মোদির নোট বাতিল এবার আসল পরীক্ষার মুখে
গোটা রাজ্যে ভোটযুদ্ধটা ত্রিমুখী হলেও পশ্চিম উত্তর প্রদেশের এই জাঠভূমিতে চতুর্থ একটা শক্তিকে আজ পর্যন্ত কেউ কোনো দিন উপেক্ষা করতে পারেনি। এবারও তেমন করার ক্ষমতা কারও নেই। চতুর্থ সেই শক্তিকে এখনো যিনি চালিয়ে আসছেন, অদৃশ্য তিনি আজ বহুদিন। কৃষকনেতা চরণ সিং। ৩০ বছর আগে তিনি পরপারে চলে যান। যাওয়ার দুই বছর আগে অনেক বুঝিয়ে একমাত্র পুত্র অজিতকে মার্কিন মুলুক থেকে দেশে ফিরিয়ে আনেন।
কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ছেলেকে বলেছিলেন, তুমি না দেখলে এই সাম্রাজ্যের দেখভাল করবেটা কে? খড়্গপুর আইআইটি থেকে পাস করে বিদেশ চলে যাওয়া ছেলে অজিত সিং দেশে ফিরে লোকদলের হাল ধরার পর একদিন এই কাহিনি শুনিয়ে বলেছিলেন, ‘রাজনীতি করব না বলেই দেশ ছেড়েছিলাম। অথচ সেই রাজনীতি আমায় দেশে টেনে আনল! বাবার ডাক ফেরাতে পারলাম না।’ বাবা যা করেছিলেন, একমাত্র পুত্র জয়ন্তর সঙ্গেও ঠিক সেটাই করেন অজিত সিং। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস থেকে পড়িয়ে ছেলেকে দেশে এনে অজিত রাজ্যপাট তাঁরই হাতে সঁপে দিয়েছেন। এবার উত্তর প্রদেশের ভোটের প্রধান আকর্ষণ যদি হয় রাহুল-অখিলেশের যুব নেতৃত্ব, ৩৮ বছরের জয়ন্ত তাহলে সেই চরিত্রের সঙ্গে পুরোপুরি মানানসই। ৭৭ বছরের বাবার কাঁধ থেকে জোয়াল নিয়ে রাষ্ট্রীয় লোকদলকে প্রাসঙ্গিক রাখার দায়িত্বটা মথুরার এই সাবেক সাংসদই নিয়েছেন। একটা সময় ছিল যখন চরণ সিংয়ের ইশারা না পেলে এই তল্লাটের গাছের পাতাও নড়ত না। সেই সুদিন অজিত সিংও তাঁর আমলে কিছুকাল দেখেছেন। কিন্তু আজ বহুদিন হলো সেই বোলবোলা উধাও। ২০১২ সালে পশ্চিম উত্তর প্রদেশে ৪৬টা আসনে লড়ে অজিত-জয়ন্ত মাত্র নয়টায় জিততে পেরেছিলেন। আর তার দুই বছর পর লোকসভা ভোটে তো ঝাড়েবংশে শেষ।
সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে এবার মাথা তুলে তাঁরা দাঁড়াতে চাইছেন দুটি রাজনৈতিক ঘটনা ঘটে গেছে বলেই। মিরাটে চরণ সিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ফতে সিং রানা ও বাগপতের সম্পন্ন চাষি নিশান্ত সিং সেই দুই রাজনৈতিক ঘটনার ব্যাখ্যা দিলেন এক ঢঙে। প্রথম ঘটনা মজফফরনগরের দাঙ্গা, যা জাঠ ও মুসলমানদের মধ্যে ঘটেছিল, দ্বিতীয় ঘটনা একেবারে লাগোয়া রাজ্য হরিয়ানায় জাঠদের জন্য সংরক্ষণের আন্দোলন। দুটি ক্ষেত্রেই জাঠদের রাগ শাসক দল বিজেপির ওপর। ফতে সিং রানার কথায়, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদিকে ঢালাও সমর্থন দেওয়া সত্ত্বেও রাজ্যের বিজেপি জনপ্রতিনিধিরা দাঙ্গা থামাতে এবং জাঠদের বিরুদ্ধে আক্রমণ রুখতে ব্যর্থ হন। একইভাবে সংরক্ষণের প্রশ্নে হরিয়ানার বিজেপি সরকারকে দিল্লির মোদি সরকার বিন্দুমাত্র সহায়তা করেনি। ফলে ভোটের মুখে হরিয়ানার জাঠেরা নতুন করে যে আন্দোলনে শামিল হয়েছে, তার ঢেউ পশ্চিম উত্তর প্রদেশের জাঠমননেও