কক্সবাজারের সব পুলিশ আর্থিকভাবে লাভবান by কামরুল হাসান
মানব পাচারের ঘটনায় কক্সবাজার জেলা পুলিশের সব কর্মকর্তা ও সদস্য আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। পাচার প্রতিরোধে তাঁরা যেমন অভিযান চালাননি, তেমনি এ-সংক্রান্ত মামলার আসামিকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদও করেননি। ঘটনার গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেননি তদন্তকারীদের কেউই। উল্টো পাচারকারীদের পৃষ্ঠপোষকদের সহায়তা করেছেন। এ ক্ষেত্রে পদস্থ কর্মকর্তারাও কোনো দায়িত্ব পালন করেননি।
এসব কারও অভিযোগ নয়। পুলিশ তদন্ত করে এ তথ্যগুলো পেয়েছে। বিশ্বজুড়ে আলোচিত মানব পাচার অপরাধের মামলাগুলোর বেহাল অবস্থাও ফুটে উঠেছে পুলিশের উচ্চপর্যায়ের তদন্তে।
পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত ডিআইজি তওফিক মাহবুব চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন গত ২৯ জুলাই পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হকের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। তবে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
প্রতিবেদনের ব্যাপারে জানতে চাইলে কমিটির প্রধান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) মোখলেসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কেউ অপরাধ করে যাতে পার পেয়ে না যায়, সে জন্য পুলিশ প্রশাসন দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুটি কমিটি গঠন করেছে। এ জন্য পুলিশকে কেউ চাপ দেয়নি। নিজেদের স্বচ্ছতার জন্যই পুলিশ কমিটি করেছে।
মানব পাচার ছাড়াও ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে কক্সবাজার জেলার ১২ জন পুলিশ সদস্যের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশের আরেকটি তদন্ত কমিটি। সিআইডির ডিআইজি সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন ২ আগস্ট পুলিশের মহাপরিদর্শকের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। এই কমিটির প্রতিবেদনে ১২ পুলিশ সদস্য ছাড়াও ইয়াবা-সংক্রান্ত মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে দায়িত্বে অবহেলার জন্য জেলার পুলিশ সুপারকে কৈফিয়ত তলব, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও এক সার্কেল অফিসারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং টেকনাফ ও উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং এসবি ও ডিবির পরিদর্শককে প্রত্যাহার করার সুপারিশ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, এটা খুবই বড় অপরাধ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হয়ে যাঁরা এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। তাঁদের কঠোর সাজা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, কেউ যাতে অযথা হয়রানির শিকার না হন।
পুলিশ কীভাবে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে, তার ব্যাখ্যা ওই তদন্ত প্রতিবেদনে নেই। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নুরুল হুদা বলেন, এখানে বৈধভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে।
গত ১ মে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে গণকবর আবিষ্কৃত হওয়ার পর মানব পাচারের বিষয়টি বিশ্বজুড়ে আলোচিত হয়ে ওঠে। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে অভিযোগ করা হয়, সমুদ্রপথে হাজার হাজার বাংলাদেশি অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। সমুদ্রপথে পাচারের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কক্সবাজার উপকূল। পাচারের সঙ্গে কক্সবাজার জেলা পুলিশের জড়িত থাকার বিষয়টিও আলোচনায় আসে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, মানব পাচারের সবচেয়ে বেশি মামলা হয় কক্সবাজারে। এ কারণে সেখানকার পাচারের ঘটনায় করা মামলার তদন্ত, তদারকি, জেলা পুলিশের কার্যক্রমসহ সার্বিক বিষয় খতিয়ে দেখতে আইজিপির নির্দেশে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়।
কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ ও ১৫ সালের জুন পর্যন্ত কক্সবাজার জেলায় ২৩৬টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে এ বছরের জুন পর্যন্ত মামলা হয় ৯৬টি। কমিটি তাদের প্রতিবেদনে এ বছরের ৪০টি মামলা বিশ্লেষণ করেছে। এতে দেখা গেছে, ৯৬ মামলার মধ্যে মাত্র ছয়টিতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। বাকি ৯০টিতে ঠিকমতো তদন্তই হয়নি। স্পর্শকাতর এসব মামলার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদও করেনি পুলিশ। আবার উদ্ধার হওয়া লোকদের কাছ থেকে কোনো জবানবন্দিও রেকর্ড করা হয়নি। কিছু আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়ার প্রয়োজন থাকলেও তা করা হয়নি।
