শেষ দৃশ্যের ‘মহানায়ক’ মাহমুদউল্লাহ
খুব বেশি দিন হয়নি, বাংলাদেশের টি ২০ দলে মাহমুদউল্লার জায়গা নিয়ে টুকটাক প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল। সেই মাহমুদউল্লাহ এখন দলের ‘এমভিপি’, ‘মোস্ট ভ্যালুয়েবল প্লেয়ার’!ছক্কা-কাহন পাকিস্তানের বিপক্ষে মাহমুদউল্লাহর জয়সূচক বাউন্ডারি হয়তো বাংলাদেশের ক্রিকেটগাথার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবে। উইকেটে গিয়েই মাশরাফি মুর্তজার দুটি বাউন্ডারিও লোকের হৃদয়ে গেঁথে থাকবে অনেক দিন। লোকে শেষটাই মনে রাখে। আরেকটু পেছনে যাওয়া যাক।
ম্যাচের সেটি ১৭তম ওভার, রান-বলের টানাপোড়েনে ম্যাচ পেন্ডুলামের মতো দুলছে- এই অবস্থা থেকে কত টি ২০ হেরেছে বাংলাদেশ। জমছে চাপ, বাড়ছে টেনশন। হঠাৎ একটি শট বদলে দিল আবহ। ধারাভাষ্য কক্ষে ‘প্রফেসর’ ডিন জোন্স বললেন, ‘সম্ভবত টুর্নামেন্টের সেরা শট’! ৭ ফুট ১ ইঞ্চি লম্বা মোহাম্মদ ইরফানের শট অফ লেংথ বল, অ্যাঙ্গেলে বেরিয়ে যাচ্ছে। চকিতে একটু জায়গা বানিয়ে সেটিকে ব্যাকফুট অফ ড্রাইভে লং অফের ওপর দিয়ে উড়িয়ে দেয়া; পেশির শক্তি নয়, ব্যাটের মনোমুগ্ধকর ছোঁয়ায়। শুধু শটের ক্রিকেটীয় বিচারেই টুর্নামেন্টের সেরা শট মাহমুদউল্লাহর ওই ছক্কা। ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে শটের ওজন বাড়ছে আরও। দুলতে থাকা ম্যাচ ওই শটেই বাংলাদেশের দিকে হেলে পড়া শুরু। তবে এই ছক্কার শট নিয়ে এত আলোচনা শুধু পাকিস্তান ম্যাচের প্রেক্ষাপটেও নয়। আগের ম্যাচে শ্রীলংকার বিপক্ষেও একটি ছক্কা মেরেছিলেন মাহমুদউল্লাহ, তার আগের ম্যাচে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে দুটি। টি ২০ ক্যারিয়ারে এই প্রথম, টানা তিন ইনিংসে ছক্কা মারলেন মাহমুদউল্লাহ। ছক্কা নিয়ে এত গুণগানের কারণ বুঝতে হলে যেতে হবে আরেকটু পেছনে। গত ২২ ফেব্রুয়ারি, মিরপুর শেরেবাংলায় অনুশীলন শেষে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ। টি ২০ ম্যাচ বা সিরিজ প্রসঙ্গে মাহমুদউল্লাহকে পাওয়া মানেই একটি প্রশ্ন প্রায় অবধারিত, টি ২০তে তার ভূমিকা বা সামর্থ্য জাতীয় কিছু।
এবার প্রশ্ন হল। মাহমুদউল্লাহ ঝটপট বললেন, ‘এবার প্রতি ম্যাচে গিয়েই প্রথম বলে ছক্কা মারার চেষ্টা করব।’ মাহমুদউল্লাহর মুখে ছিল হাসি, উচ্চারণে ছিল না ঝাঁঝ। তবে কে জানে, হয়তো ওই মিষ্টি হাসি আর নরম কথায় লুকিয়ে ছিল ক্ষোভ, ‘কেন এত প্রশ্ন’; হয়তো লুকিয়ে ছিল প্রতিজ্ঞা, ‘এবার দেখিয়ে দেব!’ আক্ষরিক অর্থেই প্রথম বলে পারেননি, তবে সবশেষ তিন ম্যাচেই উইকেটে যাওয়ার খানিক পরই মাহমুদউল্লাহর ব্যাট থেকে এসেছে ছক্কা। টি ২০ জয় ছক্কা মারার সবশেষ এই তিন ম্যাচেই তিনি অপরাজিত। ৩৬, ২৩, ২২... ছোট্ট কিন্তু দলের জন্য অমূল্য; তিনটি ইনিংসই যে জিতিয়েছে দলকে! টুর্নামেন্টে চার ইনিংসে রান ৮৮। গড়ও সেটিই ৮৮, কোনো মানদণ্ড বেঁধে না নিলেও এই গড় টুর্নামেন্টের সেরা! স্ট্রাইকরেট ১৪৬.৬৬, অন্তত ২৫ রান করা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে টুর্নামেন্টসেরা। সেরা গড়, সেরা স্ট্রাইকরেট। পাশাপাশি বল হাতে চার উইকেটও। টি ২০-র আদর্শ প্যাকেজ। অথচ টি ২০তে তার উপযোগিতা-কার্যকারিতা নিয়ে সংশয়ে থাকার লোকের অভাব ছিল না। কঠোর অধ্যবসায়, পরিশ্রম, শেখার ক্ষুধা ও তাড়না দিয়ে ক্যারিয়ারের আরও চ্যালেঞ্জ জয় করেছেন মাহমুদউল্লাহ। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই মাহমুদউল্লাহকে দেখে আসছেন মাশরাফি মুর্তজা। খুব কাছ থেকে দেখেছেন মাহমুদউল্লার ক্যারিয়ারের নানা ধাপ। তার টি ২০ সামর্থ্য নিয়ে সংশয়বাদীদের দলে কখনোই ছিলেন না বাংলাদেশ অধিনায়ক। ‘কথাটি আমি অনেকবারই বলেছি, রিয়াদ যেখানে ব্যাট করে, কাজটি খুব কঠিন। হয়তো দ্রুত উইকেট পড়ে যায়, নয়তো দ্রুত রান করতে হয়। অনেক সময় উইকেট ধরে রাখতে হয়, দ্রুত রানও করতে হয়। বিশ্বের কত বড় বড় নাম এসব সামলাতে পারেনি। রিয়াদ বাংলাদেশের জন সেটি দিনের পর দিন করে আসছে,’ মন্তব্য মাশরাফির। তবু প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্নের বর্শার ফলা মাহমুদউল্লাহ আপন করে নিয়েছেন, সেই ফলা দিয়েই আরও শানিত করেছেন নিজেকে। এশিয়া কাপে তাই ঝড়ো সুন্দর মাহমুদউল্লাহ। মাশরাফির মতে, ঝড় তোলার সামর্থ্যও মাহমদুউল্লাহর বরাবরই ছিল। ‘দেখুন, মাহমুদউল্লাহ কিন্তু অপ্রথাগত কোনো শট খেলেনি! এমন নয় যে ব্যাটিংয়ে অনেক কিছু যোগ করেছে টি ২০তে। শুধু ‘মাইন্ড সেট’ বদলেছে। আগে যেটা করেছে, সেটাও দলের জন্য কার্যকর ছিল। এখন হয়তো ঠিক করেছে শুরু থেকেই শট খেলবে। এখানেও সফল। ক্রিকেটার হিসেবে ওর সামর্থ্য বুঝিয়ে দিচ্ছে এটিই,’ মাশরাফির কথা। একজন ‘বিশ্বসেরা’ সামর্থ্য নিয়ে সংশয় না থাকলেও মাহমুদউল্লাহ যে নিজের খেলার নতুন দিগন্ত ক্রিকেটবিশ্বে উন্মোচিত করেছেন, এতে উচ্ছ্বসিত মাশরাফি। বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতে বারবার যেভাবে উদ্ধার করছেন দলকে, একটা জায়গায় মাহমুদউল্লাহকে বিশ্বসেরাই বললেন বাংলাদেশ অধিনায়ক, ‘রিয়াদ যে পজিশনে খেলে,
সেখানে ‘সেন্সিবল’ ব্যাটিংয়ের প্রয়োজন হয়। কাজটা গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু ভীষণ কঠিন। রিয়াদ ঠিকই পরিস্থিতির বিচারে পারফেক্ট ব্যাটিং করে। উইকেট ধরে রাখে, স্ট্রাইক বদলায়, একই সঙ্গে আবার ঝড়ও তোলে। যদি শুধু এই পরিস্থিতিতে ‘সেন্সিবল’ ব্যাটিংয়ের কথা বলি, শুধু বাংলাদেশ কেন, বিশ্বেই ওর মতো আর কাউকে আমি দেখি না।’ এবং দল অন্তঃপ্রাণ মাশরাফির এই দলের মূল দর্শন আর সাফল্যের রেসিপি, দুটিই একই- টিম স্পিরিট। দলীয় ঐক্য, পারস্পরিক সৌহার্দ্য, দলের জন্য নিজেকে উজাড় করে দেয়া। সর্বোপরি দল অন্তঃপ্রাণ হওয়া। মাহমুদউল্লাহর এসব একদমই সহজাত, বরাবরই এই দর্শনের অনুসারী! এমনিতে তাকে সবাই অন্তর্মুখী বলে জানলেও আপন আঙিনায় তিনি উচ্ছল। ড্রেসিংরুমে প্রাণশক্তির অন্যতম উৎস। মাতিয়ে রাখেন, নিজেও উপভোগ করেন। টিম মিটিংয়ে, দলের কৌশল নির্ধারণে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। প্রয়োজনের সময় মাঠের ভেতরে-বাইরে সাকিব-তামিম-মুশফিকের মতো মাহমুদউল্লাহকেও পাশে পান মাশরাফি, ‘রিয়াদ খুবই সক্রিয়। লিডারশিপ ব্যাপারটা ওর সহজাত, নিজেও উপভোগ করে। দারুণ সব আইডিয়া নিয়ে আসে। দলকে চাঙা রাখতে পারে দারুণ।’
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
No comments