বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ মোকাবিলার সবচেয়ে কার্যকর উপায় by বিয়র্ন লোমবোর্গ
উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের
অগ্রাধিকার কী হওয়া উচিত, তা চিহ্নিত করার লক্ষ্যে গবেষণা করছে কোপেনহেগেন
কনসেনসাস সেন্টার। অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি সামাজিক, স্বাস্থ্য ও
পরিবেশগত উন্নয়নের ওপরও জোর দিচ্ছে সংস্থাটি। বাংলাদেশের জন্য ভিশন ২০২১
অর্জনে এই গবেষণাভিত্তিক কিছু নিবন্ধ প্রকাশ করছে প্রথম আলো। আজ প্রকাশ
করা হলো বারোতম নিবন্ধটি। সংক্রামক সব রোগের ব্যাপারেই আমরা সব সময় বেশি
সাবধানতা অবলম্বন করি। একটা দীর্ঘ সময় ধরে এসব রোগের কারণেই সারা বিশ্বের
অধিকাংশ মানুষ প্রাণ হারাত। আমরা সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবকে অনেকখানি
নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অসংক্রামক রোগ (এনসিডি)
হিসেবে পরিচিত হৃদ্রোগ, স্ট্রোক, ক্যানসার ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে মারা
যাচ্ছি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এমনটা দেখা যাচ্ছে। চাঁদপুরের মতলব উপজেলায়
চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮৬ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে সংক্রামক রোগে
মৃত্যুর হার ৫২ শতাংশ থেকে ১১ শতাংশে নেমে এসেছে। একই সময়কালে অসংক্রামক
রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬৮ শতাংশ হয়েছে। বর্তমানে
অসংক্রামক রোগগুলোই সবচেয়ে বড় ঘাতক। দেশে যত মানুষ মারা যাচ্ছে, তার ৫৯
শতাংশ মারা যায় নানা অসংক্রামক রোগে। স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশকে অনেক
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয় এবং স্বাস্থ্য খাতের বাইরেও আরও অনেক চ্যালেঞ্জ
রয়েছে। সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে এ দেশে প্রথমে কোন সমাধানের দিকে নজর
দেওয়া উচিত? এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রায়োরিটিজ সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করছে।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগের সহযোগিতায় কোপেনহেগেন
কনসেনসাস সেন্টার গবেষণা ও পরামর্শ–বিষয়ক প্রকল্প বাংলাদেশ প্রায়োরিটিজ
গঠন করে। এ প্রকল্পে বাংলাদেশ, আশপাশের অঞ্চলসহ সারা বিশ্বের শীর্ষস্থানীয়
ডজন খানেক অর্থনীতিবিদ কাজ করছেন। বাংলাদেশ উন্নয়নের জন্য যে টাকাটা ব্যয়
করছে, কীভাবে তার সর্বোচ্চ কল্যাণ নিশ্চিত করা যায়, সে বিষয়েই তাঁরা
গবেষণা করছেন এবং পরামর্শ তুলে ধরছেন। চারজন মার্কিন অর্থনীতিবিদ লিংক নামে
তাঁদের লিখিত একটি নতুন গবেষণাপত্রে বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ মোকাবিলায়
বিভিন্ন কৌশল পরীক্ষা করে দেখেছেন। তাঁরা দেখেছেন যে সবচেয়ে সাশ্রয়ী সমাধান
হলো সেগুলো, যেগুলোর লক্ষ্য উচ্চরক্তচাপ (হাইপারটেনশন) ও তামাকসেবন হ্রাস
করা। বাংলাদেশজুড়ে ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশ
ক্লিনিক বাড়ি থেকে আধা ঘণ্টা হাঁটার দূরত্বের মধ্যে অবস্থিত। এই বিদ্যমান
অবকাঠামো অসংক্রামক রোগসমূহ মোকাবিলার ক্ষেত্রে একটি সাশ্রয়ী সুযোগ সৃষ্টি
করেছে। বাংলাদেশে হাইপারটেনশন বা অস্বাভাবিক উচ্চরক্তচাপের প্রকোপ যে শুধু
ব্যাপক তা নয়, এটি হৃদ্রোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিসসহ আরও অনেক গুরুতর অসুখের
জন্যও প্রাথমিক ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। আপনি বা আপনার পরিচিত যে কারও এই রোগ
থাকার সম্ভাবনা খুব বেশি। ৩৫ বছরের বেশি বয়স্ক প্রতি তিনজন নারীর একজন এবং
প্রতি পাঁচজন পুরুষের একজনের উচ্চরক্তচাপ রয়েছে। কিন্তু এর চিকিৎসা বেশ সহজ
এবং মোটামুটি সস্তা: পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধের খরচসহ প্রতি ব্যক্তির
ক্ষেত্রে বার্ষিক খরচ প্রায় ৭ হাজার টাকা। উচ্চরক্তচাপ কমানোর ক্ষেত্রে এই
