মিলিব্যান্ডকে ঘিরেই যেন ব্রিটেনের নির্বাচন! by কামাল আহমেদ
ব্রিটেনে
আজ যে নির্বাচন হচ্ছে, আমার দেখা গত চারটি নির্বাচনের মধ্যে তা নানা দিক
থেকে ব্যতিক্রমী। তবে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান তা হলো, এটি যতটা না
বিদায়ী ক্যামেরন সরকারের পুনর্নির্বাচনের প্রতিযোগিতা, তার চেয়ে অনেক বেশি
বিরোধী নেতা এড মিলিব্যান্ডকে ক্ষমতায় না আসতে দেওয়ার নির্বাচন। অবশ্য
এটুকু বললেও কম বলা হয়। বাস্তবে এই নির্বাচনের পুরোটাই হচ্ছে এড
মিলিব্যান্ডকে ঘিরে। নির্বাচনী প্রচারণার শুরু থেকেই নির্বাচনের ইস্যুগুলো
যেন ঠিক করছেন মিলিব্যান্ড। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা টিকিয়ে রাখা থেকে শুরু
করে বৃহৎ ব্যবসার কর ফাঁকি বন্ধের বিষয়গুলো ভোটারদের সামনে বড় করে তুলে
আনায় মি. মিলিব্যান্ডের সাফল্যে কনজারভেটিভ পার্টির প্রচারবিদেরা অনেকটাই
বেসামাল। শেষ পর্যন্ত তাই তাঁদের প্রচারকৌশলের মূল বিষয় হয়েছে মিলিব্যান্ড
সম্পর্কে একধরনের ভীতি ছড়িয়ে ভোট টানার চেষ্টা। এবারের নির্বাচনের
ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের পাল্লায় এরপর যুক্ত হয়েছে স্কটল্যান্ডের
জাতীয়তাবাদী দল স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির (এসএনপি) বিস্ময়কর উত্থানের
প্রসঙ্গ। স্কটিশ জাতীয়তাবাদীদের এই উত্থানকেও এখন ভীতি ছড়ানোর একটি
হাতিয়ারে পরিণত করেছেন মি. ক্যামেরন। তিনি সপ্তাহ খানেক ধরে ইংল্যান্ডের
নানা প্রান্ত চষে বেড়াচ্ছেন একটি মাত্র বার্তা নিয়ে যে ইংলিশরা যদি তাঁকে
নির্বাচিত না করেন, তাহলে এসএনপির সহায়তায় মিলিব্যান্ড সরকার গঠন করবেন এবং
তাতে করে স্কটিশদের হাতে যুক্তরাজ্য সরকার জিম্মি হয়ে পড়বে। যুক্তরাজ্যের
প্রধানমন্ত্রী তাঁর পদ ধরে রাখার জন্য স্কটিশদের বিরুদ্ধে ইংলিশ
জাতীয়তাবাদকে উসকে দেওয়ার এমন কৌশল এর আগে এভাবে দেখা যায়নি।
স্কটল্যান্ডে লেবার পার্টি ঐতিহাসিকভাবে শক্তিশালী। লিবারেল ডেমোক্র্যাটরাও সেখানে কিছুটা অবস্থান ধরে রেখেছে। আর কনজারভেটিভরা বরাবরই সেখানে দুর্বল। তবে স্বাধীনতার প্রশ্নে গত বছর অনুষ্ঠিত গণভোটের পর এসব অবস্থানে বড় ধরনের রূপান্তর ঘটেছে। গণভোটে স্বাধীনতার প্রস্তাব সামান্য ব্যবধানে পরাস্ত হলেও স্কটিশ জাতীয়তাবাদীদের নাটকীয় উত্থান ঘটেছে। ফলে সেখানে লেবার পার্টি এখন কয়েক ডজন আসন হারানোর পথে। কিন্তু তাতেও কনজারভেটিভদের কোনো সুবিধা হচ্ছে না এবং এসএনপি যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে লেবারকে সমর্থনের আভাস দিয়েছে। এসএনপির নীতি অনেকটাই বাম-ঘেঁষা এবং সে কারণে লেবার পার্টিকে সমর্থনের বিষয়টি তাদের পক্ষে যতটা সহজ, কনজারভেটিভদের ক্ষেত্রে তা ততটাই কঠিন। লিবারেল ডেমোক্র্যাটরাও শেষ দিকে এই ভীতি ছড়ানোর প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়ে বলতে আরম্ভ করে যে তারা যদি তৃতীয় দল হিসেবে আভির্ভূত না হয়, তাহলে দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিকে মধ্যপন্থায় ধরে রাখা সম্ভব হবে না। তাদের দাবি, এসএনপির সমর্থনে লেবার পার্টি সরকার গড়লে সেই সরকার বামপন্থার দিকে ঝুঁকবে, আর কনজারভেটিভরা ছোট ছোট ডানপন্থী দলের (ইউকিপ ও আলস্টার ইউনিয়নিস্ট পার্টি) সমর্থনে ক্ষমতায় এলে তারা আরও ডানপন্থার দিকে ঝুঁকবে।
