মুক্ত বিশ্বের নেতা নিজেকে আবদ্ধ করছেন কেন?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অনেক ক্ষেত্রেই মুক্ত বিশ্বের নেতা বলা হয়। দেশটির আয়তন, জনসংখ্যা, প্রযুক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ, সমরশক্তি ও সর্বোপরি বিশাল অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য এ নেতৃত্ব দেশটির ওপর বর্তায়। সে দেশে নতুন প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নিয়ে তাঁর নিকট প্রতিবেশী মেক্সিকো সীমান্তে উঁচু ও দুর্ভেদ্য দেয়াল দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ফলে তিনি অবগুণ্ঠনের আড়াল করে ফেলছেন তাঁর নিজ দেশটিকেও। আকাশে দেয়াল দেওয়া যায় না। বিমানযোগে আসা যাত্রীদেরও সে দেশের ইমিগ্রেশনের বেড়াজাল আটকে দিচ্ছে। ভিসা নিষিদ্ধ করেছেন কয়েকটি বিশেষ দেশের নাগরিকদের। এমনকি সে দেশগুলোতে ইতিপূর্বে যাঁদের ভিসা দেওয়া হয়েছিল, তা-ও বাতিলের নির্দেশ দিয়েছেন। গ্রিন কার্ডধারী ব্যক্তিরাও অনেক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে প্রবল বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। অবশ্য আদালতের নির্দেশে এসব বাধা কিছুটা কাটছে।
তবে প্রেসিডেন্ট আদালতকেও সমালোচনা করে নতুন ব্যবস্থার ফন্দি আঁটছেন। শরণার্থী প্রবেশ করা নিষিদ্ধ হয়েছে। অবশ্য বলছেন, সেটা সাময়িক। অভিবাসীদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ভুলে গেছেন তাঁর পূর্বপুরুষও ছিলেন অভিবাসী। আর বর্তমান ফার্স্ট লেডিও তা-ই। জন্ম স্লোভেনিয়ায়। ট্রাম্পের সঙ্গে বিয়ের এক বছর পর ২০০৬ সালে পান নাগরিকত্ব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মূলত ছিল রেড ইন্ডিয়ানদের দেশ। ইউরোপীয় অভিবাসীরা তাদের মেরে-কেটে এক কোণে তাড়িয়ে নিজেরা বসতি স্থাপন করেছেন। পরে আফ্রিকা থেকে লোক ধরে এনে কৃষি ও শিল্পে শ্রমিকের কাজে লাগান। আরও পরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসীরা গিয়ে সে দেশের সংস্কৃতি ও অর্থনীতিকে করেছেন সমৃদ্ধ। ওই দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন বলেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হবে সারা পৃথিবীর ভাগ্যহত মানুষের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। অবশ্য ধীরে ধীরে অভিবাসীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আসতে থাকে। তবে অতীতে এরূপ বিভেদের দেয়াল তোলা হয়নি জলে, স্থলে ও অন্তরিক্ষে। স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে বিশ্বের দেশগুলো মোটা দাগে দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। মূলত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দর্শন ছিল এ বিভক্তির ভিত্তি। অবশ্য জোটনিরপেক্ষ বলে একটি তৃতীয় ধারা থাকলেও কার্যত তাদের অনেকেই এ দুটো মূল ধারায় কোনো কোনোটির সঙ্গে বিশেষ সংযোগ ছিল। পুঁজিবাদী শিবির বলত, প্রণোদনা না থাকলে উৎপাদন ও সমৃদ্ধি হয় না। অন্যদিকে বাক্স্বাধীনতাসহ মৌলিক অধিকারের প্রতি তারা বিশ্বস্ত এবং প্রচলিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চর্চা করে।
