‘বেকার’ শিক্ষা এবং প্রতিবন্ধী মাহাফুজারের প্রতিবাদ by সোহরাব হাসান

টেলিফোনে যখন মাহাফুজার রহমানের সঙ্গে কথা বলি, তখন তাঁকে আত্মপ্রত্যয়ী মনে হলো। তিনি একজন প্রতিবন্ধী। শৈশব থেকে তাঁর একটি হাত অকেজো। তিনি এক হাতেই দৈনন্দিন কাজকর্ম ও পড়াশোনা করে এসেছেন। এসএসসি ও এইচএসসিতে প্রথম বিভাগ পেয়েছেন। স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে দ্বিতীয় বিভাগ। এরপর চাকরির পরীক্ষায় পাস করেও চূড়ান্ত নিয়োগ না হওয়ায় নিজের সব কটি মূল সনদ প্রধানমন্ত্রীর কাছে ফিরিয়ে দিতে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি লালমনিরহাট জেলা প্রশাসকের কাছে জমা দিয়েছেন। প্রশাসনিকভাবে রীতিসম্মত না হলেও মানবিক কারণে তাঁর আবেদনপত্রের সঙ্গে ওই সনদগুলো জমা নেওয়া হয় বলে প্রথম আলোর খবরে বলা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বরাবর আবেদনপত্রে মাহাফুজার রহমান উল্লেখ করেন, লালমনিরহাট সদর উপজেলার রতিপুর গ্রামের বাসিন্দা তিনি। তিনি একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। ২০১২ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। জেলার পাঁচটি উপজেলায় লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ৪৫ জনের মধ্যে মাহাফুজার রহমান একমাত্র শারীরিক প্রতিবন্ধী হিসেবে মৌখিক পরীক্ষা দেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল ৩৩ বছর। চূড়ান্ত নিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যান্য কোটা পূরণ করা হলেও প্রতিবন্ধী কোটা পূরণ করা হয়নি। এরপর সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এবং বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের লিখিত পরীক্ষায় পাস করার পরও তাঁকে চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। তিনি জানান, ওপরের মামা, খালু বা অর্থ না থাকায় তিনি ও তাঁর স্ত্রী নাসরিন নাহার উচ্চশিক্ষিত হয়েও বেকার জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। তাঁদের সংসারে মোতাসসীম ফুয়াদ লামীম নামের ১ বছর ৮ মাসের একটি ছেলেশিশু রয়েছে।
মাহাফুজারের বাবা অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক মো. সৈয়দ আলী বলেন, ‘ছেলেটি বা তাঁর স্ত্রী একটি চাকরি পেলে আমি মরেও শান্তি পেতাম। কিন্তু কোথাও কোনো আলোর দেখা না পেয়ে সে তার শিক্ষাগত যোগ্যতার সব মূল সনদ সরকারের কাছে হস্তান্তরের জন্য জেলা প্রশাসককে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
একজন মানুষ কতটা আশাহত হলে তাঁর শিক্ষাগত সনদগুলো ফেরত দিতে পারেন! নদীতে নৌকা ডুবে গেলেও মানুষ খড়কুটো ধরে পাড়ে উঠতে চায়। কিন্তু মাহাফুজার বেঁচে থাকার কোনো অবলম্বনই খুঁজে পাচ্ছেন না। একজন প্রতিবন্ধী মানুষের এই আকুতি রাষ্ট্র শুনবে না?
২.
মাহাফুজারের ঘটনাটি আমাদের ‘বেকার’ শিক্ষাব্যবস্থার করুণ চিত্রই তুলে ধরে। তিনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও চাকরি পাননি। কেননা, কর্তৃপক্ষ প্রতিবন্ধী কোটা পূরণকে গুরুত্ব দেয়নি এবং তাঁকে উপেক্ষা করেছে। কিন্তু হাজার হাজার সাধারণ উচ্চশিক্ষিত তরুণ একটি চাকরির জন্য বছরের পর বছর জুতোর সুকতলি ক্ষয় করছেন, তাঁদেরও কোনো সান্ত্বনা নেই। এই রাষ্ট্র, এই শিক্ষাব্যবস্থা অমিত সম্ভাবনাময় তরুণদের প্রতি নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে আসছে। শিক্ষার অর্থ নিজেকে ও সমাজকে যোগ্য করে তোলা। যে শিক্ষা ব্যক্তি বা সমাজের কোনো কাজে আসছে না, সেই শিক্ষা নিয়ে কী লাভ? শিক্ষার নামে আর কত বেকার তৈরি করব আমরা?
