ইডেনের সাবেক অধ্যক্ষ হত্যায় একাধিক ব্যক্তি, ২ গৃহপরিচারিকাকে খুঁজছে পুলিশ by শুভ্র দেব
ছিলেন
জনপ্রিয় শিক্ষক। ইডেন কলেজের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে
দায়িত্ব পালন করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। কলেজের অনেক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হয়েছে
তার হাত ধরে। দীর্ঘদিন থেকে থাকতেন এলিফ্যান্ট রোডের বাসায়। অবসরের পরও এ
বাসাতেই জীবনের শেষ সময়টুকু কাটানোর ইচ্ছা ছিল মাহফুজা চৌধুরীর। কিন্তু তার
সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। নিরাপদ বাসায়ই ঘাতকের হাতে জীবন দিতে হয়েছে
তাকে। রোববার রাতে ওই বাসা থেকে মাহফুজা চৌধুরীর লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ
ধারণা করছে, কয়েকজন মিলে তাকে সংঘবদ্ধভাবে হত্যা করেছে।
কিন্তু কেন একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষককে এভাবে খুন করা হলো।
এর পেছনে কী কারণ তা খুঁজতে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জনপ্রিয় এই শিক্ষকের হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারছেন না তার শিক্ষার্থী ও সহকর্মীরা। খুনিদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন তারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা প্রাথমিকভাবে মনে করছেন, চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে ওই বাসার গৃহকর্মীরা এমন ঘটনা ঘটিয়েছে। হত্যার পর থেকে তারা পলাতক। এছাড়া এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি না, এমন চিন্তা মাথায় রেখে তারা তদন্ত করছেন। কারণ ফরেনসিক রিপোর্টে এই হত্যাকাণ্ডে একাধিক ব্যক্তি জড়িত থাকার আলামত পাওয়া গেছে। কোনো সক্রিয় চক্র পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সাবেক এই অধ্যক্ষকে খুন করেছে এমন চিন্তাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তদন্ত কর্মকর্তারা। তাই দফায় দফায় পুলিশের পাশাপাশি মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।
মাহফুজা চৌধুরীর ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, বালিশ বা অন্য কিছু দিয়ে মুখ চেপে শ্বাসরোধ করে ইডেন কলেজের সাবেক এই অধ্যক্ষকে হত্যা করা হয়েছে। তার নাক, মুখ ও ঠোটে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এছাড়া হাতের একটি আঙুল ভাঙা ছিল। তিনি বলেন, হত্যার মিশনে একাধিক লোক অংশগ্রহণ করেছে বলে ধারণা করছি। হত্যার আগে ধস্তাধস্তি হয়েছিল। পরে একপর্যায়ে তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। নিউ মার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আতিকুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, হত্যার মোটিভ দেখে প্রাথমিকভাবে মনে করছি টাকাপয়সা, সোনা-গয়নার লোভেই কাজের লোকেরা এই কাজ করেছে। হয়তো চুরি করার সময় তিনি টের পেয়ে বাধা দিয়েছেন তখন তারা তাকে মেরে ফেলেছে। ওসি বলেন, তাকে হত্যার পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি না তা আমরা খতিয়ে দেখছি। বাসার ভেতরে ঘুমন্ত অবস্থায় যে গৃহপরিচারিকা ছিল তাকে এনেও আমরা কথা বলেছি।
