নির্লিপ্ত নির্বাচন কমিশন by কাজী জেবেল
ভোটের দিন কারচুপি বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি * আমলে নেয়নি প্রার্থীদের অভিযোগ * তদন্ত রোধে তড়িঘড়ি গেজেট প্রকাশ...
তিন
সিটি নির্বাচনে ভোট কারচুপি, অনিয়ম ও জালিয়াতি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি
নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ভোটের দিন ও পরে নির্বাচনী অনিয়মের তথ্য-উপাত্তসহ
প্রার্থীদের অভিযোগও আমলে নেয়নি ইসি। উল্টো ফল প্রকাশের ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে
তড়িঘড়ি গেজেট প্রকাশ করে ওইসব তদন্তের সুযোগও বন্ধ করে দিয়েছে কমিশন। ফলে
দেশে ও বিদেশে সিটি নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচন
কমিশনের নির্লিপ্ততার সুযোগে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন নির্বাচন
বিশেষজ্ঞরা।
অভিযোগ উঠেছে, কেন্দ্র দখলকারীরা অনেক প্রিসাইডিং অফিসারকে জিম্মি করে তার রুমে বসেই ব্যালটে সিল মেরেছেন। বিষয়টি তাৎক্ষণিক সংশ্লিষ্ট সহকারী রিটার্নিং অফিসারকে ফোনে জানানো হয়েছে। ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। কিন্তু তারা ‘দেখি’, ‘দেখছি’, ‘পুলিশ-র্যাব আসছে’ এসব সান্ত্বনার কথা শুনিয়ে সময় পার করেছেন বলে অভিযোগ করেন বেশ কিছু প্রিসাইডিং অফিসার। মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা পাননি বলে অভিযোগ করেন একাধিক কর্মকর্তা।
এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ভোটগ্রহণের সময় যেসব অভিযোগ পেয়েছি সেগুলোর বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ভোট গণনার পর যেসব অভিযোগ এসেছে তা আমলে নেয়ার সুযোগ নেই। সুতরাং কমিশন কিছুই করেনি তা বলা যাবে না। তিনি বলেন, তড়িঘড়ি করে নয়, নিয়ম মেনেই গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিশৃংখলার কারণে তিনটি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বাতিল করেছি। ওই তিন কেন্দ্রের কারচুপির ঘটনায় কে দায়ী, কেন ওই পরিস্থিতির সৃষ্টি হল তা তদন্ত করে দেখা হবে। তিনি বলেন, প্রিসাইডিং অফিসারকে জিম্মি করে তার রুমে বসেই সিল মারার মতো ঘটনা সম্পর্কে ওই সময় লিখিত কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ না পেলে ব্যবস্থা নেয়া যায় না।
এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন বলেন, ভোটের দিনের ঘটনাগুলো আরও শক্তভাবে মোকাবেলা করলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। ভোটের দিন নির্বাচন কমিশনকে নির্লিপ্ত দেখেছি। ভোটগ্রহণের দিন অনেক অভিযোগ পাওয়া সত্ত্বেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেননি। সবকিছুই রিটার্নিং ও প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের দায়িত্ব বলে তাদের ওপর দায় চাপিয়ে দিলেন। এখানে কমিশন অনেক ভূমিকা রাখতে পারত। এ ধরনের পরিস্থিতিতে কী করা উচিত ছিল তার উদাহরণ অতীতে অনেক রয়েছে। সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজনে কমিশন যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেনি।