বেশি মামলা হয়েছে টেকনাফ থানায়। তদন্তে অবহেলার ব্যাপারে জানতে চাইলে টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘টেকনাফ থানায় যোগদানের পর থেকে ইয়াবা ও মানব পাচারের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছি। অনেক মামলা তদন্ত করেছি। কিন্তু এখন কেন এ অভিযোগ, তা জানি না।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু নিজেদের মামলা নয়, মানব পাচারের ঘটনায় বিজিবি ও কোস্টগার্ড যেসব আসামিদের ধরে দিয়েছিল, পুলিশ তাদেরও ঠিকমতো জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। রহস্য উদ্ঘাটনে কেউ কোনো ধরনের চেষ্টাও করেনি। অনেক মামলায় তদন্তকারীরা নিজেরাও আসামিদের জবানবন্দি রেকর্ড করেননি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কক্সবাজার জেলার কিছু পুলিশ সদস্য ও জেলার অন্যান্য সরকারি সংস্থার কিছু সদস্য মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অজানা কারণে উদাসীন। কমিটি মনে করে, পাচার প্রতিরোধে পুলিশ সেখানে কোনো ভূমিকাই পালনই করেনি, উল্টো পৃষ্ঠপোষকদের পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে। অনেক ক্ষেত্রে জেলার ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারাও পাচারকারীদের প্রশ্রয় দিয়েছেন।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমেদ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
কমিটি জেলা পুলিশ সুপারসহ চার কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করে বলেছে, জেলা পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ একটি মামলারও তদারক করেননি। তদন্তের ব্যাপারে তিনি কোনো লিখিত নির্দেশনাও দেননি। গুরুত্বপূর্ণ এসব মামলার ব্যাপারে তিনি ছিলেন উদাসীন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমেদ, উখিয়া সার্কেলের এএসপি জসিম উদ্দিন, টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আতাউর রহমান এবং থানার পরিদর্শক কবির হোসেনের বিরুদ্ধে দায়িত্বে ও কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
জানতে চাইলে পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ প্রথম আলোকে বলেন, এ নিয়ে তিনি কিছু বলতে চান না। অবশ্য উখিয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার জসিম উদ্দিন তালুকদার বলেন, গত ছয় মাসে টেকনাফে অভিযান চালিয়ে প্রায় ৩০০ এবং উখিয়ায় ১০০ জন মানব পাচারকারী ও দালালকে আটক করেছে পুলিশ। তিনিও কয়েকজন পাচারকারীকে ধরেছেন বলে দাবি করেন।
কমিটির সুপারিশ: মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত সব দালালই রোহিঙ্গা। এরা মিয়ানমারের নাগরিক। পাচারে ব্যবহার করা ট্রলারের মালিকও তারা। আবার পাচার শুরু হয় মিয়ানমারের জলসীমা থেকে। এ কারণে পাচার বন্ধে রোহিঙ্গা সমাধান খুব জরুরি। তা ছাড়া মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২-তে কেউ যদি স্বেচ্ছায় বিদেশে পাচার হয়, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট নেই। এ কারণে এই আইনটি সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
ইয়াবা পাচার: গত ২০ জুন ফেনীর লালপুর এলাকা থেকে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এএসআই মাহফুজুর রহমানকে ৬ লাখ ৮০ হাজার ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে র্যাব। এই ইয়াবার মধ্যে কক্সবাজার পুলিশের জব্দ করা ১৩টি ইয়াবাও ছিল। তাঁকে আটকের পর র্যাব জানতে পারে, আরও ১০ পুলিশ সদস্য ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, এসব অভিযোগ লিখিতভাবে পুলিশ সদর দপ্তরে জানানো হয়েছে। তারা ব্যবস্থা নেবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র জানায়, এ ঘটনার পর ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্যদের খুঁজে বের করতে সিআইডির ডিআইজি সাইফুল আলমকে প্রধান করে কমিটি করা হয়।
কমিটি তাদের প্রতিবেদনে মাদক মামলার পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেছে, ২০১৫ সালে কক্সবাজারে ৬২১টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫৭টি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। তবে এসব মামলার তদন্তেও অনেক ত্রুটি রয়েছে। এর মধ্যে সদর থানার ১ এপ্রিল দায়ের করা একটি মামলার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, ওই মামলার দুজন আসামি ধরা পড়েছে। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মনিরুল ইসলাম জিজ্ঞাসাবাদ করেননি। আসামিদের রিমান্ডেও আনা হয়নি। তদারককারী কর্মকর্তারাও মামলাটির তদন্ত তদারক করেননি। এমন মামলার আরও কয়েকটি উদাহরণ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, জেলা পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন। তবে এসব পুলিশ সদস্যের বেশির ভাগ ইয়াবার বাহক হিসেবে কাজ করেন। কক্সবাজারে কিছু কর্মকর্তা আছেন, যাঁরা ঘুরে-ফিরে একাধিকবার কক্সবাজারে আসেন। এঁরাই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কমিটি তাঁদের প্রতিবেদনে জেলা ডিবির তিনজন ও বিশেষ শাখার দুজনসহ মোট ১২ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছেন। এঁদের সবার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কক্সবাজারের স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি ও টেকনাফের বিপুল জনগোষ্ঠী সরাসরি মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