এছাড়া ওই সময় যে নিরাপত্তাকর্মীরা দায়িত্ব পালন করেছে, তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। পলাতক গৃহ পরিচারিকাদের আটক করতে পারলে হত্যাকাণ্ডের রহস্য জানা যাবে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘটনার পর থেকেই ওই দুই গৃহকর্মীকে আটক করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সঙ্গে তাদেরকে যে কাজে দিয়েছিল সেই রুনিকে। আলাদা আলাদা টিম গঠন করে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালনো হচ্ছে। কারন, তাদের পালিয়ে যাওয়াটাই সন্দেহজনক। মাহফুজা চৌধুরীর স্বামী মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ব্যবসায়ী ইসমত কাদির গামা গতকাল নিউমার্কেট থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। মামলায় আসামি করা হয়েছে, দুই গৃহকর্মী স্বপ্না (৩৬), রেশমা (৩০) ও গৃহকর্মী সরবরাহকারী রুনুকে। স্বপ্নার বাড়ি ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে ও রেশমার বাড়ি কিশোরগঞ্জে। মামলার এজাহারে ইসমত কাদির গামা উল্লেখ করেছেন, প্রতিদিনের মতো আমি সেদিন সকাল ১০টার দিকে আমার স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে যাই। দুপুরের দিকে তার সঙ্গে আমার সর্বশেষ কথা হয়। সন্ধ্যার বাসার ফেরার সময় কিছু আনতে হবে কি না সেজন্য আমি তার মোবাইলে ফোন দিয়ে বন্ধ পাই। সাড়ে সাতটার দিকে বাসায় এসে আমাদের ডুপ্লেক্স বাসার ১৬ তলার কলিং বেল চাপতে থাকি। কিন্তু ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেয়নি। তারপর আমি ১৫ তলায় গিয়ে বেল চাপি।
তখন কাজের মেয়ে রশিদা দেখতে পায় ভেতর থেকে দরজার বন্ধ করে দেয়া আছে এবং তালার মধ্যে চাবি ঝুলছে। রশিদা দরজা খুলে দেয়ার পর ভেতরে গিয়ে আমি অন্য কাজের মেয়েদের খুঁজতে থাকি। তাদেরকে না পেয়ে ওপরে গিয়ে আমার স্ত্রীর শোবার ঘরে দেখি খাটের ওপর গলায় ওড়না পেঁচানো, ঠোঁটে রক্তের দাগ লাগানো নিথর দেহ পড়ে আছে। এমন অবস্থা দেখে আমি চিৎকার করি। তখন আশপাশের ফ্ল্যাটের লোকজন এগিয়ে আসে। সেখানে উপস্থিত একজন চিকিৎসক তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন, তিনি মারা গেছেন। তারপর থানায় খবর দিলে তারা এসে মরদেহ উদ্ধার করে নিয়ে যায়। এজাহারে তিনি আরো উল্লেখ করেছেন, মৃত্যুর খবর পাওয়ার কিছুক্ষণ পর আমাদের গাড়িচালক সুজন এসে বলে, বিকাল তিনটার পরে সে ম্যাডামের কাছ থেকে মাসিক বেতন নিয়ে গেছে।
বাসার বিভিন্ন আলমিরা খুলে নগদ ১০ লাখ টাকা, ২০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও ৬০ হাজার টাকা মূল্যের একটি মোবাইল ফোন নিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এজাহারে।
এলিফ্যান্ট রোডের সুকন্যা টাওয়ারের ১৫ ও ১৬ তলার ১৫/সি, ১৬/সি ডুপ্লেক্স বাসায় থাকেন ইসমত কাদির গামার পরিবার। এ বাসাতেই তাদের জীবনের বহু বছর কেটে গেছে। বাসার ১৫ তলার ফ্ল্যাটে রান্নাঘর, ডাইনিং রুম, ড্রয়িং রুম, গৃহকর্মীদের থাকার জায়গা রয়েছে। আর ওপরের অংশে তারা সবাই মিলে থাকতেন। গতকাল ওই বাসায় গিয়ে দেখা যায় হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি। ২০ তলা এই বাসার নিচে পার্কিং প্লেসে রাখা হয়েছে মাহফুজা চৌধুরীর মরদেহের ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্স। তাকে ঘিরে আত্মীয়স্বজন, সহকর্মী, প্রতিবেশী, শিক্ষার্থীরা অঝোর ধারায় কাঁদছিলেন। সেখান থেকে লিফট দিয়ে ওপরে উঠে দেখা যায় ১৬ তলার ডান পাশের ১৬/সি নম্বর ফ্ল্যাটের ভেতরে স্বজনদের আহাজারি। ফ্ল্যাটের ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায় ডুপ্লেক্স এই বাসার সিঁড়ি। ওই কক্ষের বাম পাশে আরেকটি কক্ষ রয়েছে। আরেকটু ভেতরে গিয়ে পাওয়া যায় আরো তিনটি কক্ষ। ডান পাশের একটি কক্ষে থাকতেন মাহফুজা চৌধুরী। এই কক্ষ থেকেই তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ যখন তার মরদেহ উদ্ধার করেছিল তখন তার গলায় দুটো ওড়না পেঁচানো ছিল। কোমরের ওপরের অংশ ছিল খাটের ওপরে আর বাকিটা নিচে। দুহাত ছিল দুই দিকে ছড়ানো। ঠোঁটে ছিল লাল রক্তের দাগ। বাসার ভেতরের অনেক দেয়ালে দেয়ালে টানানো আছে ২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত দায়িত্বে থাকা ইডেন কলেজের এই অধ্যক্ষের ছবি। তার দুই ছেলে অভিক ও অমিত। অভিক সেনা চিকিৎসক ও অমিত একটি ব্যাংকে চাকরি করছেন। মায়ের এমন মৃত্যু মেনে নিতে না পেরে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন দুই ভাই। তাদেরকে ঘিরেই যেন স্বজনদের সব সান্ত্বনা। মায়ের মৃত্যুতে তাদের অশ্রুসিক্ত চোখ কেউ সহ্য করতে পারছিলেন না।
মাহফুজা চৌধুরীর বড় ছেলে মেজর অভিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যশোর ক্যান্টনমেন্টে সেনা চিকিৎসক হিসাবে চাকরি করেন। তিনি মানবজমিনকে বলেন, মা প্রতিদিন সকাল, দুপুর ও রাতে আমাকে ফোন দিয়ে কোথায় আছি, কী করছি, খাবার খেয়েছি কি না সেই খোঁজ নিতেন। ঘটনার দিন দুপুর দেড়টার দিকে তিনি আমাকে ফোন দিয়ে খাবার খেয়েছি কি না খোঁজ নেন। তারপর আমার ঢাকায় পোস্টিং হয়েছে, কবে আসব- সে কথা জানতে চান। পরে তিনি বলেন, তাড়াতাড়ি আসো। ঢাকা আসলে কাছাকাছি থাকবা। আমাকে আর টেনশন করতে হবে না। অভিক বলেন, এই ছিল মায়ের সঙ্গে আমার শেষ কথা। চলতি মাসের ৬ তারিখে মায়ের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল। মা এভাবে চলে যাবে কখনও ভাবতে পারি নাই। আমি আমার মায়ের হত্যাকারীদের শাস্তি চাই।
মাহফুজা চৌধুরীর পারিবারিক গাড়িচালক সুজন বলেন, ওইদিন বিকাল ৩টা ৯ মিনিটে আমি ওই বাসায় যাই। কারণ আমার বেতন নেয়ার জন্য সকালে ম্যাডাম আমাকে ফোন করেছিলেন। আমি পান-সুপারি নিয়ে বাসায় যাই। যাওয়ার পর একজন গৃহকর্মী আমাকে ১৪ হাজার টাকা এনে দেন। তখন ম্যাডাম আমাকে বলেন, টাকাগুলো গুনে নেয়ার জন্য। আমি বলেছিলাম, গুনেছি ম্যাডাম, ঠিক আছে। তখন ম্যাডাম বলেন, তোমার পান-সুপারির টাকা দেয়া হয়নি। কত টাকা হয়েছে। আমি তখন বলি ৭০ টাকা। ম্যাডাম আবার গৃহকর্মী দিয়ে ১০০ টাকা দেন। ওই গৃহকর্মী আমাকে বলে, খুচরা টাকাটা যেন আমার কাছেই রেখে দেই। এই কথা শুনে আমি নিচে চলে আসি। ৩টা ২১ মিনিটে ম্যাডাম আমাকে ফোন দিয়ে আবার বলেন, খুচরা টাকা দিতে আর ওপরে উঠতে হবে না। সুজন বলেন, এই ছিল ম্যাডামের সঙ্গে আমার শেষ কথা।
ইডেন কলেজে শোকের ছায়া: মাহফুজা চৌধুরীর ময়নাতদন্ত শেষে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল ইডেন কলেজে। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন তার প্রাণের সহকর্মী, শিক্ষার্থী ও অফিস স্টাফরা। একদিকে চলছিল মাহফুজা চৌধুরীর জানাজা আর অন্যদিকে অঝোর ধারায় কাঁদছিলেন তার সহকর্মীরা। জানাজার নামাজ শেষে সহকর্মীরা তাকে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। প্রিয় শিক্ষিকাকে শেষবারের মতো দেখার জন্য এসেছিলেন কর্মসংস্থান ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার তামান্না আমিন। অশ্রুশিক্ত হয়ে তিনি বলেন, খুব ভালো শিক্ষিকা ছিলেন। আমাদেরকে নিজের মেয়ের মতো দেখতেন। তার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক ছিল মা সন্তানের। যেকোনো সমস্যা নিয়ে গেলে তিনি কখনও ফিরিয়ে দিতেন না। তাকে যারা এভাবে খুন করল তাদের বিচার চাই। তাসলিমা নামের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ভর্তি হওয়ার পরই তাকে আমি প্রিন্সিপাল হিসাবে পাই।
তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য ছিলেন এক নিবেদিত প্রাণ। তার মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। শুধু শিক্ষার্থীরা নয় তার সহকর্মীরাও তুলে ধরলেন তার কৃতকর্মের বর্ণনা। ইডেন কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক মো. জাকির হোসেন বলেন, তিনি একমাত্র অধ্যক্ষ যাকে তিন মাস থেকে ৩ বছর এক্সটেনশন দেয়া হয়েছিল। এই কলেজের বেশির ভাগ উন্নয়ন তার হাত দিয়ে করা। উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি আর কাজ করেছি আমরা। বঙ্গমাতা হল, ভাস্কর্য, বাগান, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার জন্য লাইব্রেরি, কলেজে প্রবেশর সবকটি গেট, শিক্ষার্থীদের বসার স্থান সবকিছুই তার হাত দিয়ে করা। আমরা এমন এক সহকর্মীকে হারিয়ে আজ অসহায়। কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ শামসুন নাহার বলেন, শিক্ষক হিসাবে তার প্রচুর খ্যাতি ছিল। কলেজের যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তার অংশগ্রহণ ছিল। মাহফুজা চৌধুরী অধ্যক্ষ থাকাকালীন গাড়ি চালক ছিলেন মনির চৌহান। মনির চৌহান বলেন, তিনি খুব হাসিখুশি ছিলেন। দীর্ঘদিন তার গাড়িচালক ছিলাম। প্রায়ই তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতেন। বাসায় গেলে তিনি নিজের হাতে ভাত খেতে দিতেন। তার দুই ছেলের বিয়েতে বরের গাড়ি চালিয়েছি আমি। তার সঙ্গে কোনো শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মনোমালিন্য ছিল না। অফিস সহকারী নুরুজাহান বেবি বলেন, এই ম্যাডাম আমাদের জন্য অনেক করেছেন। সবসময় আমাদের বিপদে কাছে থাকতেন।
কিন্তু কেন একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষককে এভাবে খুন করা হলো।
এর পেছনে কী কারণ তা খুঁজতে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জনপ্রিয় এই শিক্ষকের হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারছেন না তার শিক্ষার্থী ও সহকর্মীরা। খুনিদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন তারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা প্রাথমিকভাবে মনে করছেন, চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে ওই বাসার গৃহকর্মীরা এমন ঘটনা ঘটিয়েছে। হত্যার পর থেকে তারা পলাতক। এছাড়া এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি না, এমন চিন্তা মাথায় রেখে তারা তদন্ত করছেন। কারণ ফরেনসিক রিপোর্টে এই হত্যাকাণ্ডে একাধিক ব্যক্তি জড়িত থাকার আলামত পাওয়া গেছে। কোনো সক্রিয় চক্র পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সাবেক এই অধ্যক্ষকে খুন করেছে এমন চিন্তাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তদন্ত কর্মকর্তারা। তাই দফায় দফায় পুলিশের পাশাপাশি মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।
