যেন টাকার কুমির। আছে আলিশান বাড়ি, বিলাসবহুল
গাড়ি। নামে-বেনামে আছে হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি। তারা স্বাস্থ্য
অধিদপ্তরের কর্মচারী। তাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতি করে হাজার কোটি
টাকার সম্পত্তি অর্জনের অভিযোগ উঠলেও এখনো তারা কর্মক্ষেত্রে বহাল। শুধু
তাদের বদলি করা হয়েছে আগের কর্মস্থল থেকে।
সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা- কর্মচারীর দুর্নীতির তথ্য। বিশেষ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবরক্ষণ পদের কর্মচারী আবজাল হোসেনের সম্পদের অনুসন্ধান করতে গিয়ে ফাঁস হয় বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের তথ্য। মাত্র ১২শ’ টাকা বেতনে চাকরি শুরু করা আবজাল গত দুই যুগে দুর্নীতির মাধ্যমে গড়েছেন অঢেল সম্পদ। তার ও তার স্ত্রী রুবিনা খানমের এতই সম্পদ যে, দুদক কর্মকর্তারা মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। সম্প্রতি বরখাস্ত হওয়া আবজাল দীর্ঘদিন কর্মরত থাকলেও তার স্ত্রী ২০০৯ সালে চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই দম্পতির নামে উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর সড়কেই ৪টি পাঁচতলা বাড়ি ও একটি প্লট রয়েছে। ১১ নম্বর সড়কের ১৬, ৪৭, ৬২ ও ৬৬ নম্বর বাড়িটি তাদের নামে। সড়কের ৪৯ নম্বর প্লটটিও তাদের। মিরপুর পল্লবীর কালশীর ডি-ব্লকে ৬ শতাংশ জমির একটি, মেরুল বাড্ডায় আছে আরো একটি প্লট। মানিকদি এলাকায় জমি কিনে বাড়ি করেছেন। ঢাকার দক্ষিণখানে আছে ১২ শতাংশ জায়গায় দোতলা বাড়ি। আবজালের নিজ জেলা ফরিদপুর শহরে টেপাখোলা লেকপাড়ে ফরিদের স’মিলের পাশে নিজে কিনেছেন ১২ শতাংশ জমি। ওই জমির প্রায় পাশাপাশি টেপাখোলায় ওই এলাকার কমিশনার জলিল শেখের আবাসন প্রকল্পে ৬ শতাংশ করে নিজে প্লট কিনেছেন দুটি। ফরিদপুরে ওইসব ভূ-সম্পদ ছাড়াও শহরের গোপালপুর এলাকার বনলতা সিনেমা হলের পাশে মাস্টার কলোনিতে ১৫ শতাংশ জায়গায় একটি একতলা বাড়ি ও ভাড়ায়চালিত ৩০টি সিএনজিচালিত অটোরিকশার মালিক এই আবজাল। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, গুলশান, বনানী ও বারিধারায় আবজালের বাবা-মা, ভাইবোন ও নিকট আত্মীয়দের নামে ২০টিসহ সারা দেশে তাদের প্রায় শতাধিক প্লট ও বাড়ি রয়েছে।
এ ছাড়া মালয়েশিয়ায় ২ একর জমি, অস্ট্রেলিয়ায় ট্রাভেল এজেন্সি, ব্যবসা-বাড়ি, কানাডায় কেসিনোর মালিকানা-ফার্ম হাউজ এবং যুক্তরাষ্ট্রে হোটেল রয়েছে তার। অ্যাকাউন্টস অফিসার থাকা অবস্থায় আবজাল ব্যবহার করেছেন লেক্সাস গাড়ি। যা বাংলাদেশের মন্ত্রী ও সচিব পদের কর্মকর্তারা ব্যবহার করেন। আবজাল দম্পতি নানা কাজের জন্য বছরে ২০ থেকে ২৫ বার দেশের বাইরে ভ্রমণ করেন বিজনেস ক্লাসের টিকিটে।
এদিকে রাজধানীর মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতালের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী (হিসাবরক্ষক) লিয়াকত হোসেন ও তার স্ত্রী লাকি আক্তার চৌধুরীর নামে রয়েছে শত কোটি টাকার সম্পদ। গত ১৫ বছরে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন লিয়াকত। জানা গেছে তিনি সেই টাকার কুমির আবজাল হোসেনেরই ভাই। ২০০৩ সালে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের হিসাব সহকারী পদে চাকরিতে যোগদান করেন লিয়াকত হোসেন। সে হিসাবে গত ১৫ বছর ধরে চাকরি করছেন তিনি। এই ১৫ বছরেই অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে যান তিনি। ৩১শে জানুয়ারি সম্পদের হিসাবের বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
