যেভাবে ইয়াবা নেশায় বুঁদ শিক্ষার্থীরা by সুদীপ অধিকারী
ইয়াবার
থাবা কোথায় পড়েনি? কারখানা থেকে গোডাউন। এরপর আস্তানা। থেমে নেই সেখানেও।
পাড়া, মহল্লা, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি রাজপথেও প্রকাশ্যে বিচরণ
ইয়াবা ‘বাবা’র। বাজারের পণ্যের মতো চলছে বিক্রি। ভয়াবহ তথ্য হলো- ইয়াবা এখন
তৈরি হচ্ছে রাজধানী ঢাকার আশপাশে। সূত্রমতে, পুরান ঢাকার লালবাগ, উত্তরা,
শ্যামপুর, সূত্রাপুর এলাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে, সোয়ারীঘাট, কেরানীগঞ্জ,
টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জের বন্দর ও ফতুল্লায় রয়েছে কমপক্ষে ২০টি কারখানা। আর এসব
কারখানার তৈরি ইয়াবা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে রাজধানীর অলি-গলিতে। এর প্রমাণ পাওয়া
যায় ক’দিন আগে নারায়ণগঞ্জের হরিপুরে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেখানে আবিষ্কার
করে একটি ইয়াবা কারখানার। যেখান থেকে উদ্ধার করে ইয়াবা তৈরির সরঞ্জাম। আটক
করা হয় লাকী আক্তার নামে এক ইয়াবা কারবারীকে। সে সময় মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের
মহাপরিচালক সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, অ্যামফিটাসিনযুক্ত গোলাপী পাউডারের
সঙ্গে জন্ম নিরোধক ও ব্যথানাশক ট্যাবলেট গুঁড়া দিয়ে তৈরি হয় ইয়াবা। মেশানো
হয় এক ধরনের ফ্লেবারযুক্ত মেডিসিনও। যৌন উত্তেজনা বাড়ানোর জন্য আরও মেশানো
হয় ভায়াগ্রা জাতীয় ওষুধ। প্রচলিত আছে ইয়াবা খেলে শরীরে শক্তি বাড়ে। যৌন
উত্তেজনাও সৃষ্টি হয়। এই প্রচারণা থেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা
ঝুঁকছে ইয়াবা নেশায়। কখনো বন্ধুর পাল্লায় পড়ে, কখনো সহপাঠীর পাল্লায় পড়ে
ইয়াবা ধরলেও আস্তে আস্তে আসক্ত হয়ে পড়ে। এক সময় সেখান থেকে আর ফিরে আসতে
পারে না। এমনই একজন সাব্বীর আহমেদ মিলন। ছোট থেকে তার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার
হয়ার। লেখা-পড়ায় ভাল হওয়ায় উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডী পেরিয়েই দেশের নামকরা
মেডিকল কলেজে পড়ার সুযোগ পায়। কিন্তু মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর সারাদিন
ক্লাস, ল্যাবসহ নানা কারণে ঠিকমতো পড়ার টেবিলে মন বসাতে পারতো না মিলন।
নতুন বন্ধু আশিকের কাছে সমস্যার কথা খুলে বলে। চটজলদি সমাধানও পেয়ে যায়।
আশিক বলেন, রাতের বেলাটাই হচ্ছে বই পড়ার উপযুক্ত সময়। এজন্যে পরীক্ষায় ভালো
রেজাল্ট করতে হলে রাত জেগে পড়তে হবে। কিন্তু চা-কফিতে রাতের ঘুম যাবে না।
এই ঘুম শুধু মাত্র ‘ইয়াবা’ই তাড়াতে পারবে। কিন্তু এটাতো নেশার ওষুধ? মিলনের
এমন প্রশ্নে আশিক বলেন, চম্পা (ছোট ইয়াবা) খেলে মানুষের ক্ষতি হয়, সেভেন
(বড় ইয়াবা) খেলে ক্ষতি হয় না কারোর। শুধু রাতের ঘুমটা নিজের কন্ট্রোলে