মাহফুজা চৌধুরীর ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, বালিশ বা অন্য কিছু দিয়ে মুখ চেপে শ্বাসরোধ করে ইডেন কলেজের সাবেক এই অধ্যক্ষকে হত্যা করা হয়েছে। তার নাক, মুখ ও ঠোটে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এছাড়া হাতের একটি আঙুল ভাঙা ছিল। তিনি বলেন, হত্যার মিশনে একাধিক লোক অংশগ্রহণ করেছে বলে ধারণা করছি। হত্যার আগে ধস্তাধস্তি হয়েছিল। পরে একপর্যায়ে তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। নিউ মার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আতিকুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, হত্যার মোটিভ দেখে প্রাথমিকভাবে মনে করছি টাকাপয়সা, সোনা-গয়নার লোভেই কাজের লোকেরা এই কাজ করেছে। হয়তো চুরি করার সময় তিনি টের পেয়ে বাধা দিয়েছেন তখন তারা তাকে মেরে ফেলেছে। ওসি বলেন, তাকে হত্যার পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে কি না তা আমরা খতিয়ে দেখছি। বাসার ভেতরে ঘুমন্ত অবস্থায় যে গৃহপরিচারিকা ছিল তাকে এনেও আমরা কথা বলেছি।
এছাড়া ওই সময় যে নিরাপত্তাকর্মীরা দায়িত্ব পালন করেছে, তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। পলাতক গৃহ পরিচারিকাদের আটক করতে পারলে হত্যাকাণ্ডের রহস্য জানা যাবে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘটনার পর থেকেই ওই দুই গৃহকর্মীকে আটক করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সঙ্গে তাদেরকে যে কাজে দিয়েছিল সেই রুনিকে। আলাদা আলাদা টিম গঠন করে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালনো হচ্ছে। কারন, তাদের পালিয়ে যাওয়াটাই সন্দেহজনক। মাহফুজা চৌধুরীর স্বামী মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ব্যবসায়ী ইসমত কাদির গামা গতকাল নিউমার্কেট থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। মামলায় আসামি করা হয়েছে, দুই গৃহকর্মী স্বপ্না (৩৬), রেশমা (৩০) ও গৃহকর্মী সরবরাহকারী রুনুকে। স্বপ্নার বাড়ি ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে ও রেশমার বাড়ি কিশোরগঞ্জে। মামলার এজাহারে ইসমত কাদির গামা উল্লেখ করেছেন, প্রতিদিনের মতো আমি সেদিন সকাল ১০টার দিকে আমার স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে যাই। দুপুরের দিকে তার সঙ্গে আমার সর্বশেষ কথা হয়। সন্ধ্যার বাসার ফেরার সময় কিছু আনতে হবে কি না সেজন্য আমি তার মোবাইলে ফোন দিয়ে বন্ধ পাই। সাড়ে সাতটার দিকে বাসায় এসে আমাদের ডুপ্লেক্স বাসার ১৬ তলার কলিং বেল চাপতে থাকি। কিন্তু ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেয়নি। তারপর আমি ১৫ তলায় গিয়ে বেল চাপি।
তখন কাজের মেয়ে রশিদা দেখতে পায় ভেতর থেকে দরজার বন্ধ করে দেয়া আছে এবং তালার মধ্যে চাবি ঝুলছে। রশিদা দরজা খুলে দেয়ার পর ভেতরে গিয়ে আমি অন্য কাজের মেয়েদের খুঁজতে থাকি। তাদেরকে না পেয়ে ওপরে গিয়ে আমার স্ত্রীর শোবার ঘরে দেখি খাটের ওপর গলায় ওড়না পেঁচানো, ঠোঁটে রক্তের দাগ লাগানো নিথর দেহ পড়ে আছে। এমন অবস্থা দেখে আমি চিৎকার করি। তখন আশপাশের ফ্ল্যাটের লোকজন এগিয়ে আসে। সেখানে উপস্থিত একজন চিকিৎসক তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন, তিনি মারা গেছেন। তারপর থানায় খবর দিলে তারা এসে মরদেহ উদ্ধার করে নিয়ে যায়। এজাহারে তিনি আরো উল্লেখ করেছেন, মৃত্যুর খবর পাওয়ার কিছুক্ষণ পর আমাদের গাড়িচালক সুজন এসে বলে, বিকাল তিনটার পরে সে ম্যাডামের কাছ থেকে মাসিক বেতন নিয়ে গেছে।
