ভারত-নেপাল সম্পর্ক পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধই চাবিকাঠি by সি. রাজা মোহন
‘আমি
এমন কোনো চুক্তিতে উপনীত হবো না, যা নেপালের জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে
যাবে।’ এই উক্তি নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলির। ভারত সফরের আগে
তিনি কাঠমান্ডুতে পার্লামেন্ট সদস্যদের আশ্বস্ত করতে এই কথা বলেন। এ ধরনের
কৈফিয়ৎ থেকেই ভারত ও নেপালের মধ্যকার সম্পর্কের দৈন্যদশার ইঙ্গিত মিলে।
এটি নিশ্চিতভাবেই নজিরবিহীন কিছু নয়। কিছুকাল আগ পর্যন্তও, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি সরকারি বৈঠককে ‘ওয়াশিংটনের চাপের মুখে দিল্লির স্বার্বভৌমত্ব বিলিয়ে দেয়া’ হিসেবেই তুলে ধরতো ভারতের পর্যবেক্ষক মহল। এমনকি স্পষ্টত ভারতের স্বার্থের পক্ষে হলেও, দিল্লির রাজনৈতিক ও আমলা শ্রেণী ‘আমেরিকাপন্থি’ হিসেবে পরিগণিত হওয়ার ভয়ে সামনে এগোতে চাইতো না। দিল্লি বাহ্যিকভাবে ওয়াশিংটনের প্রতি বিরুদ্ধাচরণ প্রদর্শনের নীতি বেছে নেয়ায়, আমেরিকার সঙ্গে তখন লেনদেনের সুযোগ কমই ছিল।
বৃহত্তর পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বোঝাপোড়া ও আস্থা তৈরির সচেতন প্রচেষ্টার ফলে গত কয়েক বছরে এই ধরনের প্রবণতা নিশ্চিতভাবেই হ্রাস পেয়েছে। কাঠমান্ডু ও দিল্লির মধ্যে ঠিক এটিই দরকার। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে যেমনটা হয়েছে, ঠিক তেমনভাবে সন্দেহ দূরীকরণ ও রাজনৈতিক স্বস্তির জায়গা তৈরি হওয়ার উদ্যোগ আসা প্রয়োজন বড় দেশটির কাছ থেকে। ক্ষমতার অসামঞ্জস্যতার কারণে দুর্বল পক্ষের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই রক্ষণাত্মক মানসিকতা তৈরি হয়। যদি ভারতের মতো বড় দেশ এত দিন ধরে যদি ‘স্মল কান্ট্রি সিনড্রমে’ আক্রান্ত থাকতে পারে, তাহলে এ নিয়েও আশ্চর্যান্বিত হওয়ার কিছু নেই যে, নেপালের অভিজাতরা এই রোগের আরও তীব্র সংস্করণের দ্বারা আক্রান্ত।
অবশ্য ভারত-নেপাল সম্পর্কে ক্ষমতার অসামঞ্জস্যতা একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলেও, এ থেকেই দুই দেশের সমস্যা পুরোপুরি বোধগম্য হয় না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নেপালের সঙ্গে চীনের সম্পর্কে কিন্তু ক্ষমতার সামঞ্জস্যহীনতা আরও অনেক বেশি। অথচ, দিল্লি সফর শেষে ওলি যখন বেইজিংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন, তখন কাঠমান্ডুর খুব অল্পসংখ্যক মানুষই নেপালের স্বার্থ বিকিয়ে দেয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকবেন। বরং, ওই সফরের প্রাক্কালে অনেকের প্রত্যাশা থাকবে যে, বেইজিং নেপালকে ভারতের বিরুদ্ধে ‘রুখে দাঁড়াতে’ সহায়তা করবে। আমরা এটি পছন্দ করি আর না করি, ভারতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই দুর্ভাগ্যবশত নেপালের স্বার্বভৌমত্বের সংজ্ঞার গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে। দিল্লির বেশিরভাগ প্রতিবেশীর ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, ভারতের সঙ্গে তাদের গভীর ঘনিষ্ঠতা ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতা একই সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক ও ব্যাপক অসন্তোষের উৎস।
প্রতিবেশী দেশগুলোর অভিজাত শ্রেণির মধ্যে ‘ভারত-বিরোধী’ মনোভাবের নিন্দা জানানো বা এই প্রবণতার সমালোচনা করা খুব সহজ। এই প্রবণতা যৌক্তিক কি না, তা বিচার করার ভার দিল্লির নয়। বরং, দিল্লিকে অবশ্যই এই নেতিবাচকতার উৎস কী, তা বুঝতে হবে এবং এই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। ইতিহাস হতে পারে এই প্রচেষ্টা শুরুর একটি ভিত্তি।
