‘উন্নয়ন’-এর জন্য গণতন্ত্রে ছাড়! by এ কে এম জাকারিয়া
তিন
দফা দেশ শাসনের পর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের চতুর্থ দফা শাসনে আমরা জানলাম
যে দলটি ‘বেশি’ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। সরকারের দায়িত্ববান একজন মন্ত্রী
যখন বলেছেন ‘বেশি গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি না’, তখন এটাকে আমরা দলের
অবস্থান বলেই ধরে নিতে পারি। আর স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের এই
বক্তব্যের পর দল থেকে কোনো ভিন্নমতের কথাও আমরা শুনিনি। কৌতূহল হয়, এটা
কি দলটির নতুন অবস্থান, নাকি সব সময়ই এই বিশ্বাস মেনে চলেছে!
১৯৯৬ বা ২০০৮ সালে নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগ যখন সরকার চালিয়েছে, তখন অবশ্য দলটির কোনো নেতার কাছ থেকে এ ধরনের কথা শোনা যায়নি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন ও এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার পর সম্ভবত দলটি বুঝতে পেরেছে যে ‘গণতন্ত্র’ নিয়ে মাতামাতি করার অবস্থা তাদের আর নেই। এর বিকল্প কিছু লাগবে। গণতন্ত্রের জায়গা দখল করে নিল ‘উন্নয়ন’। জনগণকে এখন গণতন্ত্র বাদ দিয়ে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখাতে হবে। সরকারের নেতাদের ভাষণ-বক্তব্যে জায়গা করে নেয় এই ‘উন্নয়ন’। আলোচনা এবং তর্ক-বিতর্কেও উঠে আসতে শুরু করে উন্নয়ন না গণতন্ত্র, কোনটি আমাদের জন্য বেশি জরুরি।
এসব নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম, ‘আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র?’ শিরোনামে (প্রথম আলো, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৪)। আলোচনা বা তর্ক-বিতর্কটি এ রকম যে উন্নয়ন চাইলে গণতন্ত্রে কিছুটা ছাড় দিতে হবে। অথবা উন্নয়নের বিষয়টি আগে, গণতন্ত্রের কী হবে, তা পরে দেখা যাবে। তুলনামূলক রাজনীতি ও উন্নয়ন পাঠে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা ও তর্ক–বিতর্ক বহু পুরোনো। এর পক্ষে-বিপক্ষে মতের অভাব নেই, বাস্তব ক্ষেত্রেও রয়েছে বৈপরীত্য। সামাজিক বিজ্ঞানে সম্পদ (উচ্চমাত্রার) ও গণতন্ত্রের (প্রতিষ্ঠিত) মধ্যে সম্পর্কটি স্বীকৃত। তবে গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও নেই, এমন দেশেও উন্নয়ন ও সম্পদ সৃষ্টি হয়েছে। আবার প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র আশা অনুযায়ী উন্নয়ন দিতে পারেনি, এমন উদাহরণও রয়েছে।
‘বেশি গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি না’—এই বক্তব্যের ইঙ্গিতটি পরিষ্কার। মানে সরকার ‘বেশি’ গণতন্ত্র দিয়ে ফেলেছিল এবং এখন এর ‘মাত্রা’ কমানো হবে। এবং এর সঙ্গে যে উন্নয়নের সম্পর্ক রয়েছে, তা স্পষ্ট হয়েছে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পরের বক্তব্যে। বলেছেন, ‘মালয়েশিয়ায় মাহাথির মোহাম্মদ যে পথে এগিয়ে গেছেন, বাংলাদেশেও শেখ হাসিনা সে পথে এগিয়ে যাচ্ছেন।’
মালয়েশিয়ার ‘উন্নয়ন’ নিশ্চয়ই একটি আলোচিত বিষয়, কিন্তু ‘গণতন্ত্র’ বা ‘গণতান্ত্রিক’ দেশের আলোচনায় মালয়েশিয়ার জায়গা খুঁজে পাওয়া কঠিন। এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি মাহাথিরের ‘পথে এগিয়ে’ যেতে শুরু করেন, তবে গণতন্ত্রকে যে ছাঁটতে হবে, সেটা পরিষ্কার। জনগণকে গণতন্ত্রের অনেক ছাড় মেনে নিতে হবে। আমাদের এখন জানা দরকার, এই ছাড়গুলো কী বা কতটুকু। এর বিনিময়ে কী পাবে বাংলাদেশ, উন্নয়ন? আমাদের আরও জানা দরকার যে উন্নয়ন বলতে আমরা আসলে কী বুঝব। অর্থনৈতিক বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন?
