শুভ জন্মদিন, কমরেড! by মশিউল আলম
শুভ
জন্মদিন, কমরেড!’ ‘আরে কিসের জন্মদিন? কৃষকের পোলার আবার জন্মদিন কী?’
প্রতিবছর পয়লা মে সরদার ফজলুল করিমের সঙ্গে আমার এ রকম সংলাপের পুনরাবৃত্তি
হতো। জন্মদিন পালন করা নিয়ে তাঁর কুণ্ঠার শেষ ছিল না।
যে কৃষকের ‘পোলা’ বলে তিনি নিজের পরিচয় ব্যক্ত করতেন, তিনি ছিলেন বরিশালের বানারীপাড়ার আটিপাড়া নামে অজপাড়াগাঁয়ের এক মধ্যবিত্ত মুসলমান নিরক্ষর কৃষক। গত শতকের তিরিশের দশকে তিনি তাঁর এই ‘পোলা’টাকে বিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন। পোলা পড়তে পড়তে বরিশাল জিলা স্কুলের চৌকাঠ পার হয়ে চলে এসেছিলেন ঢাকায়। ফার্স্ট ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা কলেজে। সেখান থেকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান পেয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দর্শনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক হিসেবে। কিন্তু সরদার ফজলুল করিম, আটিপাড়ার সেই মধ্যবিত্ত মুসলমান কৃষকের সন্তান, লেখাপড়া করে শুধু ‘মানুষ’ হননি, সারা পৃথিবীর মেহনতি মানুষকে যুগ-যুগান্তরের শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্ত করার দীক্ষাও নিয়েছেন, হয়েছেন আগাপাছতলা এক কমিউনিস্ট। এর মধ্যে ভারত ভেঙে দুই টুকরা, পূর্ব বাংলা পড়েছে পাকিস্তানের মধ্যে, যে পাকিস্তানের শাসকেরা পূর্ব বাংলার কমিউনিস্টদের ধরে ধরে জেলে পুরতে শুরু করেছে। একদিন কমিউনিস্ট পার্টি তাঁকে বলল, ‘পুলিশ তোমাকে খুঁজছে। তুমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাও।’ সরদার ফজলুল করিম কৃষক বাবার স্বপ্ন ভেঙে টুকরো টুকরো করে পার্টির নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দিয়ে আত্মগোপনে চলে গেলেন। তারও আগে, তখনো ভারত বিভক্ত হয়নি, ব্রিটিশ সরকার তাঁকে কমনওয়েলথ বৃত্তি দিয়ে বিলেত নিয়ে যেতে চেয়েছিল। সরদার সেই বৃত্তির কাগজ নিয়ে হাজির হলেন কলকাতার ৮ নম্বর ডেকার্স লেনে কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে। কমরেড মুজাফফর আহমদ প্রমুখ নেতাদের তিনি বললেন, ‘আমি তো বিলেত যাচ্ছি।’ নেতারা তাঁকে রসিকতা করে বললেন, ‘আপনি বিলেত যাবেন আর আমরা এখানে বসে ভেরেন্ডা ভাজব?’ সরদার জানতে চাইলেন ‘আমাকে কী করতে হবে?’ নেতারা তাঁকে বললেন, ‘কাঁথা-কম্বল নিয়ে পার্টি অফিসে চলে আসেন।’ সরদার বৃত্তির কাগজটা ফড়ফড় করে ছিঁড়ে ফেলে দিলেন। ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় ঢাকায় সন্তোষ গুপ্তের বাড়িতে পার্টির গোপন সভা থেকে গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন। ১৯৫৪ সালে কারারুদ্ধ অবস্থায় পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে চার দফায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে কাটিয়েছেন দীর্ঘ ১১ বছর। ৫৮ দিনের টানা অনশন ধর্মঘটে অংশ নিয়েছেন; শুধু লবণপানি খেয়ে কাটিয়েছেন দিনের পর দিন, পানিশূন্যতায় উন্মাদ হয়ে যেতে দেখেছেন সহরাজবন্দীদের, ফোর্স ফিডিংয়ের সময় দেখেছেন বন্দীদের দাঁত ভেঙে ফেলার দৃশ্য। ভুগেছেন প্রাণান্তকর হাঁপানিতে ও খোসপাঁচড়ায়। বরিশাল জিলা স্কুলে পড়ার সময় তিনি থাকতেন বেল ইসলামিয়া ছাত্রাবাসে। রাত ১০টায় সব ঘরের বাতি নিভিয়ে দেওয়া হলে