গণতন্ত্র কানাগলিতে আটকে গেছে
কয়েক মাস ধরে আমরা যেন স্লো মোশনে একটি ট্রেনের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখলাম। এ দৃশ্য দেখতে আমাদের মনে যেমন বিস্ময় জেগেছে, তেমনি ভীতি ও ঘৃণাও সৃষ্টি হয়েছে। আরেকটি ট্রেন যখন ওই ট্রেনকে ধাক্কা দিল, তার কিছু আগে যেন বোধগম্য কিছু ঘটে গেল। শুধু ট্রেন দুটিকে বেশি গুরুত্ব দিলে ভুল হবে। মূল ঘটনা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ খুবই গভীরভাবে বিভাজিত, যার মধ্যে স্নায়ুরোগের লক্ষণ আছে। এই দেশের গায়ে এত এত ধাক্কা লেগেছে যে মানুষের মনে ভয় ঢুকেছে। তাকে যেন আর চেনা যায় না। মূল ঘটনার কালপর্বের ব্যাপ্তি হচ্ছে গত ৩৫ বছর। সেই ১৯৮০ সালের রিগ্যান–বিপ্লবের পর একটি রক্ষণশীল মহল ধীরে ধীরে দেশটির উদার গণতন্ত্রের ভিত্তি ধ্বংস করে দিয়েছে। তারা অর্থনীতিতে পরিবর্তন এনেছে। সর্বোপরি একধরনের সামাজিক ডারউইনবাদ চালু করেছে। এই প্রক্রিয়া গত ২৫ বছরে আরও সংহত হয়েছে। ১৯৯২ সালের নির্বাচনে বিল ক্লিনটন বিজয়ী হওয়ার পর ডেমোক্র্যাট, সমাজতন্ত্রী ও উদারনৈতিক শক্তিগুলো এমনভাবে বিশ্বায়নের কাছে আত্মসমর্পণ করল যে তাদের ভাবখানা এমন, এটাই প্রকৃতির নিয়ম।
তারা প্রতি পদক্ষেপে শ্রমিক ও নিম্নমধ্যম আয়ের ভোটারদের পরিত্যাগ করেছে। এখন গত আট বছরের কথা বলি, যে সময় বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। অনেক মার্কিন নাগরিক মনে করেন, ওবামার প্রেসিডেন্ট হওয়াটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অমর্যাদাকর। এর কারণ হচ্ছে, মার্কিন সমাজে বর্ণবাদ এত গভীরে প্রোথিত যে কখনো কখনো মনে হয়, এটা সাদাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন হয়ে গেছে। মনে হয়, এটা ছাড়া তাদের আর কিছু নেই। এখন কথা হচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি জেতেন, তাহলে তা হবে বারাক ওবামার আট বছরের জমানার একদম সরাসরি প্রতিক্রিয়া। আগের প্রতিক্রিয়াশীলদের মতো ট্রাম্পও এক স্বপ্নালস অতীতের এস্তেমাল করেন, যেখানে ফিরে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। এমনকি সহিংসতার মাধ্যমেও নয়। নিউইয়র্ক টাইমস এ নির্বাচনকে ‘সাদা সংখ্যাগরিষ্ঠতার’ লড়াই হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। মার্কিন সমাজে সাদারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাচ্ছে। তাই এই নির্বাচন সাদাদের কর্তৃত্বের লড়াই। কিন্তু একই সঙ্গে এই নির্বাচন পরাজিতদের লড়াইও বটে, অন্তত যাঁরা নিজেদের পরাজিত মনে করেন। এই লড়াই বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে, যে বিশ্বায়নের পালে রিগ্যান থেকে ওবামা—সবাই হাওয়া দিয়েছেন। তাঁরা এটাকে ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির চাবিকাঠি মনে করেছেন। কিন্তু এই বিশ্বায়ন জনগোষ্ঠীর একটি অংশকে চিরতরে রাজনৈতিক ঐকমত্য ও সাধারণ বোধ–বুদ্ধিহীন করে ফেলেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ঠিক এই শূন্যতায় ডুব দিয়েছেন। এমন নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতার সঙ্গে তিনি এ কাজ করেছেন যে রিপাবলিকান পার্টির অভিজাতরা খাবি খাওয়া শুরু করেছিলেন। এমনকি এ কারণে দলটিও নিকট ভবিষ্যতে হোঁচট খাবে। এতে দেশটির উদার অভিজাতরা হতবুদ্ধি হয়ে গেছেন। তঁারা আসলে বিশ্বাস করতে পারছেন না যে ট্রাম্পের মতো একজন অশ্লীল, স্থূল ও বেকুব বক্তৃতাবাগীশ লোক হিলারির বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এত দূর আসতে পেরেছেন।
উদারনৈতিক সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনের লেখকেরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন যে ট্রাম্পের জেতার সুযোগ নেই। বিশেষ করে তাঁর কর ফাঁকি দেওয়া ও যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর। এই কিছুদিন আগ পর্যন্ত নিউইয়র্ক টাইমস একটি গ্রাফিকস ছাপাত, যেখানে তারা দেখিয়েছে, হিলারি ক্লিনটনের জেতার সম্ভাবনা ৯২ শতাংশ। কথা হচ্ছে, তথ্য সাংবাদিকতার মান খুব কম সময়েই এতটা নিচে নেমেছে। সবাই যে ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছে তা হলো, হিলারি ক্লিনটনকে সমর্থন করার মতো তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু টিভি বিতর্কে দেখা গেল, ট্রাম্পকে ভয় করার মতো অনেক কারণ আছে। তিনি প্রকাশ্যে গর্বভরে অনেক অগণতান্ত্রিক কর্মসূচি হাজির করেছিলেন, যেগুলো একজন কর্তৃত্বপরায়ণ শাসকের পক্ষেই সাজে, মানবিক মর্যাদা ও বিদ্যমান আইনের প্রতি যাঁর বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই। নানা কথা বলে ট্রাম্প জনমনে ভীতি সৃষ্টি করেছেন: হিলারিকে জেলে পোরা, পরিবেশের বারোটা বাজানো, মেক্সিকোর সীমান্তে দেয়াল, বোমা মেরে আইএসকে হটানো ইত্যাদি। তিনি যে কর হ্রাসের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাতে রিগ্যানের ঘরানার পুঁজিবাদও লজ্জা পেয়ে যেত। তিনি প্যারিস জলবায়ু চুক্তি বাতিল করে দেবেন। তিনি কালো, মুসলমান, হিস্পানিকসহ সব সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে অবিশ্বাসের পরিবেশ সৃষ্টি করবেন। তিনি সুপ্রিম কোর্টে অতি ডানপন্থী বিচারক নিয়োগ দেবেন। এর মাধ্যমে তিনি বন্দুকের মালিকানা ও গর্ভপাত-সংক্রান্ত সামাজিক পরিবেশ বদলে দেবেন। এই অবস্থানের পেছনে তিনি যে লোম খাড়া করা যুক্তি দেন সেটা হলো, যুক্তরাষ্ট্র এখনো ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের কারণে ভুগছে। ট্রাম্পকে যাঁরা ভোট দেবেন, তাঁদের যুক্তি অনেকটা এমন: কোনো ব্যক্তির গাড়ি–বাড়ি চুরি হয়ে গেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি চোরকে রাতের খাবার খেতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন, যাতে সে চেয়ার ও টেবিল চুরি করে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু এরা কোনো না কোনোভাবে এটা করে যাচ্ছে।
আর কী হচ্ছে, তা বুঝতে অভিজাত মতামত সৃষ্টিকারীদের অনেক সময় লেগে গেছে। এবারের নির্বাচনী প্রচারণা গণতন্ত্রের চর্চা ও সৌন্দর্য—উভয়ের জন্যই হানিকর। এটা আসলে বড় কোনো কিছুর লক্ষণ। এতে বোঝা যায়, বড় একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে, যেটা অনেক বেশি অর্থবহ, আর যার প্রভাবও অনেক দীর্ঘস্থায়ী। যুক্তরাষ্ট্রের দুই বড় পার্টির কূটচাল ও অভিসন্ধির মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে এক কানাগলির ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ফলে বৈপ্লবিক পরিবর্তন না হলে এখান থেকে বেরিয়ে আসাও সম্ভব নয়। রাজনৈতিক ব্যবস্থার এই বড় ক্ষতির জন্য মূলত রিপাবলিকানরাই দায়ী, যার কারণে ট্রাম্পের মতো এক প্রচারকের পক্ষে এত দূর আসা সম্ভব হয়েছে। সেই ২০০৯ সাল থেকে বারাক ওবামা যা-ই করেছেন, রিপাবলিকানরা তার তীব্র বিরোধিতা করেছে। প্রতি পদে তারা ওবামাকে আটকানোর চেষ্টা করেছে। এর ফল হচ্ছে, গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, রিপাবলিকান পার্টি এতটা চরমপন্থী হয়ে গেছে যে জর্জ ডব্লিউ বুশের মতো মানুষও এখন দলটির বামপন্থী ঘরানার লোক হিসেবে চিহ্নিত হবেন। এমনকি হাউসের রিপাবলিকান স্পিকার পল রায়ান নিজেকে ‘রক্ষণশীল আন্দোলনের রক্ষণশীল ঘরানার রক্ষণশীল’ হিসেবে নিজেকে আখ্যা দিয়েছেন।
হিলারির প্রসঙ্গে ফিরে আসি। কথা হচ্ছে, তাঁর বিরোধিতা করারও যথেষ্ট কারণ আছে। তিনি আসলে এক ক্রান্তিকালে উপনীত হয়েছেন। এক অন্যায্য যুগ থেকে এমন এক যুগে তিনি প্রবেশ করছেন, যেখানে নতুন প্রজন্মই সব নির্ধারণ করবে। তাঁর সমস্যা হচ্ছে, তিনি নিজের দোষত্রুটি কাটাতে পারেন না। সম্ভবত তিনি আফ্রিকান-মার্কিন ভোটারদের একটি অংশকে উজ্জীবিত করতে পারবেন না, ওবামা যাঁদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। হিলারি যদি হারেন, তাহলে এ কারণেই হারবেন। তবে নির্বাচনে শেষমেশ ব্যাপক লড়াই হবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে বিভক্ত ও পুনর্বিন্যাস করছে। গ্রামীণ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বড় শহর, অন্যদের বিপক্ষে সাদারা, সবার বিরুদ্ধে মধ্যবিত্ত, অতীতের যুদ্ধ, যার ছায়া নির্বাচনী প্রচারণায় পড়েছে। এ জন্যই অনেক বর্ষীয়ান নাগরিক ট্রাম্পকে ভোট দেবেন, যদিও ইরাক ও আফগানিস্তানে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টরাই হামলা করেছিলেন। ট্রাম্প যেন ঘৃণার এক অনিঃশেষ আধার। এ পরিপ্রেক্ষিতে বারাক ওবামার প্রচারণার মূলমন্ত্র স্মরণ করা যেতে পারে: আশা। যা-ই হোক, সম্প্রতি মনে হয়েছে, মিশেল ওবামা যেন ২০২০ সালের নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, দের স্পিগল ইন্টারন্যাশনালঅনলাইন থেকে নেওয়া।
গেয়র্গ ডিয়াজ: জার্মান সাংবাদিক।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, দের স্পিগল ইন্টারন্যাশনালঅনলাইন থেকে নেওয়া।
গেয়র্গ ডিয়াজ: জার্মান সাংবাদিক।
No comments