বাসার বিভিন্ন আলমিরা খুলে নগদ ১০ লাখ টাকা, ২০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও ৬০ হাজার টাকা মূল্যের একটি মোবাইল ফোন নিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এজাহারে।
এলিফ্যান্ট রোডের সুকন্যা টাওয়ারের ১৫ ও ১৬ তলার ১৫/সি, ১৬/সি ডুপ্লেক্স বাসায় থাকেন ইসমত কাদির গামার পরিবার। এ বাসাতেই তাদের জীবনের বহু বছর কেটে গেছে। বাসার ১৫ তলার ফ্ল্যাটে রান্নাঘর, ডাইনিং রুম, ড্রয়িং রুম, গৃহকর্মীদের থাকার জায়গা রয়েছে। আর ওপরের অংশে তারা সবাই মিলে থাকতেন। গতকাল ওই বাসায় গিয়ে দেখা যায় হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি। ২০ তলা এই বাসার নিচে পার্কিং প্লেসে রাখা হয়েছে মাহফুজা চৌধুরীর মরদেহের ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্স। তাকে ঘিরে আত্মীয়স্বজন, সহকর্মী, প্রতিবেশী, শিক্ষার্থীরা অঝোর ধারায় কাঁদছিলেন। সেখান থেকে লিফট দিয়ে ওপরে উঠে দেখা যায় ১৬ তলার ডান পাশের ১৬/সি নম্বর ফ্ল্যাটের ভেতরে স্বজনদের আহাজারি। ফ্ল্যাটের ভেতরে প্রবেশ করে দেখা যায় ডুপ্লেক্স এই বাসার সিঁড়ি। ওই কক্ষের বাম পাশে আরেকটি কক্ষ রয়েছে। আরেকটু ভেতরে গিয়ে পাওয়া যায় আরো তিনটি কক্ষ। ডান পাশের একটি কক্ষে থাকতেন মাহফুজা চৌধুরী। এই কক্ষ থেকেই তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ যখন তার মরদেহ উদ্ধার করেছিল তখন তার গলায় দুটো ওড়না পেঁচানো ছিল। কোমরের ওপরের অংশ ছিল খাটের ওপরে আর বাকিটা নিচে। দুহাত ছিল দুই দিকে ছড়ানো। ঠোঁটে ছিল লাল রক্তের দাগ। বাসার ভেতরের অনেক দেয়ালে দেয়ালে টানানো আছে ২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত দায়িত্বে থাকা ইডেন কলেজের এই অধ্যক্ষের ছবি। তার দুই ছেলে অভিক ও অমিত। অভিক সেনা চিকিৎসক ও অমিত একটি ব্যাংকে চাকরি করছেন। মায়ের এমন মৃত্যু মেনে নিতে না পেরে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন দুই ভাই। তাদেরকে ঘিরেই যেন স্বজনদের সব সান্ত্বনা। মায়ের মৃত্যুতে তাদের অশ্রুসিক্ত চোখ কেউ সহ্য করতে পারছিলেন না।
মাহফুজা চৌধুরীর বড় ছেলে মেজর অভিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যশোর ক্যান্টনমেন্টে সেনা চিকিৎসক হিসাবে চাকরি করেন। তিনি মানবজমিনকে বলেন, মা প্রতিদিন সকাল, দুপুর ও রাতে আমাকে ফোন দিয়ে কোথায় আছি, কী করছি, খাবার খেয়েছি কি না সেই খোঁজ নিতেন। ঘটনার দিন দুপুর দেড়টার দিকে তিনি আমাকে ফোন দিয়ে খাবার খেয়েছি কি না খোঁজ নেন। তারপর আমার ঢাকায় পোস্টিং হয়েছে, কবে আসব- সে কথা জানতে চান। পরে তিনি বলেন, তাড়াতাড়ি আসো। ঢাকা আসলে কাছাকাছি থাকবা। আমাকে আর টেনশন করতে হবে না। অভিক বলেন, এই ছিল মায়ের সঙ্গে আমার শেষ কথা। চলতি মাসের ৬ তারিখে মায়ের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল। মা এভাবে চলে যাবে কখনও ভাবতে পারি নাই। আমি আমার মায়ের হত্যাকারীদের শাস্তি চাই।
