বিভক্ত রাজনীতিকেই দায়ী করছে বিশ্ব মিডিয়া by মিজানুর রহমান খান
গুলশানের
বেদনার্ত উপাখ্যানের পর প্রকাশিত প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে
বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান হারে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার জন্য বাংলাদেশের
বিভক্ত রাজনীতিকে প্রধানত দায়ী করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিষয়টি উঠে এলেও তা
তেমন একটা গুরুত্ব পায়নি রাজনৈতিক মহলে।
‘হিন্দুস্তান টাইমস’-এর ৩ জুলাইয়ের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে উগ্রপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ দমন এক প্রকার অসম্ভব, কারণ দেশটির রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো গভীরভাবে অকার্যকর। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দল ও সরকার উভয়ই সেই অকার্যকারতার ফসল এবং তার এক চালকও বটে।’ পত্রিকাটি আরও উল্লেখ করে, ‘বাংলাদেশ এখন ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজবে, কিন্তু মরিয়াভাবে তার যেটা দরকার, সেটা হলো এক নতুন ধাঁচের রাজনীতি। যদিও এই মুহূর্তে তা শুধুই স্বপ্নচারিতা (উইশফুল থিংকিং)।’
‘দ্য হিন্দু’ ৫ জুলাই এক সম্পাদকীয়তে বিরোধী দল ও ভিন্নমতের জন্য রাজনৈতিক পরিসর বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেছে, ‘এখানে তার এতদিনকার হম্বিতম্বি থেকে পিছিয়ে আসা উচিত। বাংলাদেশ গণতন্ত্র অন্তসারশূন্য হয়ে পড়লে তার সুফল উগ্রপন্থীরা পাবে।’
৪ জুলাই ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ সম্পাদকীয় লিখেছে, ‘এতে সন্দেহের অবকাশ কম যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা (অথরিটারিয়ান রেসপন্সেস), যার মধ্যে রয়েছে পাইকারি গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, তা সংকটকে আরও উসকে দিয়েছে।’ ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ লিখেছে, সরকার এত দিন যে কর্তৃত্ববাদী মনোভাব এবং বিরোধী দল ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর যে নিপীড়ন চালিয়ে আসছিল, এখন গত শুক্রবারের হামলার পরে সেই কৌশল পরিবর্তনে তারা বাধ্য হতে পারে। ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ তার সম্পাদকীয়তে দুবার ‘অথরিটারিয়ান’ শব্দ ব্যবহার করেছে। পত্রিকাটির কথায়, ‘বাংলাদেশ সরকারের “অথরিটারিয়ান” কার্যক্রম তার শত্রুদের যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য মুখিয়ে আছে, ক্রমবর্ধমান হারে তাদের সাহায্য করছে।’
‘ইসলামপন্থী উগ্রবাদীরা আশা করছে যে হত্যাকাণ্ড যথেষ্ট নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে, যা সরকার বদলাবে আর তখন তাদের জন্য অধিকতর অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশ এনে দেবে। নয়াদিল্লি এ ধরনের ফলাফল এড়াতে অর্থপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।’ আমি এখানে যেটা লক্ষ্য করি সেটা হলো ‘অধিকতর অনুকূল’ কথাটির ব্যবহার। আর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বলছে, বর্তমানে যে পরিবেশ আছে, তা জঙ্গিবাদের বিকাশে অনুকূল। পত্রিকাটি শুক্রবারের আক্রমণের ভিত্তিতে পরোক্ষভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে এতে অখণ্ডতা বিপন্নের বীজ আছে। পত্রিকাটির কথায়, ‘প্যারিস থেকে ইস্তাম্বুলের ঘটনাপ্রবাহ একটা বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ, যা দেশটির অখণ্ডতাকে দ্রুত বিপন্ন করার সাক্ষ্য বহন করছে না।’
