দুর্বল কোমেনের রাতে সন্দ্বীপ উপকূল অতিক্রম- নিম্নাঞ্চল প্লাবিত, ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত নিহত ৩
ঘূর্ণিঝড় কোমেনের প্রভাবে গতকাল সকালে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের লোকালয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে। ছবি-গিয়াসউদ্দিন |
বঙ্গোপসাগরে
সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘কোমেন’-এর প্রভাবে ঝোড়ো বাতাসে দেশের উপকূলীয় এলাকায় গাছ
চাপা পড়ে নিহত হয়েছেন তিনজন। বিধ্বস্ত হয়েছে বহু কাঁচা ঘরবাড়ি, উপড়ে পড়েছে
গাছপালা, বিদ্যুতের খুঁটি। জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে কক্সবাজারের উপকূলীয়
এলাকা টেকনাফ ও চকরিয়ার কয়েক শ গ্রাম।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাত নয়টার দিকে ঘূর্ণিঝড়টি দুর্বল হয়ে সন্দ্বীপের পাশ দিয়ে চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম করার কথা জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ঝড়ের কারণে সাগর উত্তাল রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের গতিবেগ ছিল ৬৮ কিলোমিটার; যা দমকা ও ঝোড়ো হাওয়ার বেগে ৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর বিপৎসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
গতকাল চট্টগ্রাম বন্দরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সতর্কতা ‘অ্যালার্ট-৩’ জারি করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনা পর্ষদের সদস্য মো. জাফর আলম প্রথম আলোকে জানান, ‘অ্যালার্ট-৩’ জারি করার পর বন্দরে পণ্য ওঠানো-নামানো ও বন্দর চত্বর থেকে পণ্য খালাসের কাজ সীমিত আকারে হয়েছে।
গত রাত সাড়ে ১২টায় সন্দ্বীপে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল বলে প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিস জানায়। তবে তখন ঝোড়ো হাওয়া ছিল না। দিনে ঝোড়ো হাওয়ায় চট্টগ্রাম নগরের বেশ কিছু এলাকায় অসংখ্য গাছ উপড়ে যায়। বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়ায় দুপুর পর্যন্ত নগরের অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হয়। গত রাত পৌনে একটায় এই প্রতিবেদন লেখার সময় চট্টগ্রাম শহরে বৃষ্টি ছিল না।
ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আশঙ্কায় গতকাল কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় ব্যাপক সতর্কতামূলক প্রস্তুতি নেওয়া হয়। প্রশাসনের সহযোগিতায় অনেক লোককে সরিয়ে নেওয়া হয় আশ্রয়কেন্দ্রে। মাইকিং করে লোকজনকে সতর্ক করা হয়। জেলার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলো জরুরি বৈঠক করে সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। নৌপথে ঝুঁকিপূর্ণ নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিন জেলায় গাছচাপায় তিনজনের মৃত্যু এবং কক্সবাজারে সাড়ে পাঁচ হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়া এবং গাছ উপড়ে পড়া ছাড়া আর কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া কয়েকটি জেলায় নদীতে অস্বাভাবিক জোয়ারের ফলে কিছু বেড়িবাঁধে ভাঙন ও কয়েক শ গ্রাম প্লাবিত হয়।
গতকাল রাত নয়টার দিকে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, ভোলা এবং এসব জেলা-সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী চর ও দ্বীপগুলোকে ৭ নম্বর বিপৎসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়। এসব এলাকার উপকূল ও চরগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়। এ ছাড়া পায়রা ও মংলা বন্দরকে ৫ নম্বর বিপৎসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়।
উপকূলীয় জেলা বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং এসব জেলার কাছাকাছি থাকা দ্বীপ ও চরগুলো ৫ নম্বর বিপৎসংকেতের আওতায় থাকবে।
আবহাওয়া বিভাগের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে।
গাছচাপায় তিনজনের মৃত্যু: কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত) অনুপম সাহা জানান, সেন্ট মার্টিনে গাছচাপায় মো. ইসলাম (৫০) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে।
গাছের নিচে চাপা পড়ে পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার কল্যাণকলস গ্রামে মো. নুরুল ইসলাম ফকির (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়।
গাছচাপায় আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে ভোলার লালমোহনে। উপজেলার চর কচুয়া গ্রামের সোবহান মোল্লার স্ত্রী মঞ্জুমা বেগম (৫৫) মারা যান বুধবার রাতে। এ ছাড়া মনপুরা উপজেলার চৌধুরী বাজার এলাকায় চর গোয়ালিয়ার মো. ইসমাইল (৫০) ও চর ফয়জুদ্দিন এলাকার হাফেজ মামুন (৩৪) নামের দুই মোটরসাইকেল আরোহী গতকাল দুপুরে গাছ চাপা পড়ে গুরুতর আহত হন।