২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দার সময় ব্রিটেনে যে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছিল, তার দায় নিয়ে লেবার পার্টিকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল ২০১০ সালে। এরপর মি. ক্যামেরন ও তাঁর জোট শরিক লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের নেতা নিক ক্লেগ পাঁচ বছর ধরে যে অর্থনৈতিক কৃচ্ছ্রনীতি অনুসরণ করেছেন, তার কষ্ট ও যাতনার সিংহভাগই সহ্য করতে হয়েছে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে। কৃচ্ছ্রনীতির কারণে পরিসংখ্যানের হিসাবে এই সময়ে অর্থনীতি অনেকটাই চাঙা হয়েছে। তবে ওই পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত মন্দার সময় ব্রিটেনের ধনীরা যতটা সম্পদের মালিক ছিলেন, তাঁদের সেসব সম্পদ এখন দ্বিগুণ অথবা তারও বেশি হয়েছে। বিপরীতে শ্রমজীবী মানুষের মজুরি গত বছর পর্যন্ত হয় একই জায়গায় আটকে ছিল, নয়তো সংকুচিত হয়েছে। এ বছরই প্রথম তাঁদের মজুরি কিছুটা বাড়তে শুরু করে। ফলে অর্থনীতিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব দাবি করেও তাঁরা খুব একটা হালে পানি পাচ্ছেন না।
এই নির্বাচনের ভোটারদের বিচার্য বিষয় বা ইস্যুগুলো বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রেও মিলিব্যান্ডের ভূমিকাই প্রাধান্য পেয়েছে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত স্বাস্থ্যসেবা খাতকে (ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস-এনএইচএস) বেসরকারীকরণের হাত থেকে রক্ষার বিষয়টি তিনি নির্বাচনে অগ্রাধিকারের বিষয় হিসেবে তুলে এনেছেন। এর জন্য বাড়তি যে টাকার প্রয়োজন হবে, সেটা ধনীদের করের হার বাড়ানো এবং বৃহৎ ব্যবসায়ীদের কর ফাঁকি বন্ধের মাধ্যমে পূরণের কথা বলেছেন। মি. ক্যামেরন বিষয়টি সম্পর্কে আগাম আভাস পেলেও তা মোকাবিলায় সফল হতে পারেননি। বরং তিনিও এনএইচএসকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে টাকা আসবে কোত্থেকে, তার হিসাবটা স্পষ্ট করতে পারেননি। একইভাবে মা-বাবাদের সহানুভূতি আদায়ের উদ্দেশ্যে শিশুকল্যাণ ভাতা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করে মিলিব্যান্ড অভিযোগ করেছিলেন যে মি. ক্যামেরনের পুনর্নির্বাচনের মানে দাঁড়াবে এসব ভাতা বন্ধ হওয়া। শেষতক মি. ক্যামেরনকেও অঙ্গীকার করতে হয়েছে যে তিনি শিশুকল্যাণ ভাতায় হাত দেবেন না।
এমনিতেই লেবার পার্টির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে দলটি ট্রেড ইউনিয়নের হাতে জিম্মি। কেননা, ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা দলটির তহবিল জোগান দেওয়ার পাশাপাশি তার নীতিকৌশল নির্ধারণে বড় ধরনের ভূমিকা রেখে থাকেন। বিপরীতে কনজারভেটিভ পার্টি ব্যবসাবান্ধব ও রক্ষণশীল জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষাকারী হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। অবশ্য দেখা গেছে যে উভয় দলই যখন আদর্শিক অবস্থান কিছুটা নমনীয় করে মধ্যপন্থা গ্রহণ করেছে, তখনই তারা নির্বাচনে সফল হয়েছে। এ ক্ষেত্রে টনি ব্লেয়ারের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। লেবার পার্টি যখন একের পর এক নির্বাচনে হেরেই চলছিল, তখন মি. ব্লেয়ার বামপন্থা থেকে অনেকটাই সরে গিয়ে নিউ লেবার নামে নতুন এক ধ্যানধারণা আমদানি করেন, যেটি ছিল ব্যবসাবান্ধব এবং কখনো কখনো শ্রমিকদের প্রতি বৈরী। ফলে সে সময়ে তিনি কট্টর ডানপন্থী পত্রিকা ডেইলি সান-এর কাছ থেকেও সমর্থন আদায়ে সক্ষম হন। তবে এবার উভয় দলই নমনীয়তার বদলে দৃঢ়তার পথ বেছে নিয়েছে। মিলিব্যান্ড জোর দিয়েছেন ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো, বৃহৎ ব্যবসার কর ফাঁকি বন্ধ, ধনীদের আয়কর বাড়ানো, বিলাসবহুল আবাসিক ভবনের (ম্যানসন ট্যাক্স) কর বৃদ্ধি, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ কমানোর মতো বিষয়গুলোতে। বিপরীতে, ক্যামেরন জোর দিয়েছেন ব্যবসাবান্ধব নীতিগুলোর দিকে। ক্যামেরন স্পষ্টতই জানান ট্যাক্সের বিরুদ্ধে।
এ ছাড়া এক নতুন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর আবির্ভাবের কারণে মি. ক্যামেরন এবার আরও বেশি করে ডানপন্থার দিকে ঝুঁকেছেন। এই নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন নাইজেল ফারাজ, যাঁর ইউনাইটেড কিংডম ইনডিপেনডেন্টস পার্টি (ইউকিপ) যুক্তরাজ্যকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের করে আনার পক্ষপাতী। গত পার্লামেন্ট ভেঙে যাওয়ার মাত্র কয়েক মাস আগে মি. ক্যামেরন তাঁর দলের দুজন এমপিকে হারান, যাঁরা দল ত্যাগ করে ইউকিপের হয়ে উপনির্বাচন করে কনজারভেটিভ পার্টিতে একধরনের অস্থিরতার জন্ম দিয়েছিলেন। সে কারণে এবারের নির্বাচনে মি. ক্যামেরন অঙ্গীকার করেছেন যে তিনি বিজয়ী হলে দুই বছরের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা না-থাকার বিষয়ে তিনি গণভোট অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করবেন। মি. মিলিব্যান্ড অবশ্য ওই ফাঁদে পা দেননি এবং বলে দিয়েছেন যে তিনি এ ধরনের কোনো গণভোটের প্রয়োজন দেখেন না। তিনি স্পষ্টতই ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষপাতী। ব্রিটেনের পত্রপত্রিকাগুলোও এই আদর্শিক অবস্থান অনুযায়ী ক্যামেরন ও মিলিব্যান্ডের প্রতি সমর্থনের কথা ঘোষণা করেছে। টেলিগ্রাফ, সান ও মেইল ক্যামেরনের প্রতি এবং গার্ডিয়ান ও মিরর মিলিব্যান্ডের প্রতি সমর্থন দিতে তাদের পাঠকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
মি. মিলিব্যান্ডের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষগুলো ধারণা করেছিল যে তিনি দলটির নেতৃত্বে বেশি দিন টিকবেন না। কিন্তু সে আশা পূরণ হওয়া তো দূরের কথা, কয়েক মাস ধরে তাঁর ভাবমূর্তি ক্রমশই উজ্জ্বল হয়েছে। গত ছয় মাসের জনমত জরিপগুলোর সব কটিতেই দেখা যাচ্ছে তাঁর নেতৃত্বে লেবার পার্টি কনজারভেটিভদের সঙ্গে সমানতালে পাল্লা দিচ্ছে। মিলিব্যান্ডের শত্রু অবশ্য মিলিব্যান্ড নিজেই। বিরোধী দলের নেতা হিসেবে তিনি গত পার্লামেন্টে অন্তত তিনটি বিষয়ে সরকারকে তাঁর নীতি অনুসরণে বাধ্য করেছিলেন। সিরিয়ায় যুদ্ধ করতে না যাওয়া, সরকার ও পুলিশের ওপর মিডিয়া সাম্রাজ্যের