‘টাইমস অব ইন্ডিয়ার’ সাবেক রাজনৈতিক সম্পাদক মনোজ যোশী ‘মেইল টুডে’ পত্রিকায় লিখেছেন, ‘শুক্রবারের হামলা-পরবর্তী ঢাকায় সম্ভবত ভারতের জন্য সব থেকে জটিল কাজ হবে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার প্রতিযোগিতাকে উদারনৈতিক হতে দিতে রাজি করানো।’ যোশীও উল্লেখ করেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্রমেই ‘অথরিটারিয়ান’ (কর্তৃত্ববাদী) হয়ে উঠছে। তাঁর কথায়, ভারত ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে নিরঙ্কুশভাবে এটা পরিষ্কার করে দেওয়া যে ‘দুই নারী তাঁদের লড়াই, যা তাঁদের দেশে ইসলামবাদের বিকাশ ঘটাচ্ছে, এখন তা আইএস ও আল-কায়েদার শিকড় গভীরে প্রবেশ করাচ্ছে এবং বাংলাদেশের জন্য তা অস্তিত্বগত হুমকি বয়ে এনেছে।’
যোশী, যিনি সম্প্রতি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা-বিষয়ক একটি টাস্কফোর্সের সদস্য অন্তর্ভুক্ত হন, তিনি লিখেছেন, ‘এসব যখন ঘটছে, তখন ভারত ও বিশ্ব অলসভাবে বসে থাকতে পারে না। বাংলাদেশের অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে সেখানকার ঘটনাবলিতে আমাদের নিরাপত্তার ওপর তার গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য রয়েছে। এবং আমাদের উচিত হবে, এই উদীয়মান চ্যালেঞ্জ সংকল্প, পরিশীলিত মেজাজ ও ঠান্ডা মাথায় মোকাবিলা করা। কূটনৈতিক স্তরে, ‘দুই নারীকে তাঁদের কাজ একত্রে করাতে সমন্বিত আন্তর্জাতিক চাপ দরকার।’
যোশী এ কথাও স্মরণ করিয়ে দেন যে মুসলিম ব্রাদারহুড নিয়ে মিসরের অভিজ্ঞতা দেখাচ্ছে যে কেবল নিপীড়ন চালিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে না। সন্দেহভাজনদের জেলে পোরা এবং তাদের প্রতি ‘থার্ড ডিগ্রি’ থেরাপি দেওয়া সহজ, কিন্তু সেসব কেবলই উগ্রপন্থীদের পূর্ণাঙ্গ জঙ্গি ও সন্ত্রাসীতে পরিণত করে। আর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির মৈত্রীর ফলে বাংলাদেশে ইসলামবাদ মোকাবিলা করা জটিল।
৫ জুলাই টাইমস অব ইন্ডিয়ার ব্লগে পত্রিকাটির সম্পাদকীয় বিভাগে যুক্ত থাকা রুদ্রনীল ঘোষ তুরস্কের পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করে লিখেছেন, ‘তুর্কি সরকার কুর্দিদের আইএস হিসেবে সন্দেহ করে থাকে। অথচ কুর্দিরা মূলধারার রাজনীতির সঙ্গেই থাকতে আগ্রহী এবং তারা আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। বাংলাদেশও এখন তেমনই এক বিপাকে পড়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার তার রাজনৈতিক শত্রু বিএনপি ও তার মিত্রদের বিরোধিতায় এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে যে তারা এখন তাদের থেকে বড় কিছু এবং তা যে আরও কালো কিছুতে রূপ নিচ্ছে, তা দেখতে ব্যর্থ হচ্ছে।’ ওই লেখকের মতে, ‘এখন যেহেতু এক আওয়ামী লীগারের ছেলেকে অন্যতম হামলাকারী হিসেবে পাওয়া গেছে, তাই একে এখন দলনির্বিশেষে এক সমস্যা হিসেবেই দেখতে হবে।’
ভারত সরকার ও সে দেশের সংবাদমাধ্যম সব সময় বাংলাদেশ সরকারকে বিভিন্ন বিষয়ে সমর্থন দিলেও এখন সংবাদমাধ্যমে এ ধরনের মতামত জোরালোভাবে তুলে ধরা হচ্ছে।
এদিকে ব্যাংকক পোস্ট ৪ জুলাই ‘এক বিপজ্জনক প্রতিবেশী’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে বলেছে, প্রায় ১১ বছর আগে ‘ব্যাংকক পোস্ট’ অন্য অনেকের মতো স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল যে ‘বাংলাদেশ পাকিস্তানকে প্রতিস্থাপন করেছে।’ থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত এর প্রতিবাদ করেছিলেন। ঢাকার সরকার তখনো যেমন, এখনো তেমনি নাকচ করার মনোভাব নিয়ে আছে। বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদের একটি কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার কাছাকাছি আছে।
বিখ্যাত মার্কিন সাপ্তাহিক ‘টাইম’ ৪ জুলাই বলেছে, শুক্রবারের হামলা উগ্রপন্থা দমনে সরকারের প্রচেষ্টার কার্যকরতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। একই দিনে সিএনএন বলেছে, ‘পলিটিক্যাল ডিভাইড ফুয়েলস মিলিট্যান্সি’।
