কার্টুন এক তামাশা by নাজমা মোস্তফা
ফ্রান্সের
প্যারিসে নবী মুহাম্মাদ সা:কে নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে কার্টুন এঁকে যে
হাস্যকর তামাশার সূত্রপাত হয় তা অনেক দূর গড়ায়। শুধু এটিই নয়, প্রায় বেশ
কয়েক বছর থেকে এসব হচ্ছে। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে মুসলিমবিরোধী মুভি
‘ইনোসেন্স অব মুসলিমস’ মুসলিম বিশ্বে বেদনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তখন একটি
কলাম লিখেছিলাম ‘ইনোসেন্স অব মুসলিমস : এক উদভ্রান্ত পাগলা ঢিলের নাম’।
প্রায়ই এসব হয় এবং হচ্ছে, ডেনিশ কার্টুন সাম্প্রতিক কার্টুন, এসব নিয়ে
নাস্তিকদের সাইটে সারা বছরই কলমের মল্লযুদ্ধ লেগে আছে ইসলামিস্টদের সাথে।
এতে ক্ষিপ্ত হয়ে কখনো মুসলিমরা বিরোধীকে আঘাত করছেন, কখনো বা তারা নিজেরাও
নিহত হচ্ছেন। কথা হচ্ছে ফার্স্টবয়কে লাস্টবয়রা সব সময়ই ঘৃণা করে এবং করবে।
এতে ক্ষিপ্ত না হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে যুক্তির মাধ্যমে জবাব দেয়াই উত্তম বলে
মনে করি। কারণ যার কাছে যুক্তি সে জিতবেই, তার হারার কোনোই সম্ভাবনা নেই।
ফ্রান্সের কার্টুনিস্ট চার্লি হেবদো তার ম্যাগাজিনে একগুচ্ছ কার্টুন এঁকে
সারা বিশ্বে বেশ বড় রকমের নাড়া দিতে সক্ষম হয়। এ রোগ ২০১১, ১২, ১৫ ক্রমেই
এসব হচ্ছে একের পর এক, গোটা বিশ্বে দেখছে। সাম্প্রতিক সময়ে ২ জানুয়ারির
২০১৫-তে দেখা যায় দু’জন লোক সশস্ত্র সাজে সজ্জিত হয়ে এক নাগাড়ে ওই
কার্টুনিস্টসহ তার সাথের আরো ১২ জন মানুষকে প্রকাশ্য ময়দানে গুলি করে বসে।
প্রথমে ১১ জন মারা যায় এবং সেখানে আরো ১১ জন আহত হয়। ঠিক ওই সময় সেখানে
একজন ফ্রেন্স মুসলিম পুলিশও ওই বিতণ্ডাতে চার্লি হেবদোর পক্ষে নিরাপত্তা
দিতে গিয়ে খুন হয়। মিডিয়া সমান গলাতে প্রচার করছে এসব করেছে মুসলিম
টেররিস্ট জঙ্গিরা।
ও দিকে ১১ জানুয়ারিতে ৪০টি দেশে হর্তাকর্তাসহ এর প্রতিবাদে জড়ো হন প্যারিসের সব মিলে প্রায় ৩.৭ মিলিয়ন মানুষ। সে দিন তাদের সবার হাতের পতাকাতে একটি মেসেজই ছিল ‘জে স্যুট চার্লি’ এর অর্থ হচ্ছে ‘আমি চার্লি।’ এর এক মাস পর ১১ ফেব্রুয়ারিতে নর্থ ক্যারোলিনার ইউনিভার্সিটি টাউন অব চ্যাপেল হিলে তিনজন মুসলিম নিহত হয় যাদের মাঝে এক দম্পতি স্বামী-স্ত্রীসহ তিনজন, তৃতীয়জন ওই মেয়েটির বোন এক সাথে একজন সন্ত্রাসীর হাতে মারা যায়। এর ধারাবাহিকতায় ৪৬ বছরের স্টিফেন হিক্সকে আক্রমণকারী হিসেবে পুলিশ আটক করে। এসব ঘটনার পর আমার মনে ওই কার্টুন দেখার বিষয়ে কিছু উৎসাহ সৃষ্টি হয় যার পরিপ্রেক্ষিতে আমি ওগুলো খুঁজতে থাকি। যদিও ফ্রেন্স ভাষা না জানাতে তাদের প্রতিটি কথার অর্থ আমি বুঝতে পারিনি, তবে কিছু ধারণা পাই কিছু কার্টুনের আকার ইঙ্গিত দেখে। দু-একটি ছবি দেখার পর আমার এসব দেখার উৎসাহ কমে আসে। কারণ সেই পুরনো একই খেলা কত আর শোনা যায় বা দেখা যায়, জনম জনম থেকে সেই এক সাপের নাচন খেলা, ওসব দেখতে কি আর মন চায়? মনে হলো মিডিয়া, চার্লি ও অন্য কার্টুনিস্টরা যা করছে, এসব কত যে বড় রকমের হাস্যস্পদ কাজ তারা করছে, সেটি তারা নিজেরাও চিন্তা করতে পারছে না। এটা অনেকটা মিথ্যার সাথে যুদ্ধ করার মতো, ছায়ার সাথে যুদ্ধ করার মতো ব্যাপার। ইতিহাসে প্রমাণ পাওয়া যায় কিছু মানুষ নবী ঈসা আ:কে বাস্টার্ড গালি দিয়ে চরম প্রশান্তি অর্জন করেছে। তখনকার ইহুদি রাব্বিরা তাকে শূলে চড়ায়, তাদের দাবি অনুযায়ী তাকে ক্রুশে চড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। ওই ঘটনার আলোকে মানুষটিকে টিটকারি মশকরা করার কোনো কমতি তারা রাখেনি। থুথু ছিটিয়েছে, মাথায় কাঁটার মালা পরিয়েছে, বাস্টার্ড বলে গালি দিয়েছে, একই আদর্শের দিশা ধরে ভিন্ন আরেকদল যখন নবী মুহাম্মাদ সা:কে একজন যুদ্ধবাজ, নারী নির্যাতনকারী বা নারীলোভী হিসেবে উপস্থাপন করে চরম তৃপ্তি পেতে চায়। যখন একজন সম্মানিতকে কোনোভাবেই অবদমিত অপমানিত করার সুযোগ থাকে না, তখন অসুস্থ জনতা মনের সান্ত্বনার জন্য এসব অপবাদকে মুখরোচক হিসেবে গ্রহণ করে, আর ওতেই সান্ত্বনা পেতে চায়। বস্তুত এসব করে তারা নিজের অন্তরের হিংসার ক্ষতের ওপর প্রলেপ লেপে দিতে চায়।