উপমহাদেশের হর্তাকর্তা হওয়ার মনোভাব দিল্লি পেয়েছে বৃটিশ রাজ থেকে। আশ্রিত রাজ্যের ধারণা বৃটিশ রাজ এবং উপমহাদেশের সামন্ততান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠী ও উপজাতি ফেডারেশনের ক্ষেত্রে ভালোই কাজ করেছে। বৃটিশরা এই সামন্ততান্ত্রিক ও উপজাতি শাসকগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক ভর্তুকি ও অভ্যন্তরীণ বিষয়াদিতে হস্তক্ষেপ না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বিনিময়ে, উপমহাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর আক্রমণ প্রতিরোধে বৃটিশ রাজকে সহায়তা দিতে সম্মত হয় সামন্ততান্ত্রিক ও উপজাতি সরদাররা। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে স্বাধীন ভারতের জন্য এই পারস্পরিক লাভজনক ব্যবস্থা টেকসই ছিল না। এর একটি কারণ ছিল এই অঞ্চলে ক্ষমতার পরিবর্তন, যার শিকার হয় উপমহাদেশের ওপর ভারতের একচ্ছত্র প্রভাব বলয়।
উপমহাদেশে বৃটিশ রাজের আধিপত্য ছিল ব্যাপক। প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষকে ভারত দখল করা থেকে বিরত রাখার শক্তিও তাদের ছিল। উপমহাদেশের বিভাজন, মার্কিন-সোভিয়েত শীতল যুদ্ধ এবং কম্যুনিস্টদের অধীনে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ চীনের আবির্ভাব ভারতীয় নীতির জন্য ব্যাপক বাধা-বিপত্তি তৈরি করে। কিন্তু এই নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে রাজি ছিল না দিল্লি।
বৃটিশ রাজের কর্তৃত্বের ভিত্তি ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সামন্ততান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে অংশীদারি। কিন্তু স্বাধীনতার পর বিভিন্ন রাজতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য ও সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ভারতকে এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির দিকে ফেলে দেয়। এভাবে নানা কারণে, ভারত অনিবার্যভাবেই নেপালসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়াদিতে ঢুকে পড়ে। এর সর্বশেষ নজির ছিল নেপালের সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় ভারতের সংশ্লিষ্টতা।
ওলি হয়তো তীব্র জাতীয়তাবাদী স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু দিল্লির জন্য, তার আসন্ন ভারত সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ঠিক পথে ফিরিয়ে আনার বড় সুযোগ। মোট তিনটি কর্তব্য রয়েছে দিল্লির। প্রথমটি হলো নেপালের স্বার্বভৌমত্বকে স্বীকার করা এবং তার ভিত্তিতে সম্পর্ক পরিচালনার প্রতিশ্রুতি দেয়া। ‘বিশেষ সম্পর্কের পরিবর্তে ‘স্বার্বভৌম সমতা’র ভিত্তিতে নেপাল-ভারত সম্পর্ককে ফুটিয়ে তুলতে হবে। অবশ্যই এর মানে দাঁড়াবে এই যে, ভারতের উচিদ নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো বন্ধ করা এবং দুই দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সম্পর্কের দিকে মনোযোগ দেয়া। এটি নেপালের জন্য দিল্লির পক্ষ থেকে কোনো আনুকূল্য নয়। বরং, শক্তিশালী ও স্বার্বভৌম নেপাল থাকাটা ভারতের স্বার্থেরই পক্ষে।
দ্বিতীয়ত, ওলির কাছ থেকে ‘প্রথমে ভারত’ (ইন্ডিয়া ফার্স্ট) নীতি দাবি করার পরিবর্তে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অবশ্যই ‘প্রথমে নেপাল’ নীতির পক্ষে ভারতের শক্ত সমর্থনের বিষয়টি স্পষ্ট করতে হবে। বিশ্বের দুই দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির মাঝখানে অবস্থিত নেপাল নিজের অবস্থানের কারণে লাভ ঘরে তুলবে- এটাই স্বাভাবিক।
