সরকার সমালোচনাকে দেখছে বিরোধিতা হিসেবে : সুলতানা কামাল by সোহরাব হাসান
সুলতানা
কামালের জন্ম ১৯৫০ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে
স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক
ডিগ্রি নেন। এরপর হল্যান্ডের ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল স্টাডিজ থেকে
ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে মাস্টার্স করেন। তিনি ষাটের দশকে ছাত্র ও সাংস্কৃতিক
আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন এবং একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশ নেন। সাবেক
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বর্তমানে ট্রান্সপারেন্সি
ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর সভাপতি। কিছুদিন আগ পর্যন্ত তিনি
ছিলেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব
হাসান
প্রথম আলো : সম্প্রতি আপনি বিআইডিএসের এক সেমিনারে বলেছেন স্বাধীনতা না থাকলে প্রবৃদ্ধি বা উন্নয়ন দিয়ে কী করব? বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন কি?
সুলতানা কামাল : বাংলাদেশের বহুমাত্রিক উন্নয়ন নিয়ে অহংকার করার মতো অবস্থানে পৌঁছেছি আমরা। এর মধ্যে প্রবৃদ্ধি অন্যতম। তর্ক উঠেছিল উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি ও সুশাসন নিয়ে। আমি সুশাসন বলতে মানুষের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং নিরাপদ জীবনযাপনের অধিকার বুঝি। আমি বলেছি, মানুষের সার্বিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে না পারলে প্রবৃদ্ধির উপযোগিতাটা কী? সুশাসন ছাড়া বা সুশাসনকে উপেক্ষা করে প্রবৃদ্ধি দিয়ে কী করব?
প্রথম আলো : একজন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে আপনি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে কীভাবে দেখছেন?
সুলতানা কামাল : মানবাধিকারের প্রথম শর্তই হলো অন্যের ক্ষতি না করে নিজের পছন্দ অনুযায়ী জীবনযাপন করা। কেউ যদি আমার অধিকার ক্ষুণ্ন করে তাহলে তার প্রতিকার বা ন্যায়বিচার পাওয়া।কিন্তু এখন জরিপ করলে অধিকাংশ মানুষই বলবে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করি না। যেমনটি বলেছিলেন জঙ্গিবাদীদের হাতে নিহত ফয়সল আরেফিন দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। সম্প্রতি কলাবাগানের জোড়া খুনের শিকার তনয়ের স্বজনেরা বললেন, আমাদের বলার বা করার কিছু নেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর তো বিচার করার কথা নয়। এর অর্থ হলো আমাদের যে বিচারব্যবস্থা আছে, সেটি তেমন কার্যকর বলা যাচ্ছে না। মানবাধিকার থাকলে মানুষ নিরাপদে ও শান্তিতে বসবাস করতে পারে, সেটিও প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। এখন নিজের ঘরেই মানুষ বেশি অনিরাপদ বোধ করছে।
প্রথম আলো : এর দায় কার?
সুলতানা কামাল : মানবাধিকারের দৃষ্টিতে দেখলে দায়টা প্রধানত রাষ্ট্রের। জনগণ তাদের সব দায় রাষ্ট্র তথা সরকারের কাছে সমর্পণ করে এবং তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারেরই।
প্রথম আলো : সরকার কি সেই দায়িত্ব পালন করছে?
সুলতানা কামাল : বর্তমানে যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, তাতে বলা যায় সরকার করছে না, বা করতে পারছে না। দুটোই উদ্বেগের বিষয়। সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যদি সরকার সেটি করতে না পারে, বলব, তা গোটা জাতিরই অক্ষমতা।
প্রথম আলো : সরকার তো জনগণকে নিয়েই। যেকোনো সংকট মোকাবিলাও করতে হয় জনগণকে সঙ্গে নিয়েই। সেটা কি হচ্ছে?
সলতানা কামাল : সেখানে একটি বড় ফাঁক রয়ে গেছে। যাঁরা সরকারে থাকেন, তাঁরা ভাবেন সবকিছু করার কর্তৃত্ব ও এখতিয়ার তাঁদেরই। তাঁরা দায়দায়িত্বের চেয়ে ক্ষমতাকেই প্রাধান্য দেন। তাঁরা মনে করেন, ‘যা করার আমরাই করব। অন্যদের কিছু করার নেই।’
প্রথম আলো : এই ধারণাটা কতটা গণতান্ত্রিক?