চরফ্যাশন উপজেলার দক্ষিণ আইচা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. এনামুল হক ও জেলেরা জানান, গতকাল সাগরে দুটি মাছ ধরার ট্রলার ডুবে গেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। মনুরা ঘাটের আড়তদার আবদুর রহিম গতকাল বিকেলে বলেন, দুই ট্রলারডুবির ঘটনায় ২০ জন জেলে নিখোঁজ রয়েছেন।
ক্ষয়ক্ষতি: ‘কোমেন’-এর প্রভাবে ঝোড়ো হাওয়ায় কক্সবাজারে ৫ হাজার ৭০০ কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত এবং আরও ১৬ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান জেলা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক আবু হেনা মোস্তফা কামাল। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে ঘরবাড়ির পাশাপাশি হাজার হাজার গাছপালা, বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের খুঁটি ভেঙে পড়েছে। এ কারণে কিছু কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। বেড়িবাঁধ ভেঙে পাঁচ শতাধিক চিংড়ি ও মাছের ঘের বিলীন হয়ে গেছে।
কক্সবাজারের মহেশখালীতে ২৩টি গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। এ সময় ৫০টি কাঁচাবাড়ির দেয়াল ধসে পড়ে। আর জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে দুই শতাধিক চিংড়িঘেরের মাছ। এ ছাড়া চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় চারটি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে অন্তত ১১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়।
টেকনাফ উপজেলার সেন্ট মার্টিন লন্ডভন্ড হয়। নাফ নদীর বেড়িবাঁধের ওপর দিয়ে জোয়ারের পানি লোকালয়ে ঢুকে উপজেলার ৩০ গ্রাম প্লাবিত হয়।
চট্টগ্রাম নগরের বাইরের পাঁচটি উপজেলার প্রায় ৫০ হাজার মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয় বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের কারণে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, সৈকত লাগোয়া জাতীয় উদ্যানের ঝাউগাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রবল জোয়ারের কারণে কুয়াকাটা সৈকতের বালু ও মাটি ধুয়ে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে এবড়োখেবড়ো হয়ে গেছে। সৈকতে যাওয়ার প্রধান সড়কটির দক্ষিণ অংশ থেকে অন্তত ১০ ফুট জোয়ারে বিলীন হয়ে গেছে।
ভোলার লালমোহন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হোসেন জানান, ঝড়-বৃষ্টিতে লক্ষাধিক গাছ উপড়ে পড়েছে। পাশাপাশি ৩০০ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে।
পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের বেশ কয়েকটি পয়েন্টে ভাঙন দেখা দিয়েছে। কলাপাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবুল খায়ের জানান, চালিতাবুনিয়া, চর আন্ডা, বৌবাজার, চর বেষ্টিন পয়েন্টে বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া চর লতা ও গঙ্গাচরা পয়েন্টে ক্লোজার দুটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পেয়েছেন বলে জানান তিনি।
নদ-নদীতে অস্বাভাবিক জোয়ারে বরগুনার আমতলী ও তালতলী উপজেলার ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়। পানির তোড়ে তালতলী উপজেলার তেঁতুলবাড়িয়া এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১০০ মিটার বাঁধ ভেঙে ১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়।
গতকাল দুপুর ১২টার দিকে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার নলচিরা এলাকায় প্রবল জোয়ারের তোড়ে বেড়িবাঁধ ভেঙে নলচিরা ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় দেড় কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
নৌপথ বন্ধ: গতকাল সকাল ছয়টা থেকে ঢাকা-বরিশাল রুটে সব ধরনের নৌযান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।
বিআইডব্লিউটিএ বরিশালের নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের উপপরিচালক মো. আবুল বাশার মজুমদার বলেন, গত তিন দিন পর্যন্ত শুধু ৫৬ ফুটের কম দৈর্ঘ্যের নৌযান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা ছিল। গতকাল ৩ নম্বর সতর্কসংকেত থাকায় ছোট-বড় সব ধরনের নৌযান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তা বলবৎ থাকবে।
চাঁদপুর নদীবন্দরে ৪ নম্বর নৌ বিপৎসংকেত জারি করায় গতকাল সকাল সাতটায় চাঁদপুর থেকে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ রুটের ছোট বড় সব ধরনের লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেয় বিআইডব্লিউটিএ।