প্রধান রুপার্ট মারডকের প্রভাব ভেঙে দেওয়া এবং জ্বালানির বাজারে কয়েকটি কোম্পানির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটিয়ে সেখানে প্রতিযোগিতা বাড়ানো, যাতে ভোক্তারা উপকৃত হন। তবে বিরোধী নেতা হিসেবে তাঁর সাফল্যই বারবার তাঁর এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক পার্টি লেবার পার্টির আদর্শিক মিত্র হওয়া সত্ত্বেও সিরিয়া প্রশ্নে মিলিব্যান্ডের বিরোধিতার কারণে ওবামা প্রশাসন তাঁর প্রতি অনেকটাই নাখোশ। বৃহৎ জ্বালানি কোম্পানিগুলো তো বটেই, বড় ব্যবসায়ীরাও প্রকাশ্যে তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। সংবাদপত্রগুলোও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই।
এই নির্বাচনের আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। সেটি হলো সংবিধানের বিষয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অহরহ সংবিধান নিয়ে আলোচনা নতুন কোনো বিষয় নয়। কিন্তু ব্রিটেনে ভোটের আগে সংবিধানবিষয়ক আলোচনা অতীতে কখনো শুনিনি। এবার কোনো দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না বলে জনমত জরিপগুলোর যেসব ফল পাওয়া গেছে, তার পটভূমিতেই এখন চলছে সংবিধানের আলোচনা। পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও একক বৃহত্তম দল হিসেবে কোনো দল সরকার গঠনের সুযোগ পেতে পারে কি না, সেটি নিয়েই এ আলোচনা। এখানেও মি. মিলিব্যান্ডকে লক্ষ্য করে মি. ক্যামেরন বলেছেন যে ভোটের হিসাবে এবং পার্লামেন্টে আসনের দিক থেকে বৃহত্তম দল না হয়েও যদি কোনো সরকার গঠন করা হয়, তাহলে তার বৈধতা থাকবে না। অথচ সেই সম্ভাবনাই এখন প্রবল যে লেবার পার্টির আসনসংখ্যা কনজারভেটিভদের থেকে কিছুটা কম হলেও এসএনপি ও ছোট ছোট দলগুলোকে সরকারে না নিয়েই সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থার ভিত্তিতে মিলিব্যান্ড প্রধানমন্ত্রী হবেন।
এবারের ব্রিটিশ নির্বাচনে বাংলাদেশিদের আগ্রহের বিষয় অবশ্য রেকর্ডসংখ্যক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থীর অংশগ্রহণ এবং সাফল্যের সম্ভাবনায়। পাঁচজন নারী ও সাতজন পুরুষ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, যাঁদের বেশির ভাগই লড়ছেন লেবার পার্টি থেকে। এসব বাংলাদেশি-বংশোদ্ভূত প্রার্থীর মধ্যে যাঁদের জেতার সম্ভাবনা উজ্জ্বল তাঁরাও লেবার পার্টির এবং তাঁদের ভাগ্যের ওপর কিছুটা হলেও নির্ভর করছে মিলিব্যান্ডের ভবিষ্যৎ।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক, লন্ডন থেকে।
স্কটল্যান্ডে লেবার পার্টি ঐতিহাসিকভাবে শক্তিশালী। লিবারেল ডেমোক্র্যাটরাও সেখানে কিছুটা অবস্থান ধরে রেখেছে। আর কনজারভেটিভরা বরাবরই সেখানে দুর্বল। তবে স্বাধীনতার প্রশ্নে গত বছর অনুষ্ঠিত গণভোটের পর এসব অবস্থানে বড় ধরনের রূপান্তর ঘটেছে। গণভোটে স্বাধীনতার প্রস্তাব সামান্য ব্যবধানে পরাস্ত হলেও স্কটিশ জাতীয়তাবাদীদের নাটকীয় উত্থান ঘটেছে। ফলে সেখানে লেবার পার্টি এখন কয়েক ডজন আসন হারানোর পথে। কিন্তু তাতেও কনজারভেটিভদের কোনো সুবিধা হচ্ছে না এবং এসএনপি যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে লেবারকে সমর্থনের আভাস