রথিশ হত্যা: সত্য ও কল্পনা by বিভুরঞ্জন সরকার
রথিশ চন্দ্র ভৌমিক ও তার স্ত্রী দীপা ভৌমিক |
রংপুরের
বিশিষ্ট আইনজীবী রথিশ চন্দ্র ভৌমিকের ‘নিখোঁজ’ হওয়া, তাকে জঙ্গি-জামায়াত
গোষ্ঠী অপহরণ করতে পারে বলে প্রচার, সন্দেহভাজন হিসেবে তার স্ত্রীকে আটক ও
তার লাশ উদ্ধারের ঘটনাগুলো নিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই গণমাধ্যমসহ আগ্রহীদের
মধ্যে ব্যাপক তোলপাড় চলছে। রথিশরহস্যের শেষ হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করছেন।
আবার কারও কারও মনে এখনও নানা প্রশ্ন। শুধু কি স্ত্রীর পরকীয়ার বলি হলেন
রথিশ, নাকি এর পেছনে আরও কোনও কারণ আছে? রথিশের স্ত্রীর ‘প্রেমিক’ কামরুলের
রাজনৈতিক পরিচয় কী, তা জানার কৌতূহল অনেকেরই আছে। আইনি প্রক্রিয়া শেষ না
হওয়া পর্যন্ত স্ত্রীকে ‘খুনি’ বলতেও নারাজ অনেকে। বাঙালি হিসেবে আমাদের
অন্যতম জাতবৈশিষ্ট্য হলো কোনও বিষয়ে সহজে একমত না হওয়া এবং যতদূর পারা যায়
বিতর্ক জিইয়ে রাখা। একজন কোনও বিষয়ে তৃপ্ত হলে আরেকজন থাকবেন অতৃপ্ত। তাই
রথিশ হত্যাকাণ্ড নিয়ে আলোচনাও শেষ হয়েও শেষ হবে না।
৩০ মার্চ সকালে রথিশ চন্দ্র ভৌমিক বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি– এই খবর জেনে বা শুনে প্রাথমিকভাবে সবারই ধারণা হয়েছিল, তিনি নিশ্চয়ই স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করেননি। তাকে গুম বা অপহরণ করা হয়েছে। দেশে গুম-অপহরণের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। এ ধরনের ঘটনায় ‘ভিকটিম’ হয় কিছুদিন পর ফিরে আসেন এবং নিশ্চুপ হয়ে যান, ঘটনার কোনও ধরনের বিবরণ পাওয়া যায় না, আবার বিবরণ পেলেও তা অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হয় না। আবার কারও বা লাশ পাওয়া যায় ঘটনাস্থলের কাছাকাছি কোথাও। কেউ কেউ আবার একেবারেই ফিরে আসেন না, তারা হয়ে যান স্থায়ী ‘নিখোঁজ’।
কেউ গুম, অপহরণ বা নিখোঁজ হলে তার সন্ধান দেওয়ার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্র বা সরকারের। রাষ্ট্র বা সরকারের হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেই কাজটি করে। কিন্তু আমাদের দেশে দুঃখজনকভাবে কেউ নিখোঁজ হলে বা কাউকে পাওয়া না গেলে সন্দেহের তীরটা প্রথম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকেই ছোটে। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনার পর থেকে এই সন্দেহ প্রবণতাটা বেড়েছে।
রথিশ ভৌমিক রংপুরের একজন মোটামুটি পরিচিত মানুষ। বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি। তিনি রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আইনজীবী হিসেবে সুনামের অধিকারী। তিনি সরকারি দল আওয়ামী লীগের রংপুর জেলা কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক। আইনজীবী সমিতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট, পূজা উদযাপন পরিষদ, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের একজন শীর্ষ নেতা। জাপানের নাগরিক ও মাজারের খাদেম হত্যা মামলায় তিনি সরকারি পিপি ছিলেন এবং একজন মানবতাবিরোধী অপরাদের বিচারের মামলায়ও তিনি ছিলেন সাক্ষী। এ রকম একজন মানুষের ‘নিখোঁজ’ হওয়াটা নিঃসন্দেহে কোনও ছোট ঘটনা ছিল না। তাই বাসা থেকে বের হয়ে ফিরে না আসায় প্রতিক্রিয়া হয় তীব্র। রংপুরে বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ, মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলনসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি তাকে অবিলম্বে খুঁজে বের করার দাবি জানানো হয়। তিনি ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন অন্যতম নেতা হওয়ায় সংখ্যালঘুদের মধ্যে দেখা দেয় বাড়তি উদ্বেগ ও অস্থিরতা। সরকারের ওপর তৈরি হয় চাপ, কারণ তিনি সরকারি দলেরও একজন নেতা ছিলেন।