ধর্ম এক চরম মিথ্যাচার, এ বিতণ্ডার কোনো সুযোগ নেই। এর প্রধান প্রমাণ হচ্ছে এক ধর্মের সাথে অন্য ধর্মের একাত্মতা। ইহুদি, খ্রিষ্টান আর ইসলাম, ধর্মের যোগসূত্রে বাঁধা এরা তিন। সোজা করে তাকালেই দেখা যায় এরা সবাই এক ঘরের মানুষ, মূলত এরা এক আলোর দিশারি। এমনো দেখা গেছে, যারা যৌবনে ধর্ম মানেনি তারা প্রৌঢ় হলেই ধর্মের ঘাড়ে ভর করে দাঁড়াতে চেয়েছে। কিন্তু যখন গায়ে শক্তি থেকেছে তখনই শক্তির বাহাদুরিতে ধর্মকে অবজ্ঞা করেছে বহু বেশি, হয়েছে নাস্তিক। ধর্মের এ বিতণ্ডা দেখে নাস্তিকতায় সান্ত্বনা খুঁজেছে অনেকে, এ হচ্ছে বোকামির ধর্মদর্শন। দেখা যায়, ইসলামকে প্রতিপক্ষ জেনে সেই সপ্তম শতাব্দী থেকে চলছে এসব লড়াই। আজ এত দিন পরও সেটি শেষ না হয়ে বরং যেন দিনে দিনে মহীরুহ হয়ে উঠছে। তাই মহীরুহের অবস্থানকে স্পষ্ট করার দায়িত্ব ছিল আমাদের প্রতিটি ধর্মধারীর। যারা এর পেছনে রসদ জুগিয়ে চলেছে, তাদের সযতœ তদারকিতে এটি বেড়েই চলেছে। আর যাদের দায়িত্ব ছিল এসব জটিলকে খোলাসা করার তারা দিনে দিনে ধর্মের মূল গবেষণা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বরং উল্টো বিরোধীকে রসদ জুগিয়ে গেছে। এ রকম বহু উদাহরণ চার পাশে ছড়ানো আছে। এ শতকের শুরুতে ৯/১১-এ ঘটে ভিন্ন রকম যুদ্ধের সূচনাপর্ব। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বুশ একে ‘ক্রুসেড’ বলে ডাক দিলেও প্রতিবাদ উঠলে তাকে ‘সরি’ বলতে হয়েছে। কিন্তু প্রথমে সময়ক্ষ্যাপন না করে তিনি ক্রুসেডের ডাক দেন। সভ্যতার যে সঙ্কটের আশঙ্কা করেছে সচেতনেরা, তারা ওটি নির্মূল করতে আজ নতুন করে ভাবছে কিভাবে প্রত্যেকের ই-মেইল ইন্টারনেট চেক করবে। এতে মানুষের প্রাইভেসির মাত্রাটি একদম শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে, সন্দেহ নেই। তারপরও কি যুদ্ধকে সামাল দেয়া যাবে বলে মনে হয়, যদি না এসব মিথ্যা ক্যারিক্যাচার বন্ধ হয়?
বিগত শতকে হিটলার (অনেকের ধারণা মতে ৬০ লাখ) ইহুদি নিধন করে সহজ একটি সমাধান করতে চান। এতে কত দূর যে সমাধান হয়েছে তা ইতিহাসই সাক্ষী। বরং এক হিটলারের বদলে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে ইহুদিরাই পরবর্তী বিশে^র হিটলার হয়ে নতুন জন্মে ফিলিস্তিনের কলিজাতে কামড় দিয়ে চলেছে। যদিও ফিলিস্তিনিরা এর জন্য মোটেও দায়ী নয়, জার্মান হিটলারের দায় তাদের ঘাড়ে চাপার কথা নয়, কিন্তু অবিবেচকের মতো বিশ^ মোড়লরা এ ব্যাপারে চরম অনাচার করে বিধাতার দরগাহে খুব বড়দাগেই আজকের দণ্ডধারী আসামি। বড় কর্তারা যারা শুরু থেকেই এর পেছনে তেল জুুগিয়েছে তাদের ঘাড়েই এর দায় বর্তায়। সেখানে দেখা যায় নিরপরাধ প্যালেস্টিনিয়ানদের শিশু, মেয়ে, মহিলা, পুরুষ কারো মুক্তি মেলেনি ওই সব দানবস্বরূপ পরবর্তী ইহুদিদের অত্যাচার থেকে। তাদের স্বগৃহ থেকে বের করে নিয়ে সর্বস্ব লুণ্ঠন করে পথে বসিয়েছে, এমন অনাচার নেই যা তারা করেনি। জাতিসঙ্ঘ নির্ধারিত স্কুলেও হামলে পড়তে তাদের বাধেনি। বাড়ির মূল কর্তাকে বের করে নিয়ে পুরো বিশ্ব থেকে ছন্নছাড়া ইহুদিদের ধরে ধরে এনে নতুন বসতি গড়ে তোলে। যেন এ রকম, আমাদের পূর্বপুরুষেরা আরবে বাস করতেন, এর পর আমরা পুরো বিশে^ ছড়িয়ে পড়লেও কৌশলবাজরা ধরে ধরে আমাদের এনে ফের আরব ভূমিতে বসিয়ে দেয়, আর মূল আরববাসীকে তাদের পূর্বপুরুষের ভিটাবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে দেয়। বিবেকের কাছে এটি যেমন একটি অনাচার হবে, ইহুদিদের ইসরাইলে বসিয়ে দেয়া ওই রকমই একটি বড় অনাচারের উৎকৃষ্ট নমুনা মাত্র। নবী ঈসা এসেছিলেন একজন আঞ্চলিক নবী হয়ে, বাইবেলের হিসাবেও ইহুদিদের হারানো গোত্রের সন্ধানকর্তা হিসেবে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন আঞ্চলিক নবী। মূসা নবীর অনুসারীরা এভাবে ক্রমে সারা বিশ্বে এখানে ওখানে ছড়িয়ে পড়ে। তাই বাইবেল বলে, ‘তিনি (জিসাস ক্রাইস্ট) উত্তরে বলেন, ‘ইসরাইল কুলের হারানো মেষ ছাড়া আর কারো নিকট আমি প্রেরিত হই নাই’ (বাইবেল, ম্যাথ্যু ১৫:২৪ আয়াত)। দেখা যায় যে মূসার অনুসারী ইহুদিদের খুঁজে দেখার কাজে তিনি এসেছিলেন, তারাই তাকে এর মধ্যেই শূলে চড়ায়। এরা বিভ্রান্ত হয়েছিল বলেই পরবর্তী নবী ঈসাকে আসতে হয় এবং এর পরবর্তী ঈসার অনুসারীরাও বিভ্রান্ত হয়েছিল বলে তারও পরবর্তীকে আসতে হয়, আর তিনি হচ্ছেন শেষ নবী মুহাম্মাদ (সা:)। তার হতেই ধর্ম পূর্ণতা লাভ করে। পরিপূর্ণ সিলেবাস আসার পর আর কারো আসার প্রয়োজন নেই। এবার এর মধ্যে কোনো জটিলতা ধরা থাকলে কুরআনের প্রথম বাণী ‘পড়’ কথার অনুসরণে ধর্মধারী জনগণকেই প্রয়োজনে গবেষণা করে সঠিকের চর্চা করতে হবে। বিদায় হজের বাণীতে ছিল মিথ্যা ‘চিরতরে দূরীভূত হয়েছে’।