‘উন্নয়নের’ স্বার্থে গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে ছাড়টি দিতে হবে, সেটা সম্ভবত নির্বাচন। গত বছরের ৫ জানুয়ারির সংসদ বা এ বছরের সিটি নির্বাচনগুলো যেভাবে হয়েছে, সামনেও মনে হয় সরকার সে ধরনের নির্বাচনের পথেই হাঁটার কথা ভাবছে। সরকার জনগণকে যে ‘উন্নয়ন’ দিতে চাইছে, সেটা পেতে হলে এ ধরনের নির্বাচনকেই মেনে নিতে হবে। আর সরকারি দল যেহেতু ‘বেশি’ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, ফলে নাগরিক বা মানবাধিকার, আইনের শাসন, বাক্স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা বা জবাবদিহির মতো বিষয়গুলো স্বাভাবিকভাবেই কমে আসবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জনগণকে যে ‘উন্নয়নের’ আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে, তার বিনিময়ে গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে এ ছাড়গুলো তারা মেনে নিতে রাজি আছে কি না।
গণতন্ত্র ও উন্নয়নের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘উন্নয়নের’ সংজ্ঞা ঠিক করা। যুক্তরাজ্যের স্বাধীন থিংকট্যাংক ওভারসিস ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের রাজনীতি ও শাসনবিষয়ক রিসার্চ ফেলো আলিনা রোচা মেনোকাল গণতন্ত্র ও উন্নয়নবিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে পাঠ করা প্রবন্ধে বলেছেন, উন্নয়নের এই সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষেত্রে যদি আমরা অমর্ত্য সেনকে বিবেচনায় নিই, তবে তা বেশ ব্যাপক। তাঁর কাছে উন্নয়নের সংজ্ঞা হচ্ছে ‘মুক্তি’। কারণ তিনি শুধু অর্থনৈতিক সূচককেই উন্নয়নের সংজ্ঞায় যুক্ত করেননি। রাজনৈতিক ও মানবিক মুক্তি, সামাজিক সুযোগ, স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা, সুরক্ষামূলক নিশ্চয়তার বিষয়গুলোকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাহাথির মোহাম্মদের পথে এগোতে থাকলে ‘উন্নয়নের’ গতি কতটুকু বাড়বে, সেটা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। কিন্তু এই ধারার উন্নয়ন চেষ্টায় আর যাই হোক, অমর্ত্য সেনের উন্নয়ন সংজ্ঞা অনুযায়ী দেশের জনগণের রাজনৈতিক ও মানবিক মুক্তি মিলবে না। স্বচ্ছতার নিশ্চয়তাও পাওয়া যাবে না। উন্নয়নের বড় শত্রু দুর্নীতি। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিহীন পরিস্থিতি বরং উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। কার্যকর গণতন্ত্র উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে—এই ধারণার পেছনের সবচেয়ে বড় যুক্তি হচ্ছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কিছু বৈশিষ্ট্য। এই ব্যবস্থা জবাবদিহি ও ভারসাম্য নিশ্চিত করে, নির্বাচন ও অন্যান্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট সময় পর পর তা কার্যকর করা যায়।
এর বিরুদ্ধ মতও রয়েছে। আগের লেখাটিতে উল্লেখ করেছিলাম, নতুন পাঠকদের জন্য আবার উল্লেখ করছি। ‘গণতন্ত্রে জনগণের যে দাবিদাওয়াকে বিবেচনায় নেওয়া হয়, তা সব সময় উন্নয়ন–সহায়ক নয়। ...গণতন্ত্র অনেক সময় জনপ্রিয় দাবির প্রতি সংবেদনশীল...বা কখনো এমন সুনির্দিষ্ট দাবির প্রতি গণতন্ত্রকে মাথা নোয়াতে হয়, যা আসলে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ, প্রবৃদ্ধি ও বড় আকারের প্রবৃদ্ধির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।’ ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট: এ কমপ্লেক্স রিলেশনশিপ বইয়ে এই মন্তব্য ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক প্রণব কুমার বর্ধনের।