সুলতানা কামাল : গণতন্ত্রের চিরায়ত ধারণার সঙ্গে অবশ্যই সাংঘর্ষিক। গণতন্ত্র হলো জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের শাসন। রাষ্ট্র পরিচালনায় সেই জনগণই যদি উপেক্ষিত থাকে তাকে আমরা জনগণের শাসন বলতে পারি না।
প্রথম আলো : সামরিক শাসনামলেও নাগরিক সমাজ যতটুকু ভূমিকা পালন করছে, সেটি কি এখন তারা পারছে?
সুলতানা কামাল : সামরিক শাসনের সঙ্গে তুলনা চলে না। সেটি অন্তর্নিহিতভাবেই অগণতান্ত্রিক ও অগ্রহণযোগ্য। সেখানে যদি কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে নাগরিক সমাজ ভূমিকা পালন করেও থাকে, তা ‘বাই ডিফল্ট’। অর্থাৎ তাদের দুর্বলতার কারণে।
প্রথম আলো : কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসনামলে সেই ভূমিকা পালনে বাধা আসছে কেন?
সুলতানা কামাল : বাধা আসবে না, সেটাই একান্ত প্রত্যাশা ছিল। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে স্বাধীনতার পর যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হয়, নানা বিচ্যুতি সত্ত্বেও তাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিধৃত করেছিল। পঁচাত্তরের পর দীর্ঘদিন সামরিক শাসন চেপে বসে এবং শাসকেরা সেই চেতনা পুরোপুরি অস্বীকার করে। আগেরটি ছিল বিচ্যুতি, পরেরটি অস্বীকার। সে সময়ে শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সামাজিক ধ্যানধারণায় ধর্মনিরপেক্ষতাকে সরিয়ে সম্প্রদায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ার চেষ্টা চলে। এমনকি তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় শরিক করে। এরপর গণতন্ত্রের অভিযাত্রা শুরু হলেও সামাজিক অধোগতি ঠেকানো যায়নি, সামাজিক ক্ষতগুলো রয়েই গেছে।
প্রথম আলো : কিন্তু স্বৈরাচারের পতনের পর?
সুলতানা কামাল : স্বৈরাচারের পতনের সময়ে তিন জোটের যে রূপরেখা প্রণীত হয়েছিল, সেটি হতে পারত গণতান্ত্রিক শাসনের ভিত্তি। কিন্তু দুঃখের বিষয় সে সময়ে যাঁরা রূপরেখা তৈরি করলেন, পরবর্তীকালে তাঁরা সেটি মানেননি। রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকে দেওয়া অঙ্গীকার রক্ষা করেনি।
প্রথম আলো : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে যখন আপনি দেখলেন একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, তখন পদত্যাগ করে বেরিয়ে এলেন। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
সুলতানা কামাল : রাজনৈতিক দলগুলোয় গণতন্ত্রচর্চার ঘাটতি আছে। আগে যেটি ছিল ‘গণতান্ত্রিক বিচ্যুতি’, পঁচাত্তরের পর সেটিই নিয়মে পরিণত হলো। আমরা যাকে গণতন্ত্র বলে চালাচ্ছি, সেটি গণতন্ত্র নয়। একইভাবে ধর্মের নামে যা হচ্ছে, সেটিও ধর্মের আসল রূপ নয়। এই যে তনয়ের স্বজনেরা বললেন, প্রধানমন্ত্রী চাইলে বিচার হবে, না চাইলে হবে না। এ ধারণাই বা কেন আসবে? একা প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী কেন পারছেন না, তা-ও বিশ্লেষণ করতে হবে। আমাদের সবাইকে করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বঙ্গবন্ধু যে অবিসংবাদিত নেতা হলেন, তাঁর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হলো, দলমত-নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ তাঁকে সমর্থন দিয়েছিল বলেই। তখন তারা এই বার্তাই দিয়েছিল যে ‘আমরা স্বাধীনতা চাই।’ কিন্তু আজ কি জনগণের মধ্য থেকে আদৌ এই বার্তা দেওয়া হয় যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে থাকলে তাদের সঙ্গে থাকব না। দেওয়া হয় না। বরং এই বার্তাই দেওয়া হয় যত বেশি বিপরীত কথা বলব, যত বেশি ধর্মের কথা বলব, তত বেশি ভোট পাব।
প্রথম আলো : ১৫ বছরের দায় আমরা ২৫ বছরেও কেন শোধ করতে পারলাম না?