প্রায় দুই হাজার বছর পরের ইতিহাসে সারা বিশ্ব থেকে ইহুদিদের ধরে এনে প্যালেস্টাইনে ঠাঁই দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে ব্রিটিশ এমপি মি. ডেভিড ওয়ার্ড ইসরাইলি প্রাইম মিনিস্টারের বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন ওই প্যারিস সংহতিতে ২০১৫ সালের জানুয়ারির ১১ তারিখে। এবং তিনি শুধু প্রতিবাদই করেননি তার প্ল্যাকার্ডের বাণী ছিল ‘জে স্যুট প্যালেস্টাইন’ ‘আমি প্যালেস্টাইনি’ ছিল তার প্রতিবাদের স্লোগান। গাজার হামলার প্রতিবাদে তিনি বলেন, ‘আমি যদি তখন গাজাতে থাকতাম, আমি ইসরাইলের প্রতি রকেট নিক্ষেপ করতাম’। ৬০ বছরেরও বেশি সময় থেকে প্যালেস্টাইনিরা এ মার খেয়ে যাচ্ছে। যদিও বিশ্বের সুজনদের মেধাবীদের শরীরের ওপর বিবেক নামের মস্তিষ্কটি আজো সচল আছে এবং ছিল। যে ধর্ম দিয়ে বিরুদ্ধবাদীরা ইসলামের জনতাকে পাগল ঠাওর করতে চাচ্ছেন মুক্তির রাস্তা খুঁজতে এমন জটিল সময়ে সে গ্রন্থ থেকে কিছু বাণী আনছি। সে গ্রন্থে পাওয়া যায় খ্রিষ্টানরাই মুসলিমের সবচেয়ে কাছের স্বজন। আর ইসলামের শুরু থেকেই এর সর্বনাশ ও ধ্বংস সাধনে ইহুদিরা ওতোপ্রতোভাবে জড়িত থাকার ইতিহাস পাওয়া যায় সর্বত্র। নবী মুহাম্মাদকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রের সাথে তারা বারবার জড়িত থেকেছে। এসব আচরণের কিছু দাগ-চিহ্নও পবিত্র গ্রন্থ কুরআনে পাওয়া যায়। এতে ইহুদিদের কপটতা ও খ্রিষ্টানের সহজতা ধরা পড়ে (সূরা মায়দাহ এর ৮২ আয়াত)। অতীতে ইহুদিরাই নবী ঈসাকে অর্থাৎ জিসাসকে নিয়ে মশকরা করেছেন আর আজকে তারা দুই দলই (ইহুদি ও খ্রিষ্টান) নবী মুহাম্মাদকে নিয়ে মশকরা করছে, আর নাস্তিক্য ধারার কারণে এসব বেড়ে চলেছে। যদিও ধর্মের একত্ব যেখানে লক্ষ করা যায়, সেখানে এসব হওয়ার কথা ছিল না।
(কুরআনে সূরা নিসার ৫ ও ৬ আয়াতে) দেখা যায় আল্লাহর নির্দেশ এসেছে কিভাবে সংশ্লিষ্টরা একজন সাধারণ মুসলিম অনাথের প্রতি যত্নবান হবেন। সেখানে বলা হয় তাদের যত্ন নিতে হবে যত দিন না তারা বিবাহযোগ্যা হয়ে ওঠে, তত দিন তাদের দেখভাল করতে হবে, তাদের সহায় সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। তাড়াহুড়ো করে তা নষ্ট করা যাবে না। অতঃপর তাদের সম্পত্তি তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে। সবার শেষে সাবধানবাণী হিসেবে বলা হয় হিসাবরক্ষক হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট। ইসলামের এ রকম একটি নির্দেশের পর কেমন করে নবী মুহাম্মাদ (সা:) একজন ছয় বছর বা ৯ বছরের মেয়েকে বিয়ে করতে পারেন বলে যা চৌদ্দশত বছর পরও বিরোধীর জ্বালা হয়ে জ্বলছে। ধারাবাহিকভাবে সমাজে এ নিয়ে বিতণ্ডা সৃষ্টি করা হচ্ছে। সবার ওপর আবু বকর ছিলেন বিবি আয়েশার বাবা, বাবার কষ্টের চেয়েও আজকের বিরোধীর কষ্ট যেন বহুগুণ বেশি। তিনি এমন একজন বিচক্ষণ সাহাবা (নবীর সহচর) যাকে নবীর পরই খলিফার মর্যাদা দেয়া হয়। এতে কি এসব স্পষ্ট হয় না, এসবই বিরুদ্ধবাদীদের অপপ্রচার ছাড়া আর কিছু নয়? সবচেয়ে বড় কথা নবী মুহাম্মাদ ২৫ থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত এক স্ত্রী বিবি খাদিজা ছাড়া আর কারো পাণি গ্রহণ করেননি। ওই সময় তার ঘরে চার চারজন মেয়ে ফাতেমা, কুলসুম, রোকেয়া, জয়নব এদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও একজন বুদ্ধিমতি যোগ্য অভিভাবকের সংবাদ নিয়ে খাওলাহ নামের এক মহিলা বিবি আয়েশার নাম উচ্চারণ করে বিয়ের পয়গাম নিয়ে আসেন, তখন নবীর ৫৫ বছরে ওই বিয়ে হয়। এসব ক্ষেত্রে যে বা যারা আরবি ভাষা জানেন তারা ভালো করেই জানেন ‘বিকর’ শব্দটি কখনোই কোনো অপ্রাপ্তবয়স্ক(?) শিশুর জন্য বা ৯ বছরের শিশুর জন্য ব্যবহার হয় না। এটি একমাত্র তার জন্যই ব্যবহার হয়েছে যে এরই মধ্যে বিবাহযোগ্যা (তাইয়্যিবা) হয়ে উঠেছে। আমি দেখেছি অনেক মুসলমানও বিষয়টি ভালো করে জানেন না। অনেকে সহি হাদিসের দোহাই দিয়ে এ রকম কুরআনবিরোধী মিথ্যার প্রচার করে ধর্মের বারোটা বাজিয়ে চলেছেন, যার ইন্ধনে পুরো বিশে^ লঙ্কাকাণ্ড চলছে। সহি হাদিসের বড় শর্ত হচ্ছে তা কুরআনবিরোধী হতে পারবে না। কোনো হাদিস কুরআনবিরোধী হলে, তা বাতিল বলে গণ্য হবে, এটি হাদিসের প্রধান শর্ত। সারা বিশ^ই আজ বিবি আয়েশার মা বাবা সেজে যুদ্ধের মাঠে নেমেছে। বিবি আয়েশা আজ তাদের হাতের গিনিপিগ। আর বিরোধীরা মহা উৎসাহে এসবের উপর নটনৃত্য চালিয়ে যাচ্ছে। কার্টুন রচিত হচ্ছে এসব ভুলের ওপরই রঙ্গমেলা চলছে, কলমের কালিতে কার্টুনের আঁকিবুকিতে ওটিই ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে।