ভোটগ্রহণের আগের রাতে স্থানীয় প্রভাবশালী প্রার্থীর সমর্থক ও আত্মীয়-স্বজনরা কয়েকটি কেন্দ্রে জোর করে ঢুকে ব্যালটে সিল মেরে বক্সে ভরে রেখেছে বলে অভিযোগ আছে। বিষয়টি গোপন রাখতে তারা কর্মকর্তাদের হুমকিও দিয়েছে। ভোটগ্রহণের দিনেও তিন সিটির অনেক কেন্দ্রে ঢুকে সিল মারেন ক্ষমতাবান প্রার্থীর সমর্থক ও কর্মীরা। কেন্দ্রে অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা। ওই পরিস্থিতিতে দখলবাজদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েন ভোটগ্রহণ কর্মকর্তারা। তারা রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে এসব বিষয় জানিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি। আর নির্বাচন কর্মকর্তারা জানান, আইনশৃংখলা বাহিনী অসহযোগিতা এবং ক্ষমতাবানদের কেন্দ্র দখলের বিষয়টি তাৎক্ষণিক কমিশনকে জানানোর পরও কঠোর কোনো নির্দেশনা পাননি। এ কারণে তারাও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের ‘হাওয়া বুঝে চলার’ পরামর্শ দেন। চাকরির স্বার্থে কোনো কর্মকর্তা নাম প্রকাশ করে ভোটের দিনের ঘটনাগুলো বর্ণনা করতে চাননি।
তারা আরও বলেন, নিয়ম অনুযায়ী কোনো কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করা হলে তাৎক্ষণিক ওই কেন্দ্রে নিয়োজিত ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের পুলিশ পাহারায় নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কমলাপুর শেরে বাংলা রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয়, ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের সুরিটোলা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের জুরাইন আশ্রাফ মাস্টার আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণার পরও বিকাল পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উদ্ধার করেনি। ওই সময় পর্যন্ত হামলা আতংকে কর্মকর্তারা রুমের ভেতর দরজাবন্ধ করে বসে ছিলেন।
নির্বাচনে বিভিন্ন অনিয়মের তথ্য তুলে ধরে ভোটগ্রহণ চলাবস্থায় ২৮ এপ্রিল নির্বাচন কমিশন ও রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন ঢাকা উত্তরের বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল ও ঢাকা দক্ষিণের একই দলের মেয়র প্রার্থী মির্জা আব্বাসসহ বেশ কয়েকজন প্রার্থী। ওইসব অভিযোগে কোন কেন্দ্র কখন কীভাবে আক্রান্ত হয়েছে তাও উল্লেখ করা হয়েছিল। মির্জা আব্বাসের অভিযোগে বলা হয়, ঢাকা দক্ষিণের ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডে সিদ্দিক মিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কেন্দ্রে মির্জা আব্বাসের পোলিং এজেন্টদের সকাল ৯টায় কেন্দ্র থেকে মারধর করে বের করে দেয়া হয়। একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের ভাটারা মসজিদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সকাল সাড়ে ১০টায়, ২২ নম্বর ওয়ার্ডের তরুণ সংঘ স্কুলে সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে, ১০ নম্বর ওয়ার্ডের আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে সকাল ১০টায়, ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের শহীদ ফারুক সড়ক কেন্দ্রে সকাল সাড়ে ১০টায়। ভোটের পরদিন ২৯ এপ্রিল নির্বাচন কমিশন ও তিন সিটির রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে অন্তত অর্ধশত প্রার্থী নির্বাচনী অনিয়মের অভিযোগ তোলেন। এসব অভিযোগের নিষ্পত্তি না করে ৩০ এপ্রিল রাতেই গেজেট প্রকাশ করে ইসি। ওই গেজেট প্রকাশের মধ্য দিয়ে ওইসব অভিযোগ আমলে নেয়ার পথ ইসি নিজেই বন্ধ করে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হেনা বলেন, নির্বাচনে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হওয়ার পরও গেজেট প্রকাশের আগ পর্যন্ত কমিশন নির্বাচনী অনিয়মের তদন্ত করতে পারে। কিন্তু গেজেট প্রকাশ করায় অনিয়ম তদন্তের বিষয়ে কমিশনের কিছুই করার নেই। এখন সংক্ষুব্ধরা আদালতে যেতে পারেন। আদালতের রায়ের ওপর সবকিছু নির্ভর করছে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন বলেন, ভোটগ্রহণের পরও যেসব অভিযোগ এসেছে সেগুলো খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে পারত। কিন্তু কমিশন ওই অভিযোগ খতিয়ে না দেখেই নির্বাচনের গেজেট প্রকাশ করেছে। এ অবস্থায় ওই ঘটনা তদন্তের আর কোনো সুযোগ রইল না। কমিশনের কার্যক্রমের সমালোচনা করে সাবেক এ কমিশনার বলেন, সিইসি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে- এমন বক্তব্য দিয়ে নিজের নিরপেক্ষতা হারিয়েছেন।