তিনি বই নিয়ে দেয়াল টপকে বেরিয়ে যেতেন, জাহাজঘাটায় স্ট্রিটল্যাম্পের নিচে বসে বই পড়তেন। ওখানেই এক বন্ধু তাঁকে গোপনে পড়তে দিয়েছিল শরৎচন্দ্রের উপন্যাস পথের দাবি। রাজনীতির প্রতি তাঁর আগ্রহের শুরু ছিল সেটাই। অনেক পড়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন পড়তে পড়তে ঝুঁকেছিলেন সাম্যবাদী ভাবাদর্শের প্রতি। আমি তাঁকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনি প্লেটো-অ্যারিস্টটল পড়তে পড়তে কমিউনিস্ট হয়েছিলেন কীভাবে?’ সরাসরি উত্তর না দিয়ে তিনি আমাকে এই গল্প বলেছিলেন, ‘তেতাল্লিশ সালে খুব বড় একটা দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। বাংলায় পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ বলে ওটাকে। আমি তখন সক্রেটিস, প্লেটো, হেগেল ইত্যাদি নিয়ে পড়াশোনা করছিলাম। একদিন এক কমরেড এসে বলল, এই, তুমি এত কী লেখাপড়া করো? হেগেল তোমাকে কোন স্বর্গে নিয়ে যাবে? তোমার মা-বোনেরা না খেয়ে মারা যাচ্ছে, আর তুমি হেগেল পড়ে কী করবে? তুমি নয়াবাজারে গিয়ে লঙ্গরখানায় ডিউটি করো। দেখো গিয়ে সেখানে তোমার মা-বোনেরা এসে হাজির হয়েছে। আমি আর হেগেলের কাছে থাকতে পারলাম না। পরদিন সিরাজউদ্দৌলা পার্কে গেলাম রিলিফের কাজ করতে।’ অন্যায়-অবিচার, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রামী এই মানুষটির জ্ঞান অর্জন করা ও তা বিতরণ করার প্রতিও প্রবল ঝোঁক ছিল। ১৯৬৪ সালে যোগ দিয়েছিলেন বাংলা একাডেমির অনুবাদ বিভাগে। সে সময় অনুবাদ করেছেন প্লেটোর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংলাপ, তাঁর মহাগ্রন্থ রিপাবলিক, অ্যারিস্টটলের পলিটিকস। সরল বাংলা অনুবাদের মাধ্যমে গ্রিক দর্শনকে বাংলাদেশের মানুষের কাছে তিনিই প্রথম পৌঁছে দিয়েছেন। স্বাধীনতার পর আবার যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, এবার দর্শন নয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক তাঁকে বলেছিলেন, ‘সরদার, আমার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছেলেমেয়েদের আপনি একটু দর্শন পড়াবেন।’ তারপর তিনি রুশোর সোশ্যাল কন্ট্র্যাক্ট অনুবাদ করেছেন, কনফেশনস-এরও একটা বড় অংশ অনুবাদ করে আমি রুশো বলছি নামে একটা বই প্রকাশ করেছেন।
বিদ্যার্জন ও রাজনৈতিক তৎপরতার মধ্যে কোনো বিরোধ তিনি কখনোই দেখেননি। বহু বছর ধরে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ তাঁর ছিল না। কিন্তু শোষণ-বঞ্চনার অবসান সব সময়ই দেখেছেন, কখনো হতাশা প্রকাশ করেননি। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলোপের পর বামপন্থী দলগুলোর ক্ষয়িষ্ণু দশা নিয়ে আলাপ তুললে তিনি বলতেন, ‘কমিউনিস্ট পার্টি বলে আমার কাছে কোনো ব্যাপার নাই। পৃথিবীতে যত সৎ মানুষ আছে, মানুষের জন্য যার বুকে ভালোবাসা আছে, তাকেই আমি কমিউনিস্ট বলি।’ আজ তাঁর ৯১তম জন্মদিন। দুবছর হলো তিনি প্রয়াত। কিন্তু চোখের আড়াল হলেই মানুষ মনের আড়ালে চলে যায়—এই আপ্তবাক্য সরদার ফজলুল করিমের বেলায় সত্য নয়। তাঁর সান্নিধ্য যিনি পেয়েছেন, তাঁর পক্ষে তাঁকে ভুলে যাওয়া কখনো সম্ভব নয় বলে আমার বিশ্বাস। আর তিনি এমনই স্নেহময় একজন মানুষ ছিলেন যে, তাঁর স্নেহের ভাগ যাঁরা পেয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই মনে হবে, তিনি বুঝি আমাকেই সবচেয়ে বেশি স্নেহ করতেন।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