পুঁজিবাদী শিবির নিজদের পরিচয় দেয় মুক্ত বিশ্ব বলে। ওই সব দেশে বাক্স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশের অধিকারসহ বিতর্কহীন ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে বলে তারা এমনটা দাবি করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক সমাজ মানবাধিকার প্রশ্নে সচেতন। তবে ভিন্ন চরিত্রের লোকও সেখানে কম নয়। কৃষ্ণাঙ্গদের সমান অধিকার পেতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। অবশ্য সে পথযাত্রায় সজ্জন শ্বেতাঙ্গরাও সহযাত্রী ছিলেন। দাসপ্রথা উচ্ছেদ করতে গৃহযুদ্ধ মোকাবিলা করে দেশটি। সে অমানবিক ব্যবস্থা রদ করার অল্প পরেই এর উদ্যোক্তা প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন নিহত হন আততায়ীর গুলিতে। তবে সেখানে সরকার সময়ে-সময়ে প্রতিক্রিয়াশীলদের পক্ষাবলম্বন করে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়েও এমনটা হয়েছিল। তবে বলতে গেলে সে দেশটির গণমাধ্যম, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিরতিহীন সমর্থন জানাতে থাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতি। কখনো কখনো সে দেশের সরকার অন্য দেশে সরকারের পতন ঘটায়, উসকানি দেয় গৃহযুদ্ধের, সংশ্লিষ্ট থাকে কোনো কোনো নেতাকে হত্যায়—এমন অভিযোগ রয়েছে। আবার এ দেশটির মানবতাবাদী মানুষগুলো প্রতিবাদী হন এ ধরনের অনাচারে।
অন্য দেশেও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে সোচ্চার হন তাঁরা। ক্ষেত্রবিশেষে মার্কিন সরকারও এরূপ ভূমিকায় থাকে। তবে দেশ ও কালভেদে তাদের সরকারকে অনেক ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী ভূমিকায় দেখা যায়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারণাতেই মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য দিচ্ছিলেন। নির্বাচিত হয়েও ওই অবস্থান আরও কঠোর করেছেন। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী এই ধর্মমতে বিশ্বাসী। মোট জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বসবাস করেন ৩৩ লাখ মুসলমান। অর্থাৎ তাদের জনসংখ্যার ১ শতাংশ। কোনো কোনো মুসলিম দেশে কিছুসংখ্যক বিভ্রান্ত লোক সন্ত্রাসী তৎপরতায় লিপ্ত থাকার অভিযোগ অমূলক নয়। তবে মূলধারা সর্বতোভাবে এর বিপক্ষে। আর এ ধরনের মৌলবাদ সৃষ্টিতে ক্ষেত্রবিশেষে মার্কিন ভূমিকার কথাও বহুলভাবে আলোচিত। ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন মানবাধিকার লঙ্ঘনবিষয়ক বিতর্কিত ভূমিকায় ছিলেন। তবে মৌলবাদী ছিলেন না। সেই সাদ্দামকে ভুল অপবাদ দিয়ে মার্কিন শক্তি প্রয়োগে উৎখাত করা হয়েছে। অস্থিতিশীল হয়েছে দেশটি। ঠাঁই নিয়েছে মৌলবাদ। আফগানিস্তানে পাকিস্তানের মাধ্যমে তালেবান গঠনে মার্কিন ভূমিকা ছিল একরূপ প্রকাশ্য। আইএস-সংক্রান্ত বিষয়েও অনুরূপ রটনা রয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প কারণে-অকারণে মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত করে চলছেন। ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিব। আর জেরুজালেম মুসলমান, খ্রিষ্টান ও ইহুদি—এই তিন ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র স্থান। মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেম স্থানান্তরের ঘোষণা দিয়ে তিনি ইসরায়েলকে আশকারা দিলেন। সেখানকার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের একজন সক্রিয় দোসর পেয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে ফিলিস্তিনবিরোধী অভিযান চালাচ্ছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প নারীদের সম্ভ্রমহানি ও তাঁদের বিরুদ্ধে চরম অবমাননাকর বক্তব্য দিয়ে সমালোচিত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। তাঁর শপথ গ্রহণের দিন পৃথিবীর ৬০টি দেশে নারীরা প্রতিবাদী মিছিল করেন। যুক্তরাষ্ট্রে সেদিনটিতে নারী-পুরুষের সম্মিলিত বিক্ষোভ ছিল নজিরবিহীন।