উন্মুক্ত সীমান্ত ও সাগরপথে সহজতম প্রবেশাধিকারের বিষয়গুলো ভারতের সঙ্গে নেপালের সম্পর্কের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই আলাদা বৈশিষ্ট্যকে স্বীকৃতি দিতে ওলির সমস্যা থাকা উচিত নয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ব্যপক ম্যান্ডেট সহকারে নির্বাচিত ওলি নেপালকে আত্মবিশ্বাসী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ভালো অবস্থানে রয়েছেন। আত্মবিশ্বাসী নেপালই পারে ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে রাজনীতিমুক্ত করতে।
তৃতীয়ত, ভারতের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলো সবসময়ই নেপালের সঙ্গে বিশেষ রাজনৈতিক সম্পর্ক থাকার দাবি করলেও, দিল্লির অর্থনৈতিক নীতির কারণে দুই দেশের মধ্যে সহজাত পারস্পরিক অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা পরিপূর্ণরূপে বিকশিত হয়নি। দুই দেশের দীর্ঘ ও উন্মুক্ত সীমান্তে ভঙ্গুর বাণিজ্য অবকাঠামো, অর্থনৈতিক সহায়তা পরিচালনার ক্ষেত্রে দিল্লির অসুবিধাজনক কার্যপ্রণালী এবং যৌক্তিক সময়সীমার মধ্যে অবকাঠামো প্রকল্প সম্পন্ন করার সামর্থ্যহীনতাই নেপালে ভারতের দুর্দশা বাড়িয়েছে।
ইতিমধ্যেই যেসব প্রকল্প নিয়ে কথাবার্তা ঠিক করা আছে এবং যেগুলোর ফল দুই দেশের মানুষ আগেভাগে পাবে, সেসবের ওপরই দুপক্ষের মনোযোগ দেয়া উচিৎ। আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য, পরিবহন ও পর্যটন সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে জোর দেয়ার মাধ্যমে গড়ে উঠতে পারে স্বার্বভৌম নেপালের সঙ্গে ভারতের টেকসই রাজনৈতিক অংশীদারির দৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তি।
(সি. রাজা মোহন দিল্লি-ভিত্তিক থিংকট্যাংক কার্নেগি ইন্ডিয়ার পরিচালক ও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কন্ট্রিবিউটিং এডিটর।)
এটি নিশ্চিতভাবেই নজিরবিহীন কিছু নয়। কিছুকাল আগ পর্যন্তও, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি সরকারি বৈঠককে ‘ওয়াশিংটনের চাপের মুখে দিল্লির স্বার্বভৌমত্ব বিলিয়ে দেয়া’ হিসেবেই তুলে ধরতো ভারতের পর্যবেক্ষক মহল। এমনকি স্পষ্টত ভারতের স্বার্থের পক্ষে হলেও, দিল্লির রাজনৈতিক ও আমলা শ্রেণী ‘আমেরিকাপন্থি’ হিসেবে পরিগণিত হওয়ার ভয়ে সামনে এগোতে চাইতো না। দিল্লি বাহ্যিকভাবে ওয়াশিংটনের প্রতি বিরুদ্ধাচরণ প্রদর্শনের নীতি বেছে নেয়ায়, আমেরিকার সঙ্গে তখন লেনদেনের সুযোগ কমই ছিল।
বৃহত্তর পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বোঝাপোড়া ও আস্থা তৈরির সচেতন প্রচেষ্টার ফলে গত কয়েক বছরে এই ধরনের প্রবণতা নিশ্চিতভাবেই হ্রাস পেয়েছে। কাঠমান্ডু ও দিল্লির মধ্যে ঠিক এটিই দরকার। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে যেমনটা হয়েছে, ঠিক তেমনভাবে সন্দেহ দূরীকরণ ও রাজনৈতিক স্বস্তির জায়গা তৈরি হওয়ার উদ্যোগ আসা প্রয়োজন বড় দেশটির কাছ থেকে। ক্ষমতার অসামঞ্জস্যতার কারণে দুর্বল পক্ষের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই রক্ষণাত্মক মানসিকতা তৈরি হয়। যদি ভারতের মতো বড় দেশ এত দিন ধরে যদি ‘স্মল কান্ট্রি সিনড্রমে’ আক্রান্ত থাকতে পারে, তাহলে এ নিয়েও আশ্চর্যান্বিত হওয়ার কিছু নেই যে, নেপালের অভিজাতরা এই রোগের আরও তীব্র সংস্করণের দ্বারা আক্রান্ত।