দেখা যায় বেশির ভাগ কার্টুনের ক্যারিকেচার হচ্ছে বহুবিবাহ, বিবি আয়েশার বিয়ে, যুদ্ধবাজ ধর্ম এসব নিয়ে বিতণ্ডা। আমরা সবাই জানি বাইবেলে বহু বিবাহ একটি সাধারণ ঘটনা। নবী ইব্রাহিমের দুই সন্তান ইসমাইল ও ইসহাক দুই মায়ের দুই সন্তান। তাই বলে ওই সব নিয়ে ইসলামে কোনো বিতণ্ডা করতে দেখা যায় না বা কোনো বিতণ্ডা বাধে না। ইসলামের বক্তব্যও এক বিয়েতেই টিকে, সূরা নিসার ৩ আয়াতে শর্ত হচ্ছে একাধিক স্ত্রী থাকলে সবার সাথে সমতা রাখতে হবে ও সেটি জটিল। তোমরা একাধিকের সাথে সমতা রাখতে পারবে না (৪:১২৯) তা হলে একজনকেই এবং এটিই বেশি সঙ্গত’ (সূরা নিসার ৩ আয়াত)। ইসলামের শক্তি প্রবল বলেই হয়তো মিথ্যা গল্প জুড়ে কুরআন, মুহাম্মাদ ও ইসলাম নিয়ে মশকরা করার লোকের বিধর্মী বা নাস্তিকের কোনো কমতি নেই এ পৃথিবীতে, কোনো যুগেই এদের কমতি হয়নি। বেশির ভাগ বিতণ্ডাকারীদের কথা হচ্ছে বিবি আয়েশার বিয়ে হয়েছে ছয় বছর বয়সে আর ঘরে তোলা হয়েছে ৯ বছর বয়সে। গোটা বিশ্বে এ রকম অনেক কর্ম অপকর্ম আছে যার কোনো অভাব নেই কিন্তু ইসলামকে নিয়ে এ ক্যারিকেচার যেন কিয়ামত পর্যন্তই চলবে। সে দিন যখন কার্টুন খুঁজতে থাকি তখন দু’টি আঁকিবুকি আমার কাছে স্পষ্ট হয় একটি চাকাওয়ালা বাহনে দেখা যায় নবী মুহাম্মাদ (সা:) ও ছয় বছরের শিশু আয়েশা বসে আছেন এবং ছবিতে টেগ লাগানো আছে যে মুহাম্মাদ ও তার কনে আয়েশা এ রকম কিছু একটা। অন্য একটি ছবিতে এক মুসলিম সম্ভবত নবী স্বয়ং কুরআন হাতে দাঁড়িয়ে আর দূর থেকে সেখানে শেলের মতো কিছু এসে কুরআনকে বিদ্ধ করছে। যেন কুরআনের সাথে যুদ্ধ চলছে, অস্ত্রের যুদ্ধ। আজ থেকে প্রায় বারো-তেরো বছর আগে ইন্টারনেটে নাস্তিকের সাথে যুদ্ধ করতে যেয়ে এর জবাবে ১৬টি পয়েন্টের ভিত্তিতে যুক্তি খুঁজে পাই যেখানে প্রমাণিত হয় যে, বিবি আয়েশার বিয়ে মোটেও ৬ বা ৯ বছরে হয়নি, বরং বিয়েটি হয় ১৯ বছর বয়সে তার বহুবিধ প্রমাণ পাওয়া যায়। কিভাবে মিথ্যার সাথে আজ চৌদ্দ শতাব্দী পরও তারা যুদ্ধ করে চলেছে, যেন ছায়ার সাথে যুদ্ধ করছে। ওখান থেকে শুধু কুরআনের যুক্তিটুকুই যথেষ্ট মনে করে আনছি, কারণ এটি আল্লাহর বাণী। ‘আর এতিমদের পরীক্ষা করে দেখবে যে পর্যন্ত না তারা বিবাহ বয়সে পৌঁছে যায়, তারপর যদি তাদের মধ্যে বিচারবুদ্ধি দেখতে পাও তবে তাদের সম্পত্তি তাদের হস্তার্পণ করবে, আর তা মাত্রাতিরিক্তভাবে ও তাড়াহুড়া করে খেয়ে ফেলো না পাছে তারা বড় হয়ে যাবে (এই আশঙ্কায়) আর যে অবস্থায় পড়বে সে যেন বিরত থাকে, আর যে গরিব সে ন্যায়সঙ্গতভাবে খায়। তারপর যখন তোমরা তাদের সম্পত্তি তাদের ফিরিয়ে দাও তখন তাদের সামনে সাক্ষী ডাকো। আর হিসাবরক্ষকরূপে আল্লাহ যথেষ্ট’ (সূরা নিসার ৬ আয়াত)।
বাকি অনেক হাদিস ও ঐতিহাসিক যুক্তিতেও এসব বানোয়াট কথা টিকে না। এবন হেশাম, হালবি, এয়াবা প্রভৃতিতে পাওয়া যায় বিবি আয়েশা (রা:) সমরক্ষেত্রে উপস্থিত থেকে সৈনিকদের সেবা শুশ্রুষা করেন। বিবি আয়েশা বদর যুদ্ধের ময়দানে সেবা শুশ্রুষা করেন। ইতিহাসে বা হাদিসে পাওয়া যায় প্রত্যক্ষ যুদ্ধের ময়দানে অংশ নেয়ার একটি বয়স নির্ধারিত আছে ১৫ বছরের নিচে কেউ যুদ্ধে যোগ দিতে পারত না। এমতাবস্থায় তিনি ৬ বছরের বা ৯ বছরের হলে কেমন করে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন। এ রকম কোনো যুক্তিতেই এসব টিকে না যে বিবি আয়েশার বয়স ৬ বা ৯ ছিল। সূক্ষ্মভাবে প্রতিটি কার্টুনের নষ্টামির স্পষ্ট জবাব দেয়া সম্ভব। তা না করে মিছামিছি খণ্ডযুদ্ধ করার কোনো মানে নেই। কারণ তা হলে ওতে অসহিষ্ণুতার উদাহরণ সৃষ্টি হয়। মুসলমানকে ধৈর্যধারণ করতে শক্ত করেই বলা হয়েছে। বিনিময়ে তাদের জন্য অফুরান পাওনা জমা আছে। সবার ওপর মানুষকে কুরআনে বলা হয় আশরাফুল মাখলুকাত। মানে মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। আর এই শ্রেষ্ঠ জীবের স্বীকৃতিস্বরূপ মাথাটি তার প্রতিটি সুকর্মের প্রকৃত জোগানদাতা। তাই কাউকে নিয়ে মশকারা করার আগে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার আগে দরকার তার মূল ইতিহাসকে জানার। ঘটনার মূল গোড়াতে না পৌঁছে শুধু ডালপালা নিয়ে নাড়াচাড়া করলে ডাল ভেঙে হাত পা ভাঙার সমূহ সম্ভাবনাকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। তারা ইহকালে কোনো দিনও সফল হতে পারবে না। ধৈর্য ও সবরের আয়াতটি হচ্ছে : ‘তারাই শ্রেষ্ঠ যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করছে ও পরস্পরকে সততা অবলম্বনে উপদেশ দিচ্ছে এবং পরস্পরকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিচ্ছে’ (সূরা আল আসরের ৩ আয়াত)। ধৈর্যের মাধ্যমে জটিলকে মোকাবেলা করার আহ্বান জানিয়ে এখানেই শেষ করছি।