আর তা অব্যাহত আছে। তাঁর ঘোষিত অবস্থান মূলত শরণার্থী, অভিবাসী ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে। আর এ অবস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার চেতনা ও সে সমাজের মূল্যবোধের পরিপন্থী। অবশ্য তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন এসব বিষয়ে অবস্থান সুস্পষ্ট করেই। আর বিজয়ী হয়েছেন ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে। সাধারণ ভোট তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ৩০ লাখ বেশি পেয়েছেন। ট্রাম্প আবার এগুলোকে বলছেন ভুয়া ভোট। তাহলে কি আমরা ধরে নেব, সে দেশেও ভুয়া ভোট হয়। তাহলে তো সে ধরনের ভোট তাঁর পক্ষেও পড়তে পারে। কথাটি বলে তিনি মার্কিন গণতন্ত্রের বনিয়াদকে আঘাত করেছেন। অন্য দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে যাঁরা ছোটাছুটি করেন, তাঁদের দেশে আজকের অবস্থা অবশ্যই বেদনাদায়ক। মেক্সিকোর বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান মূলত বাণিজ্যিক। সেটিও একটি সমৃদ্ধ দেশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি রয়েছে সে দেশের সঙ্গে। শিল্পজাত পণ্য ছাড়াও তাজা সবজি ও ফলমূল যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি হয় মেক্সিকো থেকে। অতিরিক্ত কর বসালে এর দায় পড়বে মার্কিন জনগণের ওপর। তাদের শ্রমিক না এলে মার্কিন কৃষিব্যবস্থাও হুমকির মুখে পড়তে পারে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এ ধরনের কার্যক্রমে ক্ষুব্ধ হয়ে মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট বাতিল করেছেন তাঁর যুক্তরাষ্ট্র সফরসূচি।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী এসেছিলেন ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলতে। কিছু বক্তব্যের সঙ্গে একমত হওয়ায় নিজ দেশে ব্যাপকভাবে সমালোচনার মুখে পরিবর্তন করেছেন অবস্থান। তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে তাঁর দেশে রাষ্ট্রীয় সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। অথচ বিস্ময়করভাবে এ সফরের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠছে সে দেশের জনগণ। ইতিমধ্যে ১০ লাখের বেশি লোক স্বাক্ষর করে প্রতিবাদলিপি দিয়েছেন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ও সরকারের কাছে। নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে একটি অস্বস্তিকর অবস্থা বিরাজ করছে ইউরোপের অন্যান্য দেশে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে টেলিফোন আলাপে ট্রাম্প যথোচিত সৌজন্য দেখাননি। পক্ষ-বিপক্ষের অনেককেই তিনি এরই মাঝে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলছেন। বিষয়গুলো সচেতন মার্কিন জনগণের জন্যও চরম হতাশা ও বেদনার। তাঁরা অবশ্য আইন, আদালত ও রাজপথে সংগ্রাম করছেন। গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষোভ, ঘৃণার পর্যায়ে চলে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে এমনটি হবে, এ কথা কেউ ভেবেছেন বলে মনে হয় না। গণমাধ্যমের প্রচুর ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও মানবাধিকার, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য এর প্রয়োজনীয়তা দিন দিন জোরদার হচ্ছে। মনে হচ্ছে, এগুলোও তিনি ভয় দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে চান। তাহলে বলা যায়, সবকিছু মিলে তিনি তাঁর দেশটিকে মুক্ত বিশ্বের চেতনা থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে ওই দেশ কী করে নেতৃত্ব করবে মুক্ত বিশ্বের?
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
No comments