গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ বিরাট চ্যালেঞ্জ by কাজল ঘোষ
আমাদের
রাজনীতির মূল সমস্যা ‘Winner takes all’। এখানে নির্বাচনে যে দল হারছে
তারা প্রায় সর্বহারা হয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনী প্রতিযোগিতা প্রচণ্ড সংঘাতের
রাজনীতি সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে আমাদের নির্বাচিত রাজনৈতিক শাসকগণ সামরিক
শাসকদের অনেকে অগণতান্ত্রিক চর্চা পরিত্যাগ তো করেইনি বরং এগুলোকে তারা
লালন করে নিয়মে পরিণত করেছেন। সংসদে একটি কার্যকর বিরোধী পক্ষের অভাবে আমরা
সরকার প্রক্রিয়ার ভেতর কোনোরকম ‘ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ’ (Check and balance)
পদ্ধতির প্রচলন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছি। যা গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতি টিকিয়ে
রাখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি, আগামীর
বাংলাদেশ আর আমাদের চলমান সংকটের নেপথ্যে কি? এমন নানা প্রশ্নে খোলামেলা
কথা বলেছেন অধ্যাপক রওনক জাহান। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিডিপি)-এর
সম্মানীয় ফেলো রওনক জাহান ১৯৭০ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত
যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড
পাবলিক অ্যাফেয়ার্সে অতিথি অধ্যাপক ছিলেন। বাংলাদেশের উইমেন ফর উইমেন-এর
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, এশিয়া, নিউ ইয়র্ক এবং কর্নেল
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়া প্রোগ্রামের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য রওনক জাহান
আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত বেশকিছু গ্রন্থ ও প্রবন্ধের লেখকও।
অধ্যাপক রওনক জাহান বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ও রাজনীতিকে দেখেছেন খুব কাছে থেকে। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের সংকট ও এর সমাধান নিয়ে খোলামেলা সাক্ষাৎকার পাঠকদের কাছে তুলে ধরা হলো-
আমাদের রাজনীতির মূল সমস্যা কোথায়?
১৯৯১ এর পর থেকে আমরা নির্বাচনী গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবার চেষ্টা করছি। নির্বাচনী গণতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো শান্তিপূর্ণ উপায়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার হস্তান্তর। নির্বাচনে এক দল হারবে, এক দল জিতবে। যারা একবার হারল তারা এর পরের বার আবার জিততেও পারে। নির্বাচনী গণতন্ত্রে বিভিন্ন দলের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা হতে পারে, তবে সেই প্রতিযোগিতা কখনো সংঘাতে পরিণত হওয়া উচিত নয়। আমাদের রাজনীতির মূল সমস্যা হলো আমাদের নির্বাচনী প্রতিযোগিতা একটা প্রচণ্ড সংঘাতের রাজনীতি সৃষ্টি করেছে। যারা নির্বাচনে জিতছেন তারা যারা হারছেন তাদের প্রতি অত্যন্ত অগণতান্ত্রিক আচরণ করছেন। বিরোধী দলের অনেক নেতা-কর্মী জেলে যাচ্ছেন, কিংবা মামলায় পড়ছেন। আমাদের এই Winner takes all রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে দল হারছে তারা প্রায় সর্বহারা হয়ে যাচ্ছে। সংঘাতের রাজনীতির ফলে দুই প্রধান দলের মধ্যে বাদানুবাদ কখনই রাজনৈতিক সংলাপের মধ্যে দিয়ে সমাধান করা যাচ্ছে না। রাজনীতিতে বিভিন্ন দলের মধ্যে মতভেদ থাকতেই পারে, কিন্তু একটা ব্যবস্থা সকল দলকেই মানতে হবে যার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে এই সব মতভেদ নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে এবং সমাধানের বিভিন্ন পথ খুঁজে বের করা যায়। আমাদের দেশের রাজনীতির মূল সমস্যা হলো সকল দলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি ব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলতে পারিনি যার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক বিভেদগুলোর সমাধান করতে পারা যায় এবং শান্তিপূর্ণভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়।
আমাদের এখানে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্তিশালী না হওয়ার পেছনে প্রতিবন্ধকতাগুলো কোথায়?