সুলতানা কামাল : কীভাবে পারব? সাম্প্রদায়িকতার যে বিষবৃক্ষ রোপণ করা হয়েছিল পঁচাত্তর থেকে, সেটাই বিরাট মহিরুহ হয়ে কুফল দিতে শুরু করেছে। সমাজের ভেতর থেকে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দেখতে পাই না। তাহলে সামাজিক শক্তির দায় অস্বীকার করব কীভাবে? পঁচাত্তরের পরে যাঁরা ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁরা তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঋদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে পারবেন না। সেই কাজটি করতে পারতেন ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত যাঁরা আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন। আমি শুধু আওয়ামী লীগের কথা বলছি না, সেই সময়ের সব প্রগতিশীল শক্তির কথা বলছি। কিন্তু পঁচাত্তর-নব্বই পর্বে ক্ষমতাসীনেরা আমাদের রাজনীতি, শিল্প-সংস্কৃতিতে এমন আঘাত করেছে যে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটিও ক্ষমতায় এসে সেই হারিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের ছবিটি ফিরিয়ে আনতে পারছে না। সে কারণেই সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি রাষ্ট্রধর্মও বহাল আছে।
প্রথম আলো : আপনি যে বাংলাদেশের ছবি পুনরুদ্ধারের কথা বললেন, ক্ষমতার বাইরে থাকা, অনেক রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিও সেটি চায়। কিন্তু সরকার কি তাদের সহায়তা চাইছে?
সুলতানা কামাল : না, চাইছে না। তারা আগের চেতনায় নেই। সেটিই দুঃখের ব্যাপার। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক জিয়া হায়দার রহমান তাঁর বই ইন দ্য লাইট অব হোয়াট উই নো-এ লিখেছেন, স্যালামান্ডার হলো সেই প্রাণী যে রূপান্তরিত হয়ে তার প্রকৃত রূপে পৌঁছাতে পারে না। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থাও সেই পর্যায়ে এসেছে। আমরা যা হতে চেয়েছিলাম বা হতে যাচ্ছিলাম, তা না হয়ে অন্য কিছু হয়েছি।
প্রথম আলো : বাংলাদেশে পশ্চাৎপদ ধ্যানধারণার মানুষ যেমন আছে, তেমনি সামনে চিন্তা করার মানুষও তো আছে, তাদের কী ভূমিকা পালন করতে দেওয়া হচ্ছে?
সুলতানা কামাল : যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁদের কিন্তু নিজস্ব কিছু হিসাব-নিকাশ থাকে। আওয়ামী লীগ নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের দল বলে দাবি করছে। কিন্তু কাজে তার প্রতিফলন কতটা? নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়াই রাজনৈতিক দলের একমাত্র উদ্দেশ্য ও আদর্শ হতে পারে না। সমাজে রাজনৈতিক ভাবাদর্শ তৈরি করাও তার কাজ। সেটি করতে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।
প্রথম আলো : ক্ষমতায় থাকার জন্য যদি আওয়ামী লীগ স্বৈরাচারের সঙ্গে হাত মেলাতে পারে, বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে জোট বাঁধতে পারবে না কেন?
সুলতানা কামাল : আমি তো এর কোনোটাই সমর্থন করছি না। এটা নীতিহীন রাজনীতি।
প্রথম আলো : আপনি যে হারিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য লড়াই করছেন, সেখানে সরকারের ভূমিকা কী?