থাকে। এমনই প্রলোভনে পা দিয়ে প্রথমে বন্ধুর সাথে, পরে নিজেই টাকা খরচ করে
গোপনে ইয়াবা সেবন শুরু করেন মিলন। পড়া-লেখার চাপ থেকে রক্ষা পেতে গিয়ে এখন
সে নিয়মিত একজন ইয়াবা সেবনকারী হয়ে ওঠেছেন। মিলনের মতো আশিকেরও ইয়াবা
সেবনের সূচনা হয় পরিচিত এক বড় ভাইয়ের হাত ধরে। পুরাতন এক মেছ বাসায়
থাকাকালীন শুরু হয় তার এই মাদক গ্রহণ। অন্যদিকে এক বেসরকারি মেডিকেল কলেজের
ছাত্র জহিরুল হক মিল্লাদ বলেন, গ্রামে থাকাকালে ইয়াবা সম্পর্কে কিছুই
জানতাম না। কিন্তু ঢাকা আসার পর ধীরে ধীরে এতে আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। এখন বুঝেও
কিছু করতে পারছি না। তিনি বলেন, এটা না খেলে এখন পড়া-লেখা মনই বসাতে পারি
না। আর পরীক্ষা আসলে তার ইয়াবা সেবনের মাত্রা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। তার মতো
অনেক মেডিকেল শিক্ষার্থীই প্রতিনিয়ত ইয়াবা সেবন করে। কোথা থেকে ইয়াবা কিনে
আনে। মিল্লাদ বলেন, ইয়াবা কিনতে কোথাও যাওয়া লাগে না। ফোন করলেই কলেজ
ক্যাম্পাস, বাসা, হেস্টেল যেখানে খুশি সেখানেই পৌঁছে দিয়ে যায়। এজন্যে বেশি
টাকাও দেয়া লাগে না। দেখা হয় মিল্লাদের ভ্রাম্যমাণ ইয়াবা বিক্রেতা শামীমের
সঙ্গে। খালি চোখে দেখলে পেশায় একজন রিকশাচালক। কিন্তু রিকশার আড়ালে চলে
তার ভ্রাম্যমাণ ইয়াবা ব্যবসা। শামীমের মোবাইল নম্বরে কল ঢোকা মানেই তার
ইয়াবার দোকান খোলা। ফোন পেলেই সে কিছু সময়ের মধ্যে হাজির হয়ে যায় স্পটে।
সাংকেতিক কথোপকথনের মাধ্যমেই চিনে নেয় একে-অপরকে। তারপর খালি রিকশায় যাত্রী
সেজে উঠে পড়ে ক্রেতা। চলন্ত রিকশা কিছুদূর যেতেই লেন-দেন সেরে আবার নেমে
যান যাত্রীরূপী ক্রেতা। ইয়াবায় বেশি লাভ হওয়াই নিম্নবিত্ত মানুষের পাশাপাশি
এ ব্যবসায় এখন ঝুঁকছেন অনেক উচ্চবিত্তও। এমনকি বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক
সেন্টারের আড়ালেও দেদারছে বিক্রি হচ্ছে ইয়াবা। কিছুদিন আগেই ধানমন্ডির
মেডিনোভা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা,
ফেনসিডিলসহ নানা মাদক উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একাধিক বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য খ্যাত ধানমন্ডি এলাকাতে রয়েছে প্রচুর শিক্ষার্থীর
বাস। আর এই উচ্চ-মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীদের কেন্দ্র করেও গড়ে উঠেছে বিশাল
ইয়াবা চক্র। সূত্রমতে, লাখ লাখ টাকার ইয়াবা লেন-দেনের এই চক্রগুলো
নিয়ন্ত্রণ করেন পশ্চিম ধানমন্ডির ইমন, রিপন, মিজান, মোহাম্মদপুর ক্যাম্পের
বাজারের শরীফ, জাহিদসহ বেশ ক’জন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভ্রাম্যমাণ
বিক্রেতা জানায়, নির্বিঘ্ন্নে তাদের এই ব্যবসা পরিচালনার জন্য উপার্জনের