সহযোগী একটি দৈনিকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাজারের চাহিদার সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থা সংগতিপূর্ণ না হওয়ায় দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। প্রতিবছরই উচ্চশিক্ষা নিয়ে শ্রমবাজারে আসা শিক্ষার্থীদের প্রায় অর্ধেক বেকার থাকছেন অথবা যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছেন না। ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট-এর ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। ভারতে এ হার ৩৩ শতাংশ, নেপালে ২০ শতাংশের বেশি, পাকিস্তানে ২৮ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। এই প্রতিবেদন দুই বছর আগের। বর্তমানে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা আরও বেশি। বিশ্বব্যাংক মনে করে, বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। এর ওপর এখন প্রতিবছর নতুন করে ১৩ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন (আইএলও) বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। বেকারত্ব বাড়ছে এমন ২০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান ১২তম। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ২০১২ সালের এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ‘বাংলাদেশে প্রতিবছর ২২ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। কিন্তু কাজ পায় মাত্র সাত লাখ। বেকারদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত, অর্থাৎ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে যাঁরা শিক্ষাজীবন শেষ করেছেন, তাঁরাও আছেন।’
একদিকে দেশে উচ্চশিক্ষার হার বাড়ছে, অন্যদিকে বাড়ছে বেকারত্ব। এর কারণ আমরা যে শিক্ষা দিচ্ছি সেটি কাজের নয়। দ্বিতীয়ত, দেশের উন্নয়নের জন্য যে শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন, সেটি আমরা দিতে পারছি না। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট যাকে বলেছে ‘হাই ইউনিভার্সিটি এনরোলমেন্ট, লো গ্র্যাজুয়েট এমপ্লয়মেন্ট’। ঊর্ধ্বমুখী উচ্চশিক্ষা, নিম্নমুখী কর্মসংস্থান। ২০০৪-১১ সালে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষায় যুক্ত হওয়ার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। মাধ্যমিক উত্তীর্ণদের উচ্চশিক্ষায় যুক্ত হওয়ার হার ২০০৪ সালে ছিল ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০১১ সালে হয়েছে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ। উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে নারীশিক্ষা। কিন্তু সেই অনুযায়ী শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান বাড়েনি।
পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক কাঠামোয় তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষিজাত খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ খাত, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, জাহাজ নির্মাণ এবং তৈরি পোশাক খাত, পর্যটন ও পর্যটনসেবা, হালকা কারিগরি নির্মাণ খাতকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এসব খাতের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত যথাযথ কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন (বিশেষায়িত ও সাধারণ) কর্মীর প্রচণ্ড অভাব রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র সেই অভাব পূরণে সচেষ্ট না থেকে এমন সব বিষয়ে উচ্চশিক্ষা দিচ্ছে, শ্রমবাজারে যার কোনো চাহিদা নেই। স্বাধীনতার পর গেল শতকের সত্তর ও আশির দশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই দেশের আনাচকানাচে বিদ্যালয় ও কলেজ করার হিড়িক পড়ে এবং বাছবিচারহীনভাবে এগুলো এমপিওভুক্ত হয়ে যায়। এসব প্রতিষ্ঠানের পেছনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও তা জাতীয় উন্নয়নে কতটা ভূমিকা রাখছে, সেটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে যাঁরা ডিগ্রি নিয়ে বের হন, তাঁদের বেশির ভাগই চাকরি পান না। এমনকি গত দেড়-দুই দশকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যে নতুন নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে, তার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