সুলতানা কামাল : সেখানে সরকার যে খুব সহায়ক ভূমিকা রাখছে, তা বলা যায় না। সমালোচনাকে তারা বিরোধিতা হিসেবে দেখছে। এই মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে বুঝতে হবে তাদের আসল মিত্র কারা হতে পারে। আওয়ামী লীগ অনেক সময় ভুল করে বলেই তো গোটা জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রথম আলো : নারী উন্নয়ন নীতির বিরোধিতাকারী হেফাজতের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ কি তার আগের অবস্থান থেকে সরে আসেনি?
সুলতানা কামাল : আমি বলব অনেক ক্ষেত্রেই আপসকামিতা আওয়ামী লীগকে গ্রাস করছে। এর থেকে বেরিয়ে আসার উপায় হলো জনগণের ভেতর থেকে তাদের রাজনৈতিক সহযোগী ও মিত্রকে খুঁজে নেওয়া এবং ক্ষমতার ভিত্তিটা জনগণের মধ্যে প্রতিস্থাপন করা।
প্রথম আলো : ২০১৪ সালের নির্বাচন ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?
সুলতানা কামাল : নির্বাচন যদি কৌশলের খেলা হয়ে থাকে সেটি সব সময় সততা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দেয় না। তাতে আপসকামিতা ও সুবিধাবাদ থাকে।
প্রথম আলো : ২০১৪-এর আগের ও পরের আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো ফারাক দেখেন কি?
সুলতানা কামাল : ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। তরুণ প্রজন্মের বিপুল সমর্থন তারা পেয়েছিল। কিন্তু সেই সুযোগটি ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছে তারা।
প্রথম আলো : আপনি কি মনে করেন না মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে?
সুলতানা কামাল : মত প্রকাশের অধিকার এ কারণেই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে যে মত প্রকাশ করলেই তার ওপর আঘাত আসছে। রাষ্ট্র থেকে আসুক বা বাইরের শক্তি থেকে আসুক, রাষ্ট্র তাকে সে রকম সুরক্ষা দিচ্ছে না। বরং রাষ্ট্র থেকে মানুষকে কথা বলা ও আচরণের ব্যাপারে সাবধান করে দেওয়া হচ্ছে।
প্রথম আলো : এতে কারা উৎসাহিত হচ্ছে?
সুলতানা কামাল : এতে তারাই উৎসাহিত হচ্ছে, যারা মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরোধী। যারা সহিংসতার মাধ্যমে নিজেদের মত অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে। তবে এ ক্ষেত্রে শুধু ক্ষমতাসীনদের এককভাবে দায়ী করলে হবে না। বিরোধী দলেরও দায় আছে। কিন্তু তারা একদম সে দায়িত্ব পালন করছে না। বিএনপি যুদ্ধাপরাধের বিচারের যেমন বিরোধিতা করছে, তেমনি মত প্রকাশের স্বাধীনতার ব্যাপারেও নিশ্চুপ। তারা দায়িত্ব পালন করলে হয়তো সংকট এত ঘনীভূত হতো না।
প্রথম আলো : সংকট থেকে উত্তরণের পথ কী?
সুলতানা কামাল : রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শুদ্ধতা নিয়ে আসা। সত্যিকার অর্থে জনগণের স্বার্থের পক্ষে দাঁড়ানো। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক সচেতন নাগরিককেও সোচ্চার হতে হবে।
প্রথম আলো : তারা কি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে?
সুলতানা কামাল : পারছে না বলেই চাইতে হবে। সোচ্চার হতে হবে। যদি মনে করি সরকার বা ধর্মান্ধ শক্তির কাছ থেকে আঘাত আসবে, আমরা কি সেটি মেনে নেব? না মেনে নেব না। রাষ্ট্রকে যেমন বারবার বলতে হবে, তেমনি নিজের শক্তিও সঞ্চয় করতে হবে।
প্রথম আলো : বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে দেশের ভেতরে-বাইরে অনেক সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না।
সুলতানা কামাল : বন্ধ হচ্ছে না বলেই আমাদের বলে যেতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে। আমার মা (সুফিয়া কামাল) একটি কথা বলতেন, তুমি কাজ করলেই ফলের আশা করতে পারো। না করলে সেই আশাও করতে পারো না। আমি যদি লক্ষ্য স্থির করি ধানমন্ডি ৩২ নম্বর থেকে শহীদ মিনারে যাব। পথে অনেক বাধা এলেও আমি উল্টো দিকে যেতে পারি না। সব বাধা পেরিয়ে আমাকে শহীদ মিনারেই পৌঁছাতে হবে।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
সুলতানা কামাল : আপনাকেও ধন্যবাদ।
প্রথম আলো : সম্প্রতি আপনি বিআইডিএসের এক সেমিনারে বলেছেন স্বাধীনতা না থাকলে প্রবৃদ্ধি বা উন্নয়ন দিয়ে কী করব? বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন কি?
