সত্যের মুখোমুখি হতে সবাই কি প্রস্তুত? by আলী রীয়াজ
জাতীয়
সংসদে আবারও ২০০৭-০৮ সালের ক্ষমতাসীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যকলাপের
তদন্তের দাবি উঠেছে। ক্ষমতাসীন জোটের নেতা ও মন্ত্রীরা তত্ত্বাবধায়ক
সরকারের সময়কার ঘটনাবলি তদন্তের জন্য কমিশন গঠনের দাবি করেছেন এবং
সুস্পষ্টভাবেই ওই সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিচার দাবি করেছেন।
জোটের শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা ও মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন তাঁর ভাষায় ‘এক-এগারোর সমস্ত ঘটনা বোঝার জন্য’ সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে দিয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করার দাবি তুলেছেন। রাশেদ খান মেনন তাঁর বক্তব্যে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে তাঁর নেতৃত্বাধীন ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত আগস্ট/২০০৭-এর ঘটনাবলি’-বিষয়ক সংসদীয় কমিটি তার প্রতিবেদনে ২০১২ সালেই এই সুপারিশ করেছিল। ফলে আজকেই শুধু এ নিয়ে আলোচনা উঠছে তা নয়। এখন নতুন করে এই আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে কারণ ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম বলেছেন যে ২০০৭-০৮ সালে সেনা গোয়েন্দা সংস্থার সরবরাহ করা খবর প্রকাশ করে তিনি ভুল করেছিলেন। গত প্রায় এক মাসে এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া থেকে এই রকমের ধারণা জন্মাতে পারে যে বিষয়টি কারও জানা ছিল না। ২০১২ সালে ওই কমিটির প্রতিবেদন নিয়ে সংসদে খুব বেশি আলোচনা হয়নি, এখন যতটা উৎসাহ লক্ষণীয়, তখন ততটা উৎসাহ গণমাধ্যমেও দৃষ্ট হয়েছে বলে দাবি করা যাবে না।
সেই তুলনায় ২০০৯ সালের গোড়াতে সংসদে যখন এই বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল, তখন বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। অনেকেই এর পরিণতি কী হয়, সেটা নিয়ে জল্পনাকল্পনা করেছিলেন, অনেকে এর একটা পরিণতি দেখতে চেয়েছিলেন। সে সময় এ নিয়ে বিএনপি নেতাদের আগ্রহ ছিল সংগত ও বোধগম্য কারণেই বেশি। সরকারি দলের যাঁরা ২০০৭-০৮ সরকারের আমলে বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন, অনেকেই তখন এ নিয়ে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। সেই আলোচনায় সেনা গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকার বিষয়ে যেসব আলোচনা হয়েছিল, তা সংবাদপত্রের পাতা খুললেই পাওয়া যাবে। এদের মধ্যে মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলের বক্তব্য ছিল বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। ২০০৯ সালের ২৮ জানুয়ারি সংসদে আলোচনা করতে গিয়ে আব্দুল জলিল অভিযোগ করেছিলেন যে ডিজিএফআইয়ের লোকজন তাঁকে গ্রেপ্তার করে চোখ বেঁধে নিয়ে যান, পাঁচ দিন আটক রাখেন এবং তাঁকে নির্যাতন করেন। আব্দুল জলিল বলেন, ‘আমরা মানবাধিকারের জন্য লড়াই করেছি। কিন্তু আমাদের এমন একটা এজেন্সি আছে, যারা মানুষের প্রতি মর্যাদার সঙ্গে আচরণ করতে জানে না। এই এজেন্সির নাম ডিজিএফআই।’ আব্দুল জলিল তাদের শাস্তি চেয়েছিলেন। সে সময় কোনো কোনো গণমাধ্যমে এই খবর বেরিয়েছিল যে আব্দুল জলিল ও মহীউদ্দীন খান আলমগীর আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার কথা বিবেচনা করছেন এবং তাঁদের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ লড়বেন। তখন প্রকাশিত সেই সংবাদের সত্যতা কতটুকু সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু আলোচনার সমাপ্তি হয় অকস্মাৎ।
সেই সময়ে এই আলোচনায় যবনিকাপাত ঘটার পেছনে সে সময়কার ঘটনাপ্রবাহ কাজ করেছিল, না ক্ষমতাসীন দলের সিদ্ধান্ত কাজ করেছিল, সেটা আমরা জানি না। কিন্তু আমরা জানি যে এগুলো হচ্ছে সরকারি দলের সদস্যদের তোলা আলোচনা ও প্রশ্ন। ২০০৯ সাল থেকে তৎকালীন সংসদীয় বিরোধী দল বিএনপির সদস্যরা, বিশেষ করে তৎকালীন সংসদীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া, এ নিয়ে সুযোগ পেলেই প্রশ্ন তুলেছেন। সেগুলো নেহাতই তাঁদের ক্ষোভের বিষয় বলেই বিবেচনা করা হয়েছে, তার বেশি নয়। অনেকেই একে দলীয় স্বার্থে তোলা প্রশ্ন বলেই চিহ্নিত করেছেন। ২০১১ সালের ১৫ মার্চ জাতীয় সংসদে খালেদা জিয়া অভিযোগ করেছিলেন, সংবাদপত্রের ওপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হচ্ছে। তিনি বলেছিলেন, ‘সংবাদপত্রে ফোন করে বলে দেওয়া হয় কোন নিউজ যাবে, কোনটা যাবে না। তাহলে এখনো কি ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দীনের ভূতরা দেশ চালাচ্ছে?’ ২০১৬ সালে মাহ্ফুজ আনাম যে কথা বলার জন্য এখন আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন, সেটা সংসদে খালেদা জিয়া ইঙ্গিত করেছিলেন ২০১১ সালে। যাঁরা ২০০৭-০৮ সালের ঘটনাপ্রবাহ জানেন, তাঁদের জন্য এ কোনো নতুন বিষয় ছিল না। তাঁরা একে উপেক্ষা করতে পেরেছেন, কিন্তু ২০১৬ সালে তাঁদের উৎসাহে কোনো ঘাটতি দেখা যায় না। শুধু তা-ই নয়, দীর্ঘদিন সংসদে অনুপস্থিত থাকার পর সংসদে ফিরেই খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ‘অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী’ বলে বর্ণনা করে ফখরুদ্দীন আহমদ এবং মইন উ আহমেদের বিচার দাবি করেছিলেন।
বিএনপির এসব বক্তব্যের কারণ আমরা বুঝতে পারি, ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির কারণে যে নির্বাচন বাতিল হয়েছিল, তা ছিল বিএনপির সাজানো নির্বাচন। সেই সময়ে রাষ্ট্রপতি যে বিএনপির হাতের পুতুল হিসেবে কাজ করছিলেন, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বিস্তর। কিন্তু ২০১১ সালে দেওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উত্তর স্মরণ করা দরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন ২৪ মার্চ অষ্টম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে। প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের উদ্দেশে বলেছিলেন, ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দীনদের বিচার চাইলে আদালতে মামলা করেন না কেন? আদালত এখন স্বাধীন। বিচার চাইলে মামলা করেন। আমাদের ঘাড়ে চাপাচ্ছেন কেন?