প্রথমে সবারই ধারণা হয়েছিল, রথিশ ভৌমিক হয়তো কোনও জঙ্গি, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর রোষের শিকার হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একমুখী তদন্ত না করে নানাভাবে চেষ্টা চালাতে থাকে। জামায়াত-শিবিরের কয়েকজনকে আটকও করা হয়। তবে তার স্ত্রীর সহকর্মী স্কুলশিক্ষক কামরুল ইসলামকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের পর সম্ভবত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে প্রকৃত ঘটনা কী ঘটেছে, তা পরিষ্কার হয়। রথিশ ভৌমিকের স্ত্রী দীপা ওরফে স্নিগ্ধাকে আটকের পর তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রথিশের লাশ উদ্ধার করা হয় কামরুলের ভাইয়ের নির্মাণাধীন একটি বাড়ির মাটি খুঁড়ে। জানা যায়, রথিশ নিখোঁজ হননি। আগের রাতে স্ত্রী ও কামরুল যৌথভাবেই হত্যা করেছিলেন তাকে। পরিকল্পিতভাবেই তাকে হত্যা করে লাশ মাটি চাপা দিয়ে ‘নিখোঁজ’ হওয়ার গল্প প্রচার করা হয়।
রথিশের যে পরিচিতি, তাতে এই ঘটনার পেছনে জঙ্গি-জামায়াতকে জড়ালে সেটা বিশ্বাসযোগ্য হবে–এটা বুঝে কামরুলই সে ধরনের প্রচার চালিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের শেষ রক্ষা হলো না। দীপা-কামরুলের গোপন সম্পর্কের কথা আর গোপন থাকলো না। এ পর্যন্ত এই হলো কাহিনি। কিন্তু এটা আবার বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। কারণ এই তথ্যগুলো জানা গেছে র্যাব সূত্রে। তারা যে সঠিক তথ্য দিয়েছে, তার নিশ্চয়তা বা কী? পেছনের বিশেষ কোনও শক্তিকে আড়াল করার জন্য এই গল্প ফাঁদা হয়নি, তা কে বলতে পারে?
ব্যক্তিগতভাবে আমি বিষয়টিকে অবিশ্বাসযোগ্য মনে করছি না। মানুষের মনের খবর রাখা খুব সহজ কাজ নয়। রথিশ ভৌমিকের দাম্পত্যজীবন কেমন ছিল, আমি জানি না। তবে দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময় তারা সংসার করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া একপুত্র ও স্কুল পড়ুয়া এককন্যা সন্তান থাকার পরও প্রায় পরিণত বয়সে নতুন প্রেমে পড়া কারও কারও কাছে স্বাভাবিক মনে না হলেও বিষয়টি অসম্ভব নয়।
রথিশ ভৌমিক ঘরের চেয়ে বাইরের দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছিলেন কি? নাকি ঘরের অশান্তি তাকে বাইরের নানা কাজে বেশি আকৃষ্ট করেছিল? এ সব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। এরপরও স্ত্রীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী লাশ উদ্ধারের ঘটনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, তিনি সব জানতেন।
প্রশ্ন উঠছে, স্ত্রী কারও হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন কিনা? কামরুলের রাজনৈতিক পরিচয়ই বা কী? কামরুল কি রথিশকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়েই স্নিগ্ধা বা দীপার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন? আমার কাছে এসব প্রশ্ন খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। এটা নিয়ে বড় রহস্য গল্প বা উপন্যাস লেখা যেতে পারে, কিন্তু রথিশকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না।
কোনও ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা যতটা কৌতূহলী বা অনুসন্ধানী হয়ে উঠি, স্বাভাবিক অবস্থায় তা হই না। আমার ছেলে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে কিনা, আমি জানি না। আমার ছেলেমেয়ে কার সঙ্গে মিশছে, তার খবর রাখার প্রয়োজন বোধ করি না। আমি কোথায় যাই, কাদের সঙ্গে মিশি, তা আমার স্ত্রীকে বলি না। আমার স্ত্রীও আমাকে বলে না। আমাদের এই পারস্পরিক স্বাধীনতা ভেতরে ভেতরে একরকম সুড়ঙ্গ তৈরি করছে। আর সেই সুড়ঙ্গ পথে দীপা-কামরুলের অবাধ যাতায়াত শেষ পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছে রথিশের জীবন।
রথিশ হত্যার সব দায় আমি কেবল স্ত্রীর ওপর যেমন চাপাতে চাই না, তেমনি তাকে একজন মানুষ মনে করি বলেই তার কৃত অপরাধকেও ছোট করে দেখতে চাই না। জামায়াত-শিবির পরিকল্পনা করে কামরুলকে দিয়ে দীপার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তারপর রথিশকে হত্যা করে বদলা নিলো বলে এক ধরনের কষ্টকল্পনা কাউকে কাউকে করতে দেখা যাচ্ছে। যারা এ সব কল্পগল্পে মজছেন, তারা একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন, দীপার সঙ্গে কামরুলের সম্পর্ক আগে হয়েছে, নাকি রথিশ ভৌমিক জঙ্গিদের বিরুদ্ধে মামলা আগে লড়েছেন? আমরা অজ্ঞাতসারে আততায়ী বা ঘাতককে ঘরে স্বাগত জানাচ্ছি, তারপর অঘটন ঘটলে এলোপাতাড়ি একে ওকে দোষ দিচ্ছি।