গত ৪৭ বছর ধরে আমরা রাজনীতি চর্চা এবং শাসনপ্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে এমন কিছু রীতিকে নিয়মে পরিণত করেছি যেগুলো আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্তিশালী হওয়ার জন্য প্রতিবন্ধক। এর মধ্যে কিছু রীতি সামরিক শাসন থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি; দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের নির্বাচিত রাজনৈতিক শাসকগণ সামরিক শাসকদের অনেক অগণতান্ত্রিক চর্চা পরিত্যাগ তো করেইনি, বরং এগুলোকে তারা লালন করে নিয়মে পরিণত করেছেন।
রাষ্ট্রপুষ্ট দল গঠন করা সামরিক শাসনের একটি বৈশিষ্ট্য। যখন কোনো সামরিক শাসক নিজেদেরকে বেসামরিক করে তোলার চিন্তা করে এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন তারা তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক দল গঠন করে। জিয়াউর রহমান গঠন করেছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) আর এরশাদ গঠন করেছিলেন জাতীয় পার্টি। দুঃখের বিষয় সামরিক শাসনের অধীনে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ব্যবহার করে জনসমর্থন ধরে রাখার সংস্কৃতিটি সামরিক শাসন অবসানের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায়নি। রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানকে ক্রমশ দলীয়করণ করার মাধ্যমে এবং বিজয়ী রাজনৈতিক দল বা জোট সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতার ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ফলে ১৯৯১ এর পর থেকে নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্রে এই চর্চা আরো শোচনীয় অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারগুলো জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন এবং নিম্ন আদালতসমূহকে রাজনীতিকরণের প্রয়াস চালিয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন দল বা দলগুলোর সমর্থকদের পুরস্কৃত করা হয়েছে এবং যাদেরকে বিদায়ী সরকারের অনুগত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে বা বর্তমান সরকারের নির্দেশ উপেক্ষা করছে বলে মনে করা হয়েছে তাদেরকে শাস্তির মুখোমুখি করা হয়েছে। আইন প্রয়োগ ব্যবস্থাকেও দলীয় করার চেষ্টা হয়েছে।
বর্তমান সংসদের আগ পর্যন্ত সংসদীয় বিরোধীপক্ষ সবসময় দাবি করে এসেছে যে, সংসদে তাদের কথা বলার যথেষ্ট সুযোগ দেয়া হয় না, ফলে তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে সংসদ অধিবেশন বর্জন করেছে এবং এর পরিবর্তে রাজপথে নির্বাচিত সরকারের পদত্যাগ বা নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার হুমকি দিয়েছে। সংসদে একটি কার্যকরী বিরোধীপক্ষের অভাবে আমরা সরকার প্রক্রিয়ার ভেতরে কোনো রকম ‘ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ’ (পযবপশ ধহফ নধষধহপব) পদ্ধতির প্রচলন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছি, যা গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতি টিকিয়ে রাখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নির্বাহী বিভাগের কার্যক্রম খুঁটিয়ে দেখা এবং এটিকে জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত একটি প্রতিষ্ঠান হলো জাতীয় সংসদ। সংসদীয় তদারকির অভাবে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাহী বিভাগ উত্তরোত্তর ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। প্রশাসন, পুলিশ ও নিম্ন আদালতসমূহ প্রতিনিয়ত দলীয় রাজনৈতিক চাপের মুখোমুখি হয়, ফলে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলো ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েছে।
রাজনীতি আবারো সংকটে- বারবার দেশ একইরকম পরিস্থিতির দিকে কেন ফিরছে?
আমি আগেই বলেছি যতদিন পর্যন্ত না সব রাজনৈতিক দল তাদের নিজেদের মধ্যে মতভেদ এবং শান্তিপূর্ণভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে একটি ব্যবস্থা সম্পর্কে ঐকমত্যে না পৌঁছাতে পারবে ততদিন পর্যন্ত আমরা বারে বারে এই সংকটে পড়বো।
অনেকেই দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের কথা বলে থাকেন- আপনি কি এতে কোনো সমাধান দেখেন?