অবশ্য ভারত-নেপাল সম্পর্কে ক্ষমতার অসামঞ্জস্যতা একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলেও, এ থেকেই দুই দেশের সমস্যা পুরোপুরি বোধগম্য হয় না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নেপালের সঙ্গে চীনের সম্পর্কে কিন্তু ক্ষমতার সামঞ্জস্যহীনতা আরও অনেক বেশি। অথচ, দিল্লি সফর শেষে ওলি যখন বেইজিংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেবেন, তখন কাঠমান্ডুর খুব অল্পসংখ্যক মানুষই নেপালের স্বার্থ বিকিয়ে দেয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকবেন। বরং, ওই সফরের প্রাক্কালে অনেকের প্রত্যাশা থাকবে যে, বেইজিং নেপালকে ভারতের বিরুদ্ধে ‘রুখে দাঁড়াতে’ সহায়তা করবে। আমরা এটি পছন্দ করি আর না করি, ভারতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই দুর্ভাগ্যবশত নেপালের স্বার্বভৌমত্বের সংজ্ঞার গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে। দিল্লির বেশিরভাগ প্রতিবেশীর ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, ভারতের সঙ্গে তাদের গভীর ঘনিষ্ঠতা ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতা একই সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক ও ব্যাপক অসন্তোষের উৎস।
প্রতিবেশী দেশগুলোর অভিজাত শ্রেণির মধ্যে ‘ভারত-বিরোধী’ মনোভাবের নিন্দা জানানো বা এই প্রবণতার সমালোচনা করা খুব সহজ। এই প্রবণতা যৌক্তিক কি না, তা বিচার করার ভার দিল্লির নয়। বরং, দিল্লিকে অবশ্যই এই নেতিবাচকতার উৎস কী, তা বুঝতে হবে এবং এই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। ইতিহাস হতে পারে এই প্রচেষ্টা শুরুর একটি ভিত্তি।
উপমহাদেশের হর্তাকর্তা হওয়ার মনোভাব দিল্লি পেয়েছে বৃটিশ রাজ থেকে। আশ্রিত রাজ্যের ধারণা বৃটিশ রাজ এবং উপমহাদেশের সামন্ততান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠী ও উপজাতি ফেডারেশনের ক্ষেত্রে ভালোই কাজ করেছে। বৃটিশরা এই সামন্ততান্ত্রিক ও উপজাতি শাসকগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক ভর্তুকি ও অভ্যন্তরীণ বিষয়াদিতে হস্তক্ষেপ না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বিনিময়ে, উপমহাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর আক্রমণ প্রতিরোধে বৃটিশ রাজকে সহায়তা দিতে সম্মত হয় সামন্ততান্ত্রিক ও উপজাতি সরদাররা। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে স্বাধীন ভারতের জন্য এই পারস্পরিক লাভজনক ব্যবস্থা টেকসই ছিল না। এর একটি কারণ ছিল এই অঞ্চলে ক্ষমতার পরিবর্তন, যার শিকার হয় উপমহাদেশের ওপর ভারতের একচ্ছত্র প্রভাব বলয়।
উপমহাদেশে বৃটিশ রাজের আধিপত্য ছিল ব্যাপক। প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষকে ভারত দখল করা থেকে বিরত রাখার শক্তিও তাদের ছিল। উপমহাদেশের বিভাজন, মার্কিন-সোভিয়েত শীতল যুদ্ধ এবং কম্যুনিস্টদের অধীনে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ চীনের আবির্ভাব ভারতীয় নীতির জন্য ব্যাপক বাধা-বিপত্তি তৈরি করে। কিন্তু এই নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে রাজি ছিল না দিল্লি।
বৃটিশ রাজের কর্তৃত্বের ভিত্তি ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সামন্ততান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে অংশীদারি। কিন্তু স্বাধীনতার পর বিভিন্ন রাজতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য ও সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ভারতকে এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির দিকে ফেলে দেয়। এভাবে নানা কারণে, ভারত অনিবার্যভাবেই নেপালসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়াদিতে ঢুকে পড়ে। এর সর্বশেষ নজির ছিল নেপালের সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় ভারতের সংশ্লিষ্টতা।