দিয়েছে। এসএনপির নীতি অনেকটাই বাম-ঘেঁষা এবং সে কারণে লেবার পার্টিকে সমর্থনের বিষয়টি তাদের পক্ষে যতটা সহজ, কনজারভেটিভদের ক্ষেত্রে তা ততটাই কঠিন। লিবারেল ডেমোক্র্যাটরাও শেষ দিকে এই ভীতি ছড়ানোর প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়ে বলতে আরম্ভ করে যে তারা যদি তৃতীয় দল হিসেবে আভির্ভূত না হয়, তাহলে দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিকে মধ্যপন্থায় ধরে রাখা সম্ভব হবে না। তাদের দাবি, এসএনপির সমর্থনে লেবার পার্টি সরকার গড়লে সেই সরকার বামপন্থার দিকে ঝুঁকবে, আর কনজারভেটিভরা ছোট ছোট ডানপন্থী দলের (ইউকিপ ও আলস্টার ইউনিয়নিস্ট পার্টি) সমর্থনে ক্ষমতায় এলে তারা আরও ডানপন্থার দিকে ঝুঁকবে।
২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দার সময় ব্রিটেনে যে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছিল, তার দায় নিয়ে লেবার পার্টিকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল ২০১০ সালে। এরপর মি. ক্যামেরন ও তাঁর জোট শরিক লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের নেতা নিক ক্লেগ পাঁচ বছর ধরে যে অর্থনৈতিক কৃচ্ছ্রনীতি অনুসরণ করেছেন, তার কষ্ট ও যাতনার সিংহভাগই সহ্য করতে হয়েছে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে। কৃচ্ছ্রনীতির কারণে পরিসংখ্যানের হিসাবে এই সময়ে অর্থনীতি অনেকটাই চাঙা হয়েছে। তবে ওই পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত মন্দার সময় ব্রিটেনের ধনীরা যতটা সম্পদের মালিক ছিলেন, তাঁদের সেসব সম্পদ এখন দ্বিগুণ অথবা তারও বেশি হয়েছে। বিপরীতে শ্রমজীবী মানুষের মজুরি গত বছর পর্যন্ত হয় একই জায়গায় আটকে ছিল, নয়তো সংকুচিত হয়েছে। এ বছরই প্রথম তাঁদের মজুরি কিছুটা বাড়তে শুরু করে। ফলে অর্থনীতিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব দাবি করেও তাঁরা খুব একটা হালে পানি পাচ্ছেন না।
এই নির্বাচনের ভোটারদের বিচার্য বিষয় বা ইস্যুগুলো বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রেও মিলিব্যান্ডের ভূমিকাই প্রাধান্য পেয়েছে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত স্বাস্থ্যসেবা খাতকে (ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস-এনএইচএস) বেসরকারীকরণের হাত থেকে রক্ষার বিষয়টি তিনি নির্বাচনে অগ্রাধিকারের বিষয় হিসেবে তুলে এনেছেন। এর জন্য বাড়তি যে টাকার প্রয়োজন হবে, সেটা ধনীদের করের হার বাড়ানো এবং বৃহৎ ব্যবসায়ীদের কর ফাঁকি বন্ধের মাধ্যমে পূরণের কথা বলেছেন। মি. ক্যামেরন বিষয়টি সম্পর্কে আগাম আভাস পেলেও তা মোকাবিলায় সফল হতে পারেননি। বরং তিনিও এনএইচএসকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে টাকা আসবে কোত্থেকে, তার হিসাবটা স্পষ্ট করতে পারেননি। একইভাবে মা-বাবাদের সহানুভূতি আদায়ের উদ্দেশ্যে শিশুকল্যাণ ভাতা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করে মিলিব্যান্ড অভিযোগ করেছিলেন যে মি. ক্যামেরনের পুনর্নির্বাচনের মানে দাঁড়াবে এসব ভাতা বন্ধ হওয়া। শেষতক মি. ক্যামেরনকেও অঙ্গীকার করতে হয়েছে যে তিনি শিশুকল্যাণ ভাতায় হাত দেবেন না।