সমাধান অনেক মানুষের জন্য অনেক বেশি সুফল বয়ে আনতে পারে। চিকিৎসাকৃত
রোগীদের তিন-চতুর্থাংশ গড়ে তিন বছর বেশি বাঁচার আশা করতে পারে।
সামগ্রিকভাবে, পরবর্তী পাঁচ বছর ধরে এই প্রচেষ্টার পেছনে ব্যয়িত প্রতি টাকা
৩৭ টাকার সুফল বয়ে আনবে। তামাকও হৃদ্রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং বাংলাদেশে এ
রোগটি একটি বড় ঘাতক: প্রতিবছর ৭০ হাজার মানুষ তামাক–সংশ্লিষ্ট রোগের কারণে
মৃত্যুবরণ করে। পুরুষেরা সাধারণত বেশি তামাক সেবন করে এবং নারীরা প্রধানত
ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত পণ্য ব্যবহার করে। ১৫ বছরের বেশি বয়স এমন প্রায় ৪ কোটি
১৩ লাখ মানুষ কোনো না কোনোভাবে তামাক ব্যবহার করে। অর্থাৎ এই বয়সসীমার
মধ্যে প্রতি পাঁচজনের দুজন তামাক ব্যবহার করে। অনেক দেশে সিগারেটের ওপর কর
আরোপ উল্লেখযোগ্যভাবে ধূমপান কমিয়ে এনেছে। গবেষকেরা সমস্ত তামাকজাত পণ্যের
ওপর কর আরোপ এবং তা কঠোরভাবে কার্যকর করার প্রস্তাব করেছেন। বর্তমানে
তামাকের খুচরা মূল্যের ওপর ৩৫ শতাংশ কর ধরা হয়, কিন্তু এই কর প্রায়ই আদায়
করা হয় না। কঠোরভাবে আরোপিত উচ্চ কর, যা খুচরা মূল্যের ৫০ শতাংশ হবে যদি
কার্যকর করা যায় তাহলে ২০২১ সালের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্যের চাহিদা ৭ শতাংশে
নামিয়ে আনবে। এই কর দিয়ে যে রাজস্ব আয় হবে, তা দিয়ে এটি বাস্তবায়নের
সম্পূর্ণ খরচ শোধ হয়ে যাবে। আর তামাকের ব্যবহার হ্রাস পাঁচ বছর ধরে
প্রতিবছর ৫ হাজারেরও বেশি মৃত্যু রোধ করবে। আপনি যদি এই সমস্ত সুবিধা একত্র
করেন, পরবর্তী পাঁচ বছর ধরে তামাকের কর ৫০ শতাংশ বৃদ্ধির জন্য ব্যয়িত
প্রতি ১ টাকায় ৮ টাকার সমান কল্যাণ সাধন করবে। গবেষকেরা তৃতীয় যে রোগটি
নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, তা হলো জরায়ুমুখের ক্যানসার। এটা বাংলাদেশের
নারীদের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ রোগগুলোর একটি। এটা প্রতিবছর প্রায় ১০ হাজার
নারীর মৃত্যু ঘটায়। যদিও আমরা জানি এ ক্ষেত্রে কীভাবে সাহায্য করতে হবে,
তবে এটা বেশ ব্যয়বহুল। বিশেষজ্ঞরা গবেষণা করে দেখেছেন যে জরায়ুমুখের
ক্যানসারের টিকা, স্ক্রিনিং ও চিকিৎসায় ব্যয়িত প্রতি টাকায় অর্ধেক টাকারও
কম সুফল বয়ে আনবে। এই রোগ যেমন ভয়াবহ, তেমনি আমাদের গবেষণা করে দেখতে হবে
যে এর থেকে ভালো আরও অন্য কোনো ক্ষেত্র আছে কি না, যেখানে আমরা ব্যয়িত
প্রতি টাকায় আরও পুরুষ ও নারীদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে সাহায্য করতে পারি।
যেমন ধরুন উচ্চরক্তচাপ মোকাবিলা। এই নতুন গবেষণায় যেমন দেখা গিয়েছে,
বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ মোকাবিলার অনেক উপায় রয়েছে এবং এর বাইরেও অনেক
সমস্যা রয়েছে, যেগুলো মোকাবিলা করতে হবে। যদি বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে
কল্যাণকর কী হবে, সে বিষয়ে আপনি সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন, তাহলে আপনি কোন
ক্ষেত্রটি অর্থ ব্যয় করার জন্য বেছে নিতেন? <https://copenhagen. fbapp.
io/ncdpriorities>-এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য শোনা যাক। ব্যয়িত প্রতি টাকায়
বাংলাদেশ কোন সমাধানের মাধ্যমে সর্বোচ্চ কল্যাণ সাধন করতে পারে, সে
ব্যাপারে আমরা আলোচনা চালিয়ে যেতে চাই।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
ড. বিয়র্ন লোমবোর্গ: কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টারের প্রেসিডেন্ট। টাইম ম্যাগাজিনের মূল্যায়নে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির একজন।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
ড. বিয়র্ন লোমবোর্গ: কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টারের প্রেসিডেন্ট। টাইম ম্যাগাজিনের মূল্যায়নে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির একজন।
No comments