জীবনের গল্পটা অল্পই! by রফিকুজজামান রুমান
শাওন
ও শশী। এই দম্পতি বিয়ের সপ্তম বার্ষিকী উদযাপন করতে যাচ্ছিলেন নেপালে।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্লেন ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফেসবুকে
শশীর স্ট্যাটাস- “এবং যাত্রা হলো শুরু!” সৌন্দর্যের শিহরণ ছড়ানো নেপালে
নামার ঠিক আগ মুহূর্তে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে শুরু হলো ভিন্ন এক ‘যাত্রা।’
কী রঙিন স্বপ্ন এঁকে জীবনের গল্পগুলো সাজাতে চেয়েছিলেন শাওন ও শশী! অথচ
মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু তছনছ করে দিয়ে আজীবনের জন্য জীবনকে বিদায় জানালেন
শশী! মনে করিয়ে দিয়ে গেলেন- জীবনের গল্পটা কত সামান্য!
যশোরের সাবেরুল হকের গল্পটাই বা কেমন। ছোট্ট নাতি অনিরুদ্ধ হক বাবা মায়ের সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছিল নেপালে। যাওয়ার তিন দিন আগে নানার সঙ্গে কথা হয় নাতির। বলেছিল, নেপাল থেকে ফিরে নানা-বাড়ি বেড়াতে যাবে। বাবা-মা সহ তিনজনেরই মৃত্যু হয় নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে। নানার কাছে ফেরা হলো না অনিরুদ্ধের। বাবার কাছে ফেরা হলো না মা সানজিদা হকের। বাবা রফিকুজজামানও পাড়ি জমালেন এমন এক জগতে যেখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না। অনিরুদ্ধের কাছে জীবন মানে কী? জীবন শুরু করার আগেই তার জীবনের গল্পটা শেষ!
কিংবা দুর্ঘটনায় নিহত কো-পাইলট পৃথুলার গল্পটাও কেমন অবেলায় সমাপ্ত হলো! বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। স্বপ্ন আর সম্ভাবনার কোনো আকুতির কাছেই হার মানতে চায়নি ভাগ্যের নির্মমতা। গল্পের ডালপালাগুলো ফুলে ফলে সুশোভিত হওয়ার আগেই লিখে ফেলা হলো চীর পরিসমাপ্তি।
এমন আরো অর্ধশতাধিক জীবনের গল্প থেমে গেল নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে। যেহেতু বিমান বিধ্বস্তের ঘটনাটি একটি দুর্ঘটনা। কারো না কারো দায় কিংবা অবহেলা নিশ্চয়ই রয়েছে। কিন্তু সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তা বের হয়ে এলেও জীবনগুলো আর ফিরে আসবে না। দোষীদের বিচারের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে হয়ত রচিত হবে অন্য কোনো গল্প। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া গল্পকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। এই হলো জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য। নেপালে বিমান ধ্বংসের ঘটনা সেই চীর সত্য’রই এক টুকরো বয়ান। এই সত্য কারো জন্য অপেক্ষা করে না। এই গল্পের চিত্রনাট্য বড় অনিশ্চয়তায় ভরপুর!
কিংবদন্তি শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর কথা আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে। ২০১৪ সালের ৩০শে নভেম্বর বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীতের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করছিলেন তিনি। একপর্যায়ে ডায়াসে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, “আমার একটি কথা বলার...।” আর বলতে পারলেন না। যে কথাটি বলার ছিল, সেটি বলা হলো না। বলা গেল না। মৃত্যু এসে কী নিদারুণভাবে থামিয়ে দিয়ে গেল সবকিছু! কথা ফুরালো। জীবন ফুরালো। ফুরিয়ে গেল জীবনের গল্পটাও। অথচ আরো কতকিছু দেয়ার ছিল তাঁর। এই দেশকে নিয়ে, দেশের শিল্পচর্চা নিয়ে কত ভাবনা ছিল। সবকিছু তুচ্ছ হয়ে যায় ঐ মৃত্যুর কাছে। গল্পটা হঠাৎ করেই থেমে যায়। মহাকালের হিসেবে সেই গল্পটা কত অল্প!
