তেলের যন্ত্রণা কত সইবে কর্ণফুলী? by পাভেল পার্থ
পাভেল পার্থ |
তেলে
আর জলে মিশ খায় না। তার পরও দেশের মুমূর্ষু নদীগুলোকে বারবার তেলে
যন্ত্রণা সামাল দিতে হয়। কোনো বিচার নেই। কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। যেন গায়ের
জোরে, রাজনৈতিক দরবার দিয়ে তেলের সঙ্গে জলকে মিশিয়ে দেয়া যাবে। যেন কিছুই
হবে না। মরুক মাছ, মরুক কাঁকড়া, মরুক শামুক, মরুক শ্যাওলা, মরুক মাটি, মরুক
প্রবাহ। একটিবার এটিও ভাবা জরুরি মাছ না থাকলে মানুষও বেশিদিন বাঁচবে না।
শামুক কি কাঁকড়া না থাকলে মানুষের সংসারও ওলটপালট হয়ে যাবে। শ্যাওলা কি
মাটি মরে গেলে মানুষও মরে যাবে একদিন। মাটি, জল, শামুক, শ্যাওলা প্রকৃতির
এই মালা এমনভাবে গাঁথা আছে গায়ের জোরে কি একতরফা বাণিজ্যিক বাহাদুরিতে এই
মালা তছনছ করে ফেলা যায়। কিন্তু এতে সকলেই টিকে থাকবার শর্ত ও রসদ হারিয়ে
ফেলে। বারবার কর্ণফুলী নদীর ওপর এলোপাতাড়ি আক্রমণ চলছে। কখনো বাঁধ, কখনো
বন্দর, কখনো পণ্য পরিবহন, কখনো তেল-দূষণ।
ভারতের মিজোরামের লুসাই পাহাড় থেকে জন্ম নেয়া বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের অনন্য এক নদী কর্ণফুলী। পাহাড় ও সমতলের ভেতর বয়ে যাওয়া ৩২০ কি.মি. দীর্ঘ এ নদীটিকে মারমা আদিবাসীরা ডাকেন কানসা খিয়ং। ১৯৬০ সনে ‘কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্পের’ নামে বাঁধ দিয়ে এ নদীর গলা টিপে ধরা হয়। তারপর প্রতিনিয়ত নগরায়ন, কলকারখানা সম্প্রসারণ, দখল ও দূষণে এ নদী কাতর আর রক্তাক্ত। তার ওপর আবার চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে রেললাইন ভেঙে তেলবাহী ওয়াগন থেকে ফার্নেস তেলের যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ নদীটির বুকে। কিন্তু রাষ্ট্র নদীটিকে আগলে ধরেনি। এর আগেও ২০১৩ সালের ৩১ জুলাই চট্টগ্রামের দোহাজারীর কালুরঘাটে তেলবাহী ওয়াগন লাইনচ্যুত হয়ে কর্ণফুলীসহ আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে ফার্নেস তেল। ওই তেল দোহাজারী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য নেয়া হচ্ছিল, এমনকি বোয়ালখালীর ওয়াগন ভেঙে পড়া এই তেলও চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারীর ১০০ মেগাওয়াট পিকিং বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্যই নেয়া হচ্ছিল। ২০১৪ সালের সুন্দরবনের তেল-বিপর্যয় ঘটনারও নেপথ্য কারণ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সেটিও গোপালগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রর জন্য নেয়া হচ্ছিল। দেখা যাচ্ছে বারবার বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহারের জন্য তেল-পরিবহন থেকেই বড় তেল-বিপর্যয়ের ঘটনাগুলো ঘটছে। কী নদীপথে, কী রেলপথে। এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া জরুরি, জরুরি জবাবহিদিমূলক তেল-পরিবহন ব্যবস্থাপনা। আশা করি বোয়ালখালী তেল-বিপর্যয় থেকে কর্ণফুলী নদীসহ সামগ্রিক বাস্তু সংস্থান সুরক্ষায় রাষ্ট্র ন্যায়পরায়ণতার পরিচয় দিতে সাহসী হবে।