যে কৃষকের ‘পোলা’ বলে তিনি নিজের পরিচয় ব্যক্ত করতেন, তিনি ছিলেন বরিশালের বানারীপাড়ার আটিপাড়া নামে অজপাড়াগাঁয়ের এক মধ্যবিত্ত মুসলমান নিরক্ষর কৃষক। গত শতকের তিরিশের দশকে তিনি তাঁর এই ‘পোলা’টাকে বিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন। পোলা পড়তে পড়তে বরিশাল জিলা স্কুলের চৌকাঠ পার হয়ে চলে এসেছিলেন ঢাকায়। ফার্স্ট ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা কলেজে। সেখান থেকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান পেয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দর্শনে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক হিসেবে। কিন্তু সরদার ফজলুল করিম, আটিপাড়ার সেই মধ্যবিত্ত মুসলমান কৃষকের সন্তান, লেখাপড়া করে শুধু ‘মানুষ’ হননি, সারা পৃথিবীর মেহনতি মানুষকে যুগ-যুগান্তরের শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্ত করার দীক্ষাও নিয়েছেন, হয়েছেন আগাপাছতলা এক কমিউনিস্ট। এর মধ্যে ভারত ভেঙে দুই টুকরা, পূর্ব বাংলা পড়েছে পাকিস্তানের মধ্যে, যে পাকিস্তানের শাসকেরা পূর্ব বাংলার কমিউনিস্টদের ধরে ধরে জেলে পুরতে শুরু করেছে। একদিন কমিউনিস্ট পার্টি তাঁকে বলল, ‘পুলিশ তোমাকে খুঁজছে। তুমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাও।’ সরদার ফজলুল করিম কৃষক বাবার স্বপ্ন ভেঙে টুকরো টুকরো করে পার্টির নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দিয়ে আত্মগোপনে চলে গেলেন। তারও আগে, তখনো ভারত বিভক্ত হয়নি, ব্রিটিশ সরকার তাঁকে কমনওয়েলথ বৃত্তি দিয়ে বিলেত নিয়ে যেতে চেয়েছিল। সরদার সেই বৃত্তির কাগজ নিয়ে হাজির হলেন কলকাতার ৮ নম্বর ডেকার্স লেনে কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে। কমরেড মুজাফফর আহমদ প্রমুখ নেতাদের তিনি বললেন, ‘আমি তো বিলেত যাচ্ছি।’ নেতারা তাঁকে রসিকতা করে বললেন, ‘আপনি বিলেত যাবেন আর আমরা এখানে বসে ভেরেন্ডা ভাজব?’ সরদার জানতে চাইলেন ‘আমাকে কী করতে হবে?’ নেতারা তাঁকে বললেন, ‘কাঁথা-কম্বল নিয়ে পার্টি অফিসে চলে আসেন।’ সরদার বৃত্তির কাগজটা ফড়ফড় করে ছিঁড়ে ফেলে দিলেন। ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় ঢাকায় সন্তোষ গুপ্তের বাড়িতে পার্টির গোপন সভা থেকে গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন। ১৯৫৪ সালে কারারুদ্ধ অবস্থায় পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে চার দফায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে কাটিয়েছেন দীর্ঘ ১১ বছর। ৫৮ দিনের টানা অনশন ধর্মঘটে অংশ নিয়েছেন; শুধু লবণপানি খেয়ে কাটিয়েছেন দিনের পর দিন, পানিশূন্যতায় উন্মাদ হয়ে যেতে দেখেছেন সহরাজবন্দীদের, ফোর্স ফিডিংয়ের সময় দেখেছেন বন্দীদের দাঁত ভেঙে ফেলার দৃশ্য। ভুগেছেন প্রাণান্তকর হাঁপানিতে ও খোসপাঁচড়ায়। বরিশাল জিলা স্কুলে পড়ার সময় তিনি থাকতেন বেল ইসলামিয়া ছাত্রাবাসে। রাত ১০টায় সব ঘরের বাতি নিভিয়ে দেওয়া হলে তিনি বই নিয়ে দেয়াল টপকে বেরিয়ে যেতেন, জাহাজঘাটায় স্ট্রিটল্যাম্পের নিচে বসে বই পড়তেন। ওখানেই এক বন্ধু তাঁকে গোপনে পড়তে দিয়েছিল শরৎচন্দ্রের উপন্যাস পথের দাবি। রাজনীতির প্রতি তাঁর আগ্রহের শুরু ছিল সেটাই। অনেক পড়ে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন পড়তে পড়তে ঝুঁকেছিলেন সাম্যবাদী ভাবাদর্শের প্রতি। আমি তাঁকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনি প্লেটো-অ্যারিস্টটল পড়তে পড়তে কমিউনিস্ট হয়েছিলেন কীভাবে?’ সরাসরি উত্তর না দিয়ে তিনি আমাকে এই গল্প বলেছিলেন, ‘তেতাল্লিশ সালে খুব বড় একটা দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। বাংলায় পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ বলে ওটাকে। আমি তখন সক্রেটিস, প্লেটো, হেগেল ইত্যাদি নিয়ে পড়াশোনা করছিলাম। একদিন এক কমরেড এসে বলল, এই, তুমি এত কী লেখাপড়া করো? হেগেল তোমাকে কোন স্বর্গে নিয়ে যাবে? তোমার মা-বোনেরা না খেয়ে মারা যাচ্ছে, আর তুমি হেগেল পড়ে কী করবে? তুমি নয়াবাজারে গিয়ে লঙ্গরখানায় ডিউটি করো। দেখো গিয়ে সেখানে তোমার মা-বোনেরা এসে হাজির হয়েছে। আমি আর হেগেলের কাছে থাকতে পারলাম না। পরদিন সিরাজউদ্দৌলা পার্কে গেলাম রিলিফের কাজ করতে।’ অন্যায়-অবিচার, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রামী এই মানুষটির জ্ঞান অর্জন করা ও তা বিতরণ করার প্রতিও প্রবল ঝোঁক ছিল। ১৯৬৪ সালে যোগ দিয়েছিলেন বাংলা একাডেমির অনুবাদ বিভাগে। সে সময় অনুবাদ করেছেন প্লেটোর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংলাপ, তাঁর মহাগ্রন্থ রিপাবলিক, অ্যারিস্টটলের পলিটিকস। সরল বাংলা অনুবাদের মাধ্যমে গ্রিক দর্শনকে বাংলাদেশের মানুষের কাছে তিনিই প্রথম পৌঁছে দিয়েছেন। স্বাধীনতার পর আবার যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, এবার দর্শন নয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক তাঁকে বলেছিলেন, ‘সরদার, আমার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছেলেমেয়েদের আপনি একটু দর্শন পড়াবেন।’ তারপর তিনি রুশোর সোশ্যাল কন্ট্র্যাক্ট অনুবাদ করেছেন, কনফেশনস-এরও একটা বড় অংশ অনুবাদ করে আমি রুশো বলছি নামে একটা বই প্রকাশ করেছেন।
বিদ্যার্জন ও রাজনৈতিক তৎপরতার মধ্যে কোনো বিরোধ তিনি কখনোই দেখেননি। বহু বছর ধরে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ তাঁর ছিল না। কিন্তু শোষণ-বঞ্চনার অবসান সব সময়ই দেখেছেন, কখনো হতাশা প্রকাশ করেননি। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলোপের পর বামপন্থী দলগুলোর ক্ষয়িষ্ণু দশা নিয়ে আলাপ তুললে তিনি বলতেন, ‘কমিউনিস্ট পার্টি বলে আমার কাছে কোনো ব্যাপার নাই। পৃথিবীতে যত সৎ মানুষ আছে, মানুষের জন্য যার বুকে ভালোবাসা আছে, তাকেই আমি কমিউনিস্ট বলি।’ আজ তাঁর ৯১তম জন্মদিন। দুবছর হলো তিনি প্রয়াত। কিন্তু চোখের আড়াল হলেই মানুষ মনের আড়ালে চলে যায়—এই আপ্তবাক্য সরদার ফজলুল করিমের বেলায় সত্য নয়। তাঁর সান্নিধ্য যিনি পেয়েছেন, তাঁর পক্ষে তাঁকে ভুলে যাওয়া কখনো সম্ভব নয় বলে আমার বিশ্বাস। আর তিনি এমনই স্নেহময় একজন মানুষ ছিলেন যে, তাঁর স্নেহের ভাগ যাঁরা পেয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই মনে হবে, তিনি বুঝি আমাকেই সবচেয়ে বেশি স্নেহ করতেন।
মশিউল আলম: সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com
No comments