গণতন্ত্র ও উন্নয়নের সম্পর্ক নিয়ে এসব তাত্ত্বিক বিতর্ক থাক। আমরা আপাতত শেখ হাসিনার মাহাথিরের পথে চলার সম্ভাব্য পরিণতি কী হতে পারে, তা খুঁজে দেখার চেষ্টা করি। মালয়েশিয়ার ‘উন্নয়ন’, এর মাথাপিছু আয়—এসব সম্পর্কে আমাদের সাধারণ ধারণা রয়েছে। এবং সেটা বেশ উঁচু বলেই আমাদের দেশের অনেকেরই স্বপ্ন মালয়েশিয়াকে ‘সেকেন্ড হোম’ বানানো। কিন্তু এই স্বপ্নের দেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র—এসবেরও তো খোঁজখবর জানা দরকার।
লিম কিট সিয়াং মালয়েশিয়ার বিরোধী ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন পার্টির নেতা। মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তাঁর উপস্থাপিত প্রবন্ধ থেকে সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যেতে পারে। লিম রাজনৈতিক কারণে বেশ কয়েক দফা বিনা বিচারে আটক ছিলেন এবং কোনোটির মেয়াদ ছিল দুই বছরেরও বেশি। এসব আটক কার্যকর করা হয়েছে ‘ইন্টারনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’–এর আওতায়। একবার বিচারে তাঁর শাস্তিও হয়েছে, ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’-এর আওতায়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, মালয়েশিয়া সরকার ও একটি সুইস কোম্পানির গোপন চুক্তির অনিয়ম প্রকাশ করা। মালয়েশিয়া বা মাহাথিরের আমলের শাসনের দশা অন্তত কিছুটা হলেও টের পাওয়া যায় এক লিম কিটের ওপর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো দিয়ে।
‘ডেমোক্রেসি ইন মালয়েশিয়া, নিদার ফ্রি নর ফেয়ার’ শিরোনামের উপস্থাপনায় লিম অনেক কিছু বলেছেন। মালয়েশিয়ার গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে তাঁর বক্তব্যের কিছু কথা তুলে ধরছি। কথাগুলো সাধারণভাবে এ রকম, নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র নয়, কার্যকর গণতন্ত্রে অনেক কিছুর স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হয়। এর সঙ্গে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের সম্পর্ক রয়েছে। সম্পর্ক রয়েছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সভা-সমাবেশ করার স্বাধীনতার। গণতন্ত্রে সংসদীয় নজরদারি বা নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহির মতো যথাযথ চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স নিশ্চিত করতে হয়। সিভিল সার্ভিসের ভূমিকা হতে হয় স্বাধীন। থাকতে হয় নির্বাচন কমিশন, অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়, দুর্নীতি দমন সংস্থা ও স্বাধীন বিচার বিভাগের মতো প্রতিষ্ঠান। মালয়েশিয়ার ক্ষমতাসীন সরকার গণতন্ত্রের এই গুরুত্বপূর্ণ সব দিকই উপেক্ষা করে চলেছে। নির্বাচনের মাঠ সমতল নয় এবং অগণতান্ত্রিকভাবে সরকারি দল বারিসান নাসিওনালের (বিএন) পক্ষে নানা সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এভাবেই বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা ৫৬ বছর ধরে তাদের শাসনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে।