আল-জাজিরার ইসলামাবাদভিত্তিক বিশ্লেষক টম হুসেন ৪ জুলাই এক নিবন্ধে প্রধানত বিভক্ত রাজনীতিকেই সব থেকে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ‘ঢাকা আক্রমণের জন্য মঞ্চ তৈরি রেখেছে বিভক্ত রাজনীতি’ শীর্ষক শিরোনামের এক নিবন্ধে আল-জাজিরা বলেছে, ‘বিরোধী দলের ওপর নির্যাতন এবং বাংলাদেশি জঙ্গিদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগসূত্র প্রত্যাখ্যান করে চলা আইএসএর জন্য পথ করে দিয়েছে। পরিস্থিতি যা দাঁড়াচ্ছে, তাতে সরকার দেখবে, একদলীয় রাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধটা করতে পারবে না। নির্বাচিত রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্য দরকার।’ আল-জাজিরা আরও বলেছে, ‘দৃশ্যত তিনি (শেখ হাসিনা) রাজনৈতিক দলগুলোকে, যারা আওয়ামী লীগের মতোই প্রায়ই দেশ শাসন করেছে, তাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে বাইরে রেখেছেন। বাংলাদেশ সরকার এমন একটি রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি করেছে এমন এক সময়ে, যখন আইএস দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংগ্রামরত জিহাদি উপদলগুলোর কাছে পৌঁছে গেছে।’
একই দিনে ‘জাপান টাইমস’–এ ক্যানবেরার অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ ক্লিভ উইলিয়ামস লিখেছেন, ‘শেখ হাসিনা ও তাঁর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ খালেদা জিয়ার মধ্যকার বিরোধপূর্ণ রাজনৈতিক সম্পর্ক নিরাপত্তার ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে।’
ব্রিটেনের ‘দ্য ইনডিপেনডেন্ট’ অবশ্য তার ৪ জুলাইয়ের সম্পাদকীয়তে ঢাকা, বাগদাদ ও ইস্তাম্বুলের আইএস হামলার উল্লেখ করে বলেছে, এটা এখন স্পষ্ট যে শুধু সামরিক ব্যবস্থা দিয়ে একে রোখা যাবে না। সরাসরি কোনো অনুশাসন বা প্রশিক্ষণ ছাড়াই ‘নিঃসঙ্গ নেকড়েদের’ যে উত্থান, সেটা ব্রেক্সিটের পরে ইউরোপীয় অর্থনীতির মতোই একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থার গল্পের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
‘হিন্দুস্তান টাইমস’-এর ৩ জুলাইয়ের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে উগ্রপন্থা ও সন্ত্রাসবাদ দমন এক প্রকার অসম্ভব, কারণ দেশটির রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো গভীরভাবে অকার্যকর। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন দল ও সরকার উভয়ই সেই অকার্যকারতার ফসল এবং তার এক চালকও বটে।’ পত্রিকাটি আরও উল্লেখ করে, ‘বাংলাদেশ এখন ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজবে, কিন্তু মরিয়াভাবে তার যেটা দরকার, সেটা হলো এক নতুন ধাঁচের রাজনীতি। যদিও এই মুহূর্তে তা শুধুই স্বপ্নচারিতা (উইশফুল থিংকিং)।’
‘দ্য হিন্দু’ ৫ জুলাই এক সম্পাদকীয়তে বিরোধী দল ও ভিন্নমতের জন্য রাজনৈতিক পরিসর বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেছে, ‘এখানে তার এতদিনকার হম্বিতম্বি থেকে পিছিয়ে আসা উচিত। বাংলাদেশ গণতন্ত্র অন্তসারশূন্য হয়ে পড়লে তার সুফল উগ্রপন্থীরা পাবে।’
৪ জুলাই ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ সম্পাদকীয় লিখেছে, ‘এতে সন্দেহের অবকাশ কম যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা (অথরিটারিয়ান রেসপন্সেস), যার মধ্যে রয়েছে পাইকারি গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, তা সংকটকে আরও উসকে দিয়েছে।’ ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ লিখেছে, সরকার এত দিন যে কর্তৃত্ববাদী মনোভাব এবং বিরোধী দল ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর যে নিপীড়ন চালিয়ে আসছিল, এখন গত শুক্রবারের হামলার পরে সেই কৌশল পরিবর্তনে তারা বাধ্য হতে পারে। ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ তার সম্পাদকীয়তে দুবার ‘অথরিটারিয়ান’ শব্দ ব্যবহার করেছে। পত্রিকাটির কথায়, ‘বাংলাদেশ সরকারের “অথরিটারিয়ান” কার্যক্রম তার শত্রুদের যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য মুখিয়ে আছে, ক্রমবর্ধমান হারে তাদের সাহায্য করছে।’