সুলতানা কামাল : বাংলাদেশের বহুমাত্রিক উন্নয়ন নিয়ে অহংকার করার মতো অবস্থানে পৌঁছেছি আমরা। এর মধ্যে প্রবৃদ্ধি অন্যতম। তর্ক উঠেছিল উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি ও সুশাসন নিয়ে। আমি সুশাসন বলতে মানুষের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং নিরাপদ জীবনযাপনের অধিকার বুঝি। আমি বলেছি, মানুষের সার্বিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে না পারলে প্রবৃদ্ধির উপযোগিতাটা কী? সুশাসন ছাড়া বা সুশাসনকে উপেক্ষা করে প্রবৃদ্ধি দিয়ে কী করব?
প্রথম আলো : একজন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে আপনি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে কীভাবে দেখছেন?
সুলতানা কামাল : মানবাধিকারের প্রথম শর্তই হলো অন্যের ক্ষতি না করে নিজের পছন্দ অনুযায়ী জীবনযাপন করা। কেউ যদি আমার অধিকার ক্ষুণ্ন করে তাহলে তার প্রতিকার বা ন্যায়বিচার পাওয়া।কিন্তু এখন জরিপ করলে অধিকাংশ মানুষই বলবে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করি না। যেমনটি বলেছিলেন জঙ্গিবাদীদের হাতে নিহত ফয়সল আরেফিন দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক। সম্প্রতি কলাবাগানের জোড়া খুনের শিকার তনয়ের স্বজনেরা বললেন, আমাদের বলার বা করার কিছু নেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর তো বিচার করার কথা নয়। এর অর্থ হলো আমাদের যে বিচারব্যবস্থা আছে, সেটি তেমন কার্যকর বলা যাচ্ছে না। মানবাধিকার থাকলে মানুষ নিরাপদে ও শান্তিতে বসবাস করতে পারে, সেটিও প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। এখন নিজের ঘরেই মানুষ বেশি অনিরাপদ বোধ করছে।
প্রথম আলো : এর দায় কার?
সুলতানা কামাল : মানবাধিকারের দৃষ্টিতে দেখলে দায়টা প্রধানত রাষ্ট্রের। জনগণ তাদের সব দায় রাষ্ট্র তথা সরকারের কাছে সমর্পণ করে এবং তাদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব সরকারেরই।
প্রথম আলো : সরকার কি সেই দায়িত্ব পালন করছে?
সুলতানা কামাল : বর্তমানে যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, তাতে বলা যায় সরকার করছে না, বা করতে পারছে না। দুটোই উদ্বেগের বিষয়। সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যদি সরকার সেটি করতে না পারে, বলব, তা গোটা জাতিরই অক্ষমতা।
প্রথম আলো : সরকার তো জনগণকে নিয়েই। যেকোনো সংকট মোকাবিলাও করতে হয় জনগণকে সঙ্গে নিয়েই। সেটা কি হচ্ছে?
সলতানা কামাল : সেখানে একটি বড় ফাঁক রয়ে গেছে। যাঁরা সরকারে থাকেন, তাঁরা ভাবেন সবকিছু করার কর্তৃত্ব ও এখতিয়ার তাঁদেরই। তাঁরা দায়দায়িত্বের চেয়ে ক্ষমতাকেই প্রাধান্য দেন। তাঁরা মনে করেন, ‘যা করার আমরাই করব। অন্যদের কিছু করার নেই।’
প্রথম আলো : এই ধারণাটা কতটা গণতান্ত্রিক?