‘আমরা বেশি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি না’ বা ‘মালয়েশিয়ায় মাহাথির মোহাম্মদ যে পথে এগিয়ে গেছেন, বাংলাদেশেও শেখ হাসিনা সে পথে এগিয়ে যাচ্ছেন’—এসব মন্তব্য থেকে তবে আমরা কী সিদ্ধান্তে আসতে পারি? মালয়েশিয়ার এসব লক্ষণ কী এখানে পরিষ্কার হয়ে উঠছে না? উন্নয়নের আশায় কি তবে আমাদের গণতন্ত্রে ছাড় দিতে হবে!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
১৯৯৬ বা ২০০৮ সালে নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগ যখন সরকার চালিয়েছে, তখন অবশ্য দলটির কোনো নেতার কাছ থেকে এ ধরনের কথা শোনা যায়নি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন ও এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার পর সম্ভবত দলটি বুঝতে পেরেছে যে ‘গণতন্ত্র’ নিয়ে মাতামাতি করার অবস্থা তাদের আর নেই। এর বিকল্প কিছু লাগবে। গণতন্ত্রের জায়গা দখল করে নিল ‘উন্নয়ন’। জনগণকে এখন গণতন্ত্র বাদ দিয়ে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখাতে হবে। সরকারের নেতাদের ভাষণ-বক্তব্যে জায়গা করে নেয় এই ‘উন্নয়ন’। আলোচনা এবং তর্ক-বিতর্কেও উঠে আসতে শুরু করে উন্নয়ন না গণতন্ত্র, কোনটি আমাদের জন্য বেশি জরুরি।
এসব নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম, ‘আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র?’ শিরোনামে (প্রথম আলো, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৪)। আলোচনা বা তর্ক-বিতর্কটি এ রকম যে উন্নয়ন চাইলে গণতন্ত্রে কিছুটা ছাড় দিতে হবে। অথবা উন্নয়নের বিষয়টি আগে, গণতন্ত্রের কী হবে, তা পরে দেখা যাবে। তুলনামূলক রাজনীতি ও উন্নয়ন পাঠে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা ও তর্ক–বিতর্ক বহু পুরোনো। এর পক্ষে-বিপক্ষে মতের অভাব নেই, বাস্তব ক্ষেত্রেও রয়েছে বৈপরীত্য। সামাজিক বিজ্ঞানে সম্পদ (উচ্চমাত্রার) ও গণতন্ত্রের (প্রতিষ্ঠিত) মধ্যে সম্পর্কটি স্বীকৃত। তবে গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও নেই, এমন দেশেও উন্নয়ন ও সম্পদ সৃষ্টি হয়েছে। আবার প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র আশা অনুযায়ী উন্নয়ন দিতে পারেনি, এমন উদাহরণও রয়েছে।
‘বেশি গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি না’—এই বক্তব্যের ইঙ্গিতটি পরিষ্কার। মানে সরকার ‘বেশি’ গণতন্ত্র দিয়ে ফেলেছিল এবং এখন এর ‘মাত্রা’ কমানো হবে। এবং এর সঙ্গে যে উন্নয়নের সম্পর্ক রয়েছে, তা স্পষ্ট হয়েছে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পরের বক্তব্যে। বলেছেন, ‘মালয়েশিয়ায় মাহাথির মোহাম্মদ যে পথে এগিয়ে গেছেন, বাংলাদেশেও শেখ হাসিনা সে পথে এগিয়ে যাচ্ছেন।’
মালয়েশিয়ার ‘উন্নয়ন’ নিশ্চয়ই একটি আলোচিত বিষয়, কিন্তু ‘গণতন্ত্র’ বা ‘গণতান্ত্রিক’ দেশের আলোচনায় মালয়েশিয়ার জায়গা খুঁজে পাওয়া কঠিন। এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি মাহাথিরের ‘পথে এগিয়ে’ যেতে শুরু করেন, তবে গণতন্ত্রকে যে ছাঁটতে হবে, সেটা পরিষ্কার। জনগণকে গণতন্ত্রের অনেক ছাড় মেনে নিতে হবে। আমাদের এখন জানা দরকার, এই ছাড়গুলো কী বা কতটুকু। এর বিনিময়ে কী পাবে বাংলাদেশ, উন্নয়ন? আমাদের আরও জানা দরকার যে উন্নয়ন বলতে আমরা আসলে কী বুঝব। অর্থনৈতিক বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন?