এসব বিষয় স্মরণ করিয়ে দেওয়ার তাগিদ অনুভব করছি এই কারণে, সরকারি দলের নেতারা আবারও উচ্চ স্বরে এক-এগারোর কুশীলবদের বিচার চাইছেন। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এ নিয়ে গত সাত বছরে বিরোধী দলের দাবিকেই কেবল উপেক্ষা করা হয়নি, ওই কুশীলবদের কেউ কেউ এখনো নিজ নিজ ক্ষেত্রে বহাল আছেন (মশিউল আলম, ‘এক/এগারোর কুশীলবদের বিচার হয়নি কেন?’, প্রথম আলো, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এসবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলেও আমরা জানি না। এগুলোর পক্ষে যদি যুক্তিগ্রাহ্য কারণ থাকে, সেটি ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্ব নাগরিকদের জানানো। কিন্তু তা জানা নেই বলে এখন এই বিতর্কের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হচ্ছে।
এর বাইরে আরও কিছু প্রশ্ন তোলা জরুরি হয়ে পড়েছে। এক-এগারো বলে যেসব ঘটনার কথা বলা হয়, সেগুলো কোনো অরাজনৈতিক বিষয় ছিল না। একে অরাজনৈতিক বলে বিবেচনা করার চেষ্টা একধরনের রাজনৈতিক অসততা বলেই বিবেচনা করা উচিত। মনে রাখা দরকার যে কথিত এক-এগারো এক দিনে তৈরি হয়নি। তার প্রেক্ষাপট বিবেচনার বাইরে রেখে এক-এগারোকে আদৌ বিবেচনা করা কি সম্ভব? যাঁরা আজকে এক-এগারোর বিরুদ্ধে সরব, তাঁরা নিজেদের কাছে প্রশ্ন করতে পারেন, তাঁরা সেদিনও একইভাবে এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছিলেন কি না। বিএনপি নেতা ও কর্মীদের উত্তরটি আমাদের জানা আছে। ক্ষমতাসীন জোটের নেতারা আশা করি ভেবে দেখবেন। এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে ওই সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের সবই গ্রহণযোগ্য, আবার এ কথা বলার উদ্দেশ্য এ–ও নয় যে সবই অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু ২০০৭ সালের ঘটনাপ্রবাহ তৈরি হয়েছিল কয়েক বছর ধরে; সেসব ঘটনা, অন্ততপক্ষে ২০০৬ সালের অক্টোবর থেকে সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহকে অস্বীকার করার সুযোগ কোথায়? যারা ঘটনাটিকে শুধু ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি শুরু হওয়া একটি বিষয় হিসেবে দেখতে চান তার মধ্যে রাজনৈতিক সুবিধা থাকতে পারে, এর বেশি কিছু নয়। সেই পরিস্থিতি তৈরির জন্য রাজনীতিবিদেরা, যার মধ্যে বর্তমান ক্ষমতাসীনেরাও আছেন, দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত আছেন কি?
২০০৭-০৮ সালের সরকারের সময়ে কেবল কিছু প্রশাসনিক ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি, রাজনৈতিক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে আটক করা সেই রাজনৈতিক পদক্ষেপের অংশ। দুই নেত্রীকেই বন্দিজীবন যাপন করতে হয়েছে। যথাযথ আইনি ব্যবস্থা অনুসরণ করার ক্ষেত্রে ব্যত্যয় হয়েছে, সেটা বলাই বাহুল্য। কিন্তু আরও রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে, সেগুলো জানার অধিকারও নাগরিকদের আছে। ক্ষমতাসীন দল ও জোটের নেতারা যদি মনে করেন যে এসব প্রশাসনিক পদক্ষেপের তদন্ত হওয়া দরকার, তবে সুস্পষ্টভাবে এসব রাজনৈতিক বিষয়ের তদন্তের দাবিও তাঁদের তুলতে হবে। কোনো রকম রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে সেনাসমর্থিত সরকারের ক্ষমতার অবসান হয়নি, সেটা আমাদের মনে রাখতে হবে। সরকারি দলের নেতারা ২০০৯ সালে এবং এখন আবার ২০০৭-০৮ সালের সরকারের অত্যাচারের বিচার চাইছেন—ন্যায়বিচারের স্বার্থে সেটা জরুরি, কিন্তু একই কারণে তা সবার জন্যই একইভাবে প্রযোজ্য হওয়া দরকার। সে ক্ষেত্রে দলীয়ভাবে বিবেচনার ইতিহাস ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে, সেই বিষয়ে সরকারি দলের নেতাদের বক্তব্য শোনার আগ্রহ থাকল।