‘ইসলামপন্থী উগ্রবাদীরা আশা করছে যে হত্যাকাণ্ড যথেষ্ট নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে, যা সরকার বদলাবে আর তখন তাদের জন্য অধিকতর অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশ এনে দেবে। নয়াদিল্লি এ ধরনের ফলাফল এড়াতে অর্থপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।’ আমি এখানে যেটা লক্ষ্য করি সেটা হলো ‘অধিকতর অনুকূল’ কথাটির ব্যবহার। আর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বলছে, বর্তমানে যে পরিবেশ আছে, তা জঙ্গিবাদের বিকাশে অনুকূল। পত্রিকাটি শুক্রবারের আক্রমণের ভিত্তিতে পরোক্ষভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে এতে অখণ্ডতা বিপন্নের বীজ আছে। পত্রিকাটির কথায়, ‘প্যারিস থেকে ইস্তাম্বুলের ঘটনাপ্রবাহ একটা বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ, যা দেশটির অখণ্ডতাকে দ্রুত বিপন্ন করার সাক্ষ্য বহন করছে না।’
‘টাইমস অব ইন্ডিয়ার’ সাবেক রাজনৈতিক সম্পাদক মনোজ যোশী ‘মেইল টুডে’ পত্রিকায় লিখেছেন, ‘শুক্রবারের হামলা-পরবর্তী ঢাকায় সম্ভবত ভারতের জন্য সব থেকে জটিল কাজ হবে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার প্রতিযোগিতাকে উদারনৈতিক হতে দিতে রাজি করানো।’ যোশীও উল্লেখ করেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্রমেই ‘অথরিটারিয়ান’ (কর্তৃত্ববাদী) হয়ে উঠছে। তাঁর কথায়, ভারত ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে নিরঙ্কুশভাবে এটা পরিষ্কার করে দেওয়া যে ‘দুই নারী তাঁদের লড়াই, যা তাঁদের দেশে ইসলামবাদের বিকাশ ঘটাচ্ছে, এখন তা আইএস ও আল-কায়েদার শিকড় গভীরে প্রবেশ করাচ্ছে এবং বাংলাদেশের জন্য তা অস্তিত্বগত হুমকি বয়ে এনেছে।’
যোশী, যিনি সম্প্রতি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা-বিষয়ক একটি টাস্কফোর্সের সদস্য অন্তর্ভুক্ত হন, তিনি লিখেছেন, ‘এসব যখন ঘটছে, তখন ভারত ও বিশ্ব অলসভাবে বসে থাকতে পারে না। বাংলাদেশের অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে সেখানকার ঘটনাবলিতে আমাদের নিরাপত্তার ওপর তার গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য রয়েছে। এবং আমাদের উচিত হবে, এই উদীয়মান চ্যালেঞ্জ সংকল্প, পরিশীলিত মেজাজ ও ঠান্ডা মাথায় মোকাবিলা করা। কূটনৈতিক স্তরে, ‘দুই নারীকে তাঁদের কাজ একত্রে করাতে সমন্বিত আন্তর্জাতিক চাপ দরকার।’
যোশী এ কথাও স্মরণ করিয়ে দেন যে মুসলিম ব্রাদারহুড নিয়ে মিসরের অভিজ্ঞতা দেখাচ্ছে যে কেবল নিপীড়ন চালিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে না। সন্দেহভাজনদের জেলে পোরা এবং তাদের প্রতি ‘থার্ড ডিগ্রি’ থেরাপি দেওয়া সহজ, কিন্তু সেসব কেবলই উগ্রপন্থীদের পূর্ণাঙ্গ জঙ্গি ও সন্ত্রাসীতে পরিণত করে। আর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির মৈত্রীর ফলে বাংলাদেশে ইসলামবাদ মোকাবিলা করা জটিল।