লেখক : প্রবাসী, গ্রন্থকার
ও দিকে ১১ জানুয়ারিতে ৪০টি দেশে হর্তাকর্তাসহ এর প্রতিবাদে জড়ো হন প্যারিসের সব মিলে প্রায় ৩.৭ মিলিয়ন মানুষ। সে দিন তাদের সবার হাতের পতাকাতে একটি মেসেজই ছিল ‘জে স্যুট চার্লি’ এর অর্থ হচ্ছে ‘আমি চার্লি।’ এর এক মাস পর ১১ ফেব্রুয়ারিতে নর্থ ক্যারোলিনার ইউনিভার্সিটি টাউন অব চ্যাপেল হিলে তিনজন মুসলিম নিহত হয় যাদের মাঝে এক দম্পতি স্বামী-স্ত্রীসহ তিনজন, তৃতীয়জন ওই মেয়েটির বোন এক সাথে একজন সন্ত্রাসীর হাতে মারা যায়। এর ধারাবাহিকতায় ৪৬ বছরের স্টিফেন হিক্সকে আক্রমণকারী হিসেবে পুলিশ আটক করে। এসব ঘটনার পর আমার মনে ওই কার্টুন দেখার বিষয়ে কিছু উৎসাহ সৃষ্টি হয় যার পরিপ্রেক্ষিতে আমি ওগুলো খুঁজতে থাকি। যদিও ফ্রেন্স ভাষা না জানাতে তাদের প্রতিটি কথার অর্থ আমি বুঝতে পারিনি, তবে কিছু ধারণা পাই কিছু কার্টুনের আকার ইঙ্গিত দেখে। দু-একটি ছবি দেখার পর আমার এসব দেখার উৎসাহ কমে আসে। কারণ সেই পুরনো একই খেলা কত আর শোনা যায় বা দেখা যায়, জনম জনম থেকে সেই এক সাপের নাচন খেলা, ওসব দেখতে কি আর মন চায়? মনে হলো মিডিয়া, চার্লি ও অন্য কার্টুনিস্টরা যা করছে, এসব কত যে বড় রকমের হাস্যস্পদ কাজ তারা করছে, সেটি তারা নিজেরাও চিন্তা করতে পারছে না। এটা অনেকটা মিথ্যার সাথে যুদ্ধ করার মতো, ছায়ার সাথে যুদ্ধ করার মতো ব্যাপার। ইতিহাসে প্রমাণ পাওয়া যায় কিছু মানুষ নবী ঈসা আ:কে বাস্টার্ড গালি দিয়ে চরম প্রশান্তি অর্জন করেছে। তখনকার ইহুদি রাব্বিরা তাকে শূলে চড়ায়, তাদের দাবি অনুযায়ী তাকে ক্রুশে চড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। ওই ঘটনার আলোকে মানুষটিকে টিটকারি মশকরা করার কোনো কমতি তারা রাখেনি। থুথু ছিটিয়েছে, মাথায় কাঁটার মালা পরিয়েছে, বাস্টার্ড বলে গালি দিয়েছে, একই আদর্শের দিশা ধরে ভিন্ন আরেকদল যখন নবী মুহাম্মাদ সা:কে একজন যুদ্ধবাজ, নারী নির্যাতনকারী বা নারীলোভী হিসেবে উপস্থাপন করে চরম তৃপ্তি পেতে চায়। যখন একজন সম্মানিতকে কোনোভাবেই অবদমিত অপমানিত করার সুযোগ থাকে না, তখন অসুস্থ জনতা মনের সান্ত্বনার জন্য এসব অপবাদকে মুখরোচক হিসেবে গ্রহণ করে, আর ওতেই সান্ত্বনা পেতে চায়। বস্তুত এসব করে তারা নিজের অন্তরের হিংসার ক্ষতের ওপর প্রলেপ লেপে দিতে চায়।
ধর্ম এক চরম মিথ্যাচার, এ বিতণ্ডার কোনো সুযোগ নেই। এর প্রধান প্রমাণ হচ্ছে এক ধর্মের সাথে অন্য ধর্মের একাত্মতা। ইহুদি, খ্রিষ্টান আর ইসলাম, ধর্মের যোগসূত্রে বাঁধা এরা তিন। সোজা করে তাকালেই দেখা যায় এরা সবাই এক ঘরের মানুষ, মূলত এরা এক আলোর দিশারি। এমনো দেখা গেছে, যারা যৌবনে ধর্ম মানেনি তারা প্রৌঢ় হলেই ধর্মের ঘাড়ে ভর করে দাঁড়াতে চেয়েছে। কিন্তু যখন গায়ে শক্তি থেকেছে তখনই শক্তির বাহাদুরিতে ধর্মকে অবজ্ঞা করেছে বহু বেশি, হয়েছে নাস্তিক। ধর্মের এ বিতণ্ডা দেখে নাস্তিকতায় সান্ত্বনা খুঁজেছে অনেকে, এ হচ্ছে বোকামির ধর্মদর্শন। দেখা যায়, ইসলামকে প্রতিপক্ষ জেনে সেই সপ্তম শতাব্দী থেকে চলছে এসব লড়াই। আজ এত দিন পরও সেটি শেষ না হয়ে বরং যেন দিনে দিনে মহীরুহ হয়ে উঠছে। তাই মহীরুহের অবস্থানকে স্পষ্ট করার দায়িত্ব ছিল আমাদের প্রতিটি ধর্মধারীর। যারা এর পেছনে রসদ জুগিয়ে চলেছে, তাদের সযতœ তদারকিতে এটি বেড়েই চলেছে। আর যাদের দায়িত্ব ছিল এসব জটিলকে খোলাসা করার তারা দিনে দিনে ধর্মের মূল গবেষণা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বরং উল্টো বিরোধীকে রসদ জুগিয়ে গেছে। এ রকম বহু উদাহরণ চার পাশে ছড়ানো আছে। এ শতকের শুরুতে ৯/১১-এ ঘটে ভিন্ন রকম যুদ্ধের সূচনাপর্ব। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বুশ একে ‘ক্রুসেড’ বলে ডাক দিলেও প্রতিবাদ উঠলে তাকে ‘সরি’ বলতে হয়েছে। কিন্তু প্রথমে সময়ক্ষ্যাপন না করে তিনি ক্রুসেডের ডাক দেন। সভ্যতার যে সঙ্কটের আশঙ্কা করেছে সচেতনেরা, তারা ওটি নির্মূল করতে আজ নতুন করে ভাবছে কিভাবে প্রত্যেকের ই-মেইল ইন্টারনেট চেক করবে। এতে মানুষের প্রাইভেসির মাত্রাটি একদম শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে, সন্দেহ নেই। তারপরও কি যুদ্ধকে সামাল দেয়া যাবে বলে মনে হয়, যদি না এসব মিথ্যা ক্যারিক্যাচার বন্ধ হয়?