একটা বড় অংশ তুলে দিতে হয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। এর সত্যতা মেলে জেনেভা
ক্যাম্প বাজারের দুই পাশের প্রবেশ দ্বারেই রয়েছে পোশাকি পুলিশের অবস্থান।
আর সেই পুলিশি প্রহরার অদূরে বাজারে পণ্যের মতো চলছে ইয়াবার দর কষাকষি।
মাঝে-মধ্যে বাজারের আশপাশের রাস্তায় তল্লাশি চালিয়ে কিছু ক্রেতা বা
সেবনকারীকে লোক দেখানো আটক কিংবা জরিমানা করা হয়। বিক্রেতারা জানান, ইয়াবা
এখন আর মিয়ানমার বা চট্টগ্রাম থেকে আসে না। এখন খোদ ঢাকা ও এর আশপাশের
এলাকাতেও তৈরি হচ্ছে। দেশের বাইরে থেকে আসা ইয়াবার সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে
তৈরিকৃত প্রয়োজনাধিক ইয়াবার কারণেই এই নেশা অল্প সময়ের মধ্যেই সর্বত্র
বিস্তার লাভ করেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ সদর দপ্তরের তালিকা অনুযায়ী,
ডিএমপি’র বিভাগ অনুযায়ী রমনায় ৫৩টি, লালবাগে ৫৭টি, ওয়ারীতে ৭৭টি, মিরপুরে
৫৬টি, গুলশানে ২৫টি, উত্তরায় ৪০টি, মতিঝিলে ২২টি, তেজগাঁওয়ে ২৫টি চিহ্নিত
মাদক স্পট রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্পটগুলো হচ্ছে, ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বর, টিএসসি, ঢাকা মেডিকেল কলেজের আশপাশ, বুয়েট স্টাফ
কোয়ার্টারের পেছনে, তিন নেতার মাজার, সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান, কাঁটাবন
এলাকা, ফুলবাড়ীয়া, আজিমপুর কবরস্থানের আশপাশ, আজিমপুর মেটার্নিটি
হাসপাতাল-সংলগ্ন এলাকা, ঢাকেশ্বরী মন্দির-সংলগ্ন পিয়ারী বেগমের বাড়ি, দিলু
রোডের পশ্চিম মাথা, মগবাজার রেলক্রসিং-সংলগ্ন কাঁচাবাজার, আমবাগানের
চল্লিশঘর বস্তি, পেয়ারাবাগ বস্তি, মধুবাগ ঝিলপাড়, মালিবাগ রেলক্রসিং থেকে
মগবাজার রেলক্রসিং পর্যন্ত এলাকা, সেক্রেটারিয়েট রোডের আনন্দবাজার বস্তি,
ওসমানী উদ্যান, লালবাগের শহীদনগর ১ থেকে ৬ নং গলি, বালুরঘাট বেড়িবাঁধ,
শহীদনগর পাইপ কারখানা, নবাবগঞ্জ পার্ক, রসূলবাগ পার্ক, কোতোয়ালি থানা
এলাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে এবং কর্মচারীদের স্টাফ কোয়ার্টারের
আশপাশের এলাকা, সামসাবাদ এলাকার জুম্মন কমিউনিটি সেন্টারের আশপাশ, কসাইটুলী
কমিউনিটি সেন্টারের আশপাশ, বাবুবাজার ব্রিজের ঢালে, বুড়ির বাগান, স্টার
সিনেমা হলের সামনে, নয়াবাজার ব্রিজের ঢালে, নয়াবাজার ইউসুফ মার্কেট,
চানখাঁরপুল ট্রাকস্ট্যান্ড, নিমতলী মোড়, কামরাঙ্গীরচর থানা এলাকার ট্যানারি
পুকুরপাড়, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরীক্ষাগার অফিসের পশ্চিম পাশে,
কাপ্তানবাজার মুরগিপট্টি, ধূপখোলা মাঠ, মুন্সীরটেক কবরস্থান, যাত্রাবাড়ী
থানা এলাকার ধলপুর সিটি পল্লী, আইডিয়াল স্কুল গলিসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত
বেচা-কেনা হয় ইয়াবা। সরজমিন জানা যায়, প্রতিটি এলাকাতেই রয়েছে নির্দিষ্ট