এমনিতেই লেবার পার্টির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে দলটি ট্রেড ইউনিয়নের হাতে জিম্মি। কেননা, ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা দলটির তহবিল জোগান দেওয়ার পাশাপাশি তার নীতিকৌশল নির্ধারণে বড় ধরনের ভূমিকা রেখে থাকেন। বিপরীতে কনজারভেটিভ পার্টি ব্যবসাবান্ধব ও রক্ষণশীল জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষাকারী হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। অবশ্য দেখা গেছে যে উভয় দলই যখন আদর্শিক অবস্থান কিছুটা নমনীয় করে মধ্যপন্থা গ্রহণ করেছে, তখনই তারা নির্বাচনে সফল হয়েছে। এ ক্ষেত্রে টনি ব্লেয়ারের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। লেবার পার্টি যখন একের পর এক নির্বাচনে হেরেই চলছিল, তখন মি. ব্লেয়ার বামপন্থা থেকে অনেকটাই সরে গিয়ে নিউ লেবার নামে নতুন এক ধ্যানধারণা আমদানি করেন, যেটি ছিল ব্যবসাবান্ধব এবং কখনো কখনো শ্রমিকদের প্রতি বৈরী। ফলে সে সময়ে তিনি কট্টর ডানপন্থী পত্রিকা ডেইলি সান-এর কাছ থেকেও সমর্থন আদায়ে সক্ষম হন। তবে এবার উভয় দলই নমনীয়তার বদলে দৃঢ়তার পথ বেছে নিয়েছে। মিলিব্যান্ড জোর দিয়েছেন ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো, বৃহৎ ব্যবসার কর ফাঁকি বন্ধ, ধনীদের আয়কর বাড়ানো, বিলাসবহুল আবাসিক ভবনের (ম্যানসন ট্যাক্স) কর বৃদ্ধি, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ কমানোর মতো বিষয়গুলোতে। বিপরীতে, ক্যামেরন জোর দিয়েছেন ব্যবসাবান্ধব নীতিগুলোর দিকে। ক্যামেরন স্পষ্টতই জানান ট্যাক্সের বিরুদ্ধে।
এ ছাড়া এক নতুন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর আবির্ভাবের কারণে মি. ক্যামেরন এবার আরও বেশি করে ডানপন্থার দিকে ঝুঁকেছেন। এই নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন নাইজেল ফারাজ, যাঁর ইউনাইটেড কিংডম ইনডিপেনডেন্টস পার্টি (ইউকিপ) যুক্তরাজ্যকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বের করে আনার পক্ষপাতী। গত পার্লামেন্ট ভেঙে যাওয়ার মাত্র কয়েক মাস আগে মি. ক্যামেরন তাঁর দলের দুজন এমপিকে হারান, যাঁরা দল ত্যাগ করে ইউকিপের হয়ে উপনির্বাচন করে কনজারভেটিভ পার্টিতে একধরনের অস্থিরতার জন্ম দিয়েছিলেন। সে কারণে এবারের নির্বাচনে মি. ক্যামেরন অঙ্গীকার করেছেন যে তিনি বিজয়ী হলে দুই বছরের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা না-থাকার বিষয়ে তিনি গণভোট অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করবেন। মি. মিলিব্যান্ড অবশ্য ওই ফাঁদে পা দেননি এবং বলে দিয়েছেন যে তিনি এ ধরনের কোনো গণভোটের প্রয়োজন দেখেন না। তিনি স্পষ্টতই ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষপাতী। ব্রিটেনের পত্রপত্রিকাগুলোও এই আদর্শিক অবস্থান অনুযায়ী ক্যামেরন ও মিলিব্যান্ডের প্রতি সমর্থনের কথা ঘোষণা করেছে। টেলিগ্রাফ, সান ও মেইল ক্যামেরনের প্রতি এবং গার্ডিয়ান ও মিরর মিলিব্যান্ডের প্রতি সমর্থন দিতে তাদের পাঠকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