১৯ জুন ২০১৫ চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নের খিতাপচর এলাকায় শাইরাপুলে এ বিপর্যয় ঘটে। বোয়ালখালীর বেঙ্গুরা ও পটিয়ার ধলঘাট এলাকার মাঝামাঝি রেলপথের ২৪ নং সেতু ভেঙে ইঞ্জিনসহ তিনটি তেলবাহী ওয়াগন হারগেজি খালে পড়ে যায়। হারগেজি খালকে বোয়ালখালী খালও বলেন অনেকে। তেলবাহী ওয়াগন থেকে হাজার হাজার লিটার (গণমাধ্যম সূত্রগুলো ৫২ থেকে ৮০ হাজার লিটার লিখছে) ফার্নেস তেল ছড়িয়ে পড়ে এই খালে। বোয়ালখালী খালের সঙ্গে কর্ণফুলী নদীর সংযোগ। কর্ণফুলী নদী থেকে দূরত্ব মাত্র ১০ কি.মি.। তাই জোয়ার-ভাটার স্রোতে এ তেল ছড়িয়ে পড়ছে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী কর্ণফুলীর পানির স্রোতে এবং আশপাশের আবাদি জমিগুলোতেও। এ পর্যন্ত প্রায় ত্রিশ কি.মি.-এর বেশি তেলের বিস্তার ও দূষণ ঘটেছে। হারগেজি খাল থেকে তেলের বিস্তার পানির ধাক্কায় আশপাশের পাড়ের মাটিতে আছড়ে কালো আস্তরণ তৈরি করছে। পাশাপাশি মিলিটারি পুল এলাকা দিয়ে কর্ণফুলী নদীতে মিশছে এই ফার্নেস তেল। রেল কর্তৃপক্ষ ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে প্রথম থেকেই নিশ্চুপ থাকায় এ বিস্তার কর্ণফুলী পর্যন্ত পৌঁছেছে। পরিবেশ অধিদফতর নিজ থেকে এ তেল অপসারণে স্থানীয়দের নিয়ে স্থানীয় পদ্ধতিতে কাজ শুরু করেছে। তেল-বিপর্যয় থেকে বোয়ালখালী খাল ও কর্ণফুলী নদীর সুরক্ষায় এখনো কোনো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ দেখা যায়নি।
সুন্দরবনের সর্বশেষ তেল-বিপর্যয়কে স্থানীয় জনগণ যেভাবে জান দিয়ে সামাল দিয়েছিল সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগতে পারে বোয়ালখালী খালের তেল-বিপর্যয় ঘটনায়। তেল সংগ্রহ থেকে শুরু করে স্থানীয় পদ্ধতিতে তেলের বিস্তার রোধ সবকিছুই। তবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা জরুরি। যদিও স্থানীয় মানুষ জীবনবাজি রেখে পাটের দড়ি, রশি, কাপড়, কলাগাছ দিয়ে বোয়ালখালী খাল থেকে তেল অপসারণ শুরু করেছে। কিন্তু পায়ের চাপে বা অন্য কোনোভাবে তেল মাটির নিচে দেবে না যায় বিষয়টি খেয়াল রাখা জরুরি। বোয়ালখালীতে সাম্প্রতিক এই তেল-বিপর্যয়ের দীর্ঘ ক্ষতি তৈরি হবে কর্ণফুলী অববাহিকায়। ইতোমধ্যেই হারগেজি খাল থেকে তেলের আবরণ আশপাশের আবাদি জমিতে বিস্তার লাভ করেছে। খিতাপচর ও খালপাড়ে লাগানো কচু, ঢেঁড়স ও সবজি ক্ষেতগুলো তেলের কালো আবরণে ঢেকে গেছে। নদীতীরের ঘাস-গুল্মতৃণলতা সব তেলে আক্রান্ত। নদীর কাদায় তেলের আবরণ পড়ায় শামুক ও ছোট কাঁকড়া কয়েকদিন ধরে দেখা যাচ্ছে না। স্থানীয় জেলেদের ভাষ্য, তেলের বিস্তারের পর মাছের বিচরণও হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেছে। খালপাড়ের বাসিন্দা যাদের এই তেল-মিশ্রিত পানি গায়ে লাগছে তাদের চুলকানি ও পেটের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। সুন্দরবনের সর্বশেষ তেল-বিপর্যয়েও এই ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু তার পরও রাষ্ট্র সুন্দরবেনর ভেতর দিয়ে সর্বনাশা নৌপথ অব্যাহত রেখেছে, গায়ের জোরে। আবারো ডুবেছে সিমেন্টভর্তি জাহাজ। বোয়ালখালীর তেল-বিপর্যয়ে দুটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। যদিও এসব তদন্ত প্রতিবেদন কখনোই প্রকাশিত হবে না, আর হলেও নিজেদের যাবতীয় দায় দায়িত্ব ঢাকতে এক মন্ত্রণালয় আরেক মন্ত্রলায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। ২০০৪ সালে পতেঙ্গা মোহনায় ‘বাংলার সৌরভ’ নামের এক জাহাজ থেকে কর্ণফুলী নদীতে তেল-দূষণ ঘটে। তখন মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দায়ীদের শাস্তিও দেয়া হয়, কিন্তু জোয়ার-ভাটায় তেলের দূষণ তিন মাস তীব্র হয়েছিল। তখনো স্থানীয় জেলেরাই স্থানীয় পদ্ধতিতে জীবন দিয়ে কর্ণফুলীর বুক থেকে টেনে তুলেছে তেল। একই সনে এক বিদেশি জাহাজ কুতুবদিয়া উপকূলে নোঙর করে গভীর রাতে বর্জ্য তেল ফেলে রেখে যায়, যদিও তাদের ধরা যায়নি। তখনো তেলের যন্ত্রণায় কাতর হয় কর্ণফুলী। ২০১১ সালের ৪ জুন চট্টগ্রাম বন্দরের ডলফিন জেটি-৫ এ ১৮০ মেট্রিক টন তেল নিয়ে ‘ওটি মুন’ নামের একটি তেলের বার্জ ডুবে গিয়েছিল। ওটি মুনকে জব্দ করে পরিবেশ অধিদফতর ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করে। যদিও নদীদূষণের ক্ষতিপূরণ কোনোভাবেই কোনো মুদ্রার মান দিয়ে যাচাই বা পরিশোধযোগ্য নয়। তার পরও দেশের বিদ্যমান পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী দ্রুত বোয়ালখালী ঘটনার তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করুক রাষ্ট্র।
পানির শরীর ও জল-দুনিয়ায় বসবাসরত প্রাণের জন্য এই তেলের বিস্তার দুঃসহ। কারণ এতে পানির দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা পরিবর্তিত হয়ে যায়। পানির ভেতরে বসবাসরত মাছ, শামুক, কাঁকড়া, কুমির, ঘড়িয়াল, ডলফিন, শুশুক এরা শ্বাস নিতে পারে না। তেল পানিতে মিশে না বলে পানির উপরিভাগে একটি দীর্ঘস্থায়ী আস্তর তৈরি করে। এই আর সূর্যের আলো পানিতে প্রবেশে বাঁধা দেয়। ফলে পানিতে বসবাসকারী শৈবাল ও অণুজীবের খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শৈবাল আর অণুজীব হলো কোনো জলজ বাস্তু সংস্থানের প্রাথমিক স্তরের খাদ্য উৎপাদক। যখন কোনো এলাকার প্রাথমিক খাদ্য উৎপাদক সমস্যায় পড়ে তখন এর জ্বালা পোহাতে হয় সকল স্তরের প্রাণসত্তাকেই। এভাবেই এক এক স্তরে খাদ্যাভাব দেখা দেয়, অসুখ-বিসুখ বাড়ে। মড়ক লাগে এবং প্রাণ নিশ্চিহ্ন হতে থাকে। ভেঙে পড়ে খাদ্যশৃঙ্খল আর জীবনের টিকে থাকবার সূত্র। এই ভোগান্তি জল থেকে ক্রমান্বয়ে মাটিতে বসবাসকারী মানুষসহ সকল প্রাণের ওপরও চড়াও হয়। মাছ কমে যাওয়া মানে মাছের ওপর নির্ভরশীল মানুষের খাদ্যতালিকা ওলটপালট হয়ে যাওয়া। পানির এই দুর্বিষহ আকাল সরাসরি প্রভাবিত করে জলের ওপর নির্ভরশীল পেশাজীবীদের। জেলে, মাঝি, বেদে, পাটনি সম্প্রদায়কে। পানির দেশে পানিতে তেলের সব প্রশ্নহীন দূষণ ও যখন তখন ছড়িয়ে পড়া সমূলে বন্ধ হওয়া জরুরি। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি নজরদারি ও ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তোলা দরকার। বারবার তেলে-আক্রান্ত কর্ণফুলী নদীটির পাশে একবার কলিজা মেলে দাঁড়াক রাষ্ট্র। তেলের যন্ত্রণা সহ্য করার একটা মাত্রা নদীরও আছে। কর্ণফুলীও তার বাইরে নয়। আসুন আমরা আমাদের প্রিয় নদীটিকে তেলের যন্ত্রণা থেকে বাঁচাতে আগলে দাঁড়াই।
লেখক : গবেষক ও লেখক
ভারতের মিজোরামের লুসাই পাহাড় থেকে জন্ম নেয়া বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের অনন্য এক নদী কর্ণফুলী। পাহাড় ও সমতলের ভেতর বয়ে যাওয়া ৩২০ কি.মি. দীর্ঘ এ নদীটিকে মারমা আদিবাসীরা ডাকেন কানসা খিয়ং। ১৯৬০ সনে ‘কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্পের’ নামে বাঁধ দিয়ে এ নদীর গলা টিপে ধরা হয়। তারপর প্রতিনিয়ত নগরায়ন, কলকারখানা সম্প্রসারণ, দখল ও দূষণে এ নদী কাতর আর রক্তাক্ত। তার ওপর আবার চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে রেললাইন ভেঙে তেলবাহী ওয়াগন থেকে ফার্নেস তেলের যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এ নদীটির বুকে। কিন্তু রাষ্ট্র নদীটিকে আগলে ধরেনি। এর আগেও ২০১৩ সালের ৩১ জুলাই চট্টগ্রামের দোহাজারীর কালুরঘাটে তেলবাহী ওয়াগন লাইনচ্যুত হয়ে কর্ণফুলীসহ আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে ফার্নেস তেল। ওই তেল দোহাজারী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য নেয়া হচ্ছিল, এমনকি বোয়ালখালীর ওয়াগন ভেঙে পড়া এই তেলও চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারীর ১০০ মেগাওয়াট পিকিং বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্যই নেয়া হচ্ছিল। ২০১৪ সালের সুন্দরবনের তেল-বিপর্যয় ঘটনারও নেপথ্য কারণ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সেটিও গোপালগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রর জন্য নেয়া হচ্ছিল। দেখা যাচ্ছে বারবার বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহারের জন্য তেল-পরিবহন থেকেই বড় তেল-বিপর্যয়ের ঘটনাগুলো ঘটছে। কী নদীপথে, কী রেলপথে। এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া জরুরি, জরুরি জবাবহিদিমূলক তেল-পরিবহন ব্যবস্থাপনা। আশা করি বোয়ালখালী তেল-বিপর্যয় থেকে কর্ণফুলী নদীসহ সামগ্রিক বাস্তু সংস্থান সুরক্ষায় রাষ্ট্র ন্যায়পরায়ণতার পরিচয় দিতে সাহসী হবে।
১৯ জুন ২০১৫ চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নের খিতাপচর এলাকায় শাইরাপুলে এ বিপর্যয় ঘটে। বোয়ালখালীর বেঙ্গুরা ও পটিয়ার ধলঘাট এলাকার মাঝামাঝি রেলপথের ২৪ নং সেতু ভেঙে ইঞ্জিনসহ তিনটি তেলবাহী ওয়াগন হারগেজি খালে পড়ে যায়। হারগেজি খালকে বোয়ালখালী খালও বলেন অনেকে। তেলবাহী ওয়াগন থেকে হাজার হাজার লিটার (গণমাধ্যম সূত্রগুলো ৫২ থেকে ৮০ হাজার লিটার লিখছে) ফার্নেস তেল ছড়িয়ে পড়ে এই খালে। বোয়ালখালী খালের সঙ্গে কর্ণফুলী নদীর সংযোগ। কর্ণফুলী নদী থেকে দূরত্ব মাত্র ১০ কি.মি.। তাই জোয়ার-ভাটার স্রোতে এ তেল ছড়িয়ে পড়ছে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী কর্ণফুলীর পানির স্রোতে এবং আশপাশের আবাদি জমিগুলোতেও। এ পর্যন্ত প্রায় ত্রিশ কি.মি.-এর বেশি তেলের বিস্তার ও দূষণ ঘটেছে। হারগেজি খাল থেকে তেলের বিস্তার পানির ধাক্কায় আশপাশের পাড়ের মাটিতে আছড়ে কালো আস্তরণ তৈরি করছে। পাশাপাশি মিলিটারি পুল এলাকা দিয়ে কর্ণফুলী নদীতে মিশছে এই ফার্নেস তেল। রেল কর্তৃপক্ষ ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে প্রথম থেকেই নিশ্চুপ থাকায় এ বিস্তার কর্ণফুলী পর্যন্ত পৌঁছেছে। পরিবেশ অধিদফতর নিজ থেকে এ তেল অপসারণে স্থানীয়দের নিয়ে স্থানীয় পদ্ধতিতে কাজ শুরু করেছে। তেল-বিপর্যয় থেকে বোয়ালখালী খাল ও কর্ণফুলী নদীর সুরক্ষায় এখনো কোনো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ দেখা যায়নি।
সুন্দরবনের সর্বশেষ তেল-বিপর্যয়কে স্থানীয় জনগণ যেভাবে জান দিয়ে সামাল দিয়েছিল সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগতে পারে বোয়ালখালী খালের তেল-বিপর্যয় ঘটনায়। তেল সংগ্রহ থেকে শুরু করে স্থানীয় পদ্ধতিতে তেলের বিস্তার রোধ সবকিছুই। তবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা জরুরি। যদিও স্থানীয় মানুষ জীবনবাজি রেখে পাটের দড়ি, রশি, কাপড়, কলাগাছ দিয়ে বোয়ালখালী খাল থেকে তেল অপসারণ শুরু করেছে। কিন্তু পায়ের চাপে বা অন্য কোনোভাবে তেল মাটির নিচে দেবে না যায় বিষয়টি খেয়াল রাখা জরুরি। বোয়ালখালীতে সাম্প্রতিক এই তেল-বিপর্যয়ের দীর্ঘ ক্ষতি তৈরি হবে কর্ণফুলী অববাহিকায়। ইতোমধ্যেই হারগেজি খাল থেকে তেলের আবরণ আশপাশের আবাদি জমিতে বিস্তার লাভ করেছে। খিতাপচর ও খালপাড়ে লাগানো কচু, ঢেঁড়স ও সবজি ক্ষেতগুলো তেলের কালো আবরণে ঢেকে গেছে। নদীতীরের ঘাস-গুল্মতৃণলতা সব তেলে আক্রান্ত। নদীর কাদায় তেলের আবরণ পড়ায় শামুক ও ছোট কাঁকড়া কয়েকদিন ধরে দেখা যাচ্ছে না। স্থানীয় জেলেদের ভাষ্য, তেলের বিস্তারের পর মাছের বিচরণও হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেছে। খালপাড়ের বাসিন্দা যাদের এই তেল-মিশ্রিত পানি গায়ে লাগছে তাদের চুলকানি ও পেটের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। সুন্দরবনের সর্বশেষ তেল-বিপর্যয়েও এই ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু তার পরও রাষ্ট্র সুন্দরবেনর ভেতর দিয়ে সর্বনাশা নৌপথ অব্যাহত রেখেছে, গায়ের জোরে। আবারো ডুবেছে সিমেন্টভর্তি জাহাজ। বোয়ালখালীর তেল-বিপর্যয়ে দুটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। যদিও এসব তদন্ত প্রতিবেদন কখনোই প্রকাশিত হবে না, আর হলেও নিজেদের যাবতীয় দায় দায়িত্ব ঢাকতে এক মন্ত্রণালয় আরেক মন্ত্রলায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। ২০০৪ সালে পতেঙ্গা মোহনায় ‘বাংলার সৌরভ’ নামের এক জাহাজ থেকে কর্ণফুলী নদীতে তেল-দূষণ ঘটে। তখন মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দায়ীদের শাস্তিও দেয়া হয়, কিন্তু জোয়ার-ভাটায় তেলের দূষণ তিন মাস তীব্র হয়েছিল। তখনো স্থানীয় জেলেরাই স্থানীয় পদ্ধতিতে জীবন দিয়ে কর্ণফুলীর বুক থেকে টেনে তুলেছে তেল। একই সনে এক বিদেশি জাহাজ কুতুবদিয়া উপকূলে নোঙর করে গভীর রাতে বর্জ্য তেল ফেলে রেখে যায়, যদিও তাদের ধরা যায়নি। তখনো তেলের যন্ত্রণায় কাতর হয় কর্ণফুলী। ২০১১ সালের ৪ জুন চট্টগ্রাম বন্দরের ডলফিন জেটি-৫ এ ১৮০ মেট্রিক টন তেল নিয়ে ‘ওটি মুন’ নামের একটি তেলের বার্জ ডুবে গিয়েছিল। ওটি মুনকে জব্দ করে পরিবেশ অধিদফতর ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ আদায় করে। যদিও নদীদূষণের ক্ষতিপূরণ কোনোভাবেই কোনো মুদ্রার মান দিয়ে যাচাই বা পরিশোধযোগ্য নয়। তার পরও দেশের বিদ্যমান পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী দ্রুত বোয়ালখালী ঘটনার তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করুক রাষ্ট্র।
পানির শরীর ও জল-দুনিয়ায় বসবাসরত প্রাণের জন্য এই তেলের বিস্তার দুঃসহ। কারণ এতে পানির দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা পরিবর্তিত হয়ে যায়। পানির ভেতরে বসবাসরত মাছ, শামুক, কাঁকড়া, কুমির, ঘড়িয়াল, ডলফিন, শুশুক এরা শ্বাস নিতে পারে না। তেল পানিতে মিশে না বলে পানির উপরিভাগে একটি দীর্ঘস্থায়ী আস্তর তৈরি করে। এই আর সূর্যের আলো পানিতে প্রবেশে বাঁধা দেয়। ফলে পানিতে বসবাসকারী শৈবাল ও অণুজীবের খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শৈবাল আর অণুজীব হলো কোনো জলজ বাস্তু সংস্থানের প্রাথমিক স্তরের খাদ্য উৎপাদক। যখন কোনো এলাকার প্রাথমিক খাদ্য উৎপাদক সমস্যায় পড়ে তখন এর জ্বালা পোহাতে হয় সকল স্তরের প্রাণসত্তাকেই। এভাবেই এক এক স্তরে খাদ্যাভাব দেখা দেয়, অসুখ-বিসুখ বাড়ে। মড়ক লাগে এবং প্রাণ নিশ্চিহ্ন হতে থাকে। ভেঙে পড়ে খাদ্যশৃঙ্খল আর জীবনের টিকে থাকবার সূত্র। এই ভোগান্তি জল থেকে ক্রমান্বয়ে মাটিতে বসবাসকারী মানুষসহ সকল প্রাণের ওপরও চড়াও হয়। মাছ কমে যাওয়া মানে মাছের ওপর নির্ভরশীল মানুষের খাদ্যতালিকা ওলটপালট হয়ে যাওয়া। পানির এই দুর্বিষহ আকাল সরাসরি প্রভাবিত করে জলের ওপর নির্ভরশীল পেশাজীবীদের। জেলে, মাঝি, বেদে, পাটনি সম্প্রদায়কে। পানির দেশে পানিতে তেলের সব প্রশ্নহীন দূষণ ও যখন তখন ছড়িয়ে পড়া সমূলে বন্ধ হওয়া জরুরি। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি নজরদারি ও ব্যবস্থাপনা কাঠামো গড়ে তোলা দরকার। বারবার তেলে-আক্রান্ত কর্ণফুলী নদীটির পাশে একবার কলিজা মেলে দাঁড়াক রাষ্ট্র। তেলের যন্ত্রণা সহ্য করার একটা মাত্রা নদীরও আছে। কর্ণফুলীও তার বাইরে নয়। আসুন আমরা আমাদের প্রিয় নদীটিকে তেলের যন্ত্রণা থেকে বাঁচাতে আগলে দাঁড়াই।
লেখক : গবেষক ও লেখক
No comments