মাদক বিক্রেতা। তারাই ইয়াবা নির্দিষ্ট কমিশনের ভিত্তিতে বিভিন্ন ব্যক্তির
মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ ব্যবসা পরিচালনা করেন। তাদের এই ভ্রাম্যমাণ মাদক
ব্যবসায় মোবাইল ফোনের পাশাপাশি ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ
মাধ্যম। তাই সাধারণ মানুষের ধারণা, শিক্ষাকেন্দ্রের আশপাশসহ হাতের নাগালে
এমন ইয়াবা পেয়ে খুব সহজেই আসক্ত হয়ে পড়ছে কোমলমতি কিশোর-তরুণী শিক্ষর্থীরা।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মো. মোস্তফা রাসেল বলেন, ইয়াবা সেবন
করলে অন্যান্য নেশার মতো চোখ লাল বা শরীরে মাতাল মাতাল ভাব হয় না। এজন্যে
প্রথম প্রথম ইয়াবা সেবনকারীদের চলাফেরা দেখে কেউ বুঝতেই পারবে না যে, তারা
কোনো নেশায় আসক্ত। এরই সুযোগ নিয়ে লেখা-পড়াসহ নানা অজুহাত দেখিয়ে
বাবা-মায়ের কাছ থেকে নেয়া টাকা দিয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের বেশির ভাগ সময়ই
বুঁদ হয়ে থাকছেন ইয়াবা সেবনে। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিক্ষাজীবনের
পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়া প্রেমের সম্পর্কের
উত্থান-পতনে হতাশাগ্রস্ত হয়ে অনেক শিক্ষার্থী বেছে নিয়েছেন ইয়াবাকে। মনের
সাময়িক দুঃখ ভুলে থাকতে গিয়ে তারা ডুবে যাচ্ছেন ইয়াবার নেশায়। রাজধানীতে
পড়তে এসে তৈরি হওয়া নতুন বন্ধু-বান্ধবীর সামনে মডার্ন হতে গিয়েও অনেকে
আসক্ত হয়ে পড়ছেন এই নেশায়। ক্ষমতা পিপাসু ছাত্ররা রাজনীতিতে পা দিয়ে নিজের
প্রভাব বিস্তার করতে গিয়েও করছেন ইয়াবা সেবন। ইয়াবা সেবনকারীদের এই তালিকায়
বর্তমানে পুরুষের পাশাপাশি রয়েছে নারীদের নামও। এইসব শিক্ষার্থীর ইয়াবা
সেবনের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ
মাহফুজুল হক মারজান বলেন, সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি’র জন্য বাংলাদেশ
সরকার প্রতিবছর যে অর্থ ব্যয় করে তার থেকে বেশি টাকার ইয়াবা এদেশে
বেচা-কেনা হয়। আর স্বার্থ লাভের জন্য এই ইয়াবা ব্যবসায়ীদের মূল টার্গেট
থাকে আবেগে ভরা তরুণ শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, মূলত আগের তুলনায় আমাদের
বর্তমান তরুণ সমাজ তাদের বেশির ভাগ সময়ই পার করেন ফোন বা কম্পিউটারে মুখ
গুঁজে। অভিবাবকেরাও তেমন একটা খেয়াল রাখেন না তাদের সন্তানের দিকে। আর এ
থেকেই এই শিক্ষিত সমাজের মধ্যে সৃষ্টি হয় একাকিত্বতা ও হীনম্মন্যতা। এ
থেকেই তারা ধীরে ধীরে ঝুঁকে পড়ছেন মরণ নেশা ইয়াবার প্রতি। যদি ইয়াবা
ব্যবসার গডফাদারদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা যায় এবং
সামাজিক সকল স্তর থেকে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা হয়, তাহলেই ইয়াবার
প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব বলে জানান এই অপরাধ বিজ্ঞানী।
No comments