ওলি হয়তো তীব্র জাতীয়তাবাদী স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু দিল্লির জন্য, তার আসন্ন ভারত সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ঠিক পথে ফিরিয়ে আনার বড় সুযোগ। মোট তিনটি কর্তব্য রয়েছে দিল্লির। প্রথমটি হলো নেপালের স্বার্বভৌমত্বকে স্বীকার করা এবং তার ভিত্তিতে সম্পর্ক পরিচালনার প্রতিশ্রুতি দেয়া। ‘বিশেষ সম্পর্কের পরিবর্তে ‘স্বার্বভৌম সমতা’র ভিত্তিতে নেপাল-ভারত সম্পর্ককে ফুটিয়ে তুলতে হবে। অবশ্যই এর মানে দাঁড়াবে এই যে, ভারতের উচিদ নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো বন্ধ করা এবং দুই দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সম্পর্কের দিকে মনোযোগ দেয়া। এটি নেপালের জন্য দিল্লির পক্ষ থেকে কোনো আনুকূল্য নয়। বরং, শক্তিশালী ও স্বার্বভৌম নেপাল থাকাটা ভারতের স্বার্থেরই পক্ষে।
দ্বিতীয়ত, ওলির কাছ থেকে ‘প্রথমে ভারত’ (ইন্ডিয়া ফার্স্ট) নীতি দাবি করার পরিবর্তে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে অবশ্যই ‘প্রথমে নেপাল’ নীতির পক্ষে ভারতের শক্ত সমর্থনের বিষয়টি স্পষ্ট করতে হবে। বিশ্বের দুই দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির মাঝখানে অবস্থিত নেপাল নিজের অবস্থানের কারণে লাভ ঘরে তুলবে- এটাই স্বাভাবিক।
উন্মুক্ত সীমান্ত ও সাগরপথে সহজতম প্রবেশাধিকারের বিষয়গুলো ভারতের সঙ্গে নেপালের সম্পর্কের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই আলাদা বৈশিষ্ট্যকে স্বীকৃতি দিতে ওলির সমস্যা থাকা উচিত নয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ব্যপক ম্যান্ডেট সহকারে নির্বাচিত ওলি নেপালকে আত্মবিশ্বাসী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ভালো অবস্থানে রয়েছেন। আত্মবিশ্বাসী নেপালই পারে ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে রাজনীতিমুক্ত করতে।
তৃতীয়ত, ভারতের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলো সবসময়ই নেপালের সঙ্গে বিশেষ রাজনৈতিক সম্পর্ক থাকার দাবি করলেও, দিল্লির অর্থনৈতিক নীতির কারণে দুই দেশের মধ্যে সহজাত পারস্পরিক অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা পরিপূর্ণরূপে বিকশিত হয়নি। দুই দেশের দীর্ঘ ও উন্মুক্ত সীমান্তে ভঙ্গুর বাণিজ্য অবকাঠামো, অর্থনৈতিক সহায়তা পরিচালনার ক্ষেত্রে দিল্লির অসুবিধাজনক কার্যপ্রণালী এবং যৌক্তিক সময়সীমার মধ্যে অবকাঠামো প্রকল্প সম্পন্ন করার সামর্থ্যহীনতাই নেপালে ভারতের দুর্দশা বাড়িয়েছে।
ইতিমধ্যেই যেসব প্রকল্প নিয়ে কথাবার্তা ঠিক করা আছে এবং যেগুলোর ফল দুই দেশের মানুষ আগেভাগে পাবে, সেসবের ওপরই দুপক্ষের মনোযোগ দেয়া উচিৎ। আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য, পরিবহন ও পর্যটন সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে জোর দেয়ার মাধ্যমে গড়ে উঠতে পারে স্বার্বভৌম নেপালের সঙ্গে ভারতের টেকসই রাজনৈতিক অংশীদারির দৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তি।
(সি. রাজা মোহন দিল্লি-ভিত্তিক থিংকট্যাংক কার্নেগি ইন্ডিয়ার পরিচালক ও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক কন্ট্রিবিউটিং এডিটর।)
No comments