সকাল সাড়ে ১০টা থেকে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া নৌপথে লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। আরিচা লঞ্চমালিক সমিতির দৌলতদিয়া ঘাট তত্ত্বাবধায়ক নুরুল আনোয়ার বলেন, কর্তৃপক্ষের নির্দেশে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ও আরিচা-কাজিরহাট নৌপথে সব ধরনের লঞ্চ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাত নয়টার দিকে ঘূর্ণিঝড়টি দুর্বল হয়ে সন্দ্বীপের পাশ দিয়ে চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম করার কথা জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ঝড়ের কারণে সাগর উত্তাল রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের গতিবেগ ছিল ৬৮ কিলোমিটার; যা দমকা ও ঝোড়ো হাওয়ার বেগে ৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছিল। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর বিপৎসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
গতকাল চট্টগ্রাম বন্দরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সতর্কতা ‘অ্যালার্ট-৩’ জারি করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনা পর্ষদের সদস্য মো. জাফর আলম প্রথম আলোকে জানান, ‘অ্যালার্ট-৩’ জারি করার পর বন্দরে পণ্য ওঠানো-নামানো ও বন্দর চত্বর থেকে পণ্য খালাসের কাজ সীমিত আকারে হয়েছে।
গত রাত সাড়ে ১২টায় সন্দ্বীপে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল বলে প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিস জানায়। তবে তখন ঝোড়ো হাওয়া ছিল না। দিনে ঝোড়ো হাওয়ায় চট্টগ্রাম নগরের বেশ কিছু এলাকায় অসংখ্য গাছ উপড়ে যায়। বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়ায় দুপুর পর্যন্ত নগরের অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হয়। গত রাত পৌনে একটায় এই প্রতিবেদন লেখার সময় চট্টগ্রাম শহরে বৃষ্টি ছিল না।
ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার আশঙ্কায় গতকাল কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় ব্যাপক সতর্কতামূলক প্রস্তুতি নেওয়া হয়। প্রশাসনের সহযোগিতায় অনেক লোককে সরিয়ে নেওয়া হয় আশ্রয়কেন্দ্রে। মাইকিং করে লোকজনকে সতর্ক করা হয়। জেলার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলো জরুরি বৈঠক করে সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। নৌপথে ঝুঁকিপূর্ণ নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিন জেলায় গাছচাপায় তিনজনের মৃত্যু এবং কক্সবাজারে সাড়ে পাঁচ হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়া এবং গাছ উপড়ে পড়া ছাড়া আর কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া কয়েকটি জেলায় নদীতে অস্বাভাবিক জোয়ারের ফলে কিছু বেড়িবাঁধে ভাঙন ও কয়েক শ গ্রাম প্লাবিত হয়।
গতকাল রাত নয়টার দিকে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, ভোলা এবং এসব জেলা-সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী চর ও দ্বীপগুলোকে ৭ নম্বর বিপৎসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়। এসব এলাকার উপকূল ও চরগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে পাঁচ ফুট পর্যন্ত উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়। এ ছাড়া পায়রা ও মংলা বন্দরকে ৫ নম্বর বিপৎসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়।
উপকূলীয় জেলা বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং এসব জেলার কাছাকাছি থাকা দ্বীপ ও চরগুলো ৫ নম্বর বিপৎসংকেতের আওতায় থাকবে।
আবহাওয়া বিভাগের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে।
গাছচাপায় তিনজনের মৃত্যু: কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত) অনুপম সাহা জানান, সেন্ট মার্টিনে গাছচাপায় মো. ইসলাম (৫০) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে।
গাছের নিচে চাপা পড়ে পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার কল্যাণকলস গ্রামে মো. নুরুল ইসলাম ফকির (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়।
গাছচাপায় আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে ভোলার লালমোহনে। উপজেলার চর কচুয়া গ্রামের সোবহান মোল্লার স্ত্রী মঞ্জুমা বেগম (৫৫) মারা যান বুধবার রাতে। এ ছাড়া মনপুরা উপজেলার চৌধুরী বাজার এলাকায় চর গোয়ালিয়ার মো. ইসমাইল (৫০) ও চর ফয়জুদ্দিন এলাকার হাফেজ মামুন (৩৪) নামের দুই মোটরসাইকেল আরোহী গতকাল দুপুরে গাছ চাপা পড়ে গুরুতর আহত হন।
চরফ্যাশন উপজেলার দক্ষিণ আইচা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. এনামুল হক ও জেলেরা জানান, গতকাল সাগরে দুটি মাছ ধরার ট্রলার ডুবে গেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। মনুরা ঘাটের আড়তদার আবদুর রহিম গতকাল বিকেলে বলেন, দুই ট্রলারডুবির ঘটনায় ২০ জন জেলে নিখোঁজ রয়েছেন।