বিগত শতকে হিটলার (অনেকের ধারণা মতে ৬০ লাখ) ইহুদি নিধন করে সহজ একটি সমাধান করতে চান। এতে কত দূর যে সমাধান হয়েছে তা ইতিহাসই সাক্ষী। বরং এক হিটলারের বদলে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে ইহুদিরাই পরবর্তী বিশে^র হিটলার হয়ে নতুন জন্মে ফিলিস্তিনের কলিজাতে কামড় দিয়ে চলেছে। যদিও ফিলিস্তিনিরা এর জন্য মোটেও দায়ী নয়, জার্মান হিটলারের দায় তাদের ঘাড়ে চাপার কথা নয়, কিন্তু অবিবেচকের মতো বিশ^ মোড়লরা এ ব্যাপারে চরম অনাচার করে বিধাতার দরগাহে খুব বড়দাগেই আজকের দণ্ডধারী আসামি। বড় কর্তারা যারা শুরু থেকেই এর পেছনে তেল জুুগিয়েছে তাদের ঘাড়েই এর দায় বর্তায়। সেখানে দেখা যায় নিরপরাধ প্যালেস্টিনিয়ানদের শিশু, মেয়ে, মহিলা, পুরুষ কারো মুক্তি মেলেনি ওই সব দানবস্বরূপ পরবর্তী ইহুদিদের অত্যাচার থেকে। তাদের স্বগৃহ থেকে বের করে নিয়ে সর্বস্ব লুণ্ঠন করে পথে বসিয়েছে, এমন অনাচার নেই যা তারা করেনি। জাতিসঙ্ঘ নির্ধারিত স্কুলেও হামলে পড়তে তাদের বাধেনি। বাড়ির মূল কর্তাকে বের করে নিয়ে পুরো বিশ্ব থেকে ছন্নছাড়া ইহুদিদের ধরে ধরে এনে নতুন বসতি গড়ে তোলে। যেন এ রকম, আমাদের পূর্বপুরুষেরা আরবে বাস করতেন, এর পর আমরা পুরো বিশে^ ছড়িয়ে পড়লেও কৌশলবাজরা ধরে ধরে আমাদের এনে ফের আরব ভূমিতে বসিয়ে দেয়, আর মূল আরববাসীকে তাদের পূর্বপুরুষের ভিটাবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে দেয়। বিবেকের কাছে এটি যেমন একটি অনাচার হবে, ইহুদিদের ইসরাইলে বসিয়ে দেয়া ওই রকমই একটি বড় অনাচারের উৎকৃষ্ট নমুনা মাত্র। নবী ঈসা এসেছিলেন একজন আঞ্চলিক নবী হয়ে, বাইবেলের হিসাবেও ইহুদিদের হারানো গোত্রের সন্ধানকর্তা হিসেবে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন আঞ্চলিক নবী। মূসা নবীর অনুসারীরা এভাবে ক্রমে সারা বিশ্বে এখানে ওখানে ছড়িয়ে পড়ে। তাই বাইবেল বলে, ‘তিনি (জিসাস ক্রাইস্ট) উত্তরে বলেন, ‘ইসরাইল কুলের হারানো মেষ ছাড়া আর কারো নিকট আমি প্রেরিত হই নাই’ (বাইবেল, ম্যাথ্যু ১৫:২৪ আয়াত)। দেখা যায় যে মূসার অনুসারী ইহুদিদের খুঁজে দেখার কাজে তিনি এসেছিলেন, তারাই তাকে এর মধ্যেই শূলে চড়ায়। এরা বিভ্রান্ত হয়েছিল বলেই পরবর্তী নবী ঈসাকে আসতে হয় এবং এর পরবর্তী ঈসার অনুসারীরাও বিভ্রান্ত হয়েছিল বলে তারও পরবর্তীকে আসতে হয়, আর তিনি হচ্ছেন শেষ নবী মুহাম্মাদ (সা:)। তার হতেই ধর্ম পূর্ণতা লাভ করে। পরিপূর্ণ সিলেবাস আসার পর আর কারো আসার প্রয়োজন নেই। এবার এর মধ্যে কোনো জটিলতা ধরা থাকলে কুরআনের প্রথম বাণী ‘পড়’ কথার অনুসরণে ধর্মধারী জনগণকেই প্রয়োজনে গবেষণা করে সঠিকের চর্চা করতে হবে। বিদায় হজের বাণীতে ছিল মিথ্যা ‘চিরতরে দূরীভূত হয়েছে’।
প্রায় দুই হাজার বছর পরের ইতিহাসে সারা বিশ্ব থেকে ইহুদিদের ধরে এনে প্যালেস্টাইনে ঠাঁই দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে ব্রিটিশ এমপি মি. ডেভিড ওয়ার্ড ইসরাইলি প্রাইম মিনিস্টারের বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন ওই প্যারিস সংহতিতে ২০১৫ সালের জানুয়ারির ১১ তারিখে। এবং তিনি শুধু প্রতিবাদই করেননি তার প্ল্যাকার্ডের বাণী ছিল ‘জে স্যুট প্যালেস্টাইন’ ‘আমি প্যালেস্টাইনি’ ছিল তার প্রতিবাদের স্লোগান। গাজার হামলার প্রতিবাদে তিনি বলেন, ‘আমি যদি তখন গাজাতে থাকতাম, আমি ইসরাইলের প্রতি রকেট নিক্ষেপ করতাম’। ৬০ বছরেরও বেশি সময় থেকে প্যালেস্টাইনিরা এ মার খেয়ে যাচ্ছে। যদিও বিশ্বের সুজনদের মেধাবীদের শরীরের ওপর বিবেক নামের মস্তিষ্কটি আজো সচল আছে এবং ছিল। যে ধর্ম দিয়ে বিরুদ্ধবাদীরা ইসলামের জনতাকে পাগল ঠাওর করতে চাচ্ছেন মুক্তির রাস্তা খুঁজতে এমন জটিল সময়ে সে গ্রন্থ থেকে কিছু বাণী আনছি। সে গ্রন্থে পাওয়া যায় খ্রিষ্টানরাই মুসলিমের সবচেয়ে কাছের স্বজন। আর ইসলামের শুরু থেকেই এর সর্বনাশ ও ধ্বংস সাধনে ইহুদিরা ওতোপ্রতোভাবে জড়িত থাকার ইতিহাস পাওয়া যায় সর্বত্র। নবী মুহাম্মাদকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রের সাথে তারা বারবার জড়িত থেকেছে। এসব আচরণের কিছু দাগ-চিহ্নও পবিত্র গ্রন্থ কুরআনে পাওয়া যায়। এতে ইহুদিদের কপটতা ও খ্রিষ্টানের সহজতা ধরা পড়ে (সূরা মায়দাহ এর ৮২ আয়াত)। অতীতে ইহুদিরাই নবী ঈসাকে অর্থাৎ জিসাসকে নিয়ে মশকরা করেছেন আর আজকে তারা দুই দলই (ইহুদি ও খ্রিষ্টান) নবী মুহাম্মাদকে নিয়ে মশকরা করছে, আর নাস্তিক্য ধারার কারণে এসব বেড়ে চলেছে। যদিও ধর্মের একত্ব যেখানে লক্ষ করা যায়, সেখানে এসব হওয়ার কথা ছিল না।