সুলতানা কামাল : গণতন্ত্রের চিরায়ত ধারণার সঙ্গে অবশ্যই সাংঘর্ষিক। গণতন্ত্র হলো জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের শাসন। রাষ্ট্র পরিচালনায় সেই জনগণই যদি উপেক্ষিত থাকে তাকে আমরা জনগণের শাসন বলতে পারি না।
প্রথম আলো : সামরিক শাসনামলেও নাগরিক সমাজ যতটুকু ভূমিকা পালন করছে, সেটি কি এখন তারা পারছে?
সুলতানা কামাল : সামরিক শাসনের সঙ্গে তুলনা চলে না। সেটি অন্তর্নিহিতভাবেই অগণতান্ত্রিক ও অগ্রহণযোগ্য। সেখানে যদি কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে নাগরিক সমাজ ভূমিকা পালন করেও থাকে, তা ‘বাই ডিফল্ট’। অর্থাৎ তাদের দুর্বলতার কারণে।
প্রথম আলো : কিন্তু গণতান্ত্রিক শাসনামলে সেই ভূমিকা পালনে বাধা আসছে কেন?
সুলতানা কামাল : বাধা আসবে না, সেটাই একান্ত প্রত্যাশা ছিল। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে স্বাধীনতার পর যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হয়, নানা বিচ্যুতি সত্ত্বেও তাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিধৃত করেছিল। পঁচাত্তরের পর দীর্ঘদিন সামরিক শাসন চেপে বসে এবং শাসকেরা সেই চেতনা পুরোপুরি অস্বীকার করে। আগেরটি ছিল বিচ্যুতি, পরেরটি অস্বীকার। সে সময়ে শিক্ষা-সংস্কৃতি ও সামাজিক ধ্যানধারণায় ধর্মনিরপেক্ষতাকে সরিয়ে সম্প্রদায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ার চেষ্টা চলে। এমনকি তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় শরিক করে। এরপর গণতন্ত্রের অভিযাত্রা শুরু হলেও সামাজিক অধোগতি ঠেকানো যায়নি, সামাজিক ক্ষতগুলো রয়েই গেছে।
প্রথম আলো : কিন্তু স্বৈরাচারের পতনের পর?
সুলতানা কামাল : স্বৈরাচারের পতনের সময়ে তিন জোটের যে রূপরেখা প্রণীত হয়েছিল, সেটি হতে পারত গণতান্ত্রিক শাসনের ভিত্তি। কিন্তু দুঃখের বিষয় সে সময়ে যাঁরা রূপরেখা তৈরি করলেন, পরবর্তীকালে তাঁরা সেটি মানেননি। রাজনৈতিক দলগুলো জনগণকে দেওয়া অঙ্গীকার রক্ষা করেনি।
প্রথম আলো : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে যখন আপনি দেখলেন একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, তখন পদত্যাগ করে বেরিয়ে এলেন। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
সুলতানা কামাল : রাজনৈতিক দলগুলোয় গণতন্ত্রচর্চার ঘাটতি আছে। আগে যেটি ছিল ‘গণতান্ত্রিক বিচ্যুতি’, পঁচাত্তরের পর সেটিই নিয়মে পরিণত হলো। আমরা যাকে গণতন্ত্র বলে চালাচ্ছি, সেটি গণতন্ত্র নয়। একইভাবে ধর্মের নামে যা হচ্ছে, সেটিও ধর্মের আসল রূপ নয়। এই যে তনয়ের স্বজনেরা বললেন, প্রধানমন্ত্রী চাইলে বিচার হবে, না চাইলে হবে না। এ ধারণাই বা কেন আসবে? একা প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী কেন পারছেন না, তা-ও বিশ্লেষণ করতে হবে। আমাদের সবাইকে করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বঙ্গবন্ধু যে অবিসংবাদিত নেতা হলেন, তাঁর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হলো, দলমত-নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ তাঁকে সমর্থন দিয়েছিল বলেই। তখন তারা এই বার্তাই দিয়েছিল যে ‘আমরা স্বাধীনতা চাই।’ কিন্তু আজ কি জনগণের মধ্য থেকে আদৌ এই বার্তা দেওয়া হয় যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে থাকলে তাদের সঙ্গে থাকব না। দেওয়া হয় না। বরং এই বার্তাই দেওয়া হয় যত বেশি বিপরীত কথা বলব, যত বেশি ধর্মের কথা বলব, তত বেশি ভোট পাব।
প্রথম আলো : ১৫ বছরের দায় আমরা ২৫ বছরেও কেন শোধ করতে পারলাম না?