না আমি এতে কোনো সমাধান দেখি না। আমাদের বিরোধী দলের সাংসদরা ১৯৯৪ সালের পর থেকে ২০১৪ প্রায় বিশ বছর, পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম এবং নবম- চার চারটি সংসদে ক্রমাগত একই ব্যবহার করেছেন। তারা নির্বাচিত হয়েও সংসদ বর্জন করেছেন এবং সংসদকে কার্যকর করার চেষ্টা করেননি। রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা থাকলে একপক্ষ বিশিষ্ট সংসদ কার্যকরী হতো। দ্বিকক্ষ হলেই যে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। উপরন্তু আর একটি কক্ষের সাংসদরাও নিজেদের সুযোগ-সুবিধা এবং প্রভাব বিস্তারের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তে পারেন। তাতে আমাদের রাজনীতির গুণগত কোনো পরিবর্তন হবে না।
উন্নয়ন আগে, গণতন্ত্র পরে- এ কথাটি নানাভাবে আলোচনায়। আপনার কি মনে হয়?
এই আলোচনা একেবারেই অবান্তর এবং যুক্তিহীন। দুটোই একে অপরের সম্পূরক। দুটোই জনগণ চায় এবং এক সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া উচিত।
দেশ আবারো একদলীয় শাসনের দিকে এগুচ্ছে বলে আপনি বলেছেন- কেন এমনটা মনে হচ্ছে?
দেশ একদলীয় শাসনের দিকে এগুচ্ছে এমন কথা আমি বলিনি। আমি বলেছি স্বাধীনতা পরবর্তী সময় আমাদের দেশে বহুদলের মধ্যে একটি মাত্র দল (আওয়ামী লীগ) প্রধান ছিল যেমন ভারতে স্বাধীনতার পর বহু বছর কংগ্রেস এরকম অবস্থায় ছিল। ১৯৯১ এর পর থেকে আমরা দেখেছি আমাদের দেশে দু’টি প্রধান দল (আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি) পালা বদল করে ক্ষমতায় এসেছে। তখন মনে হচ্ছিল আমরা যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের মতো দুই প্রধান দল বিশিষ্ট দলীয় ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু ২০০৮ এর পর থেকে বিএনপি আর ক্ষমতায় আসেনি। বর্তমানে তাদেরকে অনেক দুর্বল মনে হয় এবং দেশে এখন আবার বহুদলের মধ্যে একটি দল (আওয়ামী লীগ) প্রধান হয়ে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে। একদলীয় শাসন এবং বহুদলের মধ্যে একটি প্রধান দলের শাসন দুটি দুই রকম দলীয় ব্যবস্থা।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি যেদিকে এগুচ্ছে তাতে ভবিষ্যৎ কোনদিকে যাচ্ছে বলে মনে করেন?
স্বাধীনতার পর থেকে ক্রমান্বয়ে আমাদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নতি যথেষ্ট হয়েছে এবং ভবিষতেও ভালো হবে বলে মনে হচ্ছে। তবে রাজনৈতিক উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এখনো আমাদের সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ।
অধ্যাপক রওনক জাহান বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ও রাজনীতিকে দেখেছেন খুব কাছে থেকে। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের সংকট ও এর সমাধান নিয়ে খোলামেলা সাক্ষাৎকার পাঠকদের কাছে তুলে ধরা হলো-
আমাদের রাজনীতির মূল সমস্যা কোথায়?