৫ জুলাই টাইমস অব ইন্ডিয়ার ব্লগে পত্রিকাটির সম্পাদকীয় বিভাগে যুক্ত থাকা রুদ্রনীল ঘোষ তুরস্কের পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করে লিখেছেন, ‘তুর্কি সরকার কুর্দিদের আইএস হিসেবে সন্দেহ করে থাকে। অথচ কুর্দিরা মূলধারার রাজনীতির সঙ্গেই থাকতে আগ্রহী এবং তারা আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। বাংলাদেশও এখন তেমনই এক বিপাকে পড়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার তার রাজনৈতিক শত্রু বিএনপি ও তার মিত্রদের বিরোধিতায় এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে যে তারা এখন তাদের থেকে বড় কিছু এবং তা যে আরও কালো কিছুতে রূপ নিচ্ছে, তা দেখতে ব্যর্থ হচ্ছে।’ ওই লেখকের মতে, ‘এখন যেহেতু এক আওয়ামী লীগারের ছেলেকে অন্যতম হামলাকারী হিসেবে পাওয়া গেছে, তাই একে এখন দলনির্বিশেষে এক সমস্যা হিসেবেই দেখতে হবে।’
ভারত সরকার ও সে দেশের সংবাদমাধ্যম সব সময় বাংলাদেশ সরকারকে বিভিন্ন বিষয়ে সমর্থন দিলেও এখন সংবাদমাধ্যমে এ ধরনের মতামত জোরালোভাবে তুলে ধরা হচ্ছে।
এদিকে ব্যাংকক পোস্ট ৪ জুলাই ‘এক বিপজ্জনক প্রতিবেশী’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে বলেছে, প্রায় ১১ বছর আগে ‘ব্যাংকক পোস্ট’ অন্য অনেকের মতো স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল যে ‘বাংলাদেশ পাকিস্তানকে প্রতিস্থাপন করেছে।’ থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূত এর প্রতিবাদ করেছিলেন। ঢাকার সরকার তখনো যেমন, এখনো তেমনি নাকচ করার মনোভাব নিয়ে আছে। বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদের একটি কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার কাছাকাছি আছে।
বিখ্যাত মার্কিন সাপ্তাহিক ‘টাইম’ ৪ জুলাই বলেছে, শুক্রবারের হামলা উগ্রপন্থা দমনে সরকারের প্রচেষ্টার কার্যকরতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। একই দিনে সিএনএন বলেছে, ‘পলিটিক্যাল ডিভাইড ফুয়েলস মিলিট্যান্সি’।
আল-জাজিরার ইসলামাবাদভিত্তিক বিশ্লেষক টম হুসেন ৪ জুলাই এক নিবন্ধে প্রধানত বিভক্ত রাজনীতিকেই সব থেকে বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ‘ঢাকা আক্রমণের জন্য মঞ্চ তৈরি রেখেছে বিভক্ত রাজনীতি’ শীর্ষক শিরোনামের এক নিবন্ধে আল-জাজিরা বলেছে, ‘বিরোধী দলের ওপর নির্যাতন এবং বাংলাদেশি জঙ্গিদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগসূত্র প্রত্যাখ্যান করে চলা আইএসএর জন্য পথ করে দিয়েছে। পরিস্থিতি যা দাঁড়াচ্ছে, তাতে সরকার দেখবে, একদলীয় রাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধটা করতে পারবে না। নির্বাচিত রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্য দরকার।’ আল-জাজিরা আরও বলেছে, ‘দৃশ্যত তিনি (শেখ হাসিনা) রাজনৈতিক দলগুলোকে, যারা আওয়ামী লীগের মতোই প্রায়ই দেশ শাসন করেছে, তাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থেকে বাইরে রেখেছেন। বাংলাদেশ সরকার এমন একটি রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি করেছে এমন এক সময়ে, যখন আইএস দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংগ্রামরত জিহাদি উপদলগুলোর কাছে পৌঁছে গেছে।’
একই দিনে ‘জাপান টাইমস’–এ ক্যানবেরার অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ ক্লিভ উইলিয়ামস লিখেছেন, ‘শেখ হাসিনা ও তাঁর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ খালেদা জিয়ার মধ্যকার বিরোধপূর্ণ রাজনৈতিক সম্পর্ক নিরাপত্তার ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে।’
ব্রিটেনের ‘দ্য ইনডিপেনডেন্ট’ অবশ্য তার ৪ জুলাইয়ের সম্পাদকীয়তে ঢাকা, বাগদাদ ও ইস্তাম্বুলের আইএস হামলার উল্লেখ করে বলেছে, এটা এখন স্পষ্ট যে শুধু সামরিক ব্যবস্থা দিয়ে একে রোখা যাবে না। সরাসরি কোনো অনুশাসন বা প্রশিক্ষণ ছাড়াই ‘নিঃসঙ্গ নেকড়েদের’ যে উত্থান, সেটা ব্রেক্সিটের পরে ইউরোপীয় অর্থনীতির মতোই একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থার গল্পের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
No comments