অন্ধকারে আলোর দীপশিখা
কী করে আশ্চর্য এই অতিচেনা আমাদেরই ছেলে—কুড়িটি বছর যে প্রাচুর্যের মাঝে বড় হলো এ দেশেরই জল-হাওয়া, মাটি ও মানুষের কোলাহলে; সেই ছেলে কেমন করে এত ঘৃণা, এত দ্বেষ, এত হিংসা, এত হিংস্রতার মাঝে, রক্তচক্ষু মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে, প্রাণদান তুচ্ছ জ্ঞান করে, দৃঢ়চিত্তে সগর্বে জানিয়ে দিল যে ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’—এ কথা যতই ভাবি অবাক হয়ে যাই। জাতির ইতিহাসে কালিমালিপ্ত এক চরম অন্ধকার রাতে আপন মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে মেঘের রুপালি প্রান্তের মতো জ্বলে উঠল ফারাজ-তারকা। ফারাজ আইয়াজ হোসেন তার প্রাণের বিনিময়ে জানান দিল তার অনুচ্চারিত, কিন্তু সগর্বে ঘোষিত রক্তস্নাত মানবতার বাণী। এ বাণী সমমর্মিতার, এ বাণী নৈতিক নিষ্ঠার, এ বাণী অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা নত না করার, এ বাণী জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবাইকে মানবতার অচ্ছেদ্য বন্ধনে গেঁথে পৃথিবীকে প্রীতিময় পরিবেশে বাসযোগ্য করে তোলার। তার আত্মবলিদান অন্ধকারের পাদপীঠে জ্বালিয়ে দিল ভুবন আলো করা অনির্বাণ এক মঙ্গল প্রদীপ। ১ জুলাইয়ের বিভীষিকাময় রাতে গুলশানে হলি আর্টিজান ক্যাফে ট্র্যাজেডি বাংলাদেশের জন্য, বাঙালির জন্য এক চরম শোকাবহ ঘটনা, জাতির ইতিহাসের একটি করুণতম মুহূর্ত। আতিথেয়তা বাঙালির স্বভাবজাত আর ইসলামের মর্মবাণী হচ্ছে শান্তি। অথচ এই প্রেক্ষাপটেই রচিত হলো ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মন্তুদ একটি চরম বিয়োগান্ত কাহিনি। কূটনৈতিক মহলে একটি প্রচলিত কথা রয়েছে। ঢাকায় আগত বিদেশিরা দুবার কাঁদেন। প্রথমবার যখন আসেন তখন দুশ্চিন্তা থাকে, কোথায় যাচ্ছি?
ট্রাফিক জ্যাম আর রাজনৈতিক অস্থিরতার এই দেশ। ঝড়-বন্যার প্রকোপ। বিনোদনকেন্দ্রের অনুপস্থিতি, পরিবহনের দুষ্প্রাপ্যতা। আবার তাঁরা কাঁদেন বিদায়ের মুহূর্তে, বাংলাদেশ ছাড়ার প্রাক্কালে। তাঁদের অভিজ্ঞতার উপলব্ধি, এত অতিথিবৎসল সজ্জন বাঙালিরা। আন্তরিকভাবে এঁরা বিদেশিদের বরণ করে নেয়। বিদেশিদের জন্য তাঁদের গৃহের অবারিত দ্বার। বিদেশিকে সাহায্য-সহায়তায় উদ্গ্রীব থাকা যেন একজন বাঙালির স্বভাবজাত ধর্ম, আর এরই সঙ্গে রয়েছে সাম্যবাদী ইসলামের আলোতে সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে একই কাতারে রেখে সবাইকে একান্ত আপন করে নেওয়া। কিন্তু বাঙালির এই চিরন্তন ইতিবাচক চরিত্র হনন করতেই যেন বিধ্বংসী আঘাত এল, যা সিরিয়া-ইরাকের ইসলামিক স্টেটের মুখপাত্রের দাবি অনুসারে এক আন্তর্জাতিক চক্রের ধ্যানধারণাপ্রসূত। বেপথু এই চক্রান্তকারীরা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত মুসলমানদের প্রতি অন্যায়, অবিচার ও নৃশংসতার প্রতিবাদে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য এক বিধ্বংসী পন্থার উদ্ভাবন করেছে; যা ঘৃণা-বিদ্বেষ-অসহনশীলতায় লালিত এবং হিংস্র প্রতিশোধ গ্রহণের অযৌক্তিক স্পৃহাপ্রসূত। তা নিষ্ঠুর এবং অফলপ্রসূ, ধিক্কৃত, পাশবিক এবং সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। সেই যে তথাকথিত ‘অবিশ্বাসী’ সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে আমেরিকান সিআইএর সৃষ্ট তালেবান দলে যোগ দেওয়ার জন্য রিক্রুটমেন্ট করা শুরু হলো—বুশ-ব্লেয়ারের অমার্জনীয় ক্রাইমে সৃষ্ট ইরাক-সিরিয়ার ধ্বংসস্তূপে তা হলো বিধৃত। দুর্ভাগ্যক্রমে তা আজ নিয়েছে আইএস নামধারী আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের রূপ।
গুলশান ট্র্যাজেডির পর যুদ্ধরত সিরিয়ার রাকা থেকে তিন আন্তর্জাতিক অথচ বাঙালি জঙ্গি ঘোষণা দিল—বেশ করেছি, দুর্গতি আরও আছে। হয়ে গেল শোলাকিয়া। কী অসহনীয় ধৃষ্টতা, কী পাশবিক কল্পনা! কী করে কীভাবে এদের মগজধোলাই হলো? এসব ঘোষক এবং গুলশানে যেসব জঙ্গি তাণ্ডবলীলা চালাল, তারা তো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। অনেকেই বিত্তবান পরিবারের সন্তান। নতুন করে ভিডিওতে হুমকি শোনা গেল এমন এক তরুণের কাছ থেকে, যে শিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনা পরিবারের একজন, ছিলেন সুগায়কও, ‘ক্লোজ-আপ ওয়ান’ তারকা। বাবা ছিলেন এই