মি. মিলিব্যান্ডের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষগুলো ধারণা করেছিল যে তিনি দলটির নেতৃত্বে বেশি দিন টিকবেন না। কিন্তু সে আশা পূরণ হওয়া তো দূরের কথা, কয়েক মাস ধরে তাঁর ভাবমূর্তি ক্রমশই উজ্জ্বল হয়েছে। গত ছয় মাসের জনমত জরিপগুলোর সব কটিতেই দেখা যাচ্ছে তাঁর নেতৃত্বে লেবার পার্টি কনজারভেটিভদের সঙ্গে সমানতালে পাল্লা দিচ্ছে। মিলিব্যান্ডের শত্রু অবশ্য মিলিব্যান্ড নিজেই। বিরোধী দলের নেতা হিসেবে তিনি গত পার্লামেন্টে অন্তত তিনটি বিষয়ে সরকারকে তাঁর নীতি অনুসরণে বাধ্য করেছিলেন। সিরিয়ায় যুদ্ধ করতে না যাওয়া, সরকার ও পুলিশের ওপর মিডিয়া সাম্রাজ্যের প্রধান রুপার্ট মারডকের প্রভাব ভেঙে দেওয়া এবং জ্বালানির বাজারে কয়েকটি কোম্পানির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটিয়ে সেখানে প্রতিযোগিতা বাড়ানো, যাতে ভোক্তারা উপকৃত হন। তবে বিরোধী নেতা হিসেবে তাঁর সাফল্যই বারবার তাঁর এগিয়ে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক পার্টি লেবার পার্টির আদর্শিক মিত্র হওয়া সত্ত্বেও সিরিয়া প্রশ্নে মিলিব্যান্ডের বিরোধিতার কারণে ওবামা প্রশাসন তাঁর প্রতি অনেকটাই নাখোশ। বৃহৎ জ্বালানি কোম্পানিগুলো তো বটেই, বড় ব্যবসায়ীরাও প্রকাশ্যে তাঁর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। সংবাদপত্রগুলোও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই।
এই নির্বাচনের আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। সেটি হলো সংবিধানের বিষয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অহরহ সংবিধান নিয়ে আলোচনা নতুন কোনো বিষয় নয়। কিন্তু ব্রিটেনে ভোটের আগে সংবিধানবিষয়ক আলোচনা অতীতে কখনো শুনিনি। এবার কোনো দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না বলে জনমত জরিপগুলোর যেসব ফল পাওয়া গেছে, তার পটভূমিতেই এখন চলছে সংবিধানের আলোচনা। পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও একক বৃহত্তম দল হিসেবে কোনো দল সরকার গঠনের সুযোগ পেতে পারে কি না, সেটি নিয়েই এ আলোচনা। এখানেও মি. মিলিব্যান্ডকে লক্ষ্য করে মি. ক্যামেরন বলেছেন যে ভোটের হিসাবে এবং পার্লামেন্টে আসনের দিক থেকে বৃহত্তম দল না হয়েও যদি কোনো সরকার গঠন করা হয়, তাহলে তার বৈধতা থাকবে না। অথচ সেই সম্ভাবনাই এখন প্রবল যে লেবার পার্টির আসনসংখ্যা কনজারভেটিভদের থেকে কিছুটা কম হলেও এসএনপি ও ছোট ছোট দলগুলোকে সরকারে না নিয়েই সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থার ভিত্তিতে মিলিব্যান্ড প্রধানমন্ত্রী হবেন।
এবারের ব্রিটিশ নির্বাচনে বাংলাদেশিদের আগ্রহের বিষয় অবশ্য রেকর্ডসংখ্যক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থীর অংশগ্রহণ এবং সাফল্যের সম্ভাবনায়। পাঁচজন নারী ও সাতজন পুরুষ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, যাঁদের বেশির ভাগই লড়ছেন লেবার পার্টি থেকে। এসব বাংলাদেশি-বংশোদ্ভূত প্রার্থীর মধ্যে যাঁদের জেতার সম্ভাবনা উজ্জ্বল তাঁরাও লেবার পার্টির এবং তাঁদের ভাগ্যের ওপর কিছুটা হলেও নির্ভর করছে মিলিব্যান্ডের ভবিষ্যৎ।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক, লন্ডন থেকে।
No comments