সূত্রে জানা যায়, ফরিদপুর সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে রয়েছে তার বিপুল পরিমাণ সম্পদ। শহরের টেপাখোলার লক্ষ্মীপুর এলাকায় স্ত্রী লাকির নামে রয়েছে একটি আলিশান বাড়ি। টেপাখোলার ফরিদাবাদে ‘মাহি মাহাদ ভিলা’ নামে রয়েছে আরেকটি দৃষ্টিনন্দন বাড়ি। এই বাড়িতে বসবাস করছেন জুয়েলের শ্বশুরবাড়ির লোকজন। শহরতলীর বায়তুল আমান এলাকায় পাঁচ কাঠার আবাসিক প্লট রয়েছে স্ত্রীর নামে। নর্থ-চ্যানেল গোলডাঙ্গীর চরে এল অ্যান্ড এমএম নামে রয়েছে তার একটি ইটভাটা। বড় বোন নাসরিন আক্তারের নামে সিঅ্যান্ডবি ঘাটের ওপারে নাজিরপুরে এঅ্যান্ডআর ব্রিকস নামে আরেকটি ইটভাটা রয়েছে। এ ছাড়া সিঅ্যান্ডবি ঘাটের বাজারে রয়েছে ১৭ শতাংশ জমিতে দোতলা ভবন। এ ছাড়া শহরের ভাটি লক্ষ্মীপুরে ২৪ কাঠা জমিতে রয়েছে তার বাগান বাড়ি। শহরতলীর আদমপুর এলাকার বেরহমপুর মৌজায় ১৭ বিঘা জমি রয়েছে স্ত্রীর নামে। তার ছোট কার্গো জাহাজ রয়েছে ১৬টি, তবে এসব জাহাজ শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজনদের নামে।
এ ছাড়া পারিবারিকভাবে ব্যবহারের জন্য রয়েছে আধুনিক মডেলের তিনটি প্রাইভেটকার। লিয়াকত ছাড়াও তার ভাই আবজালের এই সিন্ডিকেটের মধ্যে রয়েছে তাদের আরেক ভাই। তিনি ফরিদপুর টিভি হাসপাতালের ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে কর্মরত। এ ছাড়া এই সিন্ডিকেটের মধ্যে রয়েছেন আবজালেরই আরো তিন শ্যালক। এরা হলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক রকিবুল ইসলাম, উচ্চমান সহকারী বুলবুল ইসলাম এবং খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অফিস সহকারী শরিফুল ইসলাম। ৩১শে জানুয়ারি দিনভর তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সিন্ডিকেট করে টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানা দুর্নীতি করে আবজাল হোসেন ও তার পাঁচ সহযোগী ব্যাপক সম্পদের মালিক হয়েছে। দেশে-বিদেশে থাকা স্থাবর ও অস্থাবর এসব সম্পত্তির অনুসন্ধানেও নেমেছে দুদক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এরই মধ্যে ২৩ জন কর্মকর্তা- কর্মচারীকে দুদকের সুপারিশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে দেশের বিভিন্ন জেলায় বদলি করে দিয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধান সূত্রে জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বিভাগের সহকারী প্রধান মীর রায়হান আলীও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন। এরই মধ্যে দুদকের সুপারিশের ভিত্তিতে বদলি করা হয়েছে তিনিসহ একই অধিদপ্তরের ২৩ কর্মকর্তাকে। এই দপ্তরেই টানা ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কর্মরত এই ব্যক্তি ঢাকাতেই গড়েছেন বিপুল পরিমাণ স্থাবর সম্পত্তি। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকের হিসাবে জমা রয়েছে রায়হানের শত কোটি টাকা। এসব অবৈধ সম্পদ থাকার বিষয়টি একেবারেই অস্বীকার করেন তিনি। মানবজমিনের সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, আমি জীবনভর সৎ পথে উপার্জন করেছি। কোনো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত না। নির্ভেজাল মানুষ। দুদকের সুপারিশে বদলি করা হয়েছে কেন জানতে চাইলে রায়হান বলেন, আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। শুধু বদলির নোটিশ পেয়েছি। আর কিছু আমাকে জানানো হয়নি। টেন্ডার জালিয়াতির মাধ্যমে শতকোটি টাকা অবৈধভাবে অর্জনের অভিযোগ রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেরই আরেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তিনি বাজেট বিভাগের সহকারী পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান। দুদক সূত্রে জানা যায়, বাজেট বিভাগের এই কর্মকর্তা ভুয়া টেন্ডারের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। তবে গত ১৪ই জানুয়ারি দুদকের জিজ্ঞাসাবাদের পর নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেছেন ডা. আনিসুর রহমান।
