ভারতের ইরান-আফগান বণিক-রাজনীতি
ইরানের ‘চাবাহার’ বন্দর উন্নয়নের জন্য সোমবার ৫০০ মিলিয়ন ডলার প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বিনিময়ে ইরানের সস্তা গ্যাস ব্যবহার করে কম খরচে ইউরিয়া উৎপাদনের জন্য সেই পোর্টে প্লান্ট স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয় ভারতকে। এ ব্যাপারে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেন, ‘চাবাহার বন্দরকে কেন্দ্র করে অনেকগুলো রাষ্ট্রের যোগাযোগের কেন্দ্রভূমি হয়ে উঠবে ইরান। বিশেষ করে আফগানিস্তানের জন্য এটি যোগাযোগের নতুন দিগন্ত খুলে দেবে।’ এদিকে তেলের দাম পরিশোধ বাবদ ইরানকে ৪৩ হাজার কোটি রুপি বা ৬.৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মোদি। মোদির তেহরান সফরেই আগেই ১.২ বিলিয়ন ডলার ইউরোমানিতে পরিশোধ করেছে ভারত। ইরানের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর গত চার মাসে এটাই প্রথম ইউরো পেল দেশটি। পারস্য উপসাগরের দক্ষিণাঞ্চলে ‘চাবাহার’ পোর্টকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক বাণিজ্য বিকাশে ইরান, ভারত এবং আফগানিস্তানের মধ্যে সোমবার এক ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি, আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এ চুক্তি উপলক্ষে দুই দিনের সফরে রোববার তেহরান পৌঁছান মোদি। এ সময় মোদি বলেন, ‘আমাদের বন্ধুত্ব এ অঞ্চলের স্থিতিস্থাপনে নিয়ামক হয়ে উঠবে। এছাড়া জলসীমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করণে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে’। রুহানি বলেন, ‘কৌশলগত বন্ধুত্বের ইতিহাসে নতুন যুগের সূচনা করবে এ চুক্তি।’ সোমবারের তেহরান টাইমসকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তারা এসব জানান। এর আগে রোববার ভারত-ইরান দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে ১২টি বিষয়ে একসঙ্গে কাজ করার বিষয়ে সহমত পোষণ করেন দুই দেশের রাষ্ট্রপতি। এ সময় বিখ্যাত কবি মির্জা গালিবের একটি শায়ের আবৃত্তি করেন মোদি। মোদি বলেন, ‘একবার যদি মন স্থির করে ফেলি আমরা, তাহলে কাশী আর কাশানের মধ্যকার দূরত্ব কমানো কোনো ব্যাপারই নয়।’ এ সময় আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদ ও মাদক চোরাচালান প্রতিরোধের বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের ব্যাপারে দেশদুটি সহমত পোষণ করে বলে জানিয়েছে প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া (পিঅটিআই)। এছাড়া বাণিজ্য, অর্থনীতি, পরিবহন যোগাযোগ, বন্দর উন্নয়ন, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি এবং শিক্ষা বিনিময় সংক্রান্ত ১২ দফার এক ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদিত বলে জানিয়েছে তারা। এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে স্থলবেষ্টিত ইরানের বন্দর ব্যবহারের সুবিধা পাবে স্থল বেষ্টিত দেশ আফগানিস্তান। তাহলে পাকিস্তানের করাচি পোর্টের ওপর আফগানিস্তানকে আর কখনোই নির্ভর করতে হবে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘আফগান বাজার দখলসহ ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও আফগানিস্তানের গা থেকে পাকিস্তানের জামা সরিয়ে ফেলাও এ চুক্তির অন্যতম একটা কারণ।’ চাবাহার পোর্ট ব্যবহার করে ভারত এমনকি ইউরোপের সঙ্গেও সরাসরি ব্যবসা করতে সমর্থ্য হবে আফগানরা। এই পোর্ট থেকে আমদানি-রফতানির পণ্য পরিবহনের জন্য নির্মিত হচ্ছে অভ্যন্তরীণ দীর্ঘ সড়ক পথ। রেলপথে চাবাহার থেকে আফগান সীমান্তবর্তী জাহদান শহর পর্যন্ত পণ্য যাবে সরাসরি রেলপথে। তারপর আফগানিস্তান এমনকি তাজিকিস্তান পর্যন্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে উন্নত সড়কপথ। আফগানিস্তান হয়ে মধ্য এশিয়া এমনকি রাশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হবে এই সড়ক যোগাযোগ।
এছাড়া পূর্ব ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গেও সংযোগ বাড়বে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি। এছাড়াও ভারত-ইরান বাণিজ্য চুক্তির আড়ালে মধ্যপ্রাচ্য এবং মধ্য এশিয়ার সঙ্গে ভারতের সরাসরি যোগাযোগের নতুন দুয়ার উন্মোচিত হচ্ছে বলেও জানিয়েছে দি ডিপলোম্যাট। চীন এবং পাকিস্তানকে টেক্কা দিয়ে পারস্য উপসাগরের প্রবেশাধিকার ভারতের কূটনীতির জন্য সৌভাগ্য এনে দেবে বলে মন্তব্য করেছেন ভারতের পরিবহনমন্ত্রী নীতিন গাদকারি। দ্য ইন্ডিয়া টাইমস’কে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এখন থেকে আফগানিস্তান, রাশিয়া ও ইউরোপের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারব। মাধ্যম হিসেবে পাকিস্তানকে আর প্রয়োজন হবে না। ভৌগলিক রাজনীতিতে এই চুক্তির ঐতিহাসিক গুরুত্ব এটাই।’ এদিকে পাকিস্তানে ‘গাদার’ বন্দর থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরত্বের জলসীমায় ইরানের ‘চাবাহার’ বন্দরটি অবস্থিত। চীনের পরিচালনায় গাদার বন্দরের একক আধিপাত্য নিরসনে এবার ভারত-ইরানের যৌথ প্রজেক্ট এই চাবাহার পোর্ট। আরব সাগরের স্রোত ঘেঁষে এবং পারস্য উপসাগরের দক্ষিণকূলেই নির্মিত হতে যাচ্ছে এই নতুন বাণিজ্যকেন্দ্র। মধ্যপ্রাচ্যের বাণিজ্য ভাগাভাগিতেও এর সুদূরপ্রসারি প্রভাব থাকবে বলে জানয়েছে এএফপি। ফার্স্টপোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের বিরূপ আচরণের কারণে আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ভারত যোগাযোগ করতে পারছে না। স্থল সীমান্তে ভারত এক্ষেত্রে পাকিস্তান দ্বারা বাধাগ্রস্ত। এ কারণে ভারতকে অনেক ব্যয়বহুল বাণিজ্য এবং কূটনীতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয় প্রতিবছর। এবার খুব কম খরচেই তা সম্ভব হবে।
No comments