‘উন্নয়নের’ স্বার্থে গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে ছাড়টি দিতে হবে, সেটা সম্ভবত নির্বাচন। গত বছরের ৫ জানুয়ারির সংসদ বা এ বছরের সিটি নির্বাচনগুলো যেভাবে হয়েছে, সামনেও মনে হয় সরকার সে ধরনের নির্বাচনের পথেই হাঁটার কথা ভাবছে। সরকার জনগণকে যে ‘উন্নয়ন’ দিতে চাইছে, সেটা পেতে হলে এ ধরনের নির্বাচনকেই মেনে নিতে হবে। আর সরকারি দল যেহেতু ‘বেশি’ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, ফলে নাগরিক বা মানবাধিকার, আইনের শাসন, বাক্স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা বা জবাবদিহির মতো বিষয়গুলো স্বাভাবিকভাবেই কমে আসবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জনগণকে যে ‘উন্নয়নের’ আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে, তার বিনিময়ে গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে এ ছাড়গুলো তারা মেনে নিতে রাজি আছে কি না।
গণতন্ত্র ও উন্নয়নের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘উন্নয়নের’ সংজ্ঞা ঠিক করা। যুক্তরাজ্যের স্বাধীন থিংকট্যাংক ওভারসিস ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের রাজনীতি ও শাসনবিষয়ক রিসার্চ ফেলো আলিনা রোচা মেনোকাল গণতন্ত্র ও উন্নয়নবিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে পাঠ করা প্রবন্ধে বলেছেন, উন্নয়নের এই সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষেত্রে যদি আমরা অমর্ত্য সেনকে বিবেচনায় নিই, তবে তা বেশ ব্যাপক। তাঁর কাছে উন্নয়নের সংজ্ঞা হচ্ছে ‘মুক্তি’। কারণ তিনি শুধু অর্থনৈতিক সূচককেই উন্নয়নের সংজ্ঞায় যুক্ত করেননি। রাজনৈতিক ও মানবিক মুক্তি, সামাজিক সুযোগ, স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা, সুরক্ষামূলক নিশ্চয়তার বিষয়গুলোকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাহাথির মোহাম্মদের পথে এগোতে থাকলে ‘উন্নয়নের’ গতি কতটুকু বাড়বে, সেটা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। কিন্তু এই ধারার উন্নয়ন চেষ্টায় আর যাই হোক, অমর্ত্য সেনের উন্নয়ন সংজ্ঞা অনুযায়ী দেশের জনগণের রাজনৈতিক ও মানবিক মুক্তি মিলবে না। স্বচ্ছতার নিশ্চয়তাও পাওয়া যাবে না। উন্নয়নের বড় শত্রু দুর্নীতি। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিহীন পরিস্থিতি বরং উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। কার্যকর গণতন্ত্র উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে—এই ধারণার পেছনের সবচেয়ে বড় যুক্তি হচ্ছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কিছু বৈশিষ্ট্য। এই ব্যবস্থা জবাবদিহি ও ভারসাম্য নিশ্চিত করে, নির্বাচন ও অন্যান্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট সময় পর পর তা কার্যকর করা যায়।
এর বিরুদ্ধ মতও রয়েছে। আগের লেখাটিতে উল্লেখ করেছিলাম, নতুন পাঠকদের জন্য আবার উল্লেখ করছি। ‘গণতন্ত্রে জনগণের যে দাবিদাওয়াকে বিবেচনায় নেওয়া হয়, তা সব সময় উন্নয়ন–সহায়ক নয়। ...গণতন্ত্র অনেক সময় জনপ্রিয় দাবির প্রতি সংবেদনশীল...বা কখনো এমন সুনির্দিষ্ট দাবির প্রতি গণতন্ত্রকে মাথা নোয়াতে হয়, যা আসলে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ, প্রবৃদ্ধি ও বড় আকারের প্রবৃদ্ধির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।’ ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট: এ কমপ্লেক্স রিলেশনশিপ বইয়ে এই মন্তব্য ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক প্রণব কুমার বর্ধনের।