নির্বাচনে বড় ধরনের অনিয়মের বিষয় অস্বীকার করে আসছেন ইসি। সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে দাবি করেছেন।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহ আলম সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ভোটগ্রহণ পরিস্থিতি আমার নিয়ন্ত্রণে ছিল। কেন্দ্র দখল বা অনিয়মের বিষয়ে আমার কাছে কোনো প্রিসাইডিং বা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা অভিযোগ করেননি। নির্বাচন পরিচালনায় আমি কোনো সমস্যার মুখেও পড়িনি। শান্তিপূর্ণভাবেই নির্বাচন সম্পন্ন করেছি।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, গেজেট প্রকাশের আগে ও পরে নির্বাচনে অনিয়মের বিষয়ে এ পর্যন্ত শতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে কমিশনে। এছাড়া নির্বাচনের দিন দায়িত্বে থাকা মেজিস্ট্রেটদের রিপোর্টেও ভোটগ্রহণে অনিয়মের তথ্য উঠে আসছে। এদিকে গেজেট প্রকাশের পর গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভোটগ্রহণের অনিয়ম সংক্রান্ত রিপোর্ট সংগ্রহ করছে কমিশন। কমিশনের কাছে কোন কোন কেন্দ্রের অনিয়ম ছিল, আর গণমাধ্যমে কোন কোন কেন্দ্রের অনিয়মের খবর বেরিয়েছে তা মিলিয়ে দেখতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
গেজেট প্রকাশের আগে নির্বাচন কমিশনে ৩০ এপ্রিল দিনে অভিযোগ করেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী মো. শফিকুল ইসলাম। ভোট কারচুপির প্রমাণস্বরূপ তিনি দুটি কেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের লিখিত বক্তব্য কমিশনে জমা দেন। লিখিত বক্তব্যে ৪৮ নম্বর কেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার আমিনুল ইসলাম উল্লেখ করেন- ৪৮ নম্বর ভোট কেন্দ্রে দুপুর ১টায় হঠাৎ কিছু লোক এসে আমার কাছ থেকে নীল রংয়ের বই কেড়ে নিয়ে সিল মারতে শুরু করে। আমি প্রিসাইডিং অফিসারকে এ ব্যাপারে জানাই এবং ব্যালট বাক্স সরিয়ে ফেলি। তারা বইয়ের ০০২৬১৫৭ থেকে ০০২২৬২০০ নম্বর ব্যালটে সিল মারে। তবে ব্যালট পেপারে আমার কোনো স্বাক্ষর ছিল না। নিরাপত্তার কারণে ভোটগ্রহণ আপাতত বন্ধ রাখি। অবস্থা অনুকূলে এলে পুনরায় শুরু করব। একই ধরনের লিখিত বক্তব্য দেন ৪৭ নম্বর কেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নাজনীন আরা।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক মহলের মতে, নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু থেকেই কমিশনকে নির্লিপ্ত দেখা গেছে। সিটি নির্বাচনে আচরণবিধির ১১টি ধারা সুষ্পষ্টভাবে লংঘন করে প্রচার চালিয়েছেন হেভিওয়েট প্রার্থীসহ খোদ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা। ক্ষমতা থাকার পরও বিধি অনুযায়ী আচরণবিধি লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়নি নির্বাচন কমিশন। শুধু সতর্ক নোটিশ জারি করে দায় সেরেছে। এছাড়া নির্বাচনী প্রচারে গেলে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে কয়েক দফায় হামলার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি কমিশন। তখন থেকেই সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে প্রার্থী ও ভোটারদের মধ্যে শংকা বদ্ধমূল হয়েছিল। নির্বাচন পর্যবেক্ষকেরা বলেন, আচরণবিধি লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়ার পরিণাম দেখা গেছে উপজেলা নির্বাচনে। ওই নির্বাচনের শেষ চার ধাপে যে হারে সহিংসতা হয়েছে তাতে ইসির ভাবমূর্তি দারুণভাবে নষ্ট হয়েছে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি সিটি নির্বাচনে ঘটেছে।