রথিশ
হত্যাকাণ্ডের জন্য যে বা যারাই দায়ী হোক না কেন, ন্যায়বিচার যেন নিশ্চিত
হয়। অপরাধীর যেন উপযুক্ত শাস্তি হয়। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইচ্ছা করলে
রহস্য ভেদ যেমন করতে পারে, তেমন রহস্য তৈরিও করতে পারে। অপরাধীকে ধরতেও
পারে, আবার আড়ালও করতে পারে। আমরা চাইবো, অপরাধমুক্ত দেশ গড়তেই উদ্যোগী হবে
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মনে রাখতে হবে, অপরাধী আড়াল করার প্রবণতা যদি দূর বা
বন্ধ না হয় তাহলে সমাজ-সংসার থেকে অপরাধ প্রবণতাও দূর হবে না।
লেখক: কলামিস্ট
৩০ মার্চ সকালে রথিশ চন্দ্র ভৌমিক বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি– এই খবর জেনে বা শুনে প্রাথমিকভাবে সবারই ধারণা হয়েছিল, তিনি নিশ্চয়ই স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করেননি। তাকে গুম বা অপহরণ করা হয়েছে। দেশে গুম-অপহরণের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। এ ধরনের ঘটনায় ‘ভিকটিম’ হয় কিছুদিন পর ফিরে আসেন এবং নিশ্চুপ হয়ে যান, ঘটনার কোনও ধরনের বিবরণ পাওয়া যায় না, আবার বিবরণ পেলেও তা অনেকের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হয় না। আবার কারও বা লাশ পাওয়া যায় ঘটনাস্থলের কাছাকাছি কোথাও। কেউ কেউ আবার একেবারেই ফিরে আসেন না, তারা হয়ে যান স্থায়ী ‘নিখোঁজ’।
কেউ গুম, অপহরণ বা নিখোঁজ হলে তার সন্ধান দেওয়ার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্র বা সরকারের। রাষ্ট্র বা সরকারের হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেই কাজটি করে। কিন্তু আমাদের দেশে দুঃখজনকভাবে কেউ নিখোঁজ হলে বা কাউকে পাওয়া না গেলে সন্দেহের তীরটা প্রথম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকেই ছোটে। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনার পর থেকে এই সন্দেহ প্রবণতাটা বেড়েছে।
রথিশ ভৌমিক রংপুরের একজন মোটামুটি পরিচিত মানুষ। বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি। তিনি রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আইনজীবী হিসেবে সুনামের অধিকারী। তিনি সরকারি দল আওয়ামী লীগের রংপুর জেলা কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক। আইনজীবী সমিতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট, পূজা উদযাপন পরিষদ, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের একজন শীর্ষ নেতা। জাপানের নাগরিক ও মাজারের খাদেম হত্যা মামলায় তিনি সরকারি পিপি ছিলেন এবং একজন মানবতাবিরোধী অপরাদের বিচারের মামলায়ও তিনি ছিলেন সাক্ষী। এ রকম একজন মানুষের ‘নিখোঁজ’ হওয়াটা নিঃসন্দেহে কোনও ছোট ঘটনা ছিল না। তাই বাসা থেকে বের হয়ে ফিরে না আসায় প্রতিক্রিয়া হয় তীব্র। রংপুরে বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ, মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলনসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি তাকে অবিলম্বে খুঁজে বের করার দাবি জানানো হয়। তিনি ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন অন্যতম নেতা হওয়ায় সংখ্যালঘুদের মধ্যে দেখা দেয় বাড়তি উদ্বেগ ও অস্থিরতা। সরকারের ওপর তৈরি হয় চাপ, কারণ তিনি সরকারি দলেরও একজন নেতা ছিলেন।
প্রথমে সবারই ধারণা হয়েছিল, রথিশ ভৌমিক হয়তো কোনও জঙ্গি, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর রোষের শিকার হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একমুখী তদন্ত না করে নানাভাবে চেষ্টা চালাতে থাকে। জামায়াত-শিবিরের কয়েকজনকে আটকও করা হয়। তবে তার স্ত্রীর সহকর্মী স্কুলশিক্ষক কামরুল ইসলামকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের পর সম্ভবত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে প্রকৃত ঘটনা কী ঘটেছে, তা পরিষ্কার হয়। রথিশ ভৌমিকের স্ত্রী দীপা ওরফে স্নিগ্ধাকে আটকের পর তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রথিশের লাশ উদ্ধার করা হয় কামরুলের ভাইয়ের নির্মাণাধীন একটি বাড়ির মাটি খুঁড়ে। জানা যায়, রথিশ নিখোঁজ হননি। আগের রাতে স্ত্রী ও কামরুল যৌথভাবেই হত্যা করেছিলেন তাকে। পরিকল্পিতভাবেই তাকে হত্যা করে লাশ মাটি চাপা দিয়ে ‘নিখোঁজ’ হওয়ার গল্প প্রচার করা হয়।
