দেশ থেকে দূরে থাকা দেশকন্যারা!
দশের বোঝা একের লাঠি গল্প শুনে বড় হওয়া আমাদের দেশকন্যারা কেমন থাকেন দেশের বাইরে? মায়ার অন্দর থেকে জগৎ জানার বন্দরে যারা নোঙর ফেলেন, হয়ে যান দেশ থেকে দেশান্তর। কেমন করে তাদের অন্তর? যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, নেপাল, আয়ারল্যান্ড—কোথায় নেই তারা! কেমন থাকেন তারা দশ থেকে যখন এক হয়ে যান? একা, কখনো হয়তো সঙ্গী থাকে। মায়ের বুকের বারান্দায় চাঁদ মামা গান শোনা চেনা মুখটি মা কিংবা মাতৃভূমিকে ছেড়ে অচেনা আকাশে তারা কিংবা নক্ষত্র হওয়ার চেষ্টায় কি করে? দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও তাদের ভাবনায় কেমন করে। যেমন করেই হোক, আমার বাংলাদেশকে মুখর করে তুলব আমি আমার কর্মে, আমার অর্জনে। সেই ভাবনায় ভোর এসে স্নান করায় জীবনের। একটা নতুন দেশ। একটা ভিন্ন মহাদেশ। তবু এক নেশা। ঘুম থেকে উঠে এক কাপ চা। নাহ, বাবার আদুরে মেয়েটির জন্য এখানে কোনো বিশেষ কাজের সহকারী নেই। করেই খেতে হয়। আশ্চর্য এক দিন, দুই দিন, তিন দিন পর তারা চা করা থেকে শুরু করে ড্রাইয়ারে শুকানো চাদরের ভাঁজ সবই করতে শিখে যায়। জেনে যায় নিজের কাজ নিজে করায় আছে ভিন্ন এক আনন্দ। মাঝে মধ্যে দেশে থাকা আদুরে বোনটিকে তাই বলতে ভোলে না, বুয়া নেইতো কী হলো, কিসের কান্নাকাটি এত? নিজের কাজ নিজে করাতে যে সুখ আছে, এটা কখন বুঝবেন নন্দ ঘোষ। সেই ঘোষণা দিতে না দিতেই রেফ্রিজারেটরে চোখ। আয় হায় বাজার তো করতেই হবে। বহুদিন হয় দেশে বাজার করে দেওয়া তাজুল কাকাদের কথা মনে পড়ে না আর। ছুট ছুট এখনই। নাহ এখানে তাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য রাস্তায় বসে নেই কোনো ড্রাইভার। নিজেই ধরে গাড়ির স্টিয়ারিং। কি পারে না আমাদের দেশকন্যারা। কিন্তু গাড়িটা কী আর ভাত খায়?
তার খাবার ভিন্ন। তার জন্য লাগে তেল। এই তেল সেই তোষামোদের তেল নয়। এই তেলের জন্য দেশকন্যাদের পার্টটাইম কাজ করতে হয়। উপার্জন করতে হয়। এই করতে করতে তারা বেমালুম ভুলে যান পরনির্ভরশীলতা। অন্যদিকে কন্যারা সংসার নামের বিনি সুতোর মালায় জড়ানো থাকলে তাদেরও সন্তান থাকে। থাকতে পারে। জীবনসঙ্গীসহ দুয়ে মিলে সামলাতে হয় সন্তানদের। কখনো বা একা। একান্নবর্তী পরিবারের সকলে মিলে দেখভাল করবার সুযোগ যে নেই। নেই যে প্রাইভেট টিউটর। সন্ধ্যা নামলেই সন্তানদের হোমওয়ার্ক নিয়ে বসতে হয় তাদের। অতপর কবেকার কথা। বেগম রোকেয়া বলে গিয়েছিলেন, জাগো গো ভগিনী। ছুট ছুট এখনই। পড়াশোনা করতেই হবে। নতুন ভাষা। নতুন কলেজের করিডর। তবু সব ডর ডিঙিয়ে অন্য এক যুদ্ধ। আয়ত্ত করতে হবে সব। দেশের বাইরে নতুন করে পড়াশোনা শুরু করা খুব কঠিন ও সময়সাপেক্ষ। কিন্তু পড়াশোনার মাধ্যমেই যে ভিন দেশের মানুষদের জানিয়ে দিতে হবে, ধনী না হতে পারি, শিক্ষার দৈন্যতা আমাদের নেই। আমরা উন্নয়নশীল দেশ। আমাদের মাঝেই তবু আছে রবীন্দ্রনাথ–ইউনূসদের আবেশ। আবেশের সেই ছোঁয়ায় কেউ কেউ ছুঁয়ে যায় বিশ্বময় অন্য দিকেও। পৃথিবীর সব সৌন্দর্যকে হারিয়ে বিশ্বকে দেখায় নিজস্ব রূপ। কেউ কেউ হন মিস আয়ারল্যান্ড। কেউবা বাঁচিয়ে রাখেন দেশীয় সংস্কৃতি। নিজেদের গ্র্যাজুয়েশনের দিনে শত বিদেশির মাঝে শনাক্ত করা যায়। ওই, ওইতো আমার দেশের কন্যা। তার অঙ্গে যে জড়ানো দেশীয় শাড়ি। কখনোবা বুকে জড়ানো থাকে লাল সবুজ পতাকা। বুকের উনুনে মাতৃভাষায় কথা বলতে না পারার জন্য কারও জাগে ব্যাকুলতা। তাই কেউবা ভিন্ন ভাষা আয়ত্ত করবার প্রতিকূল অবস্থানে থেকেও, সময়ের অনুকূলে ধরে রাখে কলম। যে কলম অবিরল লিখে যায় আমার ভাষা। বাংলা ভাষা। আশা এই, যা কিছু সুন্দর, যা কিছু শিক্ষণীয় নাও, গ্রহণ করো। আমার কথা শোনো। হোক ভিন্ন দেশের ভিন্ন চিন্তা। ভিন্নভাবে ভালোর কাজের প্রয়োগ দেখে তা নিজেদের মাঝে আত্মস্থ করতে অহম করতে নেই। এমন অচিন্তনীয় সব কর্মে কেটে যায় তাদের এক একটা ব্যস্ততম দিন। দিন শেষে ঘুম যখন দুয়ারে ঠিক তখনই মন বলে, এই ভোর হলো। না, না। এখানে নয়, আমার দেশে। তারপর ভীষণ কর্মব্যস্ত দিনের সব ক্লান্তি কোমল হয়ে যায় দেশে রেখে আসা প্রিয় স্বজনের স্বরে। ওতেই এই একলা চলতে হয়, জীবনে আরেকটি ভোর নিয়ে আসে জীবনের স্নান! এই জল, এই পুকুর ভিন্ন। তবু কোথায় যেন এক হয়ে রয়, জলের একই রং।
No comments