গণতন্ত্র ও উন্নয়নের সম্পর্ক নিয়ে এসব তাত্ত্বিক বিতর্ক থাক। আমরা আপাতত শেখ হাসিনার মাহাথিরের পথে চলার সম্ভাব্য পরিণতি কী হতে পারে, তা খুঁজে দেখার চেষ্টা করি। মালয়েশিয়ার ‘উন্নয়ন’, এর মাথাপিছু আয়—এসব সম্পর্কে আমাদের সাধারণ ধারণা রয়েছে। এবং সেটা বেশ উঁচু বলেই আমাদের দেশের অনেকেরই স্বপ্ন মালয়েশিয়াকে ‘সেকেন্ড হোম’ বানানো। কিন্তু এই স্বপ্নের দেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র—এসবেরও তো খোঁজখবর জানা দরকার।
লিম কিট সিয়াং মালয়েশিয়ার বিরোধী ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন পার্টির নেতা। মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তাঁর উপস্থাপিত প্রবন্ধ থেকে সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যেতে পারে। লিম রাজনৈতিক কারণে বেশ কয়েক দফা বিনা বিচারে আটক ছিলেন এবং কোনোটির মেয়াদ ছিল দুই বছরেরও বেশি। এসব আটক কার্যকর করা হয়েছে ‘ইন্টারনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’–এর আওতায়। একবার বিচারে তাঁর শাস্তিও হয়েছে, ‘অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’-এর আওতায়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, মালয়েশিয়া সরকার ও একটি সুইস কোম্পানির গোপন চুক্তির অনিয়ম প্রকাশ করা। মালয়েশিয়া বা মাহাথিরের আমলের শাসনের দশা অন্তত কিছুটা হলেও টের পাওয়া যায় এক লিম কিটের ওপর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো দিয়ে।
‘ডেমোক্রেসি ইন মালয়েশিয়া, নিদার ফ্রি নর ফেয়ার’ শিরোনামের উপস্থাপনায় লিম অনেক কিছু বলেছেন। মালয়েশিয়ার গণতন্ত্র ও নির্বাচন নিয়ে তাঁর বক্তব্যের কিছু কথা তুলে ধরছি। কথাগুলো সাধারণভাবে এ রকম, নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র নয়, কার্যকর গণতন্ত্রে অনেক কিছুর স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হয়। এর সঙ্গে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের সম্পর্ক রয়েছে। সম্পর্ক রয়েছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সভা-সমাবেশ করার স্বাধীনতার। গণতন্ত্রে সংসদীয় নজরদারি বা নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহির মতো যথাযথ চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স নিশ্চিত করতে হয়। সিভিল সার্ভিসের ভূমিকা হতে হয় স্বাধীন। থাকতে হয় নির্বাচন কমিশন, অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়, দুর্নীতি দমন সংস্থা ও স্বাধীন বিচার বিভাগের মতো প্রতিষ্ঠান। মালয়েশিয়ার ক্ষমতাসীন সরকার গণতন্ত্রের এই গুরুত্বপূর্ণ সব দিকই উপেক্ষা করে চলেছে। নির্বাচনের মাঠ সমতল নয় এবং অগণতান্ত্রিকভাবে সরকারি দল বারিসান নাসিওনালের (বিএন) পক্ষে নানা সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এভাবেই বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা ৫৬ বছর ধরে তাদের শাসনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে।
‘আমরা বেশি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি না’ বা ‘মালয়েশিয়ায় মাহাথির মোহাম্মদ যে পথে এগিয়ে গেছেন, বাংলাদেশেও শেখ হাসিনা সে পথে এগিয়ে যাচ্ছেন’—এসব মন্তব্য থেকে তবে আমরা কী সিদ্ধান্তে আসতে পারি? মালয়েশিয়ার এসব লক্ষণ কী এখানে পরিষ্কার হয়ে উঠছে না? উন্নয়নের আশায় কি তবে আমাদের গণতন্ত্রে ছাড় দিতে হবে!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
No comments