মনে পড়ে যায় জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী ফিরোজ সাঁই এর কথা। ১৯৯৫ সালের ১২ই জানুয়ারি শিল্পকলা একাডেমিতে চলছিল গানের উৎসব। ফিরোজ সাঁই এর গানে মাতোয়ারা হাজার হাজার দর্শক। একপর্যায়ে গাওয়া শুরু করলেন, “এক সেকেন্ডের নাই ভরসা/বন্ধ হইবে রঙ তামাশা।” গান শেষ হওয়ার আগেই শেষ হয়ে গেল জীবন, জীবনের সমস্ত ‘তামাশা।’ “এক সেকেন্ডের নাই ভরসা” গেয়ে মঞ্চ মাতানো শিল্পীই প্রমাণ করলেন এই কথা কী ভয়ানক রকমের সত্যি! গান গাইতে গাইতেই চলে গেলেন। গল্পটা নিজের মতো করে লেখা হলো না; কারোরই হয় না।
তবু আমাদের কতো অহংকার! অবিরাম স্বার্থের পেছনে ছুটে চলা। যুদ্ধ বিগ্রহ, হানাহানি, ক্ষমতা, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, দুর্নীতি, মিথ্যা, কলুষতা- এসব নিয়েই আমাদের দিনযাপন। আরো চাই, আরো চাই। আমাদের প্রয়োজন শেষ হয়, চাওয়া শেষ হয় না। বিত্ত-বৈভব আর ক্ষমতার লোভে ভুলে যেতে বসেছি জীবনের সবচেয়ে বড় অনিবার্যতা। আজ এই মুহূর্তে যে জন্ম গ্রহণ করেছে, সবকিছুকে বাদ দিয়ে অন্তত একটি সত্যকে সঙ্গী করে সে এসেছে যে, তাকে মরে যেতে হবে। এবং সেটি যে কোনো সময়! তাহলে কেন এই দাম্ভিকতা? কেন স্বার্থপর বেঁচে থাকা? পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তিও মরবে, মরে যাবে সবচেয়ে বেশি বিত্ত-বৈভবের অধিকারী লোকটিও। কোনো কিছুর বিনিময়েই শেষ পর্যন্ত মৃত্যুকে ঠেকানো যায় না। শত দম্ভ, অহংকার, অট্টালিকা নিমিষেই শেষ!
বিমানের যাত্রীদের কেউ হয়ত ভাবেননি তারা আর ফিরে আসবেন না। কাইয়ুম চৌধুরী হয়ত কল্পনাও করেননি এটাই তাঁর শেষ বক্তব্য। ফিরোজ সাঁই হয়ত সাজিয়ে নিয়েছিলেন আরো আরো কত পরিকল্পনা! সবকিছুই হার মানে মৃত্যু নামক ঐ অনিবার্য বাস্তবতার কাছে। এই লেখাটি ছাপা হবে, আমি সেটি দেখব- এই নিশ্চয়তাই বা আমাকে কে দিতে পারে? জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের একটি গান আছে- ‘জীবনের গল্প, আছে বাকি অল্প। যা কিছু দেখার নাও দেখে নাও, যা কিছু বলার যাও বলে যাও, পাবে না সময় আর হয়ত।’ কী নির্মম সত্য এই গানের কথায় ফুটে উঠেছে! সত্যিই তো আমাদের কারোর সময় নেই! এই ফুরলো বুঝি জীবনের গল্প! ‘যাচ্ছি’- এই কথাটি বলে যাওয়ার সময়ও হয়ত আমরা পাব না। জীবনের গল্পটা অল্পই! শেষ হয়ে যাওয়ার আগে তাই বিনয়ী হই, নিরহংকার হই, নির্লোভ হই। পরের জন্য কিছু করি। ভালো কিছু করি। চারদিকে এত মৃত্যু; তবু সেই মৃত্যুর কথা কীভাবে ভুলে যাই! নেপালের ঐ উড়োজাহাজে আমি থাকলে আমার গল্পটাও এতক্ষণে পুরনো হয়ে যেত!
যশোরের সাবেরুল হকের গল্পটাই বা কেমন। ছোট্ট নাতি অনিরুদ্ধ হক বাবা মায়ের সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছিল নেপালে। যাওয়ার তিন দিন আগে নানার সঙ্গে কথা হয় নাতির। বলেছিল, নেপাল থেকে ফিরে নানা-বাড়ি বেড়াতে যাবে। বাবা-মা সহ তিনজনেরই মৃত্যু হয় নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে। নানার কাছে ফেরা হলো না অনিরুদ্ধের। বাবার কাছে ফেরা হলো না মা সানজিদা হকের। বাবা রফিকুজজামানও পাড়ি জমালেন এমন এক জগতে যেখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না। অনিরুদ্ধের কাছে জীবন মানে কী? জীবন শুরু করার আগেই তার জীবনের গল্পটা শেষ!
কিংবা দুর্ঘটনায় নিহত কো-পাইলট পৃথুলার গল্পটাও কেমন অবেলায় সমাপ্ত হলো! বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। স্বপ্ন আর সম্ভাবনার কোনো আকুতির কাছেই হার মানতে চায়নি ভাগ্যের নির্মমতা। গল্পের ডালপালাগুলো ফুলে ফলে সুশোভিত হওয়ার আগেই লিখে ফেলা হলো চীর পরিসমাপ্তি।
এমন আরো অর্ধশতাধিক জীবনের গল্প থেমে গেল নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে। যেহেতু বিমান বিধ্বস্তের ঘটনাটি একটি দুর্ঘটনা। কারো না কারো দায় কিংবা অবহেলা নিশ্চয়ই রয়েছে। কিন্তু সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে তা বের হয়ে এলেও জীবনগুলো আর ফিরে আসবে না। দোষীদের বিচারের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে হয়ত রচিত হবে অন্য কোনো গল্প। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া গল্পকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। এই হলো জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য। নেপালে বিমান ধ্বংসের ঘটনা সেই চীর সত্য’রই এক টুকরো বয়ান। এই সত্য কারো জন্য অপেক্ষা করে না। এই গল্পের চিত্রনাট্য বড় অনিশ্চয়তায় ভরপুর!
কিংবদন্তি শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর কথা আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে। ২০১৪ সালের ৩০শে নভেম্বর বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীতের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করছিলেন তিনি। একপর্যায়ে ডায়াসে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, “আমার একটি কথা বলার...।” আর বলতে পারলেন না। যে কথাটি বলার ছিল, সেটি বলা হলো না। বলা গেল না। মৃত্যু এসে কী নিদারুণভাবে থামিয়ে দিয়ে গেল সবকিছু! কথা ফুরালো। জীবন ফুরালো। ফুরিয়ে গেল জীবনের গল্পটাও। অথচ আরো কতকিছু দেয়ার ছিল তাঁর। এই দেশকে নিয়ে, দেশের শিল্পচর্চা নিয়ে কত ভাবনা ছিল। সবকিছু তুচ্ছ হয়ে যায় ঐ মৃত্যুর কাছে। গল্পটা হঠাৎ করেই থেমে যায়। মহাকালের হিসেবে সেই গল্পটা কত অল্প!
মনে পড়ে যায় জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী ফিরোজ সাঁই এর কথা। ১৯৯৫ সালের ১২ই জানুয়ারি শিল্পকলা একাডেমিতে চলছিল গানের উৎসব। ফিরোজ সাঁই এর গানে মাতোয়ারা হাজার হাজার দর্শক। একপর্যায়ে গাওয়া শুরু করলেন, “এক সেকেন্ডের নাই ভরসা/বন্ধ হইবে রঙ তামাশা।” গান শেষ হওয়ার আগেই শেষ হয়ে গেল জীবন, জীবনের সমস্ত ‘তামাশা।’ “এক সেকেন্ডের নাই ভরসা” গেয়ে মঞ্চ মাতানো শিল্পীই প্রমাণ করলেন এই কথা কী ভয়ানক রকমের সত্যি! গান গাইতে গাইতেই চলে গেলেন। গল্পটা নিজের মতো করে লেখা হলো না; কারোরই হয় না।
তবু আমাদের কতো অহংকার! অবিরাম স্বার্থের পেছনে ছুটে চলা। যুদ্ধ বিগ্রহ, হানাহানি, ক্ষমতা, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, দুর্নীতি, মিথ্যা, কলুষতা- এসব নিয়েই আমাদের দিনযাপন। আরো চাই, আরো চাই। আমাদের প্রয়োজন শেষ হয়, চাওয়া শেষ হয় না। বিত্ত-বৈভব আর ক্ষমতার লোভে ভুলে যেতে বসেছি জীবনের সবচেয়ে বড় অনিবার্যতা। আজ এই মুহূর্তে যে জন্ম গ্রহণ করেছে, সবকিছুকে বাদ দিয়ে অন্তত একটি সত্যকে সঙ্গী করে সে এসেছে যে, তাকে মরে যেতে হবে। এবং সেটি যে কোনো সময়! তাহলে কেন এই দাম্ভিকতা? কেন স্বার্থপর বেঁচে থাকা? পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তিও মরবে, মরে যাবে সবচেয়ে বেশি বিত্ত-বৈভবের অধিকারী লোকটিও। কোনো কিছুর বিনিময়েই শেষ পর্যন্ত মৃত্যুকে ঠেকানো যায় না। শত দম্ভ, অহংকার, অট্টালিকা নিমিষেই শেষ!
বিমানের যাত্রীদের কেউ হয়ত ভাবেননি তারা আর ফিরে আসবেন না। কাইয়ুম চৌধুরী হয়ত কল্পনাও করেননি এটাই তাঁর শেষ বক্তব্য। ফিরোজ সাঁই হয়ত সাজিয়ে নিয়েছিলেন আরো আরো কত পরিকল্পনা! সবকিছুই হার মানে মৃত্যু নামক ঐ অনিবার্য বাস্তবতার কাছে। এই লেখাটি ছাপা হবে, আমি সেটি দেখব- এই নিশ্চয়তাই বা আমাকে কে দিতে পারে? জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের একটি গান আছে- ‘জীবনের গল্প, আছে বাকি অল্প। যা কিছু দেখার নাও দেখে নাও, যা কিছু বলার যাও বলে যাও, পাবে না সময় আর হয়ত।’ কী নির্মম সত্য এই গানের কথায় ফুটে উঠেছে! সত্যিই তো আমাদের কারোর সময় নেই! এই ফুরলো বুঝি জীবনের গল্প! ‘যাচ্ছি’- এই কথাটি বলে যাওয়ার সময়ও হয়ত আমরা পাব না। জীবনের গল্পটা অল্পই! শেষ হয়ে যাওয়ার আগে তাই বিনয়ী হই, নিরহংকার হই, নির্লোভ হই। পরের জন্য কিছু করি। ভালো কিছু করি। চারদিকে এত মৃত্যু; তবু সেই মৃত্যুর কথা কীভাবে ভুলে যাই! নেপালের ঐ উড়োজাহাজে আমি থাকলে আমার গল্পটাও এতক্ষণে পুরনো হয়ে যেত!
No comments