রথিশের যে পরিচিতি, তাতে এই ঘটনার পেছনে জঙ্গি-জামায়াতকে জড়ালে সেটা বিশ্বাসযোগ্য হবে–এটা বুঝে কামরুলই সে ধরনের প্রচার চালিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের শেষ রক্ষা হলো না। দীপা-কামরুলের গোপন সম্পর্কের কথা আর গোপন থাকলো না। এ পর্যন্ত এই হলো কাহিনি। কিন্তু এটা আবার বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। কারণ এই তথ্যগুলো জানা গেছে র্যাব সূত্রে। তারা যে সঠিক তথ্য দিয়েছে, তার নিশ্চয়তা বা কী? পেছনের বিশেষ কোনও শক্তিকে আড়াল করার জন্য এই গল্প ফাঁদা হয়নি, তা কে বলতে পারে?
ব্যক্তিগতভাবে আমি বিষয়টিকে অবিশ্বাসযোগ্য মনে করছি না। মানুষের মনের খবর রাখা খুব সহজ কাজ নয়। রথিশ ভৌমিকের দাম্পত্যজীবন কেমন ছিল, আমি জানি না। তবে দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময় তারা সংসার করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া একপুত্র ও স্কুল পড়ুয়া এককন্যা সন্তান থাকার পরও প্রায় পরিণত বয়সে নতুন প্রেমে পড়া কারও কারও কাছে স্বাভাবিক মনে না হলেও বিষয়টি অসম্ভব নয়।
রথিশ ভৌমিক ঘরের চেয়ে বাইরের দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছিলেন কি? নাকি ঘরের অশান্তি তাকে বাইরের নানা কাজে বেশি আকৃষ্ট করেছিল? এ সব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। এরপরও স্ত্রীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী লাশ উদ্ধারের ঘটনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, তিনি সব জানতেন।
প্রশ্ন উঠছে, স্ত্রী কারও হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন কিনা? কামরুলের রাজনৈতিক পরিচয়ই বা কী? কামরুল কি রথিশকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়েই স্নিগ্ধা বা দীপার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন? আমার কাছে এসব প্রশ্ন খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। এটা নিয়ে বড় রহস্য গল্প বা উপন্যাস লেখা যেতে পারে, কিন্তু রথিশকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না।
কোনও ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা যতটা কৌতূহলী বা অনুসন্ধানী হয়ে উঠি, স্বাভাবিক অবস্থায় তা হই না। আমার ছেলে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে কিনা, আমি জানি না। আমার ছেলেমেয়ে কার সঙ্গে মিশছে, তার খবর রাখার প্রয়োজন বোধ করি না। আমি কোথায় যাই, কাদের সঙ্গে মিশি, তা আমার স্ত্রীকে বলি না। আমার স্ত্রীও আমাকে বলে না। আমাদের এই পারস্পরিক স্বাধীনতা ভেতরে ভেতরে একরকম সুড়ঙ্গ তৈরি করছে। আর সেই সুড়ঙ্গ পথে দীপা-কামরুলের অবাধ যাতায়াত শেষ পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছে রথিশের জীবন।
রথিশ হত্যার সব দায় আমি কেবল স্ত্রীর ওপর যেমন চাপাতে চাই না, তেমনি তাকে একজন মানুষ মনে করি বলেই তার কৃত অপরাধকেও ছোট করে দেখতে চাই না। জামায়াত-শিবির পরিকল্পনা করে কামরুলকে দিয়ে দীপার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তারপর রথিশকে হত্যা করে বদলা নিলো বলে এক ধরনের কষ্টকল্পনা কাউকে কাউকে করতে দেখা যাচ্ছে। যারা এ সব কল্পগল্পে মজছেন, তারা একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন, দীপার সঙ্গে কামরুলের সম্পর্ক আগে হয়েছে, নাকি রথিশ ভৌমিক জঙ্গিদের বিরুদ্ধে মামলা আগে লড়েছেন? আমরা অজ্ঞাতসারে আততায়ী বা ঘাতককে ঘরে স্বাগত জানাচ্ছি, তারপর অঘটন ঘটলে এলোপাতাড়ি একে ওকে দোষ দিচ্ছি।
লেখক: কলামিস্ট
No comments