‘এই নাও তোমার চা’ by আব্দুল কাইয়ুম
মিষ্টি গলায় স্ত্রী বললেন, ‘এই নাও তোমার চা।’ সঙ্গে বিস্কুট। বেশ কিছুক্ষণ ধরেই রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ আসছিল। চা তৈরি হচ্ছে। স্ত্রী জানেন, দেরি হলে বাজখাঁই গলায় সাহেব চেঁচিয়ে উঠবেন, চা কোথায়? সেই সুযোগ তিনি দিতে চান না। চা দিয়েই তিনি আবার ছুটলেন রান্নাঘরে। সময় নেই। চুলায় ভাত। মাছও রাঁধতে হবে। টেবিলে নাশতা দিতে হবে। সাহেবের জন্য দুপুরের খাবার টিফিন বক্সে সাজিয়ে দিতে হবে। স্ত্রী নিজেও অফিসে যাবেন। আগের দিন দেরি হয়েছিল বলে বড় সাহেবের বকুনি খেতে হয়েছে। আজ অফিসে দেরি করার উপায় নেই...।
শেষ পর্যন্ত সবকিছুই হলো, শুধু স্ত্রী নিজেই নিজের তৈরি করা নাশতা খেতে পারলেন না। অফিসে দেরি করা চলবে না আজ। সংসারের অন্য সবাই খেয়েদেয়ে পরিপাটি হয়ে যার যার কাজে চলে যায়। স্ত্রীর তাতেই তৃপ্তি। ওই যে সকালে চা দেওয়ার সময় মিষ্টি হাসিটি ধরে রাখতে পেরেছেন এত চাপের মধ্যেও, সেখানেই তাঁর সার্থকতা!
আমাদের মধ্যবিত্ত ঘরের এটাই প্রতিদিনের চিত্র। সাহেব অফিস করবেন, তাঁর বড় চাকরি, বেতন বেশি। স্ত্রীর চাকরির তো কোনো দাম নেই, তা–ও করে করুক। কিন্তু সংসারের যাবতীয় কাজও তাঁকে করতে হবে হাসিমুখে। আর যাঁদের সংসারে স্ত্রী চাকরি করেন না, তাঁর জন্য তো কাজের শেষ নেই। রান্না, ঘর ঝাড়ু, ঘর মোছা, কাপড় ধোয়া, বাচ্চা মানুষ করা, স্কুলে নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ আর কাজ। কিন্তু তাঁদের এসব কাজের কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই। দামও নেই। আর্থিক বা সামাজিক মূল্যায়ন নেই। সরকারি হিসাবের খাতায়ও তাঁদের অবদান শূন্য।
গত রোববার প্রথম আলো ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে এ বিষয়গুলো আলোচনা হয়। ‘মর্যাদায় গড়ি সমতা’ প্রচারাভিযান ও বিজ্ঞাপনী সংস্থা মাত্রাও ছিল আমাদের সঙ্গে। অ্যাকশন এইডসহ কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রধান কর্মকর্তা, গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং আরও অনেকে আলোচনায় অংশ নেন। তাঁরা সবাই বললেন, এটা নারীর প্রতি বৈষম্য। গৃহস্থালিসহ অন্য সব কাজের স্বীকৃতি ও মর্যাদা দিতে হবে। সমাজে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।
গেটস ফাউন্ডেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা মেলিন্ডা গেটস ও তাঁর স্বামী মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস গত ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে বিশ্বব্যাপী নারীদের এই সমস্যাকে ‘টাইম পভার্টি’ বা ‘সময়-দারিদ্র্য’ বলে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ মজুরিবিহীন কাজের বাইরে অন্য কাজ করার সময়ের অভাবে তাঁরা পীড়িত। এ বছর তাঁরা এই সময়-দারিদ্র্য দূর করার বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা জানান। সংসার সামলানোর কাজ নিশ্চয়ই অপরিহার্য। কিন্তু এ কাজের যথাযথ মূল্যায়ন হয় না এবং মজুরিসমৃদ্ধ কাজের চেয়ে একে কম মর্যাদা দেওয়া হয়। আর এই কাজগুলো যেহেতু নারীদেরই বেশি করতে হয়, তাই তাঁদের পক্ষে অন্য কাজ করা সম্ভব হয় না। মেলিন্ডা গেটস এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘নারীর মজুরিবিহীন শ্রম বিশ্বের সব সমাজে বৈষম্যের মূল এবং আমরা এ নিয়ে খুব বেশি কথা বলি না’ (সূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, ২৩ ফেব্রুয়ারি)।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো ধনী দেশেও এই বৈষম্য আছে, সংসারে পুরুষের চেয়ে নারীদের মজুরিবিহীন শ্রম বেশি দিতে হয়, যদিও গরিব দেশগুলোর চেয়ে সেটা কম। জাপানে এই সময়-পার্থক্য বেশি ছিল। সম্প্রতি কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যাতে সংসারে সারাক্ষণ বাচ্চা দেখাশোনার কাজ থেকে নারীরা বেরিয়ে এসে অন্য কাজে যোগ দিতে পারেন।
বিশ্বব্যাপী নারীরা মজুরিবিহীন কাজে প্রতিদিন গড়ে প্রায় সাড় চার ঘণ্টা কাজ করেন, যা পুরুষের মজুরিবিহীন কাজের সময়ের দ্বিগুণ। নরওয়েসহ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে এই পার্থক্য একটু কম। যেমন, নরওয়েতে নারীরা দিনে গড়ে সাড়ে তিন ঘণ্টা এবং পুরুষেরা তিন ঘণ্টা মজুরিবিহীন শ্রমের সাংসারিক কাজ করেন। ভারতে চিত্রটি ভিন্ন। নারীরা গড়ে ছয় ঘণ্টা এবং পুরুষেরা এক ঘণ্টারও কম সাংসারিক কাজ করেন।
বাংলাদেশে একজন নারী তাঁর সারা জীবনের প্রায় ১২ বছর রান্নাঘরে কাটান। অ্যাকশন এইড ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রজেক্টের আওতায় লালমনিরহাট ও গাইবান্ধা জেলার তৃণমূল নারী ও পুরুষের ব্যবহৃত বিভিন্ন কাজের সময়ের ভিত্তিতে ২০১৫ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে পরিচালিত এক গবেষণায় এ তথ্য পাওয়া গেছে। এর চেয়ে হতাশাজনক অবস্থা আর কী হতে পারে! গবেষণায় দেখা গেছে, বাড়িতে একজন নারী যেখানে সারা দিনে সেবামূলক কাজে পৌনে সাত ঘণ্টা ব্যয় করেন, সেখানে পুরুষ ব্যয় করেন সোয়া এক ঘণ্টারও কম।
একজন নারী প্রতিদিন ১২টিরও বেশি কাজ করেন, যা মজুরিবিহীন এবং জাতীয় আয়ের (জিডিপি) হিসাবে যোগ হয় না। আর পুরুষ করেন তিনটিরও কম। নারীর যে কাজ জাতীয় আয়ের হিসাবে (জিডিপি) যোগ হয় না—এমন কাজের আনুমানিক বার্ষিক মূল্য জিডিপির প্রায় ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ। কৃষিতে নারীর অবদান হিসাব করলে অবাক হতে হয়। ধান উৎপাদনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ২৩টি ধাপের মধ্যে ১৭টির সঙ্গে নারী সরাসরি যুক্ত। কিন্তু নারীর এই অবদানের স্বীকৃতি কোথাও নেই। কারণ এ কাজে কোনো নগদ আয় নেই বা এ কাজের জন্য কাউকে মজুরি দিতে হয় না। উপরন্তু নারী কাজ যতই করুন, যেহেতু ফসলের মালিক পুরুষ বা তাঁর স্বামী, তাই কাজের স্বীকৃতিও পুরোটা তাঁরই পকেটে চলে যায়। আর উঠতে-বসতে স্ত্রীকে কথা শুনতে হয়। বলা হয়, ‘সারা দিন করো কী?’
সাধারণত পেশাগত পরিচয়ে বলা হয়, স্বামী অমুক চাকরি করেন আর স্ত্রী গৃহিণী! স্ত্রীর পরিচয়ে অনেক সময় বলা হয়, উনি কোনো ‘কাজ’ করেন না! স্পষ্টতই এখানে ‘কাজ’ বলতে মজুরি-বেতন-ভাতা বাবদ নগদ আয় হয়—এমন কাজ বোঝানো হয়। আর নারীরা ঘরের যত কাজ করেন, সেসব কোনো কাজ বলে গণ্য হয় না, কারণ সেখানে কোনো নগদ আয় নেই।
একবার একটি চমৎকার কার্টুনচিত্র দেখেছিলাম। একজন নারী দশ-পনেরো হাতে কাজ করছেন। রান্না, সন্তান লালন-পালন, পরিবারের সদস্যদের সেবাযত্ন, ঘর পরিষ্কার করা, ...সব কাজ। আর ছবির ওপরে-নিচে লেখা, ‘আমার বউ কাজ করে না’! প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গিতে কাজগুলো এতই অদৃশ্য। নারীর মজুরি ও স্বীকৃতিবিহীন কাজের এমন তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ খুব কমই দেখেছি। কার্টুনচিত্রটি একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, আমাদের সমাজে নারীর কাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কত বৈষম্যমূলক ও ত্রুটিপূর্ণ।
নারীর সব কাজের স্বীকৃতি দিয়ে সঠিক মূল্যায়ন না করলে সমাজে অর্ধেক মানুষ উৎপাদনশীল কাজের বাইরে থেকে যাবে। যেহেতু নারীকে একাধারে ঘর ও বাইরের সব কাজ করতে হয়, তাই তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। নিজের অবসর বলতে কিছু থাকে না। তিনি যদি চাকরি করেনও, তা হলেও তাঁর পক্ষে প্রশিক্ষণ নিয়ে পেশাগত উৎকর্ষ লাভ করা সম্ভব হয় না। ফলে চাকরিতে গেলেও নারী সব সময় কম বেতনের নিম্নমানের কাজ করতে বাধ্য হন। সমাজের অর্ধেক কর্মশক্তি এভাবে পূর্ণ অবদান রাখতে ব্যর্থ হয়।
এর প্রতিকার কঠিন নয়। গৃহস্থালির কাজে পুরুষ সমান দায়িত্ব নিলে নারীর বোঝা অনেক কমে। তিনি পুরুষের সমান অবস্থানে থেকে চাকরি করতে পারেন। যেমন, স্বামী সপ্তাহে তিন-চার দিন সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া ও নিয়ে আসার দায়িত্ব নিতে পারেন। রান্নাঘরের কিছু কাজও ভাগাভাগি করে নেওয়া যায়। সরকারও নতুন কিছু আইন করতে পারে। চাকরিজীবীর জন্য বছরে ‘পরিবারের জন্য ছুটি’, ‘পিতৃত্ব ছুটি’র ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অনেক দেশে এ রকম আছে। একই সঙ্গে গৃহস্থালির কাজে আধুনিক প্রযুক্তি সহজলভ্য করা দরকার। ওয়াশিং মেশিন, রাইস কুকার, ঘর মোছার মেশিন প্রভৃতি সবার হাতের নাগালে আনা গেলে ঘরের কাজে সময় ভাগাভাগি সহজ হয়। কিন্তু এ জন্য আর্থসামাজিক উন্নয়ন দরকার। আবার বিপরীতক্রমে সমাজের অর্ধেক শক্তি নারীকে বাদ দিয়ে সমাজের উন্নয়নও সম্ভব নয়, এটাও মনে রাখতে হবে।
এক হিসাবে দেখা গেছে, গৃহস্থালির কাজে নারীর কাজের সময় দুই ঘণ্টা কমানো গেলে দেশের শ্রমশক্তিতে তাঁদের অংশগ্রহণ ১০ শতাংশ বাড়ে।
আসুন, আমাদের দেশে নারীর জন্য আপাতত ১০ শতাংশ কর্মক্ষেত্র বাড়ানোর লক্ষ্যে তাঁদের গৃহস্থালির কাজের সময় অন্তত দুই ঘণ্টা কমানোর উদ্যোগ নিই।
এ জন্য পুরুষকে এগিয়ে আসতে হবে। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
শেষ পর্যন্ত সবকিছুই হলো, শুধু স্ত্রী নিজেই নিজের তৈরি করা নাশতা খেতে পারলেন না। অফিসে দেরি করা চলবে না আজ। সংসারের অন্য সবাই খেয়েদেয়ে পরিপাটি হয়ে যার যার কাজে চলে যায়। স্ত্রীর তাতেই তৃপ্তি। ওই যে সকালে চা দেওয়ার সময় মিষ্টি হাসিটি ধরে রাখতে পেরেছেন এত চাপের মধ্যেও, সেখানেই তাঁর সার্থকতা!
আমাদের মধ্যবিত্ত ঘরের এটাই প্রতিদিনের চিত্র। সাহেব অফিস করবেন, তাঁর বড় চাকরি, বেতন বেশি। স্ত্রীর চাকরির তো কোনো দাম নেই, তা–ও করে করুক। কিন্তু সংসারের যাবতীয় কাজও তাঁকে করতে হবে হাসিমুখে। আর যাঁদের সংসারে স্ত্রী চাকরি করেন না, তাঁর জন্য তো কাজের শেষ নেই। রান্না, ঘর ঝাড়ু, ঘর মোছা, কাপড় ধোয়া, বাচ্চা মানুষ করা, স্কুলে নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ আর কাজ। কিন্তু তাঁদের এসব কাজের কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই। দামও নেই। আর্থিক বা সামাজিক মূল্যায়ন নেই। সরকারি হিসাবের খাতায়ও তাঁদের অবদান শূন্য।
গত রোববার প্রথম আলো ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে এ বিষয়গুলো আলোচনা হয়। ‘মর্যাদায় গড়ি সমতা’ প্রচারাভিযান ও বিজ্ঞাপনী সংস্থা মাত্রাও ছিল আমাদের সঙ্গে। অ্যাকশন এইডসহ কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রধান কর্মকর্তা, গবেষক, অর্থনীতিবিদ এবং আরও অনেকে আলোচনায় অংশ নেন। তাঁরা সবাই বললেন, এটা নারীর প্রতি বৈষম্য। গৃহস্থালিসহ অন্য সব কাজের স্বীকৃতি ও মর্যাদা দিতে হবে। সমাজে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।
গেটস ফাউন্ডেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা মেলিন্ডা গেটস ও তাঁর স্বামী মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস গত ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে বিশ্বব্যাপী নারীদের এই সমস্যাকে ‘টাইম পভার্টি’ বা ‘সময়-দারিদ্র্য’ বলে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ মজুরিবিহীন কাজের বাইরে অন্য কাজ করার সময়ের অভাবে তাঁরা পীড়িত। এ বছর তাঁরা এই সময়-দারিদ্র্য দূর করার বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা জানান। সংসার সামলানোর কাজ নিশ্চয়ই অপরিহার্য। কিন্তু এ কাজের যথাযথ মূল্যায়ন হয় না এবং মজুরিসমৃদ্ধ কাজের চেয়ে একে কম মর্যাদা দেওয়া হয়। আর এই কাজগুলো যেহেতু নারীদেরই বেশি করতে হয়, তাই তাঁদের পক্ষে অন্য কাজ করা সম্ভব হয় না। মেলিন্ডা গেটস এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘নারীর মজুরিবিহীন শ্রম বিশ্বের সব সমাজে বৈষম্যের মূল এবং আমরা এ নিয়ে খুব বেশি কথা বলি না’ (সূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, ২৩ ফেব্রুয়ারি)।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো ধনী দেশেও এই বৈষম্য আছে, সংসারে পুরুষের চেয়ে নারীদের মজুরিবিহীন শ্রম বেশি দিতে হয়, যদিও গরিব দেশগুলোর চেয়ে সেটা কম। জাপানে এই সময়-পার্থক্য বেশি ছিল। সম্প্রতি কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যাতে সংসারে সারাক্ষণ বাচ্চা দেখাশোনার কাজ থেকে নারীরা বেরিয়ে এসে অন্য কাজে যোগ দিতে পারেন।
বিশ্বব্যাপী নারীরা মজুরিবিহীন কাজে প্রতিদিন গড়ে প্রায় সাড় চার ঘণ্টা কাজ করেন, যা পুরুষের মজুরিবিহীন কাজের সময়ের দ্বিগুণ। নরওয়েসহ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে এই পার্থক্য একটু কম। যেমন, নরওয়েতে নারীরা দিনে গড়ে সাড়ে তিন ঘণ্টা এবং পুরুষেরা তিন ঘণ্টা মজুরিবিহীন শ্রমের সাংসারিক কাজ করেন। ভারতে চিত্রটি ভিন্ন। নারীরা গড়ে ছয় ঘণ্টা এবং পুরুষেরা এক ঘণ্টারও কম সাংসারিক কাজ করেন।
বাংলাদেশে একজন নারী তাঁর সারা জীবনের প্রায় ১২ বছর রান্নাঘরে কাটান। অ্যাকশন এইড ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রজেক্টের আওতায় লালমনিরহাট ও গাইবান্ধা জেলার তৃণমূল নারী ও পুরুষের ব্যবহৃত বিভিন্ন কাজের সময়ের ভিত্তিতে ২০১৫ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে পরিচালিত এক গবেষণায় এ তথ্য পাওয়া গেছে। এর চেয়ে হতাশাজনক অবস্থা আর কী হতে পারে! গবেষণায় দেখা গেছে, বাড়িতে একজন নারী যেখানে সারা দিনে সেবামূলক কাজে পৌনে সাত ঘণ্টা ব্যয় করেন, সেখানে পুরুষ ব্যয় করেন সোয়া এক ঘণ্টারও কম।
একজন নারী প্রতিদিন ১২টিরও বেশি কাজ করেন, যা মজুরিবিহীন এবং জাতীয় আয়ের (জিডিপি) হিসাবে যোগ হয় না। আর পুরুষ করেন তিনটিরও কম। নারীর যে কাজ জাতীয় আয়ের হিসাবে (জিডিপি) যোগ হয় না—এমন কাজের আনুমানিক বার্ষিক মূল্য জিডিপির প্রায় ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ। কৃষিতে নারীর অবদান হিসাব করলে অবাক হতে হয়। ধান উৎপাদনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ২৩টি ধাপের মধ্যে ১৭টির সঙ্গে নারী সরাসরি যুক্ত। কিন্তু নারীর এই অবদানের স্বীকৃতি কোথাও নেই। কারণ এ কাজে কোনো নগদ আয় নেই বা এ কাজের জন্য কাউকে মজুরি দিতে হয় না। উপরন্তু নারী কাজ যতই করুন, যেহেতু ফসলের মালিক পুরুষ বা তাঁর স্বামী, তাই কাজের স্বীকৃতিও পুরোটা তাঁরই পকেটে চলে যায়। আর উঠতে-বসতে স্ত্রীকে কথা শুনতে হয়। বলা হয়, ‘সারা দিন করো কী?’
সাধারণত পেশাগত পরিচয়ে বলা হয়, স্বামী অমুক চাকরি করেন আর স্ত্রী গৃহিণী! স্ত্রীর পরিচয়ে অনেক সময় বলা হয়, উনি কোনো ‘কাজ’ করেন না! স্পষ্টতই এখানে ‘কাজ’ বলতে মজুরি-বেতন-ভাতা বাবদ নগদ আয় হয়—এমন কাজ বোঝানো হয়। আর নারীরা ঘরের যত কাজ করেন, সেসব কোনো কাজ বলে গণ্য হয় না, কারণ সেখানে কোনো নগদ আয় নেই।
একবার একটি চমৎকার কার্টুনচিত্র দেখেছিলাম। একজন নারী দশ-পনেরো হাতে কাজ করছেন। রান্না, সন্তান লালন-পালন, পরিবারের সদস্যদের সেবাযত্ন, ঘর পরিষ্কার করা, ...সব কাজ। আর ছবির ওপরে-নিচে লেখা, ‘আমার বউ কাজ করে না’! প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গিতে কাজগুলো এতই অদৃশ্য। নারীর মজুরি ও স্বীকৃতিবিহীন কাজের এমন তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ খুব কমই দেখেছি। কার্টুনচিত্রটি একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, আমাদের সমাজে নারীর কাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কত বৈষম্যমূলক ও ত্রুটিপূর্ণ।
নারীর সব কাজের স্বীকৃতি দিয়ে সঠিক মূল্যায়ন না করলে সমাজে অর্ধেক মানুষ উৎপাদনশীল কাজের বাইরে থেকে যাবে। যেহেতু নারীকে একাধারে ঘর ও বাইরের সব কাজ করতে হয়, তাই তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। নিজের অবসর বলতে কিছু থাকে না। তিনি যদি চাকরি করেনও, তা হলেও তাঁর পক্ষে প্রশিক্ষণ নিয়ে পেশাগত উৎকর্ষ লাভ করা সম্ভব হয় না। ফলে চাকরিতে গেলেও নারী সব সময় কম বেতনের নিম্নমানের কাজ করতে বাধ্য হন। সমাজের অর্ধেক কর্মশক্তি এভাবে পূর্ণ অবদান রাখতে ব্যর্থ হয়।
এর প্রতিকার কঠিন নয়। গৃহস্থালির কাজে পুরুষ সমান দায়িত্ব নিলে নারীর বোঝা অনেক কমে। তিনি পুরুষের সমান অবস্থানে থেকে চাকরি করতে পারেন। যেমন, স্বামী সপ্তাহে তিন-চার দিন সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া ও নিয়ে আসার দায়িত্ব নিতে পারেন। রান্নাঘরের কিছু কাজও ভাগাভাগি করে নেওয়া যায়। সরকারও নতুন কিছু আইন করতে পারে। চাকরিজীবীর জন্য বছরে ‘পরিবারের জন্য ছুটি’, ‘পিতৃত্ব ছুটি’র ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অনেক দেশে এ রকম আছে। একই সঙ্গে গৃহস্থালির কাজে আধুনিক প্রযুক্তি সহজলভ্য করা দরকার। ওয়াশিং মেশিন, রাইস কুকার, ঘর মোছার মেশিন প্রভৃতি সবার হাতের নাগালে আনা গেলে ঘরের কাজে সময় ভাগাভাগি সহজ হয়। কিন্তু এ জন্য আর্থসামাজিক উন্নয়ন দরকার। আবার বিপরীতক্রমে সমাজের অর্ধেক শক্তি নারীকে বাদ দিয়ে সমাজের উন্নয়নও সম্ভব নয়, এটাও মনে রাখতে হবে।
এক হিসাবে দেখা গেছে, গৃহস্থালির কাজে নারীর কাজের সময় দুই ঘণ্টা কমানো গেলে দেশের শ্রমশক্তিতে তাঁদের অংশগ্রহণ ১০ শতাংশ বাড়ে।
আসুন, আমাদের দেশে নারীর জন্য আপাতত ১০ শতাংশ কর্মক্ষেত্র বাড়ানোর লক্ষ্যে তাঁদের গৃহস্থালির কাজের সময় অন্তত দুই ঘণ্টা কমানোর উদ্যোগ নিই।
এ জন্য পুরুষকে এগিয়ে আসতে হবে। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
No comments