সুলতানা কামাল : কীভাবে পারব? সাম্প্রদায়িকতার যে বিষবৃক্ষ রোপণ করা হয়েছিল পঁচাত্তর থেকে, সেটাই বিরাট মহিরুহ হয়ে কুফল দিতে শুরু করেছে। সমাজের ভেতর থেকে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দেখতে পাই না। তাহলে সামাজিক শক্তির দায় অস্বীকার করব কীভাবে? পঁচাত্তরের পরে যাঁরা ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁরা তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঋদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে পারবেন না। সেই কাজটি করতে পারতেন ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত যাঁরা আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন। আমি শুধু আওয়ামী লীগের কথা বলছি না, সেই সময়ের সব প্রগতিশীল শক্তির কথা বলছি। কিন্তু পঁচাত্তর-নব্বই পর্বে ক্ষমতাসীনেরা আমাদের রাজনীতি, শিল্প-সংস্কৃতিতে এমন আঘাত করেছে যে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটিও ক্ষমতায় এসে সেই হারিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের ছবিটি ফিরিয়ে আনতে পারছে না। সে কারণেই সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি রাষ্ট্রধর্মও বহাল আছে।
প্রথম আলো : আপনি যে বাংলাদেশের ছবি পুনরুদ্ধারের কথা বললেন, ক্ষমতার বাইরে থাকা, অনেক রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিও সেটি চায়। কিন্তু সরকার কি তাদের সহায়তা চাইছে?
সুলতানা কামাল : না, চাইছে না। তারা আগের চেতনায় নেই। সেটিই দুঃখের ব্যাপার। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক জিয়া হায়দার রহমান তাঁর বই ইন দ্য লাইট অব হোয়াট উই নো-এ লিখেছেন, স্যালামান্ডার হলো সেই প্রাণী যে রূপান্তরিত হয়ে তার প্রকৃত রূপে পৌঁছাতে পারে না। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থাও সেই পর্যায়ে এসেছে। আমরা যা হতে চেয়েছিলাম বা হতে যাচ্ছিলাম, তা না হয়ে অন্য কিছু হয়েছি।
প্রথম আলো : বাংলাদেশে পশ্চাৎপদ ধ্যানধারণার মানুষ যেমন আছে, তেমনি সামনে চিন্তা করার মানুষও তো আছে, তাদের কী ভূমিকা পালন করতে দেওয়া হচ্ছে?
সুলতানা কামাল : যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁদের কিন্তু নিজস্ব কিছু হিসাব-নিকাশ থাকে। আওয়ামী লীগ নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের দল বলে দাবি করছে। কিন্তু কাজে তার প্রতিফলন কতটা? নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়াই রাজনৈতিক দলের একমাত্র উদ্দেশ্য ও আদর্শ হতে পারে না। সমাজে রাজনৈতিক ভাবাদর্শ তৈরি করাও তার কাজ। সেটি করতে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।
প্রথম আলো : ক্ষমতায় থাকার জন্য যদি আওয়ামী লীগ স্বৈরাচারের সঙ্গে হাত মেলাতে পারে, বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে জোট বাঁধতে পারবে না কেন?
সুলতানা কামাল : আমি তো এর কোনোটাই সমর্থন করছি না। এটা নীতিহীন রাজনীতি।
প্রথম আলো : আপনি যে হারিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য লড়াই করছেন, সেখানে সরকারের ভূমিকা কী?
সুলতানা কামাল : সেখানে সরকার যে খুব সহায়ক ভূমিকা রাখছে, তা বলা যায় না। সমালোচনাকে তারা বিরোধিতা হিসেবে দেখছে। এই মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে বুঝতে হবে তাদের আসল মিত্র কারা হতে পারে। আওয়ামী লীগ অনেক সময় ভুল করে বলেই তো গোটা জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রথম আলো : নারী উন্নয়ন নীতির বিরোধিতাকারী হেফাজতের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ কি তার আগের অবস্থান থেকে সরে আসেনি?