(কুরআনে সূরা নিসার ৫ ও ৬ আয়াতে) দেখা যায় আল্লাহর নির্দেশ এসেছে কিভাবে সংশ্লিষ্টরা একজন সাধারণ মুসলিম অনাথের প্রতি যত্নবান হবেন। সেখানে বলা হয় তাদের যত্ন নিতে হবে যত দিন না তারা বিবাহযোগ্যা হয়ে ওঠে, তত দিন তাদের দেখভাল করতে হবে, তাদের সহায় সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। তাড়াহুড়ো করে তা নষ্ট করা যাবে না। অতঃপর তাদের সম্পত্তি তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে। সবার শেষে সাবধানবাণী হিসেবে বলা হয় হিসাবরক্ষক হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট। ইসলামের এ রকম একটি নির্দেশের পর কেমন করে নবী মুহাম্মাদ (সা:) একজন ছয় বছর বা ৯ বছরের মেয়েকে বিয়ে করতে পারেন বলে যা চৌদ্দশত বছর পরও বিরোধীর জ্বালা হয়ে জ্বলছে। ধারাবাহিকভাবে সমাজে এ নিয়ে বিতণ্ডা সৃষ্টি করা হচ্ছে। সবার ওপর আবু বকর ছিলেন বিবি আয়েশার বাবা, বাবার কষ্টের চেয়েও আজকের বিরোধীর কষ্ট যেন বহুগুণ বেশি। তিনি এমন একজন বিচক্ষণ সাহাবা (নবীর সহচর) যাকে নবীর পরই খলিফার মর্যাদা দেয়া হয়। এতে কি এসব স্পষ্ট হয় না, এসবই বিরুদ্ধবাদীদের অপপ্রচার ছাড়া আর কিছু নয়? সবচেয়ে বড় কথা নবী মুহাম্মাদ ২৫ থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত এক স্ত্রী বিবি খাদিজা ছাড়া আর কারো পাণি গ্রহণ করেননি। ওই সময় তার ঘরে চার চারজন মেয়ে ফাতেমা, কুলসুম, রোকেয়া, জয়নব এদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও একজন বুদ্ধিমতি যোগ্য অভিভাবকের সংবাদ নিয়ে খাওলাহ নামের এক মহিলা বিবি আয়েশার নাম উচ্চারণ করে বিয়ের পয়গাম নিয়ে আসেন, তখন নবীর ৫৫ বছরে ওই বিয়ে হয়। এসব ক্ষেত্রে যে বা যারা আরবি ভাষা জানেন তারা ভালো করেই জানেন ‘বিকর’ শব্দটি কখনোই কোনো অপ্রাপ্তবয়স্ক(?) শিশুর জন্য বা ৯ বছরের শিশুর জন্য ব্যবহার হয় না। এটি একমাত্র তার জন্যই ব্যবহার হয়েছে যে এরই মধ্যে বিবাহযোগ্যা (তাইয়্যিবা) হয়ে উঠেছে। আমি দেখেছি অনেক মুসলমানও বিষয়টি ভালো করে জানেন না। অনেকে সহি হাদিসের দোহাই দিয়ে এ রকম কুরআনবিরোধী মিথ্যার প্রচার করে ধর্মের বারোটা বাজিয়ে চলেছেন, যার ইন্ধনে পুরো বিশে^ লঙ্কাকাণ্ড চলছে। সহি হাদিসের বড় শর্ত হচ্ছে তা কুরআনবিরোধী হতে পারবে না। কোনো হাদিস কুরআনবিরোধী হলে, তা বাতিল বলে গণ্য হবে, এটি হাদিসের প্রধান শর্ত। সারা বিশ^ই আজ বিবি আয়েশার মা বাবা সেজে যুদ্ধের মাঠে নেমেছে। বিবি আয়েশা আজ তাদের হাতের গিনিপিগ। আর বিরোধীরা মহা উৎসাহে এসবের উপর নটনৃত্য চালিয়ে যাচ্ছে। কার্টুন রচিত হচ্ছে এসব ভুলের ওপরই রঙ্গমেলা চলছে, কলমের কালিতে কার্টুনের আঁকিবুকিতে ওটিই ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে।
দেখা যায় বেশির ভাগ কার্টুনের ক্যারিকেচার হচ্ছে বহুবিবাহ, বিবি আয়েশার বিয়ে, যুদ্ধবাজ ধর্ম এসব নিয়ে বিতণ্ডা। আমরা সবাই জানি বাইবেলে বহু বিবাহ একটি সাধারণ ঘটনা। নবী ইব্রাহিমের দুই সন্তান ইসমাইল ও ইসহাক দুই মায়ের দুই সন্তান। তাই বলে ওই সব নিয়ে ইসলামে কোনো বিতণ্ডা করতে দেখা যায় না বা কোনো বিতণ্ডা বাধে না। ইসলামের বক্তব্যও এক বিয়েতেই টিকে, সূরা নিসার ৩ আয়াতে শর্ত হচ্ছে একাধিক স্ত্রী থাকলে সবার সাথে সমতা রাখতে হবে ও সেটি জটিল। তোমরা একাধিকের সাথে সমতা রাখতে পারবে না (৪:১২৯) তা হলে একজনকেই এবং এটিই বেশি সঙ্গত’ (সূরা নিসার ৩ আয়াত)। ইসলামের শক্তি প্রবল বলেই হয়তো