এসব কারও অভিযোগ নয়। পুলিশ তদন্ত করে এ তথ্যগুলো পেয়েছে। বিশ্বজুড়ে আলোচিত মানব পাচার অপরাধের মামলাগুলোর বেহাল অবস্থাও ফুটে উঠেছে পুলিশের উচ্চপর্যায়ের তদন্তে।
পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত ডিআইজি তওফিক মাহবুব চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন গত ২৯ জুলাই পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হকের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। তবে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
প্রতিবেদনের ব্যাপারে জানতে চাইলে কমিটির প্রধান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) মোখলেসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কেউ অপরাধ করে যাতে পার পেয়ে না যায়, সে জন্য পুলিশ প্রশাসন দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুটি কমিটি গঠন করেছে। এ জন্য পুলিশকে কেউ চাপ দেয়নি। নিজেদের স্বচ্ছতার জন্যই পুলিশ কমিটি করেছে।
মানব পাচার ছাড়াও ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে কক্সবাজার জেলার ১২ জন পুলিশ সদস্যের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশের আরেকটি তদন্ত কমিটি। সিআইডির ডিআইজি সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন ২ আগস্ট পুলিশের মহাপরিদর্শকের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। এই কমিটির প্রতিবেদনে ১২ পুলিশ সদস্য ছাড়াও ইয়াবা-সংক্রান্ত মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে দায়িত্বে অবহেলার জন্য জেলার পুলিশ সুপারকে কৈফিয়ত তলব, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও এক সার্কেল অফিসারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং টেকনাফ ও উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং এসবি ও ডিবির পরিদর্শককে প্রত্যাহার করার সুপারিশ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, এটা খুবই বড় অপরাধ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হয়ে যাঁরা এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। তাঁদের কঠোর সাজা নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, কেউ যাতে অযথা হয়রানির শিকার না হন।
পুলিশ কীভাবে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে, তার ব্যাখ্যা ওই তদন্ত প্রতিবেদনে নেই। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নুরুল হুদা বলেন, এখানে বৈধভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে।
গত ১ মে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে গণকবর আবিষ্কৃত হওয়ার পর মানব পাচারের বিষয়টি বিশ্বজুড়ে আলোচিত হয়ে ওঠে। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে অভিযোগ করা হয়, সমুদ্রপথে হাজার হাজার বাংলাদেশি অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। সমুদ্রপথে পাচারের কেন্দ্রবিন্দু ছিল কক্সবাজার উপকূল। পাচারের সঙ্গে কক্সবাজার জেলা পুলিশের জড়িত থাকার বিষয়টিও আলোচনায় আসে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, মানব পাচারের সবচেয়ে বেশি মামলা হয় কক্সবাজারে। এ কারণে সেখানকার পাচারের ঘটনায় করা মামলার তদন্ত, তদারকি, জেলা পুলিশের কার্যক্রমসহ সার্বিক বিষয় খতিয়ে দেখতে আইজিপির নির্দেশে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়।
কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ ও ১৫ সালের জুন পর্যন্ত কক্সবাজার জেলায় ২৩৬টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে এ বছরের জুন পর্যন্ত মামলা হয় ৯৬টি। কমিটি তাদের প্রতিবেদনে এ বছরের ৪০টি মামলা বিশ্লেষণ করেছে। এতে দেখা গেছে, ৯৬ মামলার মধ্যে মাত্র ছয়টিতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। বাকি ৯০টিতে ঠিকমতো তদন্তই হয়নি। স্পর্শকাতর এসব মামলার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদও করেনি পুলিশ। আবার উদ্ধার হওয়া লোকদের কাছ থেকে কোনো জবানবন্দিও রেকর্ড করা হয়নি। কিছু আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়ার প্রয়োজন থাকলেও তা করা হয়নি।