অভিযোগ উঠেছে, কেন্দ্র দখলকারীরা অনেক প্রিসাইডিং অফিসারকে জিম্মি করে তার রুমে বসেই ব্যালটে সিল মেরেছেন। বিষয়টি তাৎক্ষণিক সংশ্লিষ্ট সহকারী রিটার্নিং অফিসারকে ফোনে জানানো হয়েছে। ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। কিন্তু তারা ‘দেখি’, ‘দেখছি’, ‘পুলিশ-র্যাব আসছে’ এসব সান্ত্বনার কথা শুনিয়ে সময় পার করেছেন বলে অভিযোগ করেন বেশ কিছু প্রিসাইডিং অফিসার। মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা পাননি বলে অভিযোগ করেন একাধিক কর্মকর্তা।
এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ভোটগ্রহণের সময় যেসব অভিযোগ পেয়েছি সেগুলোর বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ভোট গণনার পর যেসব অভিযোগ এসেছে তা আমলে নেয়ার সুযোগ নেই। সুতরাং কমিশন কিছুই করেনি তা বলা যাবে না। তিনি বলেন, তড়িঘড়ি করে নয়, নিয়ম মেনেই গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিশৃংখলার কারণে তিনটি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বাতিল করেছি। ওই তিন কেন্দ্রের কারচুপির ঘটনায় কে দায়ী, কেন ওই পরিস্থিতির সৃষ্টি হল তা তদন্ত করে দেখা হবে। তিনি বলেন, প্রিসাইডিং অফিসারকে জিম্মি করে তার রুমে বসেই সিল মারার মতো ঘটনা সম্পর্কে ওই সময় লিখিত কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ না পেলে ব্যবস্থা নেয়া যায় না।
এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন বলেন, ভোটের দিনের ঘটনাগুলো আরও শক্তভাবে মোকাবেলা করলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। ভোটের দিন নির্বাচন কমিশনকে নির্লিপ্ত দেখেছি। ভোটগ্রহণের দিন অনেক অভিযোগ পাওয়া সত্ত্বেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেননি। সবকিছুই রিটার্নিং ও প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের দায়িত্ব বলে তাদের ওপর দায় চাপিয়ে দিলেন। এখানে কমিশন অনেক ভূমিকা রাখতে পারত। এ ধরনের পরিস্থিতিতে কী করা উচিত ছিল তার উদাহরণ অতীতে অনেক রয়েছে। সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজনে কমিশন যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেনি।
ভোটগ্রহণের আগের রাতে স্থানীয় প্রভাবশালী প্রার্থীর সমর্থক ও আত্মীয়-স্বজনরা কয়েকটি কেন্দ্রে জোর করে ঢুকে ব্যালটে সিল মেরে বক্সে ভরে রেখেছে বলে অভিযোগ আছে। বিষয়টি গোপন রাখতে তারা কর্মকর্তাদের হুমকিও দিয়েছে। ভোটগ্রহণের দিনেও তিন সিটির অনেক কেন্দ্রে ঢুকে সিল মারেন ক্ষমতাবান প্রার্থীর সমর্থক ও কর্মীরা। কেন্দ্রে অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা। ওই পরিস্থিতিতে দখলবাজদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েন ভোটগ্রহণ কর্মকর্তারা। তারা রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে এসব বিষয় জানিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি। আর নির্বাচন কর্মকর্তারা জানান, আইনশৃংখলা বাহিনী অসহযোগিতা এবং ক্ষমতাবানদের কেন্দ্র দখলের বিষয়টি তাৎক্ষণিক কমিশনকে জানানোর পরও কঠোর কোনো নির্দেশনা পাননি। এ কারণে তারাও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের ‘হাওয়া বুঝে চলার’ পরামর্শ দেন। চাকরির স্বার্থে কোনো কর্মকর্তা নাম প্রকাশ করে ভোটের দিনের ঘটনাগুলো বর্ণনা করতে চাননি।
তারা আরও বলেন, নিয়ম অনুযায়ী কোনো কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করা হলে তাৎক্ষণিক ওই কেন্দ্রে নিয়োজিত ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের পুলিশ পাহারায় নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কমলাপুর শেরে বাংলা রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয়, ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের সুরিটোলা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের জুরাইন আশ্রাফ মাস্টার আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণার পরও বিকাল পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উদ্ধার করেনি। ওই সময় পর্যন্ত হামলা আতংকে কর্মকর্তারা রুমের ভেতর দরজাবন্ধ করে বসে ছিলেন।
নির্বাচনে বিভিন্ন অনিয়মের তথ্য তুলে ধরে ভোটগ্রহণ চলাবস্থায় ২৮ এপ্রিল নির্বাচন কমিশন ও রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন ঢাকা উত্তরের বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল ও ঢাকা দক্ষিণের একই দলের মেয়র প্রার্থী মির্জা আব্বাসসহ বেশ কয়েকজন প্রার্থী। ওইসব অভিযোগে কোন কেন্দ্র কখন কীভাবে আক্রান্ত হয়েছে তাও উল্লেখ করা হয়েছিল। মির্জা আব্বাসের অভিযোগে বলা হয়, ঢাকা দক্ষিণের ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডে সিদ্দিক মিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কেন্দ্রে মির্জা আব্বাসের পোলিং এজেন্টদের সকাল ৯টায় কেন্দ্র থেকে মারধর করে বের করে দেয়া হয়। একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের ভাটারা মসজিদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সকাল সাড়ে ১০টায়, ২২ নম্বর ওয়ার্ডের তরুণ সংঘ স্কুলে সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে, ১০ নম্বর ওয়ার্ডের আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে সকাল ১০টায়, ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের শহীদ ফারুক সড়ক কেন্দ্রে সকাল সাড়ে ১০টায়। ভোটের পরদিন ২৯ এপ্রিল নির্বাচন কমিশন ও তিন সিটির রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে অন্তত অর্ধশত প্রার্থী নির্বাচনী অনিয়মের অভিযোগ তোলেন। এসব অভিযোগের নিষ্পত্তি না করে ৩০ এপ্রিল রাতেই গেজেট প্রকাশ করে ইসি। ওই গেজেট প্রকাশের মধ্য দিয়ে ওইসব অভিযোগ আমলে নেয়ার পথ ইসি নিজেই বন্ধ করে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হেনা বলেন, নির্বাচনে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হওয়ার পরও গেজেট প্রকাশের আগ পর্যন্ত কমিশন নির্বাচনী অনিয়মের তদন্ত করতে পারে। কিন্তু গেজেট প্রকাশ করায় অনিয়ম তদন্তের বিষয়ে কমিশনের কিছুই করার নেই। এখন সংক্ষুব্ধরা আদালতে যেতে পারেন। আদালতের রায়ের ওপর সবকিছু নির্ভর করছে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন বলেন, ভোটগ্রহণের পরও যেসব অভিযোগ এসেছে সেগুলো খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে পারত। কিন্তু কমিশন ওই অভিযোগ খতিয়ে না দেখেই নির্বাচনের গেজেট প্রকাশ করেছে। এ অবস্থায় ওই ঘটনা তদন্তের আর কোনো সুযোগ রইল না। কমিশনের কার্যক্রমের সমালোচনা করে সাবেক এ কমিশনার বলেন, সিইসি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে- এমন বক্তব্য দিয়ে নিজের নিরপেক্ষতা হারিয়েছেন।
নির্বাচনে বড় ধরনের অনিয়মের বিষয় অস্বীকার করে আসছেন ইসি। সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে দাবি করেছেন।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহ আলম সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ভোটগ্রহণ পরিস্থিতি আমার নিয়ন্ত্রণে ছিল। কেন্দ্র দখল বা অনিয়মের বিষয়ে আমার কাছে কোনো প্রিসাইডিং বা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা অভিযোগ করেননি। নির্বাচন পরিচালনায় আমি কোনো সমস্যার মুখেও পড়িনি। শান্তিপূর্ণভাবেই নির্বাচন সম্পন্ন করেছি।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, গেজেট প্রকাশের আগে ও পরে নির্বাচনে অনিয়মের বিষয়ে এ পর্যন্ত শতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে কমিশনে। এছাড়া নির্বাচনের দিন দায়িত্বে থাকা মেজিস্ট্রেটদের রিপোর্টেও ভোটগ্রহণে অনিয়মের তথ্য উঠে আসছে। এদিকে গেজেট প্রকাশের পর গণমাধ্যমে প্রকাশিত ভোটগ্রহণের অনিয়ম সংক্রান্ত রিপোর্ট সংগ্রহ করছে কমিশন। কমিশনের কাছে কোন কোন কেন্দ্রের অনিয়ম ছিল, আর গণমাধ্যমে কোন কোন কেন্দ্রের অনিয়মের খবর বেরিয়েছে তা মিলিয়ে দেখতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
গেজেট প্রকাশের আগে নির্বাচন কমিশনে ৩০ এপ্রিল দিনে অভিযোগ করেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী মো. শফিকুল ইসলাম। ভোট কারচুপির প্রমাণস্বরূপ তিনি দুটি কেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের লিখিত বক্তব্য কমিশনে জমা দেন। লিখিত বক্তব্যে ৪৮ নম্বর কেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার আমিনুল ইসলাম উল্লেখ করেন- ৪৮ নম্বর ভোট কেন্দ্রে দুপুর ১টায় হঠাৎ কিছু লোক এসে আমার কাছ থেকে নীল রংয়ের বই কেড়ে নিয়ে সিল মারতে শুরু করে। আমি প্রিসাইডিং অফিসারকে এ ব্যাপারে জানাই এবং ব্যালট বাক্স সরিয়ে ফেলি। তারা বইয়ের ০০২৬১৫৭ থেকে ০০২২৬২০০ নম্বর ব্যালটে সিল মারে। তবে ব্যালট পেপারে আমার কোনো স্বাক্ষর ছিল না। নিরাপত্তার কারণে ভোটগ্রহণ আপাতত বন্ধ রাখি। অবস্থা অনুকূলে এলে পুনরায় শুরু করব। একই ধরনের লিখিত বক্তব্য দেন ৪৭ নম্বর কেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নাজনীন আরা।
নির্বাচন পর্যবেক্ষক মহলের মতে, নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু থেকেই কমিশনকে নির্লিপ্ত দেখা গেছে। সিটি নির্বাচনে আচরণবিধির ১১টি ধারা সুষ্পষ্টভাবে লংঘন করে প্রচার চালিয়েছেন হেভিওয়েট প্রার্থীসহ খোদ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা। ক্ষমতা থাকার পরও বিধি অনুযায়ী আচরণবিধি লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়নি নির্বাচন কমিশন। শুধু সতর্ক নোটিশ জারি করে দায় সেরেছে। এছাড়া নির্বাচনী প্রচারে গেলে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে কয়েক দফায় হামলার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি কমিশন। তখন থেকেই সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে প্রার্থী ও ভোটারদের মধ্যে শংকা বদ্ধমূল হয়েছিল। নির্বাচন পর্যবেক্ষকেরা বলেন, আচরণবিধি লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়ার পরিণাম দেখা গেছে উপজেলা নির্বাচনে। ওই নির্বাচনের শেষ চার ধাপে যে হারে সহিংসতা হয়েছে তাতে ইসির ভাবমূর্তি দারুণভাবে নষ্ট হয়েছে। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি সিটি নির্বাচনে ঘটেছে।
No comments