১৯৯১ এর পর থেকে আমরা নির্বাচনী গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবার চেষ্টা করছি। নির্বাচনী গণতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো শান্তিপূর্ণ উপায়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার হস্তান্তর। নির্বাচনে এক দল হারবে, এক দল জিতবে। যারা একবার হারল তারা এর পরের বার আবার জিততেও পারে। নির্বাচনী গণতন্ত্রে বিভিন্ন দলের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা হতে পারে, তবে সেই প্রতিযোগিতা কখনো সংঘাতে পরিণত হওয়া উচিত নয়। আমাদের রাজনীতির মূল সমস্যা হলো আমাদের নির্বাচনী প্রতিযোগিতা একটা প্রচণ্ড সংঘাতের রাজনীতি সৃষ্টি করেছে। যারা নির্বাচনে জিতছেন তারা যারা হারছেন তাদের প্রতি অত্যন্ত অগণতান্ত্রিক আচরণ করছেন। বিরোধী দলের অনেক নেতা-কর্মী জেলে যাচ্ছেন, কিংবা মামলায় পড়ছেন। আমাদের এই Winner takes all রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে দল হারছে তারা প্রায় সর্বহারা হয়ে যাচ্ছে। সংঘাতের রাজনীতির ফলে দুই প্রধান দলের মধ্যে বাদানুবাদ কখনই রাজনৈতিক সংলাপের মধ্যে দিয়ে সমাধান করা যাচ্ছে না। রাজনীতিতে বিভিন্ন দলের মধ্যে মতভেদ থাকতেই পারে, কিন্তু একটা ব্যবস্থা সকল দলকেই মানতে হবে যার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে এই সব মতভেদ নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে এবং সমাধানের বিভিন্ন পথ খুঁজে বের করা যায়। আমাদের দেশের রাজনীতির মূল সমস্যা হলো সকল দলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি ব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলতে পারিনি যার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক বিভেদগুলোর সমাধান করতে পারা যায় এবং শান্তিপূর্ণভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করা যায়।
আমাদের এখানে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্তিশালী না হওয়ার পেছনে প্রতিবন্ধকতাগুলো কোথায়?
গত ৪৭ বছর ধরে আমরা রাজনীতি চর্চা এবং শাসনপ্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে এমন কিছু রীতিকে নিয়মে পরিণত করেছি যেগুলো আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো শক্তিশালী হওয়ার জন্য প্রতিবন্ধক। এর মধ্যে কিছু রীতি সামরিক শাসন থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি; দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের নির্বাচিত রাজনৈতিক শাসকগণ সামরিক শাসকদের অনেক অগণতান্ত্রিক চর্চা পরিত্যাগ তো করেইনি, বরং এগুলোকে তারা লালন করে নিয়মে পরিণত করেছেন।
রাষ্ট্রপুষ্ট দল গঠন করা সামরিক শাসনের একটি বৈশিষ্ট্য। যখন কোনো সামরিক শাসক নিজেদেরকে বেসামরিক করে তোলার চিন্তা করে এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন তারা তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক দল গঠন করে। জিয়াউর রহমান গঠন করেছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) আর এরশাদ গঠন করেছিলেন জাতীয় পার্টি। দুঃখের বিষয় সামরিক শাসনের অধীনে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ব্যবহার করে জনসমর্থন ধরে রাখার সংস্কৃতিটি সামরিক শাসন অবসানের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায়নি। রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানকে ক্রমশ দলীয়করণ করার মাধ্যমে এবং বিজয়ী রাজনৈতিক দল বা জোট সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতার ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ফলে ১৯৯১ এর পর থেকে নির্বাচনভিত্তিক গণতন্ত্রে এই চর্চা আরো শোচনীয় অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারগুলো জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন এবং নিম্ন আদালতসমূহকে রাজনীতিকরণের প্রয়াস চালিয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন দল বা দলগুলোর সমর্থকদের পুরস্কৃত করা হয়েছে এবং যাদেরকে বিদায়ী সরকারের অনুগত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে বা বর্তমান সরকারের নির্দেশ উপেক্ষা করছে বলে মনে করা হয়েছে তাদেরকে শাস্তির মুখোমুখি করা হয়েছে। আইন প্রয়োগ ব্যবস্থাকেও দলীয় করার চেষ্টা হয়েছে।
বর্তমান সংসদের আগ পর্যন্ত সংসদীয় বিরোধীপক্ষ সবসময় দাবি করে এসেছে যে, সংসদে তাদের কথা বলার যথেষ্ট সুযোগ দেয়া হয় না, ফলে তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে সংসদ অধিবেশন বর্জন করেছে এবং এর পরিবর্তে রাজপথে নির্বাচিত সরকারের পদত্যাগ বা নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার হুমকি দিয়েছে। সংসদে একটি কার্যকরী বিরোধীপক্ষের অভাবে আমরা সরকার প্রক্রিয়ার ভেতরে কোনো রকম ‘ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ’ (পযবপশ ধহফ নধষধহপব) পদ্ধতির প্রচলন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছি, যা গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতি টিকিয়ে রাখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নির্বাহী বিভাগের কার্যক্রম খুঁটিয়ে দেখা এবং এটিকে জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত একটি প্রতিষ্ঠান হলো জাতীয় সংসদ। সংসদীয় তদারকির অভাবে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাহী বিভাগ উত্তরোত্তর ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। প্রশাসন, পুলিশ ও নিম্ন আদালতসমূহ প্রতিনিয়ত দলীয় রাজনৈতিক চাপের মুখোমুখি হয়, ফলে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলো ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েছে।
রাজনীতি আবারো সংকটে- বারবার দেশ একইরকম পরিস্থিতির দিকে কেন ফিরছে?