ক্ষয়ক্ষতি: ‘কোমেন’-এর প্রভাবে ঝোড়ো হাওয়ায় কক্সবাজারে ৫ হাজার ৭০০ কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত এবং আরও ১৬ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান জেলা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক আবু হেনা মোস্তফা কামাল। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে ঘরবাড়ির পাশাপাশি হাজার হাজার গাছপালা, বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের খুঁটি ভেঙে পড়েছে। এ কারণে কিছু কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। বেড়িবাঁধ ভেঙে পাঁচ শতাধিক চিংড়ি ও মাছের ঘের বিলীন হয়ে গেছে।
কক্সবাজারের মহেশখালীতে ২৩টি গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। এ সময় ৫০টি কাঁচাবাড়ির দেয়াল ধসে পড়ে। আর জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে দুই শতাধিক চিংড়িঘেরের মাছ। এ ছাড়া চকরিয়া ও পেকুয়া উপজেলায় চারটি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে অন্তত ১১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়।
টেকনাফ উপজেলার সেন্ট মার্টিন লন্ডভন্ড হয়। নাফ নদীর বেড়িবাঁধের ওপর দিয়ে জোয়ারের পানি লোকালয়ে ঢুকে উপজেলার ৩০ গ্রাম প্লাবিত হয়।
চট্টগ্রাম নগরের বাইরের পাঁচটি উপজেলার প্রায় ৫০ হাজার মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয় বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের কারণে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত, সৈকত লাগোয়া জাতীয় উদ্যানের ঝাউগাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রবল জোয়ারের কারণে কুয়াকাটা সৈকতের বালু ও মাটি ধুয়ে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে এবড়োখেবড়ো হয়ে গেছে। সৈকতে যাওয়ার প্রধান সড়কটির দক্ষিণ অংশ থেকে অন্তত ১০ ফুট জোয়ারে বিলীন হয়ে গেছে।
ভোলার লালমোহন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হোসেন জানান, ঝড়-বৃষ্টিতে লক্ষাধিক গাছ উপড়ে পড়েছে। পাশাপাশি ৩০০ ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে।
পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের বেশ কয়েকটি পয়েন্টে ভাঙন দেখা দিয়েছে। কলাপাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবুল খায়ের জানান, চালিতাবুনিয়া, চর আন্ডা, বৌবাজার, চর বেষ্টিন পয়েন্টে বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া চর লতা ও গঙ্গাচরা পয়েন্টে ক্লোজার দুটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পেয়েছেন বলে জানান তিনি।
নদ-নদীতে অস্বাভাবিক জোয়ারে বরগুনার আমতলী ও তালতলী উপজেলার ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়। পানির তোড়ে তালতলী উপজেলার তেঁতুলবাড়িয়া এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১০০ মিটার বাঁধ ভেঙে ১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়।
গতকাল দুপুর ১২টার দিকে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার নলচিরা এলাকায় প্রবল জোয়ারের তোড়ে বেড়িবাঁধ ভেঙে নলচিরা ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় দেড় কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
নৌপথ বন্ধ: গতকাল সকাল ছয়টা থেকে ঢাকা-বরিশাল রুটে সব ধরনের নৌযান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।
বিআইডব্লিউটিএ বরিশালের নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের উপপরিচালক মো. আবুল বাশার মজুমদার বলেন, গত তিন দিন পর্যন্ত শুধু ৫৬ ফুটের কম দৈর্ঘ্যের নৌযান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা ছিল। গতকাল ৩ নম্বর সতর্কসংকেত থাকায় ছোট-বড় সব ধরনের নৌযান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তা বলবৎ থাকবে।
চাঁদপুর নদীবন্দরে ৪ নম্বর নৌ বিপৎসংকেত জারি করায় গতকাল সকাল সাতটায় চাঁদপুর থেকে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ রুটের ছোট বড় সব ধরনের লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেয় বিআইডব্লিউটিএ।
সকাল সাড়ে ১০টা থেকে রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া নৌপথে লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। আরিচা লঞ্চমালিক সমিতির দৌলতদিয়া ঘাট তত্ত্বাবধায়ক নুরুল আনোয়ার বলেন, কর্তৃপক্ষের নির্দেশে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ও আরিচা-কাজিরহাট নৌপথে সব ধরনের লঞ্চ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
No comments