যেকোনো ধরনের তদন্তের কথা শুনলে আমার ব্যক্তিগতভাবে তিনটি প্রশ্ন মনে জাগে, তদন্ত স্বাধীনভাবে সম্পাদিত হবে কি না; তদন্ত সরকারের সমালোচক ও বিরোধীদের দমনের হাতিয়ারে পরিণত হবে কি না; আর শেষ পর্যন্ত এই তদন্তের প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখবে কি না। ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। আমি তার ব্যতিক্রম নই।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
জোটের শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা ও মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন তাঁর ভাষায় ‘এক-এগারোর সমস্ত ঘটনা বোঝার জন্য’ সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে দিয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করার দাবি তুলেছেন। রাশেদ খান মেনন তাঁর বক্তব্যে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে তাঁর নেতৃত্বাধীন ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত আগস্ট/২০০৭-এর ঘটনাবলি’-বিষয়ক সংসদীয় কমিটি তার প্রতিবেদনে ২০১২ সালেই এই সুপারিশ করেছিল। ফলে আজকেই শুধু এ নিয়ে আলোচনা উঠছে তা নয়। এখন নতুন করে এই আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে কারণ ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম বলেছেন যে ২০০৭-০৮ সালে সেনা গোয়েন্দা সংস্থার সরবরাহ করা খবর প্রকাশ করে তিনি ভুল করেছিলেন। গত প্রায় এক মাসে এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া থেকে এই রকমের ধারণা জন্মাতে পারে যে বিষয়টি কারও জানা ছিল না। ২০১২ সালে ওই কমিটির প্রতিবেদন নিয়ে সংসদে খুব বেশি আলোচনা হয়নি, এখন যতটা উৎসাহ লক্ষণীয়, তখন ততটা উৎসাহ গণমাধ্যমেও দৃষ্ট হয়েছে বলে দাবি করা যাবে না।
সেই তুলনায় ২০০৯ সালের গোড়াতে সংসদে যখন এই বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল, তখন বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। অনেকেই এর পরিণতি কী হয়, সেটা নিয়ে জল্পনাকল্পনা করেছিলেন, অনেকে এর একটা পরিণতি দেখতে চেয়েছিলেন। সে সময় এ নিয়ে বিএনপি নেতাদের আগ্রহ ছিল সংগত ও বোধগম্য কারণেই বেশি। সরকারি দলের যাঁরা ২০০৭-০৮ সরকারের আমলে বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন, অনেকেই তখন এ নিয়ে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। সেই আলোচনায় সেনা গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকার বিষয়ে যেসব আলোচনা হয়েছিল, তা সংবাদপত্রের পাতা খুললেই পাওয়া যাবে। এদের মধ্যে মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলের বক্তব্য ছিল বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। ২০০৯ সালের ২৮ জানুয়ারি সংসদে আলোচনা করতে গিয়ে আব্দুল জলিল অভিযোগ করেছিলেন যে ডিজিএফআইয়ের লোকজন তাঁকে গ্রেপ্তার করে চোখ বেঁধে নিয়ে যান, পাঁচ দিন আটক রাখেন এবং তাঁকে নির্যাতন করেন। আব্দুল জলিল বলেন, ‘আমরা মানবাধিকারের জন্য লড়াই করেছি। কিন্তু আমাদের এমন একটা এজেন্সি আছে, যারা মানুষের প্রতি মর্যাদার সঙ্গে আচরণ করতে জানে না। এই এজেন্সির নাম ডিজিএফআই।’ আব্দুল জলিল তাদের শাস্তি চেয়েছিলেন। সে সময় কোনো কোনো গণমাধ্যমে এই খবর বেরিয়েছিল যে আব্দুল জলিল ও মহীউদ্দীন খান আলমগীর আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার কথা বিবেচনা করছেন এবং তাঁদের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদ লড়বেন। তখন প্রকাশিত সেই সংবাদের সত্যতা কতটুকু সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু আলোচনার সমাপ্তি হয় অকস্মাৎ।
সেই সময়ে এই আলোচনায় যবনিকাপাত ঘটার পেছনে সে সময়কার ঘটনাপ্রবাহ কাজ করেছিল, না ক্ষমতাসীন দলের সিদ্ধান্ত কাজ করেছিল, সেটা আমরা জানি না। কিন্তু আমরা জানি যে এগুলো হচ্ছে সরকারি দলের সদস্যদের তোলা আলোচনা ও প্রশ্ন। ২০০৯ সাল থেকে তৎকালীন সংসদীয় বিরোধী দল বিএনপির সদস্যরা, বিশেষ করে তৎকালীন সংসদীয় বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া, এ নিয়ে সুযোগ পেলেই প্রশ্ন তুলেছেন। সেগুলো নেহাতই তাঁদের ক্ষোভের বিষয় বলেই বিবেচনা করা হয়েছে, তার বেশি নয়। অনেকেই একে দলীয় স্বার্থে তোলা প্রশ্ন বলেই চিহ্নিত করেছেন। ২০১১ সালের ১৫ মার্চ জাতীয় সংসদে খালেদা জিয়া অভিযোগ করেছিলেন, সংবাদপত্রের ওপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হচ্ছে। তিনি বলেছিলেন, ‘সংবাদপত্রে ফোন করে বলে দেওয়া হয় কোন নিউজ যাবে, কোনটা যাবে না। তাহলে এখনো কি ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দীনের ভূতরা দেশ চালাচ্ছে?’ ২০১৬ সালে মাহ্ফুজ আনাম যে কথা বলার জন্য এখন আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন, সেটা সংসদে খালেদা জিয়া ইঙ্গিত করেছিলেন ২০১১ সালে। যাঁরা ২০০৭-০৮ সালের ঘটনাপ্রবাহ জানেন, তাঁদের জন্য এ কোনো নতুন বিষয় ছিল না। তাঁরা একে উপেক্ষা করতে পেরেছেন, কিন্তু ২০১৬ সালে তাঁদের উৎসাহে কোনো ঘাটতি দেখা যায় না। শুধু তা-ই নয়, দীর্ঘদিন সংসদে অনুপস্থিত থাকার পর সংসদে ফিরেই খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ‘অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী’ বলে বর্ণনা করে ফখরুদ্দীন আহমদ এবং মইন উ আহমেদের বিচার দাবি করেছিলেন।
বিএনপির এসব বক্তব্যের কারণ আমরা বুঝতে পারি, ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির কারণে যে নির্বাচন বাতিল হয়েছিল, তা ছিল বিএনপির সাজানো নির্বাচন। সেই সময়ে রাষ্ট্রপতি যে বিএনপির হাতের পুতুল হিসেবে কাজ করছিলেন, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বিস্তর। কিন্তু ২০১১ সালে দেওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উত্তর স্মরণ করা দরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন ২৪ মার্চ অষ্টম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে। প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলের উদ্দেশে বলেছিলেন, ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দীনদের বিচার চাইলে আদালতে মামলা করেন না কেন? আদালত এখন স্বাধীন। বিচার চাইলে মামলা করেন। আমাদের ঘাড়ে চাপাচ্ছেন কেন?
এসব বিষয় স্মরণ করিয়ে দেওয়ার তাগিদ অনুভব করছি এই কারণে, সরকারি দলের নেতারা আবারও উচ্চ স্বরে এক-এগারোর কুশীলবদের বিচার চাইছেন। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এ নিয়ে গত সাত বছরে বিরোধী দলের দাবিকেই কেবল উপেক্ষা করা হয়নি, ওই কুশীলবদের কেউ কেউ এখনো নিজ নিজ ক্ষেত্রে বহাল আছেন (মশিউল আলম, ‘এক/এগারোর কুশীলবদের বিচার হয়নি কেন?’, প্রথম আলো, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এসবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলেও আমরা জানি না। এগুলোর পক্ষে যদি যুক্তিগ্রাহ্য কারণ থাকে, সেটি ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্ব নাগরিকদের জানানো। কিন্তু তা জানা নেই বলে এখন এই বিতর্কের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হচ্ছে।
এর বাইরে আরও কিছু প্রশ্ন তোলা জরুরি হয়ে পড়েছে। এক-এগারো বলে যেসব ঘটনার কথা বলা হয়, সেগুলো কোনো অরাজনৈতিক বিষয় ছিল না। একে অরাজনৈতিক বলে বিবেচনা করার চেষ্টা একধরনের রাজনৈতিক অসততা বলেই বিবেচনা করা উচিত। মনে রাখা দরকার যে কথিত এক-এগারো এক দিনে তৈরি হয়নি। তার প্রেক্ষাপট বিবেচনার বাইরে রেখে এক-এগারোকে আদৌ বিবেচনা করা কি সম্ভব? যাঁরা আজকে এক-এগারোর বিরুদ্ধে সরব, তাঁরা নিজেদের কাছে প্রশ্ন করতে পারেন, তাঁরা সেদিনও একইভাবে এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছিলেন কি না। বিএনপি নেতা ও কর্মীদের উত্তরটি আমাদের জানা আছে। ক্ষমতাসীন জোটের নেতারা আশা করি ভেবে দেখবেন। এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে ওই সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের সবই গ্রহণযোগ্য, আবার এ কথা বলার উদ্দেশ্য এ–ও নয় যে সবই অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু ২০০৭ সালের ঘটনাপ্রবাহ তৈরি হয়েছিল কয়েক বছর ধরে; সেসব ঘটনা, অন্ততপক্ষে ২০০৬ সালের অক্টোবর থেকে সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহকে অস্বীকার করার সুযোগ কোথায়? যারা ঘটনাটিকে শুধু ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি শুরু হওয়া একটি বিষয় হিসেবে দেখতে চান তার মধ্যে রাজনৈতিক সুবিধা থাকতে পারে, এর বেশি কিছু নয়। সেই পরিস্থিতি তৈরির জন্য রাজনীতিবিদেরা, যার মধ্যে বর্তমান ক্ষমতাসীনেরাও আছেন, দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত আছেন কি?
২০০৭-০৮ সালের সরকারের সময়ে কেবল কিছু প্রশাসনিক ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি, রাজনৈতিক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে আটক করা সেই রাজনৈতিক পদক্ষেপের অংশ। দুই নেত্রীকেই বন্দিজীবন যাপন করতে হয়েছে। যথাযথ আইনি ব্যবস্থা অনুসরণ করার ক্ষেত্রে ব্যত্যয় হয়েছে, সেটা বলাই বাহুল্য। কিন্তু আরও রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে, সেগুলো জানার অধিকারও নাগরিকদের আছে। ক্ষমতাসীন দল ও জোটের নেতারা যদি মনে করেন যে এসব প্রশাসনিক পদক্ষেপের তদন্ত হওয়া দরকার, তবে সুস্পষ্টভাবে এসব রাজনৈতিক বিষয়ের তদন্তের দাবিও তাঁদের তুলতে হবে। কোনো রকম রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে সেনাসমর্থিত সরকারের ক্ষমতার অবসান হয়নি, সেটা আমাদের মনে রাখতে হবে। সরকারি দলের নেতারা ২০০৯ সালে এবং এখন আবার ২০০৭-০৮ সালের সরকারের অত্যাচারের বিচার চাইছেন—ন্যায়বিচারের স্বার্থে সেটা জরুরি, কিন্তু একই কারণে তা সবার জন্যই একইভাবে প্রযোজ্য হওয়া দরকার। সে ক্ষেত্রে দলীয়ভাবে বিবেচনার ইতিহাস ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে, সেই বিষয়ে সরকারি দলের নেতাদের বক্তব্য শোনার আগ্রহ থাকল।
যেকোনো ধরনের তদন্তের কথা শুনলে আমার ব্যক্তিগতভাবে তিনটি প্রশ্ন মনে জাগে, তদন্ত স্বাধীনভাবে সম্পাদিত হবে কি না; তদন্ত সরকারের সমালোচক ও বিরোধীদের দমনের হাতিয়ারে পরিণত হবে কি না; আর শেষ পর্যন্ত এই তদন্তের প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখবে কি না। ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। আমি তার ব্যতিক্রম নই।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments