সুনির্বাচন by মাহবুব তালুকদার
চাচা
বললেন, এবারের তিনটি সিটি করপোরেশনের মতো অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ
নির্বাচন আর কখনও হয়নি। নির্বাচনে সরকার, নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা
বাহিনী ও আওয়ামী লীগের সমন্বয় চমৎকার ছিল। বৃটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন
স্বয়ং নির্বাচন কেন্দ্রগুলোতে গিয়ে বলেছেন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। উনি তো সবসময়ই ভোকাল। সত্য কথা বলতে কখনো পিছপা হন না।
আমি বললাম, চাচা! আপনার কথা শুনে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। সকাল বেলা একজনকে দিয়ে বিটিভি ক্যামেরায় মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বক্তব্য রেকর্ড করা হলো। বাসায় ফেরার সময় দুপুর বেলা তাকে পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে। রাতে টিভিতে যখন তিনি বলছিলেন পাকিস্তানি সেনারা এদেশের মানুষের জান ও মাল রক্ষা করছে, তখন তার লাশ নর্দমায় পড়ে আছে।
চাচা জানালেন, তোমার এ কথার অর্থ কিছুই বুঝলাম না।
আমি বলতে চাইছি, সকাল বেলা রবার্ট গিবসন যখন ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনে যান, তখন হয়তো পরিবেশ শান্তই ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ভোটকেন্দ্রগুলোর কি অবস্থা, তা মিডিয়ার কল্যাণে নগরবাসীরা স্বচোখে দেখতে পেয়েছে।
নির্বাচনে সামান্য কিছু ঘটনা ঘটেই থাকে। সেটা তেমন কিছু নয়। এমন কি সেনাবাহিনী ডাকার মতো গুরুতর কোন ব্যাপার ছিল না। তাছাড়া, বিএনপি যে নির্বাচন বয়কট করবে তা আগেই জানা ছিল।
কি করে জানলেন?
ওরা নির্বাচনে জিততে পারবে না জেনেই প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছে। তুমি তো জানো, বিএনপি হারলে সবসময় কারচুপির কথা বলে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের অভিধানে কারচুপি শব্দটাই নেই।
বিএনপি যে অভিযোগ করেছে, তাদের পোলিং এজেন্টদের নির্বাচন কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি, তা কি মিথ্যা?
অবশ্যই মিথ্যা। তাদের কোন পোলিং এজেন্টই ছিল না। যারা পোলিং এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিল, তারা বিবেকের তাড়নায় আর ভোটকেন্দ্রে যায়নি।
কি এমন বিবেকের তাড়না?
ওদের পাড়ার মুরব্বিরা জানিয়ে দিয়েছিলেন হরতাল- অবরোধকারী ও নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে বিবেক বোধকে জাগিয়ে তোলার জন্য। তাদের বিবেক বোধ না জাগলে কি ভয়াবহ পরিণতি হবে, সেটাও বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিল। ফলে বিএনপি কোন পোলিং এজেন্টই পায়নি। যে কয়েকজনের বিবেক ছিল না, তাদের নাম সন্ত্রাসী হিসেবে পুলিশের ‘অজ্ঞাতনামা’ তালিকায় ছিল। পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছে।
চাচা! আওয়ামী লীগ তো ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিনটি সিটি করপোরেশনেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গেল।
না, না। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বলছো কেন? এবারের নির্বাচনে যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সরকারি প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের বেসরকারি প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। তবে বিএনপির নির্বাচন বর্জন ছিল পূর্বপরিকল্পিত।
আওয়ামী লীগের কারচুপিও পূর্বপরিকল্পিত বলে অভিযোগ আছে। অনেকগুলো কেন্দ্রে সাংবাদিকদের ঢুকতেও দেয়া হয়নি। অথচ টেলিভিশনে দেখা গেল যারা ভোটার নয়, তারাও লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। ঢাকার বাইরে থেকেও ভোট দিতে এসেছে অনেকে।
বহিরাগতদের ভোট দিতে দেয়ার বিষয়টার প্রতি আমি অবশ্যই নিন্দা করি। বিএনপির প্রার্থীরাই মূলত এটা করিয়েছে। আওয়ামী লীগের কি ভোট দেয়ার লোকের অভাব ছিল যে বাইরে থেকে লোক হায়ার করে আনতে হবে? নির্বাচন বিধিভঙ্গ করে বিএনপির প্রার্থীরা ভোট কিনতে টাকা পয়সা বিতরণ করেছে এবং পুলিশের কাছে আটক হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের কোন নেতাকর্মী এমন অপরাধের জন্য আটক হয়েছে বলে জানা নেই।
চাচা! বিএনপির অভিযোগ, পাঁচ শতাংশের বেশি ভোটার ভোট দিতে আসেনি। ব্যালট পেপারে একধারসে সিল মেরেছে ছাত্রলীগের ছেলেরা।
নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্যই তো এসব অভিযোগ। তবে ভোটের হার কি করে বাড়াতে হয়, নির্বাচন কমিশনের তা জানা আছে।
এ কথার অর্থ কি?
কিছু বলতে গিয়ে চাচা কথার মোড় ফিরিয়ে বললেন, মাননীয় সিইসির উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়েই নগরবাসীরা ভোট দিতে এসেছে। তিনি আহ্বান না জানালে ভোটের হার অনেক কম হতো। বিএনপির সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য নিরীহ নগরবাসী ভোটকেন্দ্রে আসতে ভয় পাচ্ছিল। সিইসি তাদের সেই ভয় ভাঙ্গিয়ে দিয়েছেন।
রাতে ভোট গণনার পর দেখা গেল তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা একচেটিয়াভাবে জিতে গেলেও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরাও প্রচুর ভোট পেয়েছে। চাচা অত্যন্ত উৎফুল্লস্বরে বললেন, দেখলে তো, যা বলেছিলাম তাই ঘটেছে।
আমি বললাম, চাচা! ভোটের ফলাফল দেখে আমি খুবই আতঙ্কিত।
তোমার আতঙ্কিত হওয়ার কারণ?
আপনার হয়তো মনে আছে, মাননীয় মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, আওয়ামী প্রার্থীকে যে করেই হোক জিততে হবে। বিএনপি প্রার্থী জিতে গেলে হরতাল, অবরোধ ও মানুষ পোড়ানোর রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে।
কথাটা মনে আছে। কিন্তু বিএনপির প্রার্থীরা তো সবাই হেরে গেছে।
আমি তাদের হেরে যাওয়ার কথা বলছি না। কিন্তু তাদের প্রার্থীদের লক্ষ লক্ষ ভোট পাওয়া দেখে আমি আতঙ্কিত। বিএনপির জ্বালাও পোড়াওয়ের পরে এত লোক তাদের প্রার্থীকে ভোট দিলো কিভাবে? এর অর্থ কি বিএনপির বিরুদ্ধে সরকারের প্রচারণা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ তেমন সুফল বয়ে আনতে পারেনি? লোকে নাশকতাকারীদের কেন ভোট দিল?
চাচা বললেন, যারা বিএনপিকে ভোট দিয়েছে তারা সবাই সন্ত্রাসী। ওদের কথা বাদ দাও। নির্বাচনের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের এই সাফল্যের জন্য তাকে নগরবাসীর তরফ থেকে একটা নাগরিক সংবর্ধনা দেয়া উচিত। কি বল?
এখন এটা করতে গেলে সবাই তার পক্ষপাতিত্বের বিষয়ে সন্দেহ করতে পারে। তার চেয়ে চুপ থাকাই ভালো।
কিন্তু আমাদের জাতীয় নির্বাচনটাও যতো শিগগিরই সম্ভব সেরে নেয়া উচিত। আওয়ামী লীগের পক্ষে এখন যে গণজোয়ার দেখা যাচ্ছে, তাতে জাতীয় নির্বাচন করতে আর দেরি করা উচিত নয়।
সেটা তো মধ্যবর্তী নির্বাচন হয়ে যাবে।
তাতে অসুবিধা কি? বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ ফুরাবার আগেই তা করে ফেলা দরকার। আচ্ছা, এই কমিশনকে কি আবার পাঁচ বছরের জন্য এক্সটেনশন দেয়া যায়?
আমি সেটা বলতে পারবো না। যারা আইনজ্ঞ বা বিশেষজ্ঞ তারা বলতে পারবেন। তবে আমি ভাবছি ভিন্ন কথা।
কি কথা, বলো।
যারা মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন, এখন থেকে তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করা অত্যন্ত জরুরি।
কথাটা তুমি কি বুঝে বলেছ? নাকি, না-বুঝে বলেছ?
বুঝেই বলেছি।
শোনো। ঢাকার মেয়রের নির্বাচন পরবর্তী বক্তৃতার জন্য আমি একটা খসড়া তৈরি করেছি। কি লিখেছি শোনো: ‘প্রিয় নগরবাসী, ঢাকা মহানগরীকে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য আমি আপনাদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, মহানগরীর জনগণের স্বার্থে আমি তা প্রত্যাহার করছি। এর কারণ নিশ্চয়ই আপনারা জানতে চাইবেন এবং আমি আপনাদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। ঢাকাকে অধিকতর বাসযোগ্য করা হলে কি বিপর্যয় হবে, আপনারা কি তা ভেবে দেখেছেন? আমার ব্যক্তিগত গবেষণায় আমি দেখেছি, ঢাকা অধিকতর বাসযোগ্য হলে দেশের অন্যান্য স্থান থেকে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ লোক ঢাকায় বসবাস করতে ছুটে আসবে। তাতে যে মানবিক বিপর্যয় ঘটে যাবে, সে বিষয়ে আপনারা একটিবার ভেবে দেখুন।
‘আপনারা যানজটমুক্ত ঢাকা চেয়েছেন। ঢাকা শহরের যানজট সমস্যার সমাধান হলে প্রতিদিন আশেপাশের এলাকা থেকে আরো অনেকগুণ বেশি যানবাহন ঢাকায় ঢুকে পড়বে। অধিকসংখ্যক যানবাহন এলে ঢাকার রাজপথে বিপর্যয় ডেকে আনা হবে যা নাগরিক স্বার্থের পরিপন্থি। আমি নগরবাসীর স্বার্থের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নিতে চাই না। এ অবস্থায় আপনারা আমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন, আমি আপনাদেরকে এসব প্রতিশ্রুতি কেন দিলাম? দিলাম এ জন্য যে, প্রতিশ্রুতি না দিলে আপনারা আমাকে ভোট দিতেন না। আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, আপনারা আমাকে ভোট দিয়েছেন। সুতরাং এই বিনিময় সমান সমান হয়েছে।’-চাচা থামলেন। বললেন, বাকিটুকু লেখা হয়নি।
আমি বললাম, চাচা! আপনি কি নবনির্বাচিত মেয়রদের জন্য এই বক্তৃতা লিখেছেন?
চাচা থতমত খেয়ে বললেন, ঠিক ওদের জন্য লিখিনি। কিন্তু আমার যে ভাগনে মেয়র পদে নির্বাচন করতে পারলো না, তার জন্য এটা অগ্রিম লিখতে শুরু করেছিলাম। তোমাকে তো বলেছি, আমার ভাগনে মনোয়ার ভুল করে তার নাম মনোয়ারা লেখায় নির্বাচন কমিশন তার প্রার্থিতা বাতিল করে দেয়। তারা মনোয়ারকে মনোয়ারা হিসেবে মানতে রাজি হয়নি। কি দুঃখজনক ব্যাপার!
আমি বললাম, চাচা! আপনার ভাগনে মেয়র নির্বাচিত হয়ে এ রকম বক্তৃতা দিলে আর রক্ষা ছিল না। তার প্রার্থিতা বাতিল হওয়ায় সে বেঁচে গেছে, আপনিও বেঁচে গেছেন।
আমাদের আলোচনার এক পর্যায়ে চাচি ঘরে ঢুকলেন। চাচাকে বললেন, তুমি কি আজ ভোট দিয়েছো?
না। চাচা জানালেন।
সে কি! আপনি ভোট দিতে যাননি? আমি সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
চাচা আমতা আমতা করে বললেন, গিয়েছিলাম। কিন্তু-
কিন্তু কি? চাচির প্রশ্ন।
আমার ভোটটা আগেই দেয়া হয়ে গিয়েছিল। আসলে আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো দরকার। নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার করা একান্ত প্রয়োজন।
কি ধরনের সংস্কার? চাচি জানতে চাইলেন।
আমার ব্যাপারটাই তুমি উদাহরণ হিসেবে ধরতে পারো। যিনি আমার হয়ে দয়া করে ভোটটি দিয়ে দিয়েছেন, তিনি যদি আমাকে এসএমএস করে জানাতেন যে, আমার ভোট দেয়া হয়ে গেছে, তাহলে আর আমাকে কষ্ট করে ভোটকেন্দ্রে যেতে হতো না।
কিন্তু তিনি আপনাকে জানাবেন কি করে? তার কাছে তো আপনার কোন টেলিফোন নম্বর নেই।
সে জন্যই তো আমি বলছি, ভোটার লিস্টে প্রত্যেকের নামের পাশে মোবাইল ফোন নম্বর থাকা প্রয়োজন। নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার করা হলে আমাকে আর ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার ভোগান্তিতে পড়তে হতো না। হতাশকণ্ঠে বললেন চাচা।
আমি বললাম, চাচা! আপনার কথা শুনে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। সকাল বেলা একজনকে দিয়ে বিটিভি ক্যামেরায় মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বক্তব্য রেকর্ড করা হলো। বাসায় ফেরার সময় দুপুর বেলা তাকে পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে। রাতে টিভিতে যখন তিনি বলছিলেন পাকিস্তানি সেনারা এদেশের মানুষের জান ও মাল রক্ষা করছে, তখন তার লাশ নর্দমায় পড়ে আছে।
চাচা জানালেন, তোমার এ কথার অর্থ কিছুই বুঝলাম না।
আমি বলতে চাইছি, সকাল বেলা রবার্ট গিবসন যখন ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনে যান, তখন হয়তো পরিবেশ শান্তই ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ভোটকেন্দ্রগুলোর কি অবস্থা, তা মিডিয়ার কল্যাণে নগরবাসীরা স্বচোখে দেখতে পেয়েছে।
নির্বাচনে সামান্য কিছু ঘটনা ঘটেই থাকে। সেটা তেমন কিছু নয়। এমন কি সেনাবাহিনী ডাকার মতো গুরুতর কোন ব্যাপার ছিল না। তাছাড়া, বিএনপি যে নির্বাচন বয়কট করবে তা আগেই জানা ছিল।
কি করে জানলেন?
ওরা নির্বাচনে জিততে পারবে না জেনেই প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছে। তুমি তো জানো, বিএনপি হারলে সবসময় কারচুপির কথা বলে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের অভিধানে কারচুপি শব্দটাই নেই।
বিএনপি যে অভিযোগ করেছে, তাদের পোলিং এজেন্টদের নির্বাচন কেন্দ্রে ঢুকতে দেয়া হয়নি, তা কি মিথ্যা?
অবশ্যই মিথ্যা। তাদের কোন পোলিং এজেন্টই ছিল না। যারা পোলিং এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিল, তারা বিবেকের তাড়নায় আর ভোটকেন্দ্রে যায়নি।
কি এমন বিবেকের তাড়না?
ওদের পাড়ার মুরব্বিরা জানিয়ে দিয়েছিলেন হরতাল- অবরোধকারী ও নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে বিবেক বোধকে জাগিয়ে তোলার জন্য। তাদের বিবেক বোধ না জাগলে কি ভয়াবহ পরিণতি হবে, সেটাও বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিল। ফলে বিএনপি কোন পোলিং এজেন্টই পায়নি। যে কয়েকজনের বিবেক ছিল না, তাদের নাম সন্ত্রাসী হিসেবে পুলিশের ‘অজ্ঞাতনামা’ তালিকায় ছিল। পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছে।
চাচা! আওয়ামী লীগ তো ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিনটি সিটি করপোরেশনেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গেল।
না, না। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বলছো কেন? এবারের নির্বাচনে যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সরকারি প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের বেসরকারি প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। তবে বিএনপির নির্বাচন বর্জন ছিল পূর্বপরিকল্পিত।
আওয়ামী লীগের কারচুপিও পূর্বপরিকল্পিত বলে অভিযোগ আছে। অনেকগুলো কেন্দ্রে সাংবাদিকদের ঢুকতেও দেয়া হয়নি। অথচ টেলিভিশনে দেখা গেল যারা ভোটার নয়, তারাও লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। ঢাকার বাইরে থেকেও ভোট দিতে এসেছে অনেকে।
বহিরাগতদের ভোট দিতে দেয়ার বিষয়টার প্রতি আমি অবশ্যই নিন্দা করি। বিএনপির প্রার্থীরাই মূলত এটা করিয়েছে। আওয়ামী লীগের কি ভোট দেয়ার লোকের অভাব ছিল যে বাইরে থেকে লোক হায়ার করে আনতে হবে? নির্বাচন বিধিভঙ্গ করে বিএনপির প্রার্থীরা ভোট কিনতে টাকা পয়সা বিতরণ করেছে এবং পুলিশের কাছে আটক হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের কোন নেতাকর্মী এমন অপরাধের জন্য আটক হয়েছে বলে জানা নেই।
চাচা! বিএনপির অভিযোগ, পাঁচ শতাংশের বেশি ভোটার ভোট দিতে আসেনি। ব্যালট পেপারে একধারসে সিল মেরেছে ছাত্রলীগের ছেলেরা।
নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্যই তো এসব অভিযোগ। তবে ভোটের হার কি করে বাড়াতে হয়, নির্বাচন কমিশনের তা জানা আছে।
এ কথার অর্থ কি?
কিছু বলতে গিয়ে চাচা কথার মোড় ফিরিয়ে বললেন, মাননীয় সিইসির উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়েই নগরবাসীরা ভোট দিতে এসেছে। তিনি আহ্বান না জানালে ভোটের হার অনেক কম হতো। বিএনপির সন্ত্রাসী কার্যকলাপের জন্য নিরীহ নগরবাসী ভোটকেন্দ্রে আসতে ভয় পাচ্ছিল। সিইসি তাদের সেই ভয় ভাঙ্গিয়ে দিয়েছেন।
রাতে ভোট গণনার পর দেখা গেল তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা একচেটিয়াভাবে জিতে গেলেও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরাও প্রচুর ভোট পেয়েছে। চাচা অত্যন্ত উৎফুল্লস্বরে বললেন, দেখলে তো, যা বলেছিলাম তাই ঘটেছে।
আমি বললাম, চাচা! ভোটের ফলাফল দেখে আমি খুবই আতঙ্কিত।
তোমার আতঙ্কিত হওয়ার কারণ?
আপনার হয়তো মনে আছে, মাননীয় মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, আওয়ামী প্রার্থীকে যে করেই হোক জিততে হবে। বিএনপি প্রার্থী জিতে গেলে হরতাল, অবরোধ ও মানুষ পোড়ানোর রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে।
কথাটা মনে আছে। কিন্তু বিএনপির প্রার্থীরা তো সবাই হেরে গেছে।
আমি তাদের হেরে যাওয়ার কথা বলছি না। কিন্তু তাদের প্রার্থীদের লক্ষ লক্ষ ভোট পাওয়া দেখে আমি আতঙ্কিত। বিএনপির জ্বালাও পোড়াওয়ের পরে এত লোক তাদের প্রার্থীকে ভোট দিলো কিভাবে? এর অর্থ কি বিএনপির বিরুদ্ধে সরকারের প্রচারণা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ তেমন সুফল বয়ে আনতে পারেনি? লোকে নাশকতাকারীদের কেন ভোট দিল?
চাচা বললেন, যারা বিএনপিকে ভোট দিয়েছে তারা সবাই সন্ত্রাসী। ওদের কথা বাদ দাও। নির্বাচনের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের এই সাফল্যের জন্য তাকে নগরবাসীর তরফ থেকে একটা নাগরিক সংবর্ধনা দেয়া উচিত। কি বল?
এখন এটা করতে গেলে সবাই তার পক্ষপাতিত্বের বিষয়ে সন্দেহ করতে পারে। তার চেয়ে চুপ থাকাই ভালো।
কিন্তু আমাদের জাতীয় নির্বাচনটাও যতো শিগগিরই সম্ভব সেরে নেয়া উচিত। আওয়ামী লীগের পক্ষে এখন যে গণজোয়ার দেখা যাচ্ছে, তাতে জাতীয় নির্বাচন করতে আর দেরি করা উচিত নয়।
সেটা তো মধ্যবর্তী নির্বাচন হয়ে যাবে।
তাতে অসুবিধা কি? বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ ফুরাবার আগেই তা করে ফেলা দরকার। আচ্ছা, এই কমিশনকে কি আবার পাঁচ বছরের জন্য এক্সটেনশন দেয়া যায়?
আমি সেটা বলতে পারবো না। যারা আইনজ্ঞ বা বিশেষজ্ঞ তারা বলতে পারবেন। তবে আমি ভাবছি ভিন্ন কথা।
কি কথা, বলো।
যারা মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন, এখন থেকে তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করা অত্যন্ত জরুরি।
কথাটা তুমি কি বুঝে বলেছ? নাকি, না-বুঝে বলেছ?
বুঝেই বলেছি।
শোনো। ঢাকার মেয়রের নির্বাচন পরবর্তী বক্তৃতার জন্য আমি একটা খসড়া তৈরি করেছি। কি লিখেছি শোনো: ‘প্রিয় নগরবাসী, ঢাকা মহানগরীকে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য আমি আপনাদের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, মহানগরীর জনগণের স্বার্থে আমি তা প্রত্যাহার করছি। এর কারণ নিশ্চয়ই আপনারা জানতে চাইবেন এবং আমি আপনাদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। ঢাকাকে অধিকতর বাসযোগ্য করা হলে কি বিপর্যয় হবে, আপনারা কি তা ভেবে দেখেছেন? আমার ব্যক্তিগত গবেষণায় আমি দেখেছি, ঢাকা অধিকতর বাসযোগ্য হলে দেশের অন্যান্য স্থান থেকে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ লোক ঢাকায় বসবাস করতে ছুটে আসবে। তাতে যে মানবিক বিপর্যয় ঘটে যাবে, সে বিষয়ে আপনারা একটিবার ভেবে দেখুন।
‘আপনারা যানজটমুক্ত ঢাকা চেয়েছেন। ঢাকা শহরের যানজট সমস্যার সমাধান হলে প্রতিদিন আশেপাশের এলাকা থেকে আরো অনেকগুণ বেশি যানবাহন ঢাকায় ঢুকে পড়বে। অধিকসংখ্যক যানবাহন এলে ঢাকার রাজপথে বিপর্যয় ডেকে আনা হবে যা নাগরিক স্বার্থের পরিপন্থি। আমি নগরবাসীর স্বার্থের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নিতে চাই না। এ অবস্থায় আপনারা আমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন, আমি আপনাদেরকে এসব প্রতিশ্রুতি কেন দিলাম? দিলাম এ জন্য যে, প্রতিশ্রুতি না দিলে আপনারা আমাকে ভোট দিতেন না। আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, আপনারা আমাকে ভোট দিয়েছেন। সুতরাং এই বিনিময় সমান সমান হয়েছে।’-চাচা থামলেন। বললেন, বাকিটুকু লেখা হয়নি।
আমি বললাম, চাচা! আপনি কি নবনির্বাচিত মেয়রদের জন্য এই বক্তৃতা লিখেছেন?
চাচা থতমত খেয়ে বললেন, ঠিক ওদের জন্য লিখিনি। কিন্তু আমার যে ভাগনে মেয়র পদে নির্বাচন করতে পারলো না, তার জন্য এটা অগ্রিম লিখতে শুরু করেছিলাম। তোমাকে তো বলেছি, আমার ভাগনে মনোয়ার ভুল করে তার নাম মনোয়ারা লেখায় নির্বাচন কমিশন তার প্রার্থিতা বাতিল করে দেয়। তারা মনোয়ারকে মনোয়ারা হিসেবে মানতে রাজি হয়নি। কি দুঃখজনক ব্যাপার!
আমি বললাম, চাচা! আপনার ভাগনে মেয়র নির্বাচিত হয়ে এ রকম বক্তৃতা দিলে আর রক্ষা ছিল না। তার প্রার্থিতা বাতিল হওয়ায় সে বেঁচে গেছে, আপনিও বেঁচে গেছেন।
আমাদের আলোচনার এক পর্যায়ে চাচি ঘরে ঢুকলেন। চাচাকে বললেন, তুমি কি আজ ভোট দিয়েছো?
না। চাচা জানালেন।
সে কি! আপনি ভোট দিতে যাননি? আমি সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
চাচা আমতা আমতা করে বললেন, গিয়েছিলাম। কিন্তু-
কিন্তু কি? চাচির প্রশ্ন।
আমার ভোটটা আগেই দেয়া হয়ে গিয়েছিল। আসলে আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো দরকার। নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার করা একান্ত প্রয়োজন।
কি ধরনের সংস্কার? চাচি জানতে চাইলেন।
আমার ব্যাপারটাই তুমি উদাহরণ হিসেবে ধরতে পারো। যিনি আমার হয়ে দয়া করে ভোটটি দিয়ে দিয়েছেন, তিনি যদি আমাকে এসএমএস করে জানাতেন যে, আমার ভোট দেয়া হয়ে গেছে, তাহলে আর আমাকে কষ্ট করে ভোটকেন্দ্রে যেতে হতো না।
কিন্তু তিনি আপনাকে জানাবেন কি করে? তার কাছে তো আপনার কোন টেলিফোন নম্বর নেই।
সে জন্যই তো আমি বলছি, ভোটার লিস্টে প্রত্যেকের নামের পাশে মোবাইল ফোন নম্বর থাকা প্রয়োজন। নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার করা হলে আমাকে আর ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার ভোগান্তিতে পড়তে হতো না। হতাশকণ্ঠে বললেন চাচা।
No comments