বেশি মামলা হয়েছে টেকনাফ থানায়। তদন্তে অবহেলার ব্যাপারে জানতে চাইলে টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘টেকনাফ থানায় যোগদানের পর থেকে ইয়াবা ও মানব পাচারের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছি। অনেক মামলা তদন্ত করেছি। কিন্তু এখন কেন এ অভিযোগ, তা জানি না।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, শুধু নিজেদের মামলা নয়, মানব পাচারের ঘটনায় বিজিবি ও কোস্টগার্ড যেসব আসামিদের ধরে দিয়েছিল, পুলিশ তাদেরও ঠিকমতো জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। রহস্য উদ্ঘাটনে কেউ কোনো ধরনের চেষ্টাও করেনি। অনেক মামলায় তদন্তকারীরা নিজেরাও আসামিদের জবানবন্দি রেকর্ড করেননি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কক্সবাজার জেলার কিছু পুলিশ সদস্য ও জেলার অন্যান্য সরকারি সংস্থার কিছু সদস্য মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অজানা কারণে উদাসীন। কমিটি মনে করে, পাচার প্রতিরোধে পুলিশ সেখানে কোনো ভূমিকাই পালনই করেনি, উল্টো পৃষ্ঠপোষকদের পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে। অনেক ক্ষেত্রে জেলার ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারাও পাচারকারীদের প্রশ্রয় দিয়েছেন।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমেদ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
কমিটি জেলা পুলিশ সুপারসহ চার কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করে বলেছে, জেলা পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ একটি মামলারও তদারক করেননি। তদন্তের ব্যাপারে তিনি কোনো লিখিত নির্দেশনাও দেননি। গুরুত্বপূর্ণ এসব মামলার ব্যাপারে তিনি ছিলেন উদাসীন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমেদ, উখিয়া সার্কেলের এএসপি জসিম উদ্দিন, টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আতাউর রহমান এবং থানার পরিদর্শক কবির হোসেনের বিরুদ্ধে দায়িত্বে ও কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
জানতে চাইলে পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ প্রথম আলোকে বলেন, এ নিয়ে তিনি কিছু বলতে চান না। অবশ্য উখিয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার জসিম উদ্দিন তালুকদার বলেন, গত ছয় মাসে টেকনাফে অভিযান চালিয়ে প্রায় ৩০০ এবং উখিয়ায় ১০০ জন মানব পাচারকারী ও দালালকে আটক করেছে পুলিশ। তিনিও কয়েকজন পাচারকারীকে ধরেছেন বলে দাবি করেন।
কমিটির সুপারিশ: মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত সব দালালই রোহিঙ্গা। এরা মিয়ানমারের নাগরিক। পাচারে ব্যবহার করা ট্রলারের মালিকও তারা। আবার পাচার শুরু হয় মিয়ানমারের জলসীমা থেকে। এ কারণে পাচার বন্ধে রোহিঙ্গা সমাধান খুব জরুরি। তা ছাড়া মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২-তে কেউ যদি স্বেচ্ছায় বিদেশে পাচার হয়, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট নেই। এ কারণে এই আইনটি সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
ইয়াবা পাচার: গত ২০ জুন ফেনীর লালপুর এলাকা থেকে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এএসআই মাহফুজুর রহমানকে ৬ লাখ ৮০ হাজার ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে র্যাব। এই ইয়াবার মধ্যে কক্সবাজার পুলিশের জব্দ করা ১৩টি ইয়াবাও ছিল। তাঁকে আটকের পর র্যাব জানতে পারে, আরও ১০ পুলিশ সদস্য ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, এসব অভিযোগ লিখিতভাবে পুলিশ সদর দপ্তরে জানানো হয়েছে। তারা ব্যবস্থা নেবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র জানায়, এ ঘটনার পর ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্যদের খুঁজে বের করতে সিআইডির ডিআইজি সাইফুল আলমকে প্রধান করে কমিটি করা হয়।
কমিটি তাদের প্রতিবেদনে মাদক মামলার পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেছে, ২০১৫ সালে কক্সবাজারে ৬২১টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫৭টি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। তবে এসব মামলার তদন্তেও অনেক ত্রুটি রয়েছে। এর মধ্যে সদর থানার ১ এপ্রিল দায়ের করা একটি মামলার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, ওই মামলার দুজন আসামি ধরা পড়েছে। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মনিরুল ইসলাম জিজ্ঞাসাবাদ করেননি। আসামিদের রিমান্ডেও আনা হয়নি। তদারককারী কর্মকর্তারাও মামলাটির তদন্ত তদারক করেননি। এমন মামলার আরও কয়েকটি উদাহরণ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, জেলা পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন। তবে এসব পুলিশ সদস্যের বেশির ভাগ ইয়াবার বাহক হিসেবে কাজ করেন। কক্সবাজারে কিছু কর্মকর্তা আছেন, যাঁরা ঘুরে-ফিরে একাধিকবার কক্সবাজারে আসেন। এঁরাই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কমিটি তাঁদের প্রতিবেদনে জেলা ডিবির তিনজন ও বিশেষ শাখার দুজনসহ মোট ১২ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছেন। এঁদের সবার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কক্সবাজারের স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি ও টেকনাফের বিপুল জনগোষ্ঠী সরাসরি মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
No comments