মাহফুজা চৌধুরীর পারিবারিক গাড়িচালক সুজন বলেন, ওইদিন বিকাল ৩টা ৯ মিনিটে আমি ওই বাসায় যাই। কারণ আমার বেতন নেয়ার জন্য সকালে ম্যাডাম আমাকে ফোন করেছিলেন। আমি পান-সুপারি নিয়ে বাসায় যাই। যাওয়ার পর একজন গৃহকর্মী আমাকে ১৪ হাজার টাকা এনে দেন। তখন ম্যাডাম আমাকে বলেন, টাকাগুলো গুনে নেয়ার জন্য। আমি বলেছিলাম, গুনেছি ম্যাডাম, ঠিক আছে। তখন ম্যাডাম বলেন, তোমার পান-সুপারির টাকা দেয়া হয়নি। কত টাকা হয়েছে। আমি তখন বলি ৭০ টাকা। ম্যাডাম আবার গৃহকর্মী দিয়ে ১০০ টাকা দেন। ওই গৃহকর্মী আমাকে বলে, খুচরা টাকাটা যেন আমার কাছেই রেখে দেই। এই কথা শুনে আমি নিচে চলে আসি। ৩টা ২১ মিনিটে ম্যাডাম আমাকে ফোন দিয়ে আবার বলেন, খুচরা টাকা দিতে আর ওপরে উঠতে হবে না। সুজন বলেন, এই ছিল ম্যাডামের সঙ্গে আমার শেষ কথা।
ইডেন কলেজে শোকের ছায়া: মাহফুজা চৌধুরীর ময়নাতদন্ত শেষে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল ইডেন কলেজে। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন তার প্রাণের সহকর্মী, শিক্ষার্থী ও অফিস স্টাফরা। একদিকে চলছিল মাহফুজা চৌধুরীর জানাজা আর অন্যদিকে অঝোর ধারায় কাঁদছিলেন তার সহকর্মীরা। জানাজার নামাজ শেষে সহকর্মীরা তাকে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। প্রিয় শিক্ষিকাকে শেষবারের মতো দেখার জন্য এসেছিলেন কর্মসংস্থান ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার তামান্না আমিন। অশ্রুশিক্ত হয়ে তিনি বলেন, খুব ভালো শিক্ষিকা ছিলেন। আমাদেরকে নিজের মেয়ের মতো দেখতেন। তার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক ছিল মা সন্তানের। যেকোনো সমস্যা নিয়ে গেলে তিনি কখনও ফিরিয়ে দিতেন না। তাকে যারা এভাবে খুন করল তাদের বিচার চাই। তাসলিমা নামের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ভর্তি হওয়ার পরই তাকে আমি প্রিন্সিপাল হিসাবে পাই।
তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য ছিলেন এক নিবেদিত প্রাণ। তার মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। শুধু শিক্ষার্থীরা নয় তার সহকর্মীরাও তুলে ধরলেন তার কৃতকর্মের বর্ণনা। ইডেন কলেজের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক মো. জাকির হোসেন বলেন, তিনি একমাত্র অধ্যক্ষ যাকে তিন মাস থেকে ৩ বছর এক্সটেনশন দেয়া হয়েছিল। এই কলেজের বেশির ভাগ উন্নয়ন তার হাত দিয়ে করা। উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি আর কাজ করেছি আমরা। বঙ্গমাতা হল, ভাস্কর্য, বাগান, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার জন্য লাইব্রেরি, কলেজে প্রবেশর সবকটি গেট, শিক্ষার্থীদের বসার স্থান সবকিছুই তার হাত দিয়ে করা। আমরা এমন এক সহকর্মীকে হারিয়ে আজ অসহায়। কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ শামসুন নাহার বলেন, শিক্ষক হিসাবে তার প্রচুর খ্যাতি ছিল। কলেজের যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তার অংশগ্রহণ ছিল। মাহফুজা চৌধুরী অধ্যক্ষ থাকাকালীন গাড়ি চালক ছিলেন মনির চৌহান। মনির চৌহান বলেন, তিনি খুব হাসিখুশি ছিলেন। দীর্ঘদিন তার গাড়িচালক ছিলাম। প্রায়ই তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতেন। বাসায় গেলে তিনি নিজের হাতে ভাত খেতে দিতেন। তার দুই ছেলের বিয়েতে বরের গাড়ি চালিয়েছি আমি। তার সঙ্গে কোনো শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মনোমালিন্য ছিল না। অফিস সহকারী নুরুজাহান বেবি বলেন, এই ম্যাডাম আমাদের জন্য অনেক করেছেন। সবসময় আমাদের বিপদে কাছে থাকতেন।
No comments