সুলতানা কামাল : আমি বলব অনেক ক্ষেত্রেই আপসকামিতা আওয়ামী লীগকে গ্রাস করছে। এর থেকে বেরিয়ে আসার উপায় হলো জনগণের ভেতর থেকে তাদের রাজনৈতিক সহযোগী ও মিত্রকে খুঁজে নেওয়া এবং ক্ষমতার ভিত্তিটা জনগণের মধ্যে প্রতিস্থাপন করা।
প্রথম আলো : ২০১৪ সালের নির্বাচন ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন?
সুলতানা কামাল : নির্বাচন যদি কৌশলের খেলা হয়ে থাকে সেটি সব সময় সততা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দেয় না। তাতে আপসকামিতা ও সুবিধাবাদ থাকে।
প্রথম আলো : ২০১৪-এর আগের ও পরের আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো ফারাক দেখেন কি?
সুলতানা কামাল : ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। তরুণ প্রজন্মের বিপুল সমর্থন তারা পেয়েছিল। কিন্তু সেই সুযোগটি ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছে তারা।
প্রথম আলো : আপনি কি মনে করেন না মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে?
সুলতানা কামাল : মত প্রকাশের অধিকার এ কারণেই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে যে মত প্রকাশ করলেই তার ওপর আঘাত আসছে। রাষ্ট্র থেকে আসুক বা বাইরের শক্তি থেকে আসুক, রাষ্ট্র তাকে সে রকম সুরক্ষা দিচ্ছে না। বরং রাষ্ট্র থেকে মানুষকে কথা বলা ও আচরণের ব্যাপারে সাবধান করে দেওয়া হচ্ছে।
প্রথম আলো : এতে কারা উৎসাহিত হচ্ছে?
সুলতানা কামাল : এতে তারাই উৎসাহিত হচ্ছে, যারা মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরোধী। যারা সহিংসতার মাধ্যমে নিজেদের মত অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে। তবে এ ক্ষেত্রে শুধু ক্ষমতাসীনদের এককভাবে দায়ী করলে হবে না। বিরোধী দলেরও দায় আছে। কিন্তু তারা একদম সে দায়িত্ব পালন করছে না। বিএনপি যুদ্ধাপরাধের বিচারের যেমন বিরোধিতা করছে, তেমনি মত প্রকাশের স্বাধীনতার ব্যাপারেও নিশ্চুপ। তারা দায়িত্ব পালন করলে হয়তো সংকট এত ঘনীভূত হতো না।
প্রথম আলো : সংকট থেকে উত্তরণের পথ কী?
সুলতানা কামাল : রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শুদ্ধতা নিয়ে আসা। সত্যিকার অর্থে জনগণের স্বার্থের পক্ষে দাঁড়ানো। এ ক্ষেত্রে প্রত্যেক সচেতন নাগরিককেও সোচ্চার হতে হবে।
প্রথম আলো : তারা কি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে?
সুলতানা কামাল : পারছে না বলেই চাইতে হবে। সোচ্চার হতে হবে। যদি মনে করি সরকার বা ধর্মান্ধ শক্তির কাছ থেকে আঘাত আসবে, আমরা কি সেটি মেনে নেব? না মেনে নেব না। রাষ্ট্রকে যেমন বারবার বলতে হবে, তেমনি নিজের শক্তিও সঞ্চয় করতে হবে।
প্রথম আলো : বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে দেশের ভেতরে-বাইরে অনেক সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না।
সুলতানা কামাল : বন্ধ হচ্ছে না বলেই আমাদের বলে যেতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে। আমার মা (সুফিয়া কামাল) একটি কথা বলতেন, তুমি কাজ করলেই ফলের আশা করতে পারো। না করলে সেই আশাও করতে পারো না। আমি যদি লক্ষ্য স্থির করি ধানমন্ডি ৩২ নম্বর থেকে শহীদ মিনারে যাব। পথে অনেক বাধা এলেও আমি উল্টো দিকে যেতে পারি না। সব বাধা পেরিয়ে আমাকে শহীদ মিনারেই পৌঁছাতে হবে।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
সুলতানা কামাল : আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments