মায়ের স্বীকারোক্তি রহস্য রয়েই গেল
শুনলে
যে কারো অবিশ্বাস্য মনে হবে। কিন্তু মায়ের নিজের স্বীকারোক্তি। নিজ হাতেই
খুন করেছেন দুই সন্তানকে। সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন
তিনি। এ কারণে হঠাৎ করেই তিনি নিজের সন্তানদের হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন।
মেয়ের কাছে থাকা নিজের ওড়না দিয়েই গলায় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করেন নাড়ি
ছেঁড়া ধনটিকে। মেয়েকে হত্যার পর ঘুমন্ত ছোট্ট ছেলেকেও হত্যা করেন একই
কায়দায়। মায়ের এই স্বীকারোক্তি প্রথমে বিশ্বাস করতে চাননি র্যাবের
জিজ্ঞাসাবাদকারী কর্মকর্তারাও। বিস্মিত হন সবাই। এ কি করে সম্ভব! নেপথ্য
কারণ অন্য কিছু থাকতে পারে বলে ধারণা ছিল সবার। একারণে রাতভর চলে জোর
প্রচেষ্টা। নানা কায়দায়, নানা কৌশলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় তাকে। কিন্তু মায়ের
একই স্বীকারোক্তি। ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন, এটাই
একমাত্র কারণ। পরে অবশ্য আফসোস করেছেন। বলেছেন, দুশ্চিন্তা উপশমের জন্য যদি
মানসিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতেন তবে এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না।
দুই সন্তানকে হত্যার স্বীকারোক্তি মা দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু রহস্য রয়েই গেল,
সঙ্গে অনেক প্রশ্নও। ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় কি মা তার সন্তানদের মেরে
ফেলতে পারেন?
গত সোমবার রাজধানীর রামপুরা এলাকার বনশ্রীর বি ব্লকের ৪ নম্বর সড়কের ৯ নম্বর বাড়ির পঞ্চম তলার একটি বাসা থেকে দুই ভাইবোনকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হয়। রাত ৮টার দিকে হাসপাতালে নেয়ার পরপরই কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। নিহত দুই শিশুর মধ্যে ১৪ বছর বয়সী নুসরাত আমান অরণী ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইস্কাটন শাখার সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। আর তার ছোটভাই আলভী আমান (৬) পড়তো হলি ক্রিসেন্ট স্কুলের নার্সারিতে। তাদের বাবা আমানুল্লাহ একজন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী। আর যেই মায়ের বিরুদ্ধে শিশু সন্তানদের হত্যার অভিযোগ, তার নাম মাহফুজা মালেক জেসমিন। তিনি ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করলেও ছিলেন সাধারণ গৃহিণী।
গতকাল দুপুরে সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ‘দুশ্চিন্তার একপর্যায়ে’ নিজের ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে ছেলে-মেয়েকে হত্যা করেন তাদের মা মাহফুজা মালেক জেসমিন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি পরিকল্পিতভাবে সন্তানদের হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। পরে নিজে বাঁচতে চাইনিজ খাবার খেয়ে বিষক্রিয়ায় তারা মারা যায় বলে মা প্রচার করেন। জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘গত ২৯শে ফেব্রুয়ারি মেয়ে অরণী যখন গৃহ শিক্ষকের কাছে পড়ছিল, তার মা ও ভাই তখন শোবার ঘরে ঘুমাচ্ছিলেন। গৃহ শিক্ষক চলে যাওয়ার পর মাহফুজা তার মেয়েকেও ঘুমাতে ডাকেন। অরণী বিছানায় যাওয়ার পর মাহফুজা তার ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে মেয়েকে শ্বাসরোধ করেন। একপর্যায়ে ধস্তাধস্তিতে মেয়ে বিছানা থেকে পড়ে যায়। মেয়ের মৃত্যু হয়েছে নিশ্চিত হওয়ার পর ছেলেকেও একইভাবে ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে হত্যা করেন।’ মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের পর প্রথমে সে ঘটনা গোপন করার জন্য স্বামীকে ফোন করে ছেলেমেয়ের অসুস্থতার কথা বলে। আমানুল্লাহ তখন দুই বন্ধুকে বাসায় পাঠায়। বাচ্চাদের হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, ঘটনার পর পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে তাদের মনে হয়েছে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে পরিবারের লোকজন জড়িত থাকতে পারে। একারণে ঘটনার পরপরই র্যাব বাসার দারোয়ান, দুই গৃহ শিক্ষক ও দুই আত্মীয়কে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে। বনশ্রীর বাসায় অবস্থানকারী অরণী ও আলভীর দাদি র্যাব কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন, তিনি বিকালে অরণীর গৃহ শিক্ষক চলে যাওয়ার পর ঘর থেকে কারও কান্নার শব্দ পান। এ সময় তিনি জেসমিনের ঘরের দরজা বন্ধ পান। কয়েক মিনিট পরে জেসমিন তাকে দুই সন্তান আর পৃথিবীতে নেই বলে জানায়।
যেভাবে স্বীকারোক্তি দেয় জেসমিন: বিষক্রিয়ায় নয় দুই শিশুকে হত্যা করা হয়েছে, ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা এমন ধারণা করার পর পরই পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সন্দেহ করা দুই শিশুর নিকটাত্মীয়দের। এ ছাড়া ঘটনার পরদিন বাবা-মা ও খালা হাসপাতালের মর্গে না গিয়ে জামালপুরের গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ায় সন্দেহ আরও বাড়ে। একারণে বুধবার নিকটাত্মীয়দের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য জামালপুরের বাসা থেকে নিহত দুই শিশুর বাবা আমানউল্লাহ, মা মাহফুজা মালেক জেসমিন, খালা আফরোজা মালেক নীলাকে ঢাকায় আনা হয়। উত্তরায় র্যাব-১ এর কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদে নিহত দুই শিশুর মা আগের অবস্থানে অনড় থাকেন। তবে বারবার বিভিন্ন কায়দায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে রাত ৯টার দিকে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারেননি তিনি। একপর্যায়ে জিজ্ঞাসাবাদকারী কর্মকর্তাদের কাছে সব খুলে বলেন তিনি। কীভাবে এবং কেন দুই সন্তানকে হত্যা করেছে খুলে বলেন তার বিস্তারিত বিবরণ। এই বিবরণ শুনে রীতিমতো চমকে ওঠেন র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদকারী কর্মকর্তারা। হত্যাকাণ্ডের কারণ শুনে বিস্মিত হন সবাই। বিশ্বাসযোগ্য না হওয়ায় বারবার মূল কারণ জানতে চাওয়া হয় তার কাছে। কিন্তু ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ দুশ্চিন্তার কারণেই হত্যা করেছেন বলে বলতে থাকেন বারবার। মায়ের এই স্বীকারোক্তি শুনে ‘থ’ বনে যান দুই শিশুর বাবা আমানউল্লাহ। তিনি যেন বিশ্বাস করতেই পারছিলেন না। পরে তাদের মুখোমুখি করা হয়। আমানউল্লাহর কাছেও একই কথা স্বীকার করেন জেসমিন। র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে.কর্নেল আবুল কালাম আজাদ বলেন, মায়ের মুখে স্বীকারোক্তি শুনে আমরাই বিস্মিত হয়ে গিয়েছি। এখন এর নেপথ্যে আর কোনো কাহিনী আছে কিনা তা তদন্ত কর্মকর্তা খুঁজে বের করতে পারবেন।
জিজ্ঞাসাবাদে যা বলেছেন: দুই সন্তানের ঘাতক এই মাকে জিজ্ঞাসাবদ করার সময় রেকর্ড করা একটি অডিও রয়েছে এই প্রতিবেদকের কাছে। ওই অডিওতে শোনা যায়, হত্যার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদকারীরা জানতে চাইলে জেসমিন বলছেন, ‘অন্তত এই আমি সারাক্ষণ এরা পড়াশোনা পারবে না, কিচ্ছু করতে পারবে না, সব সময় খুব ভয় লাগতো আমার।’ ছেলেমেয়েদের পড়াশুনায় কি ব্যবস্থা নিয়েছিলেন জানতে চাইলে জেসমিন বলেন, ‘তিন জন টিচার ছিল।’ কেন সন্তানদের মেরেছে আবারও জানতে চাওয়া তার কাছে। জেসমিনের উত্তর- ‘আমার মনের মধ্যে, মাথার ভেতর সবসময় এটা কাজ করতো যে ছেলেমেয়েগুলো বোধহয় পড়াশুনায় পারবে না, কিচ্ছু পারবে না। এদের দ্বারা কিচ্ছু হবে না।’ জেসমিনের পারিবারিক অবস্থার কথা জিজ্ঞাসাবাদকারীরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের সহায়-সম্পত্তি তেমন বেশি নাই, আমার হাজব্যান্ড ব্যবসা করে এই।’ গ্রামের বাড়ি সম্পর্কে বলেন, ‘আমার হাজব্যান্ডের মেইন বাড়ি ইসলামপুর। আমার বাড়ি জামালপুর সদরে।’ আবারও প্রশ্ন করা হয় তাকে কেন মারলা? কোনও মা কি সন্তানদের মারতে পারে? জেসমিনের উত্তর ছিল- ‘এইরকম কেউ মারে না। কিন্তু কষ্ট থেকে.. মানে.. ফেব্রুয়ারি মাসের ৪ তারিখ থেকে প্রতিদিন আমি ঘুমাতে পারতাম না। মানে রাত ৩টা বাজলে সারাক্ষণ ওদের পড়া নিয়ে টেনশন, ওরা কি করবে না করবে এই টেনশন করতাম।’ জানতে চাওয়া হয় বাচ্চা দুটো প্রকৃতই তার কি না। উত্তরে জেসমিন বলেন, ‘বাচ্চা দুটাই আমার। বাচ্চা দুটোই সিজার করে হয়েছে। আমার অনেক কষ্ট হয়েছে। বাচ্চা দুটোকে মেরে ফেলার পর আমার অনেক অনুশোচনা হয়েছে। অনেক কান্না করছি। তারপর থেকে আমার মনে হয় চোখের পানি শুকায়া গেছে। এখন আমার মনে হয় আমি যদি বাচ্চা দুইটাকে কাছে পাইতাম, ওদের একটু জড়ায়া ধরতে পারতাম। তাহলে মনে হয় আমার চোখের পানিটা ফিরা আসতো।’ হত্যাকাণ্ডের পর কাউকে এ ঘটনা বলেছিল কিনা তা জানতে চাওয়া হয় জেসমিনের কাছে। জেসমিন বলেন, ‘মারার পর আমি কাউকে বলি নাই। আমি বাঁচতে চাইছিলাম আবার। বিপদ থিকা আবার বাঁচতে চাইছিলাম। মানে যা হবার তা তো হইছেই, এখন যদি আমি বলি তাহলে তো আমি ধরা পড়ে যাবো, আমার নির্ঘাত ফাঁসি হয়ে যাবে। আমি যদি বাঁচতে পারি তাহলে আমি নতুন করে আমার জীবনটাকে শুরু করতে পারবো। এই জন্য আমি কাউরে বলি নাই।’ স্বামীকে বলেছিল কিনা জানতে চাওয়া হয় আবার। জেসমিন বলেন, ‘আমার স্বামীকে আমি কখনই বলি নাই এই কথা। ও সারাদিন ব্যবসা নিয়ে তো ব্যস্ত থাকতো। আমি নিজে ভিতরে ভিতরেই অনেক ই হয়ে গেছিলাম। আসলে আমার মনে হয় তখনই যদি আমার স্বামীকে বলতাম, আমার বোনকে বলতাম, আমি যদি একটা ডাক্তারের কাছে যাইতাম, তাহলে আজকে এই এক্সিডেন্টটা...আমি জীবনে কোনদিন কল্পনা করি নাই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।’ জেসমিন বলতে থাকেন, ‘আমার মনের কষ্টটা, মনের কথাগুলা তার সঙ্গে শেয়ার করি নাই। আমি পড়াশুনা নিয়ে কথা বললে সে বলতো পড়াশুনা নিয়ে বেশি কথা বইলো না, যা হয় তাই হবে। কিন্তু আমার নিজের মনকে ই দিতে পারতাম না, সায় দিতে পারতাম না। আমার নিজের মনকে কখনই বুঝ দিতে পারতাম না, যে ওরা পারবে না, না ওরা কেন পারবে না? ওরা ভালো করবে।’ সে নিজে পড়াশুনায় কেমন ছিল জানতে চাইলে জেসমিন বলেন, ‘আমি পড়াশুনায় ভালো ছিলাম না। আমি হাউজ ওয়াইফ।’ হত্যাকাণ্ডের সময় ঘরে কে কে ছিল? জেসমিন বলেন, ‘আমি, আমার মেয়ে আর ছেলে। আর কোনও লোক ছিলো না। আর কোনও লোক ছিল না।’ কিভাবে মেরেছো জানতে চাইলে ঘাতক মা বলেন, ‘আমার মেয়ে আমার ওড়নাটা পরতো। আমি ওই ওড়নাটা গলায় পেঁচায়া ধরি। তারপর মেয়ে নিচে পড়ে যায়। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর মেয়ে নিস্তেজ হয়ে যায়। তারপর ছেলেটাকে ধরি। ছেলেটা তখন ঘুমানো ছিল। ঘুমন্ত অবস্থাতেই পেঁচায়া ধরি।’
মামলার বাদী হচ্ছেন বাবা: জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রামপুরার দুই শিশু হত্যার ঘটনায় আটককৃত মাহফুজা মালেক জেসমিন ও খালা আফরোজা মালেক নীলাকে গতকাল রামপুরা থানায় হস্তান্তর করা হয়। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহত দুই সন্তানের বাবা গার্মেন্ট ব্যবসায়ী আমানউল্লাহর বাদী হয়ে মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন র্যাব-পুলিশের কর্মকর্তারা। মামলায় মা মাহফুজা মালেক জেসমনিকেই একমাত্র আসামি করা হবে। খালাকে করা হবে সাক্ষী। বাকিদের যাচাই-বাছাই করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। রামপুরা থানার ওসি রফিকুল ইসলাম রাত ৮টায় এই প্রতিবেদককে জানান, মামলা হয়নি। তবে মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে।
গত সোমবার রাজধানীর রামপুরা এলাকার বনশ্রীর বি ব্লকের ৪ নম্বর সড়কের ৯ নম্বর বাড়ির পঞ্চম তলার একটি বাসা থেকে দুই ভাইবোনকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হয়। রাত ৮টার দিকে হাসপাতালে নেয়ার পরপরই কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। নিহত দুই শিশুর মধ্যে ১৪ বছর বয়সী নুসরাত আমান অরণী ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইস্কাটন শাখার সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। আর তার ছোটভাই আলভী আমান (৬) পড়তো হলি ক্রিসেন্ট স্কুলের নার্সারিতে। তাদের বাবা আমানুল্লাহ একজন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী। আর যেই মায়ের বিরুদ্ধে শিশু সন্তানদের হত্যার অভিযোগ, তার নাম মাহফুজা মালেক জেসমিন। তিনি ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করলেও ছিলেন সাধারণ গৃহিণী।
গতকাল দুপুরে সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ‘দুশ্চিন্তার একপর্যায়ে’ নিজের ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে ছেলে-মেয়েকে হত্যা করেন তাদের মা মাহফুজা মালেক জেসমিন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি পরিকল্পিতভাবে সন্তানদের হত্যার কথা স্বীকার করেছেন। পরে নিজে বাঁচতে চাইনিজ খাবার খেয়ে বিষক্রিয়ায় তারা মারা যায় বলে মা প্রচার করেন। জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘গত ২৯শে ফেব্রুয়ারি মেয়ে অরণী যখন গৃহ শিক্ষকের কাছে পড়ছিল, তার মা ও ভাই তখন শোবার ঘরে ঘুমাচ্ছিলেন। গৃহ শিক্ষক চলে যাওয়ার পর মাহফুজা তার মেয়েকেও ঘুমাতে ডাকেন। অরণী বিছানায় যাওয়ার পর মাহফুজা তার ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে মেয়েকে শ্বাসরোধ করেন। একপর্যায়ে ধস্তাধস্তিতে মেয়ে বিছানা থেকে পড়ে যায়। মেয়ের মৃত্যু হয়েছে নিশ্চিত হওয়ার পর ছেলেকেও একইভাবে ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে হত্যা করেন।’ মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের পর প্রথমে সে ঘটনা গোপন করার জন্য স্বামীকে ফোন করে ছেলেমেয়ের অসুস্থতার কথা বলে। আমানুল্লাহ তখন দুই বন্ধুকে বাসায় পাঠায়। বাচ্চাদের হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, ঘটনার পর পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে তাদের মনে হয়েছে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে পরিবারের লোকজন জড়িত থাকতে পারে। একারণে ঘটনার পরপরই র্যাব বাসার দারোয়ান, দুই গৃহ শিক্ষক ও দুই আত্মীয়কে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে। বনশ্রীর বাসায় অবস্থানকারী অরণী ও আলভীর দাদি র্যাব কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন, তিনি বিকালে অরণীর গৃহ শিক্ষক চলে যাওয়ার পর ঘর থেকে কারও কান্নার শব্দ পান। এ সময় তিনি জেসমিনের ঘরের দরজা বন্ধ পান। কয়েক মিনিট পরে জেসমিন তাকে দুই সন্তান আর পৃথিবীতে নেই বলে জানায়।
যেভাবে স্বীকারোক্তি দেয় জেসমিন: বিষক্রিয়ায় নয় দুই শিশুকে হত্যা করা হয়েছে, ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা এমন ধারণা করার পর পরই পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সন্দেহ করা দুই শিশুর নিকটাত্মীয়দের। এ ছাড়া ঘটনার পরদিন বাবা-মা ও খালা হাসপাতালের মর্গে না গিয়ে জামালপুরের গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ায় সন্দেহ আরও বাড়ে। একারণে বুধবার নিকটাত্মীয়দের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য জামালপুরের বাসা থেকে নিহত দুই শিশুর বাবা আমানউল্লাহ, মা মাহফুজা মালেক জেসমিন, খালা আফরোজা মালেক নীলাকে ঢাকায় আনা হয়। উত্তরায় র্যাব-১ এর কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদে নিহত দুই শিশুর মা আগের অবস্থানে অনড় থাকেন। তবে বারবার বিভিন্ন কায়দায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে রাত ৯টার দিকে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারেননি তিনি। একপর্যায়ে জিজ্ঞাসাবাদকারী কর্মকর্তাদের কাছে সব খুলে বলেন তিনি। কীভাবে এবং কেন দুই সন্তানকে হত্যা করেছে খুলে বলেন তার বিস্তারিত বিবরণ। এই বিবরণ শুনে রীতিমতো চমকে ওঠেন র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদকারী কর্মকর্তারা। হত্যাকাণ্ডের কারণ শুনে বিস্মিত হন সবাই। বিশ্বাসযোগ্য না হওয়ায় বারবার মূল কারণ জানতে চাওয়া হয় তার কাছে। কিন্তু ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ দুশ্চিন্তার কারণেই হত্যা করেছেন বলে বলতে থাকেন বারবার। মায়ের এই স্বীকারোক্তি শুনে ‘থ’ বনে যান দুই শিশুর বাবা আমানউল্লাহ। তিনি যেন বিশ্বাস করতেই পারছিলেন না। পরে তাদের মুখোমুখি করা হয়। আমানউল্লাহর কাছেও একই কথা স্বীকার করেন জেসমিন। র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে.কর্নেল আবুল কালাম আজাদ বলেন, মায়ের মুখে স্বীকারোক্তি শুনে আমরাই বিস্মিত হয়ে গিয়েছি। এখন এর নেপথ্যে আর কোনো কাহিনী আছে কিনা তা তদন্ত কর্মকর্তা খুঁজে বের করতে পারবেন।
জিজ্ঞাসাবাদে যা বলেছেন: দুই সন্তানের ঘাতক এই মাকে জিজ্ঞাসাবদ করার সময় রেকর্ড করা একটি অডিও রয়েছে এই প্রতিবেদকের কাছে। ওই অডিওতে শোনা যায়, হত্যার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদকারীরা জানতে চাইলে জেসমিন বলছেন, ‘অন্তত এই আমি সারাক্ষণ এরা পড়াশোনা পারবে না, কিচ্ছু করতে পারবে না, সব সময় খুব ভয় লাগতো আমার।’ ছেলেমেয়েদের পড়াশুনায় কি ব্যবস্থা নিয়েছিলেন জানতে চাইলে জেসমিন বলেন, ‘তিন জন টিচার ছিল।’ কেন সন্তানদের মেরেছে আবারও জানতে চাওয়া তার কাছে। জেসমিনের উত্তর- ‘আমার মনের মধ্যে, মাথার ভেতর সবসময় এটা কাজ করতো যে ছেলেমেয়েগুলো বোধহয় পড়াশুনায় পারবে না, কিচ্ছু পারবে না। এদের দ্বারা কিচ্ছু হবে না।’ জেসমিনের পারিবারিক অবস্থার কথা জিজ্ঞাসাবাদকারীরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের সহায়-সম্পত্তি তেমন বেশি নাই, আমার হাজব্যান্ড ব্যবসা করে এই।’ গ্রামের বাড়ি সম্পর্কে বলেন, ‘আমার হাজব্যান্ডের মেইন বাড়ি ইসলামপুর। আমার বাড়ি জামালপুর সদরে।’ আবারও প্রশ্ন করা হয় তাকে কেন মারলা? কোনও মা কি সন্তানদের মারতে পারে? জেসমিনের উত্তর ছিল- ‘এইরকম কেউ মারে না। কিন্তু কষ্ট থেকে.. মানে.. ফেব্রুয়ারি মাসের ৪ তারিখ থেকে প্রতিদিন আমি ঘুমাতে পারতাম না। মানে রাত ৩টা বাজলে সারাক্ষণ ওদের পড়া নিয়ে টেনশন, ওরা কি করবে না করবে এই টেনশন করতাম।’ জানতে চাওয়া হয় বাচ্চা দুটো প্রকৃতই তার কি না। উত্তরে জেসমিন বলেন, ‘বাচ্চা দুটাই আমার। বাচ্চা দুটোই সিজার করে হয়েছে। আমার অনেক কষ্ট হয়েছে। বাচ্চা দুটোকে মেরে ফেলার পর আমার অনেক অনুশোচনা হয়েছে। অনেক কান্না করছি। তারপর থেকে আমার মনে হয় চোখের পানি শুকায়া গেছে। এখন আমার মনে হয় আমি যদি বাচ্চা দুইটাকে কাছে পাইতাম, ওদের একটু জড়ায়া ধরতে পারতাম। তাহলে মনে হয় আমার চোখের পানিটা ফিরা আসতো।’ হত্যাকাণ্ডের পর কাউকে এ ঘটনা বলেছিল কিনা তা জানতে চাওয়া হয় জেসমিনের কাছে। জেসমিন বলেন, ‘মারার পর আমি কাউকে বলি নাই। আমি বাঁচতে চাইছিলাম আবার। বিপদ থিকা আবার বাঁচতে চাইছিলাম। মানে যা হবার তা তো হইছেই, এখন যদি আমি বলি তাহলে তো আমি ধরা পড়ে যাবো, আমার নির্ঘাত ফাঁসি হয়ে যাবে। আমি যদি বাঁচতে পারি তাহলে আমি নতুন করে আমার জীবনটাকে শুরু করতে পারবো। এই জন্য আমি কাউরে বলি নাই।’ স্বামীকে বলেছিল কিনা জানতে চাওয়া হয় আবার। জেসমিন বলেন, ‘আমার স্বামীকে আমি কখনই বলি নাই এই কথা। ও সারাদিন ব্যবসা নিয়ে তো ব্যস্ত থাকতো। আমি নিজে ভিতরে ভিতরেই অনেক ই হয়ে গেছিলাম। আসলে আমার মনে হয় তখনই যদি আমার স্বামীকে বলতাম, আমার বোনকে বলতাম, আমি যদি একটা ডাক্তারের কাছে যাইতাম, তাহলে আজকে এই এক্সিডেন্টটা...আমি জীবনে কোনদিন কল্পনা করি নাই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।’ জেসমিন বলতে থাকেন, ‘আমার মনের কষ্টটা, মনের কথাগুলা তার সঙ্গে শেয়ার করি নাই। আমি পড়াশুনা নিয়ে কথা বললে সে বলতো পড়াশুনা নিয়ে বেশি কথা বইলো না, যা হয় তাই হবে। কিন্তু আমার নিজের মনকে ই দিতে পারতাম না, সায় দিতে পারতাম না। আমার নিজের মনকে কখনই বুঝ দিতে পারতাম না, যে ওরা পারবে না, না ওরা কেন পারবে না? ওরা ভালো করবে।’ সে নিজে পড়াশুনায় কেমন ছিল জানতে চাইলে জেসমিন বলেন, ‘আমি পড়াশুনায় ভালো ছিলাম না। আমি হাউজ ওয়াইফ।’ হত্যাকাণ্ডের সময় ঘরে কে কে ছিল? জেসমিন বলেন, ‘আমি, আমার মেয়ে আর ছেলে। আর কোনও লোক ছিলো না। আর কোনও লোক ছিল না।’ কিভাবে মেরেছো জানতে চাইলে ঘাতক মা বলেন, ‘আমার মেয়ে আমার ওড়নাটা পরতো। আমি ওই ওড়নাটা গলায় পেঁচায়া ধরি। তারপর মেয়ে নিচে পড়ে যায়। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর মেয়ে নিস্তেজ হয়ে যায়। তারপর ছেলেটাকে ধরি। ছেলেটা তখন ঘুমানো ছিল। ঘুমন্ত অবস্থাতেই পেঁচায়া ধরি।’
মামলার বাদী হচ্ছেন বাবা: জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রামপুরার দুই শিশু হত্যার ঘটনায় আটককৃত মাহফুজা মালেক জেসমিন ও খালা আফরোজা মালেক নীলাকে গতকাল রামপুরা থানায় হস্তান্তর করা হয়। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহত দুই সন্তানের বাবা গার্মেন্ট ব্যবসায়ী আমানউল্লাহর বাদী হয়ে মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন র্যাব-পুলিশের কর্মকর্তারা। মামলায় মা মাহফুজা মালেক জেসমনিকেই একমাত্র আসামি করা হবে। খালাকে করা হবে সাক্ষী। বাকিদের যাচাই-বাছাই করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। রামপুরা থানার ওসি রফিকুল ইসলাম রাত ৮টায় এই প্রতিবেদককে জানান, মামলা হয়নি। তবে মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে।
No comments