ছায়া ফেলেছে। বিজেপির পক্ষে এটা ভালো লক্ষণ নয়। দাঙ্গা ও সংরক্ষণের পাশাপাশি সর্বজনীন হয়ে গেছে যে সমস্যা, তার দায়ও পুরোপুরি নরেন্দ্র মোদির। সেই সমস্যা হলো নোটবন্দী, অর্থাৎ ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত। নোটবন্দীর মার কী রকম, বাগপতের রাষ্ট্রীয় লোকদল প্রার্থী কারতার সিং ভারানা তার একটা ছবি এঁকে দিলেন। তাঁর কথায়, ‘পরপর দুবছরের অসময়ের বৃষ্টিতে চাষবাসের যে ক্ষতিটা এবার পুষিয়ে নেওয়ার কথা চাষিরা ভেবেছিল, নোটবন্দী সেই গুড়ে বালি ঢেলে দেয়। অবস্থাটা একবার ভাবুন। মাঠে কাটার অপেক্ষায় খরিফ শস্য, আর বোনার অপেক্ষায় রবি ফসল। ঠিক এই মোক্ষম মুহূর্তটাতেই এল নোটবন্দী। না পারা গেল কৃষিশ্রমিকদের মজুরি দিতে, না পারা গেল খেতের ফসল মান্ডিতে নিয়ে যাওয়া। মান্ডির আড়তদারেরা চেক পেমেন্ট করল। ব্যাংকে হত্যে দিয়ে পড়ে থেকেও সময়মতো সেই চেক ভাঙানো গেল না। মজুরেরা বিহার ফিরে গেল। বলে গেল, হাল ফিরলে আসবে। জমি পড়েই থাকল। রবি ফসল বোনাই গেল না।’ কারতার সিং ভারানা জাতে গুজ্জর। অর্থাৎ গোয়ালা। অজিত-জয়ন্ত এই জাঠভূমিতে তাঁকে প্রার্থী করেছেন বাড়তি হিসেবে গুজ্জর ভোটের পাশাপাশি কিছু মুসলমান সমর্থনের আশায়। ঢালাও জাঠ সমর্থনে এবার সন্দেহ আছে বলেই বিজেপির প্রচারে ব্যাপকভাবে উঠে আসছে দাঙ্গাবৃত্তান্ত।
গোরক্ষপুরের সাংসদ যোগী আদিত্যনাথ, উন্নাওয়ের সাক্ষী মহারাজ ও পশ্চিম উত্তর প্রদেশের সারধানার বিধায়ক সংগীত সোমদের রেকর্ড করা ভাষণ দেদার বাজছে। সেই ভাষণের বাক্যে বাক্যে মুসলমানদের মোকাবিলায় হিন্দু জাগরণের সংকল্প ঝরে পড়ছে। আর্যাবর্তের ভোটে ধর্মীয় মেরুকরণের প্রচেষ্টায় এ এক অতিপরিচিত দৃশ্য। বিজেপির রাজ্য নেতাদের এই রাজনীতি মুসলমান মেরুকরণের সহায়ক। বারবার সেটাই দেখে আসছে এই রাজ্য। ২০ শতাংশ সেই মুসলমানের মন জিততে একদিকে মায়াবতী অন্যদিকে অখিলেশ-রাহুল জুটি রাজ্য চষে ফেলছেন। কী করবে মুসলমান সমাজ? বাগপত থেকে মুজফফরনগর যেতে খাতৌলি থানার বাঙ্গেলা গ্রামের রহমত মসজিদের ইমাম মকসুদ আহমেদ সেই প্রশ্নের চমৎকার জবাব দিলেন। ‘আমাদের প্রথম পছন্দ অখিলেশ। রাহুল হাত বাড়াতে সেই পছন্দ আরও বেড়েছে। যেখানে জোটের প্রার্থী দুর্বল অথবা বদনামি, সেখানে মায়াবতীর প্রার্থী দ্বিতীয় পছন্দ।’ কিন্তু মায়াবতী তো মুসলমান মন জিততে উঠেপড়ে লেগেছেন? ইমাম সাহেব প্রশ্নটা শুনে একটু হাসলেন। তারপর বললেন, ‘‘আর যাই হোক অখিলেশ ও রাহুল কখনো বিজেপির সঙ্গে হাত মেলাবেন না। বহেনজি মায়াবতী সম্পর্কে জোর দিয়ে এই কথাটা বলা যায় না। ওঁর অতীতটা একটু দেখে নিন।’ বিধানসভা ত্রিশঙ্কু হলে কী করবেন মায়াবতী, মুসলমান সমাজে রীতিমতো চর্চা তা নিয়েও। অতীতে তিনি বারবার বলেছেন, ক্ষমতালাভের জন্য কেউই অচ্ছ্যুত নয়। মায়াবতীর অতীতও তাঁর পরিচয়। সেই পরিচয়ই মুসলমান হৃদয়ে কিছুটা হলেও অখিলেশদের এগিয়ে রেখেছে।
No comments