মিথ্যা গল্প জুড়ে কুরআন, মুহাম্মাদ ও ইসলাম নিয়ে মশকরা করার লোকের বিধর্মী বা নাস্তিকের কোনো কমতি নেই এ পৃথিবীতে, কোনো যুগেই এদের কমতি হয়নি। বেশির ভাগ বিতণ্ডাকারীদের কথা হচ্ছে বিবি আয়েশার বিয়ে হয়েছে ছয় বছর বয়সে আর ঘরে তোলা হয়েছে ৯ বছর বয়সে। গোটা বিশ্বে এ রকম অনেক কর্ম অপকর্ম আছে যার কোনো অভাব নেই কিন্তু ইসলামকে নিয়ে এ ক্যারিকেচার যেন কিয়ামত পর্যন্তই চলবে। সে দিন যখন কার্টুন খুঁজতে থাকি তখন দু’টি আঁকিবুকি আমার কাছে স্পষ্ট হয় একটি চাকাওয়ালা বাহনে দেখা যায় নবী মুহাম্মাদ (সা:) ও ছয় বছরের শিশু আয়েশা বসে আছেন এবং ছবিতে টেগ লাগানো আছে যে মুহাম্মাদ ও তার কনে আয়েশা এ রকম কিছু একটা। অন্য একটি ছবিতে এক মুসলিম সম্ভবত নবী স্বয়ং কুরআন হাতে দাঁড়িয়ে আর দূর থেকে সেখানে শেলের মতো কিছু এসে কুরআনকে বিদ্ধ করছে। যেন কুরআনের সাথে যুদ্ধ চলছে, অস্ত্রের যুদ্ধ। আজ থেকে প্রায় বারো-তেরো বছর আগে ইন্টারনেটে নাস্তিকের সাথে যুদ্ধ করতে যেয়ে এর জবাবে ১৬টি পয়েন্টের ভিত্তিতে যুক্তি খুঁজে পাই যেখানে প্রমাণিত হয় যে, বিবি আয়েশার বিয়ে মোটেও ৬ বা ৯ বছরে হয়নি, বরং বিয়েটি হয় ১৯ বছর বয়সে তার বহুবিধ প্রমাণ পাওয়া যায়। কিভাবে মিথ্যার সাথে আজ চৌদ্দ শতাব্দী পরও তারা যুদ্ধ করে চলেছে, যেন ছায়ার সাথে যুদ্ধ করছে। ওখান থেকে শুধু কুরআনের যুক্তিটুকুই যথেষ্ট মনে করে আনছি, কারণ এটি আল্লাহর বাণী। ‘আর এতিমদের পরীক্ষা করে দেখবে যে পর্যন্ত না তারা বিবাহ বয়সে পৌঁছে যায়, তারপর যদি তাদের মধ্যে বিচারবুদ্ধি দেখতে পাও তবে তাদের সম্পত্তি তাদের হস্তার্পণ করবে, আর তা মাত্রাতিরিক্তভাবে ও তাড়াহুড়া করে খেয়ে ফেলো না পাছে তারা বড় হয়ে যাবে (এই আশঙ্কায়) আর যে অবস্থায় পড়বে সে যেন বিরত থাকে, আর যে গরিব সে ন্যায়সঙ্গতভাবে খায়। তারপর যখন তোমরা তাদের সম্পত্তি তাদের ফিরিয়ে দাও তখন তাদের সামনে সাক্ষী ডাকো। আর হিসাবরক্ষকরূপে আল্লাহ যথেষ্ট’ (সূরা নিসার ৬ আয়াত)।
বাকি অনেক হাদিস ও ঐতিহাসিক যুক্তিতেও এসব বানোয়াট কথা টিকে না। এবন হেশাম, হালবি, এয়াবা প্রভৃতিতে পাওয়া যায় বিবি আয়েশা (রা:) সমরক্ষেত্রে উপস্থিত থেকে সৈনিকদের সেবা শুশ্রুষা করেন। বিবি আয়েশা বদর যুদ্ধের ময়দানে সেবা শুশ্রুষা করেন। ইতিহাসে বা হাদিসে পাওয়া যায় প্রত্যক্ষ যুদ্ধের ময়দানে অংশ নেয়ার একটি বয়স নির্ধারিত আছে ১৫ বছরের নিচে কেউ যুদ্ধে যোগ দিতে পারত না। এমতাবস্থায় তিনি ৬ বছরের বা ৯ বছরের হলে কেমন করে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন। এ রকম কোনো যুক্তিতেই এসব টিকে না যে বিবি আয়েশার বয়স ৬ বা ৯ ছিল। সূক্ষ্মভাবে প্রতিটি কার্টুনের নষ্টামির স্পষ্ট জবাব দেয়া সম্ভব। তা না করে মিছামিছি খণ্ডযুদ্ধ করার কোনো মানে নেই। কারণ তা হলে ওতে অসহিষ্ণুতার উদাহরণ সৃষ্টি হয়। মুসলমানকে ধৈর্যধারণ করতে শক্ত করেই বলা হয়েছে। বিনিময়ে তাদের জন্য অফুরান পাওনা জমা আছে। সবার ওপর মানুষকে কুরআনে বলা হয় আশরাফুল মাখলুকাত। মানে মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। আর এই শ্রেষ্ঠ জীবের স্বীকৃতিস্বরূপ মাথাটি তার প্রতিটি সুকর্মের প্রকৃত জোগানদাতা। তাই কাউকে নিয়ে মশকারা করার আগে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার আগে দরকার তার মূল ইতিহাসকে জানার। ঘটনার মূল গোড়াতে না পৌঁছে শুধু ডালপালা নিয়ে নাড়াচাড়া করলে ডাল ভেঙে হাত পা ভাঙার সমূহ সম্ভাবনাকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। তারা ইহকালে কোনো দিনও সফল হতে পারবে না। ধৈর্য ও সবরের আয়াতটি হচ্ছে : ‘তারাই শ্রেষ্ঠ যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করছে ও পরস্পরকে সততা অবলম্বনে উপদেশ দিচ্ছে এবং পরস্পরকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিচ্ছে’ (সূরা আল আসরের ৩ আয়াত)। ধৈর্যের মাধ্যমে জটিলকে মোকাবেলা করার আহ্বান জানিয়ে এখানেই শেষ করছি।
লেখক : প্রবাসী, গ্রন্থকার
No comments