তিনি বলেছেন, আমি বাজেট শাখায় কাজ করি। আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে বাজেট পত্রে স্বাক্ষর করি। যে কাজটার জন্য বলা হয়েছে টেন্ডার জালিয়াতিতে জড়িত, আমি তো টেন্ডার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত না। বাজেটটা এখান থেকে কীভাবে ডিসপাস (ছাড়) হয়েছে, সে বিষয়ে আমাকে দুদকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে। তাহলে কি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জড়িত এ প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রমাণিত না হওয়া ছাড়া কারো বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না। এসময় তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পর্কে বলেন, তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ভিত্তিহীন।
বদলির আদেশ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ঢাকার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের সহকারী প্রধান (পরিসংখ্যানবিদ) মীর রায়হান আলীকে বরিশালে, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ফারুক হাসানকে রাঙ্গামাটি, প্রধান সহকারী আশরাফুল ইসলামকে খাগড়াছড়ি, প্রধান সহকারী সাজেদুল করিমকে সিরাজগঞ্জ এবং উচ্চমান সহকারী তৈয়বুর রহমানকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও সাইফুল ইসলামকে হাতিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি করা হয়েছে। চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের উচ্চমান সহকারী ফয়জুর রহমানকে সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, প্রধান সহকারী মাহফুজুল হককে নেত্রকোনা সিভিল সার্জন কার্যালয়, কম্পিউটার অপারেটর আজমল খানকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ, ময়মনসিংহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমানকে রংপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়, প্রধান সহকারী-কাম হিসাবরক্ষক আবদুল কুদ্দুসকে ভোলার চরফ্যাশন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সিলেটের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের প্রধান সহকারী নুরুল হককে জামালপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়, প্রশাসনিক কর্মকর্তা গৌস আহমেদকে সিরাজগঞ্জ সিভিল সার্জন কার্যালয়, উচ্চমান সহকারী আমান আহমেদকে কুড়িগ্রামের চিলমারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও অফিস সহকারী-কাম কম্পিউটার অপারেটর নেছার আহমেদ চৌধুরীকে নেত্রকোনার বারহাট্টা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি করা হয়েছে। খুলনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের ব্যক্তিগত সহকারী ফরিদ হোসেনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, অফিস সহকারী মো. মাসুমকে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, প্রধান সহকারী আনোয়ার হোসেনকে নওগাঁ সিভিল সার্জন অফিস, বরিশাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের প্রধান সহকারী মো. রাহাত খানকে মানিকগঞ্জের সিভিল সার্জন অফিস, উচ্চমান সহকারী মো. জুয়েলকে কক্সবাজারের মহেশখালী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, রংপুর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের উচ্চমান সহকারী আজিজুর রহমানকে শেরপুরের সিভিল সার্জন কার্যালয়, স্টেনোগ্রাফার সাইফুল ইসলামকে গোপালগঞ্জের শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলমকে সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন অফিসে বদলি করা হয়েছে।
সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা- কর্মচারীর দুর্নীতির তথ্য। বিশেষ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবরক্ষণ পদের কর্মচারী আবজাল হোসেনের সম্পদের অনুসন্ধান করতে গিয়ে ফাঁস হয় বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের তথ্য। মাত্র ১২শ’ টাকা বেতনে চাকরি শুরু করা আবজাল গত দুই যুগে দুর্নীতির মাধ্যমে গড়েছেন অঢেল সম্পদ। তার ও তার স্ত্রী রুবিনা খানমের এতই সম্পদ যে, দুদক কর্মকর্তারা মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। সম্প্রতি বরখাস্ত হওয়া আবজাল দীর্ঘদিন কর্মরত থাকলেও তার স্ত্রী ২০০৯ সালে চাকরি থেকে অব্যাহতি নেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই দম্পতির নামে উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ১১ নম্বর সড়কেই ৪টি পাঁচতলা বাড়ি ও একটি প্লট রয়েছে। ১১ নম্বর সড়কের ১৬, ৪৭, ৬২ ও ৬৬ নম্বর বাড়িটি তাদের নামে। সড়কের ৪৯ নম্বর প্লটটিও তাদের। মিরপুর পল্লবীর কালশীর ডি-ব্লকে ৬ শতাংশ জমির একটি, মেরুল বাড্ডায় আছে আরো একটি প্লট। মানিকদি এলাকায় জমি কিনে বাড়ি করেছেন। ঢাকার দক্ষিণখানে আছে ১২ শতাংশ জায়গায় দোতলা বাড়ি। আবজালের নিজ জেলা ফরিদপুর শহরে টেপাখোলা লেকপাড়ে ফরিদের স’মিলের পাশে নিজে কিনেছেন ১২ শতাংশ জমি। ওই জমির প্রায় পাশাপাশি টেপাখোলায় ওই এলাকার কমিশনার জলিল শেখের আবাসন প্রকল্পে ৬ শতাংশ করে নিজে প্লট কিনেছেন দুটি। ফরিদপুরে ওইসব ভূ-সম্পদ ছাড়াও শহরের গোপালপুর এলাকার বনলতা সিনেমা হলের পাশে মাস্টার কলোনিতে ১৫ শতাংশ জায়গায় একটি একতলা বাড়ি ও ভাড়ায়চালিত ৩০টি সিএনজিচালিত অটোরিকশার মালিক এই আবজাল। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, গুলশান, বনানী ও বারিধারায় আবজালের বাবা-মা, ভাইবোন ও নিকট আত্মীয়দের নামে ২০টিসহ সারা দেশে তাদের প্রায় শতাধিক প্লট ও বাড়ি রয়েছে।
এ ছাড়া মালয়েশিয়ায় ২ একর জমি, অস্ট্রেলিয়ায় ট্রাভেল এজেন্সি, ব্যবসা-বাড়ি, কানাডায় কেসিনোর মালিকানা-ফার্ম হাউজ এবং যুক্তরাষ্ট্রে হোটেল রয়েছে তার। অ্যাকাউন্টস অফিসার থাকা অবস্থায় আবজাল ব্যবহার করেছেন লেক্সাস গাড়ি। যা বাংলাদেশের মন্ত্রী ও সচিব পদের কর্মকর্তারা ব্যবহার করেন। আবজাল দম্পতি নানা কাজের জন্য বছরে ২০ থেকে ২৫ বার দেশের বাইরে ভ্রমণ করেন বিজনেস ক্লাসের টিকিটে।
এদিকে রাজধানীর মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতালের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী (হিসাবরক্ষক) লিয়াকত হোসেন ও তার স্ত্রী লাকি আক্তার চৌধুরীর নামে রয়েছে শত কোটি টাকার সম্পদ। গত ১৫ বছরে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন লিয়াকত। জানা গেছে তিনি সেই টাকার কুমির আবজাল হোসেনেরই ভাই। ২০০৩ সালে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের হিসাব সহকারী পদে চাকরিতে যোগদান করেন লিয়াকত হোসেন। সে হিসাবে গত ১৫ বছর ধরে চাকরি করছেন তিনি। এই ১৫ বছরেই অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে যান তিনি। ৩১শে জানুয়ারি সম্পদের হিসাবের বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
সূত্রে জানা যায়, ফরিদপুর সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে রয়েছে তার বিপুল পরিমাণ সম্পদ। শহরের টেপাখোলার লক্ষ্মীপুর এলাকায় স্ত্রী লাকির নামে রয়েছে একটি আলিশান বাড়ি। টেপাখোলার ফরিদাবাদে ‘মাহি মাহাদ ভিলা’ নামে রয়েছে আরেকটি দৃষ্টিনন্দন বাড়ি। এই বাড়িতে বসবাস করছেন জুয়েলের শ্বশুরবাড়ির লোকজন। শহরতলীর বায়তুল আমান এলাকায় পাঁচ কাঠার আবাসিক প্লট রয়েছে স্ত্রীর নামে। নর্থ-চ্যানেল গোলডাঙ্গীর চরে এল অ্যান্ড এমএম নামে রয়েছে তার একটি ইটভাটা। বড় বোন নাসরিন আক্তারের নামে সিঅ্যান্ডবি ঘাটের ওপারে নাজিরপুরে এঅ্যান্ডআর ব্রিকস নামে আরেকটি ইটভাটা রয়েছে। এ ছাড়া সিঅ্যান্ডবি ঘাটের বাজারে রয়েছে ১৭ শতাংশ জমিতে দোতলা ভবন। এ ছাড়া শহরের ভাটি লক্ষ্মীপুরে ২৪ কাঠা জমিতে রয়েছে তার বাগান বাড়ি। শহরতলীর আদমপুর এলাকার বেরহমপুর মৌজায় ১৭ বিঘা জমি রয়েছে স্ত্রীর নামে। তার ছোট কার্গো জাহাজ রয়েছে ১৬টি, তবে এসব জাহাজ শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজনদের নামে।
এ ছাড়া পারিবারিকভাবে ব্যবহারের জন্য রয়েছে আধুনিক মডেলের তিনটি প্রাইভেটকার। লিয়াকত ছাড়াও তার ভাই আবজালের এই সিন্ডিকেটের মধ্যে রয়েছে তাদের আরেক ভাই। তিনি ফরিদপুর টিভি হাসপাতালের ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে কর্মরত। এ ছাড়া এই সিন্ডিকেটের মধ্যে রয়েছেন আবজালেরই আরো তিন শ্যালক। এরা হলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক রকিবুল ইসলাম, উচ্চমান সহকারী বুলবুল ইসলাম এবং খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অফিস সহকারী শরিফুল ইসলাম। ৩১শে জানুয়ারি দিনভর তাদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সিন্ডিকেট করে টেন্ডার বাণিজ্যসহ নানা দুর্নীতি করে আবজাল হোসেন ও তার পাঁচ সহযোগী ব্যাপক সম্পদের মালিক হয়েছে। দেশে-বিদেশে থাকা স্থাবর ও অস্থাবর এসব সম্পত্তির অনুসন্ধানেও নেমেছে দুদক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এরই মধ্যে ২৩ জন কর্মকর্তা- কর্মচারীকে দুদকের সুপারিশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে দেশের বিভিন্ন জেলায় বদলি করে দিয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধান সূত্রে জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বিভাগের সহকারী প্রধান মীর রায়হান আলীও দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন। এরই মধ্যে দুদকের সুপারিশের ভিত্তিতে বদলি করা হয়েছে তিনিসহ একই অধিদপ্তরের ২৩ কর্মকর্তাকে। এই দপ্তরেই টানা ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কর্মরত এই ব্যক্তি ঢাকাতেই গড়েছেন বিপুল পরিমাণ স্থাবর সম্পত্তি। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকের হিসাবে জমা রয়েছে রায়হানের শত কোটি টাকা। এসব অবৈধ সম্পদ থাকার বিষয়টি একেবারেই অস্বীকার করেন তিনি। মানবজমিনের সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, আমি জীবনভর সৎ পথে উপার্জন করেছি। কোনো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত না। নির্ভেজাল মানুষ। দুদকের সুপারিশে বদলি করা হয়েছে কেন জানতে চাইলে রায়হান বলেন, আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। শুধু বদলির নোটিশ পেয়েছি। আর কিছু আমাকে জানানো হয়নি। টেন্ডার জালিয়াতির মাধ্যমে শতকোটি টাকা অবৈধভাবে অর্জনের অভিযোগ রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেরই আরেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তিনি বাজেট বিভাগের সহকারী পরিচালক ডা. আনিসুর রহমান। দুদক সূত্রে জানা যায়, বাজেট বিভাগের এই কর্মকর্তা ভুয়া টেন্ডারের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। তবে গত ১৪ই জানুয়ারি দুদকের জিজ্ঞাসাবাদের পর নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেছেন ডা. আনিসুর রহমান।
