নাট্য অভিযাত্রায় অনবদ্য ‘শিকারী’ by জাহীদ রেজা নূর
এত
দিন পথনাটক বলতে যা দেখে এসেছি, তা থেকে একটু আলাদা কিছু দেখা গেল গতকাল
চারুকলার বকুলতলায়। ৩০ বছর পর পথনাটক করতে এসে নির্দেশক নাসির উদ্দীন ইউসুফ
কি নতুন করে এই মাধ্যম নিয়ে ভাবতে শেখালেন? কাল শনিবার বিকেল সাড়ে চারটায়
যখন বকুলতলায় পৌঁছালাম, তখনো চলছিল কিছু হাতুড়ি-পেরেকের ঠোকাঠুকি। কয়েক
সারি চেয়ার, তা–ও ছিল ফাঁকা। পথনাটক বলেই মাটি আর বালুতে ঢাকা ফাঁকা
জায়গাটির ঠিক পেছনে তিনটি ছবি। একটি সোহাগী জাহান তনুর, একটি কল্পনা
চাকমার, অন্যটি পূর্ণিমা রানী শীলের। নাটকে সরাসরি এঁদের কথা নেই। তবু কি
প্রচ্ছন্ন হয়ে নেই? নির্দেশক বলেছিলেন, ঠিক পাঁচটায় শুরু হবে নাটক। ততক্ষণে
চেয়ারগুলো ভরে গেছে। পেছনে কয়েক সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন দর্শক। নাটকে চরিত্র
কম। সুধা, হাসনা, কয়েকজন খেলোয়াড় আর রেফারি। এ রকম সাদামাটা কয়েকটি
চরিত্রই যে কিছুক্ষণের মধ্যে কাঁপিয়ে দেবে দর্শকমন, তা কে জানত আগে!
খেলোয়াড়েরা রেফারিকে একেবারেই পাত্তা দেয় না। তাদের মুখে মুখোশ! এবং তারা
শুধু খেলোয়াড় নয়, শিকারিও বটে। তাদের হিংস্রতার শিকার হয় মেয়েরা। এরা
মানে না মানা। এদের মধ্যে শুভবোধের উদয় হয় না। রেফারি মাঝে মাঝে এসে কিছু
নীতিকথা শুনিয়ে যায় বটে, কিন্তু কে শোনে কার কথা! সুধা নামের মেয়েটি মনে
করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর নাটকের সুধাকেই। ফুলের মালায় নিজেকে সাজিয়ে
পথ চলছিল সে। গাইছিল ‘ফুলে ফুলে ঢ’লে ঢ’লে’ গানটি। এ সময় শিকারিরা এসে ওকে
আঘাত করে। ওকে নিয়ে উৎসব শুরু করে। শরীরী কসরত আর বাদ্যযন্ত্রের
যুগলবন্দীতে সৃষ্টি হয় বিভীষিকার! আশপাশে তাকিয়ে বিহ্বল হয়ে যাই, অনেকের
চোখেই পানি। নাচের মুদ্রায়, হাতের প্রতীকী ভাষায়, কোরিওগ্রাফিতে;
তবলা-বাঁশি-হারমোনিয়াম আর ড্রামের সুচারু প্রয়োগে দৃশ্যগুলো শিল্প হয়ে
উঠতে থাকে। খেলোয়াড়দের শরীরী খিদে বাড়তেই থাকে। তারা আরও একটা মেয়েকে
ধর্ষণ করে। রেফারি খেলোয়াড়দের মনে করিয়ে দেয়, এই মেয়েটি কোন এলাকার, কার
মেয়ে। খেলোয়াড় বুঝতে পারে, তার দেহের ক্ষুধার শিকার হয়েছে তারই বোন। এরপর
মুখোশ আর থাকে না। কিন্তু চোখ বাঁধা থাকে কাপড়ে। মনে পড়ে যায় ইডিপাস
নাটকের কথা। আত্মোপলব্ধি হয় শিকারের। সেই ৩০ বছর আগে সেলিম আল দীনের লেখা
চর কাঁকড়ার ডকুমেন্টারি নামে পথনাটক করেছিলেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। বহুদিন
বাদে নতুন ছেলেমেয়েদের দিয়ে আবার এলেন পথনাটক নিয়ে। নতুন ছেলেমেয়েরা করলেন
অনবদ্য অভিনয়, গাইলেন প্রাণখুলে। আর সবটা মিলে যা হয়ে উঠল, তা একটি সুচারু
শিল্পকর্ম। দুটি বর্বর ঘটনার বয়ানের মাধ্যমে সামাজিক অনাচার ফুটে উঠল।
পথনাটক শিকারী লিখেছেন মান্নান হীরা। ১৪ দিনের নিয়মিত মহড়ায় নাটকটির
উদ্বোধনী পরিবেশনা ছিল গতকাল। নাটক শেষে আলোচনা করেন ড. সাদেকা হালিম,
মামুনুর রশীদ, আবদুস সেলিম, আবু সাঈদ খান, হাসান আরিফ, মান্নান হীরা ও
নাসির উদ্দীন ইউসুফ। এটি বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদের প্রথম প্রযোজনা। এটিকে
‘হত্যা ও ধর্ষণবিরোধী নাট্য অভিযাত্রা’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। আজ শহীদ
মিনারে আর টিএসসিতে শিকারী নাটকটির অভিনয় হবে।
No comments