সরকারের অধীনেই এককালে স্বরাষ্ট্রসচিব এবং অবসর-উত্তর নিয়োগপ্রাপ্ত ইলেকশন কমিশনার। কেউ বা হলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতার সন্তান। টেলিভিশনে বাবা তাঁর প্রশ্নাতীত পারিবারিক পটভূমিকার কথা তুলে ধরেছেন। যা-ই হোক না কেন, মোদ্দা কথা হলো, এখন প্রমাণিত হলো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্রের জাল বিস্তৃত হয়েছে সমাজের সর্বস্তরে। আর তাই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের মানসে কাদা ছোড়াছুড়ি না করে সন্ত্রাস দমনে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে সর্বদলীয় ঐক্যভিত্তিক আদর্শকেন্দ্রিক সার্বিক উদ্যোগ। ব্লেম-গেম ও আত্মঘাতী দলীয় রাজনীতি বাদ দিয়ে সবারই উচিত হবে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে তরুণ ফারাজ যে আশা ও আদর্শের প্রদীপ প্রজ্বালিত করল, তাতে স্নাত হয়ে তার রক্তে ভেজা বাণী অনুধাবন করে তা গ্রহণ করা এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আদর্শিক নিশ্ছিদ্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা। বাকরুদ্ধ এই মহান ট্র্যাজেডিতেও আজ আমরা মাথা উঁচু করে বলতে পারি, ফারাজ আমাদের গর্বের ধন।
আমাদের আশার উৎস। যে সমাজে ফারাজ হোসেনের মতো মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন তরুণের জন্ম হতে পারে, সে সমাজে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, সংকীর্ণতা অবশ্যই থাকতে পারে না। ফারাজের কুলখানিতে নেমেছিল মানুষের ঢল। সব শ্রেণির, সব পেশার, সব দলের বেদনায় মুহ্যমান মানুষের সমাগম। তবে মনে হচ্ছিল, শোকে ও সংকল্পে সবাই যেন ঐক্যবদ্ধ। এই ফারাজ স্মৃতি-মিলনীতে শোকাহত ইতালির রাষ্ট্রদূত মারিও পালমা (ইতালির নয়জন নাগরিক হয়েছিলেন এই নির্মমতার শিকার) আবেগাপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, ‘এই ট্র্যাজেডি আমাদের সবাইকে কাছে টেনে নিয়ে এসেছে। এ দেশের তরুণ সজ্ঞানে প্রাণ দিয়েছে সন্ত্রাস রোধে। দিয়েছে প্রাণ বাংলাদেশেই কর্মরত অনেক ইতালীয় নাগরিক। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আজ আমরা ঐক্যবদ্ধ।’ এই মনোভাব তো ফারাজের শাহাদাতেরই সৃষ্টি। পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক ত্যাগের কথা, প্রাণদানের কথা, জীবন বাজি রেখে সম্মুখসমরে এগিয়ে যাওয়ার কথা আমরা শুনেছি। শুনেছি মহাপুরুষদের মানবতাবোধের কথা। কিন্তু আমাদের চোখের সামনে আত্মাহুতি দিয়ে ফারাজ যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করল, আমি এর নজির কোথাও দেখিনি, কখনো শুনিনি।
অনায়াসেই সে দানবীয় সন্ত্রাসীদের হাত থেকে মুক্তি পেতে পারত, বস্তুত তাকে ওরা ছেড়েই দিয়েছিল। কিন্তু না, ফারাজের কাছে তা ছিল সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। বন্ধুদের সঙ্গে, আদর্শের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা সে করেনি। মানবতাবোধের জন্য, ন্যায়ের জন্য, সমমর্মিতার জন্য, সত্যের জন্য, নৈতিকতার জন্য সব বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে মাথা উঁচু করে নির্দ্বিধায় মৃত্যুকে বরণ করেছে। তার এই সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ ঘটনাক্রমে আকস্মিক বা দায়িত্ব পালন-প্রসূত নয়। হঠাৎ করে তার প্রাণ হরণ হয়নি। সুচিন্তিতভাবেই নীতিনিষ্ঠ থেকে অসীম-সাহসী ফারাজ বরণ করেছে তার নিয়তি। এর চেয়ে মহান আর কী হতে পারে? বাংলাদেশের অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশে ফারাজ হোসেন একটি আলোর ঝলকানি। তার শাহাদাত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ বিরোধের ঊর্ধ্বে উঠে আমাদের সংঘবদ্ধ সংগ্রামের জন্য প্রেরণা, উৎসাহ ও সাহস জোগাবে। সফল হবে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবিরোধী জাতীয় ঐক্যের আহ্বান। এটা আমাদের প্রত্যয়, জাতির প্রত্যাশা। ফারাজের মতো তরুণের এ ধরনের আত্মাহুতি কিছুতেই বৃথা হতে পারে না। হারিয়ে যেতে পারে না ধরার ধুলায়।
ইনাম আহমেদ চৌধুরী: অর্থনীতিবিদ ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা।
ইনাম আহমেদ চৌধুরী: অর্থনীতিবিদ ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা।
No comments