তিনি বলেছেন, আমি বাজেট শাখায় কাজ করি। আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে বাজেট পত্রে স্বাক্ষর করি। যে কাজটার জন্য বলা হয়েছে টেন্ডার জালিয়াতিতে জড়িত, আমি তো টেন্ডার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত না। বাজেটটা এখান থেকে কীভাবে ডিসপাস (ছাড়) হয়েছে, সে বিষয়ে আমাকে দুদকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে। তাহলে কি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জড়িত এ প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রমাণিত না হওয়া ছাড়া কারো বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না। এসময় তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পর্কে বলেন, তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ভিত্তিহীন।
বদলির আদেশ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ঢাকার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের সহকারী প্রধান (পরিসংখ্যানবিদ) মীর রায়হান আলীকে বরিশালে, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ফারুক হাসানকে রাঙ্গামাটি, প্রধান সহকারী আশরাফুল ইসলামকে খাগড়াছড়ি, প্রধান সহকারী সাজেদুল করিমকে সিরাজগঞ্জ এবং উচ্চমান সহকারী তৈয়বুর রহমানকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও সাইফুল ইসলামকে হাতিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি করা হয়েছে। চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের উচ্চমান সহকারী ফয়জুর রহমানকে সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, প্রধান সহকারী মাহফুজুল হককে নেত্রকোনা সিভিল সার্জন কার্যালয়, কম্পিউটার অপারেটর আজমল খানকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ, ময়মনসিংহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমানকে রংপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়, প্রধান সহকারী-কাম হিসাবরক্ষক আবদুল কুদ্দুসকে ভোলার চরফ্যাশন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সিলেটের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের প্রধান সহকারী নুরুল হককে জামালপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়, প্রশাসনিক কর্মকর্তা গৌস আহমেদকে সিরাজগঞ্জ সিভিল সার্জন কার্যালয়, উচ্চমান সহকারী আমান আহমেদকে কুড়িগ্রামের চিলমারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও অফিস সহকারী-কাম কম্পিউটার অপারেটর নেছার আহমেদ চৌধুরীকে নেত্রকোনার বারহাট্টা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি করা হয়েছে। খুলনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের ব্যক্তিগত সহকারী ফরিদ হোসেনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, অফিস সহকারী মো. মাসুমকে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, প্রধান সহকারী আনোয়ার হোসেনকে নওগাঁ সিভিল সার্জন অফিস, বরিশাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের প্রধান সহকারী মো. রাহাত খানকে মানিকগঞ্জের সিভিল সার্জন অফিস, উচ্চমান সহকারী মো. জুয়েলকে কক্সবাজারের মহেশখালী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, রংপুর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের উচ্চমান সহকারী আজিজুর রহমানকে শেরপুরের সিভিল সার্জন কার্যালয়, স্টেনোগ্রাফার সাইফুল ইসলামকে গোপালগঞ্জের শেখ সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলমকে সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন অফিসে বদলি করা হয়েছে।
No comments