আমি আগেই বলেছি যতদিন পর্যন্ত না সব রাজনৈতিক দল তাদের নিজেদের মধ্যে মতভেদ এবং শান্তিপূর্ণভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে একটি ব্যবস্থা সম্পর্কে ঐকমত্যে না পৌঁছাতে পারবে ততদিন পর্যন্ত আমরা বারে বারে এই সংকটে পড়বো।
অনেকেই দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের কথা বলে থাকেন- আপনি কি এতে কোনো সমাধান দেখেন?
না আমি এতে কোনো সমাধান দেখি না। আমাদের বিরোধী দলের সাংসদরা ১৯৯৪ সালের পর থেকে ২০১৪ প্রায় বিশ বছর, পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম এবং নবম- চার চারটি সংসদে ক্রমাগত একই ব্যবহার করেছেন। তারা নির্বাচিত হয়েও সংসদ বর্জন করেছেন এবং সংসদকে কার্যকর করার চেষ্টা করেননি। রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা থাকলে একপক্ষ বিশিষ্ট সংসদ কার্যকরী হতো। দ্বিকক্ষ হলেই যে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। উপরন্তু আর একটি কক্ষের সাংসদরাও নিজেদের সুযোগ-সুবিধা এবং প্রভাব বিস্তারের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তে পারেন। তাতে আমাদের রাজনীতির গুণগত কোনো পরিবর্তন হবে না।
উন্নয়ন আগে, গণতন্ত্র পরে- এ কথাটি নানাভাবে আলোচনায়। আপনার কি মনে হয়?
এই আলোচনা একেবারেই অবান্তর এবং যুক্তিহীন। দুটোই একে অপরের সম্পূরক। দুটোই জনগণ চায় এবং এক সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া উচিত।
দেশ আবারো একদলীয় শাসনের দিকে এগুচ্ছে বলে আপনি বলেছেন- কেন এমনটা মনে হচ্ছে?
দেশ একদলীয় শাসনের দিকে এগুচ্ছে এমন কথা আমি বলিনি। আমি বলেছি স্বাধীনতা পরবর্তী সময় আমাদের দেশে বহুদলের মধ্যে একটি মাত্র দল (আওয়ামী লীগ) প্রধান ছিল যেমন ভারতে স্বাধীনতার পর বহু বছর কংগ্রেস এরকম অবস্থায় ছিল। ১৯৯১ এর পর থেকে আমরা দেখেছি আমাদের দেশে দু’টি প্রধান দল (আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি) পালা বদল করে ক্ষমতায় এসেছে। তখন মনে হচ্ছিল আমরা যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের মতো দুই প্রধান দল বিশিষ্ট দলীয় ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু ২০০৮ এর পর থেকে বিএনপি আর ক্ষমতায় আসেনি। বর্তমানে তাদেরকে অনেক দুর্বল মনে হয় এবং দেশে এখন আবার বহুদলের মধ্যে একটি দল (আওয়ামী লীগ) প্রধান হয়ে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে। একদলীয় শাসন এবং বহুদলের মধ্যে একটি প্রধান দলের শাসন দুটি দুই রকম দলীয় ব্যবস্থা।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি যেদিকে এগুচ্ছে তাতে ভবিষ্যৎ কোনদিকে যাচ্ছে বলে মনে করেন?
স্বাধীনতার পর থেকে ক্রমান্বয়ে আমাদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নতি যথেষ্ট হয়েছে এবং ভবিষতেও ভালো হবে বলে মনে হচ্ছে। তবে রাজনৈতিক উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এখনো আমাদের সামনে বিরাট চ্যালেঞ্জ।
No comments