দেশে আমরা যোগ্য কর্মী তৈরি করতে পারিনি বলেই পোশাক কারখানা, বায়িং হাউসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিদেশি কর্মীকে নিয়োগ করা হয়েছে। এমনকি আমরা বেসরকারি হাসপাতালের জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক নার্স তৈরি করতে পারিনি। ফলে বিদেশ থেকে নার্স আনতে হচ্ছে। আবার দেশে ডিগ্রি নেওয়া নার্সরা কাজ পাচ্ছেন না। গোটা শিক্ষাব্যবস্থাতেই চলছে এই বৈপরীত্য। বর্তমান সরকার পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কৃতিত্ব দাবি করে। কিন্তু সেই পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কোন খাতে কতজন দক্ষ কর্মী প্রয়োজন, কতজন কর্মী তৈরি করা হবে, তার রূপরেখা সেখানে নেই। যে শিক্ষা সময়ের চাহিদা মেটাতে পারে না, সেই শিক্ষা দিয়ে আমরা কী করব? জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চেয়ে বেশি জরুরি অর্থনীতি ও মানুষের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ কর্মী তৈরি করা।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন মতে, ২০১৪ সালে ৩৪টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেছেন ৪ লাখ ১৯ হাজার ৫৮২ জন। ওই বছর ৭৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন ৬৫ হাজার ৩৬০ জন। সব মিলিয়ে ৫ লাখ ৫০ হাজার ৩০২ জন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করলেও বছরে এ পরিমাণ চাকরির সুযোগ নেই দেশে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিনিয়োগ বোর্ডে নিবন্ধিত শত ভাগ বিনিয়োগও যদি বাস্তবায়ন হয়, তাতেও মোট কর্মসংস্থান হওয়ার কথা ২ লাখ ২৬ হাজার ৪১১ জনের। আদতে নিবন্ধনের অর্ধেকও শেষ পর্যন্ত বিনিয়োগ হয় না।
বেসরকারি খাতের বাইরে শিক্ষিতদের চাকরি পাওয়ার দ্বিতীয় উপায় হলো সরকারি চাকরি। গত পাঁচ অর্থবছরে সরকারি খাতে কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে মোট নিয়োগ পেয়েছেন ২ লাখ ৬৬ হাজার ২৭৫ জন। এর মধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৫০ হাজার ৪৭৩ জন, ২০১৩-১৪-তে ৫৯ হাজার ১৩২ জন, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২৯ হাজার ৭৫২ জন, ২০১১-১২-তে ৫১ হাজার ০১৩ জন এবং ২০১০-১১ অর্থবছরে ৭৫ হাজার ৯০৫ জন। এই পাঁচ অর্থবছরে সরকারি চাকরিতে কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন ৬০ হাজার ২৯২ জন। তাঁদের সবাই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করা। এই পাঁচ বছরে কর্মচারী পদে নিয়োগ পেয়েছেন ২ লাখ ৫ হাজার ৯৮৩ জন। এঁদের প্রায় অর্ধেক স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাস করা। বাকিরা অষ্টম শ্রেণি, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করা।
সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে প্রায় আড়াই লাখ পদ শূন্য থাকলেও পূরণের কোনো উদ্যোগ নেই। এমনকি বিসিএস পরীক্ষা দিয়েও মেধাবী তরুণদের বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। সম্প্রতি ৩৭তম বিসিএসের পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও ৩৪তম বিসিএসে উত্তীর্ণরা এখনো নিয়োগ পাননি। ফলে বেকারত্ব, বিশেষ করে শিক্ষিত বেকারত্বের বিষয়টি বিস্ফোরণোন্মুখ অবস্থায় এসে ঠেকেছে। দেশে কর্মসংস্থান নেই। তাই তরুণেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। কিন্তু বিদেশেও শ্রমবাজার সংকুচিত হয়ে পড়ছে। এই যে প্রতিবছর হাজার হাজার তরুণ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে বের হচ্ছেন, তাঁদের প্রতি কি রাষ্ট্রের কোনোই দায়িত্ব নেই?
৩.
লেখাটি শুরু করেছিলাম একজন প্রতিবন্ধী উচ্চশিক্ষিত মানুষের আকুতি ও প্রতিবাদের ঘটনা নিয়ে। মাহাফুজার রহমান প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রতিকার চেয়েছেন। চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তাঁর জন্য সংরক্ষিত কোটায় তাঁকে চাকরি দেননি। এর প্রতিবাদে তিনি তাঁর শিক্ষাগত সনদগুলো ফেরত দেওয়ার কথাও বলেছেন। একজন প্রতিবন্ধীর প্রতি এ কেমন নিষ্ঠুর আচরণ! বিষয়টির প্রতিকার হওয়া প্রয়োজন। প্রতিকার হওয়া প্রয়োজন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও উন্নয়ন পরিকল্পনার স্তরে স্তরে যে খামখেয়ালিপনা রয়েছে, তারও।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.