‘হাসিনা-মুন সাক্ষাৎ ছিল ফটোসেশন’ by কাউসার মুমিন
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৯তম অধিবেশনে
যোগদান উপলক্ষে গত সপ্তাহে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিউ ইয়র্ক
সফরকালে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুনের সঙ্গে কোন দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিবের বৈঠক হয়েছে বলে যে
স্টিল ছবি ও ভিডিও ফুটেজ বাংলাদেশের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়
প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে তা ছিল মূলত জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে বাংলাদেশের
প্রধানমন্ত্রীর একটি ফটোসেশন, জাতিসংঘ কূটনীতির ভাষায় যাকে বলে ‘ফটো
অপর্চুনিটি।’ গতকাল মানবজমিনের এক প্রশ্নের জবাবে লিখিত বার্তায় এ তথ্য
জানিয়েছে জাতিসংঘ।
মহাসচিবের দিনের কর্মসূচি অনুযায়ী বিগত ২৭শে সেপ্টেম্বর শনিবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের জেনারেল ডিবেট (মূল ভাষণ) শুরুর আগে সকাল ৯টায় জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতে ঠিক কি কি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এবং এ বিষয়ে কোন রিডাউট (মিডিয়ার জন্য রেকর্ড) রয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে জাতিসংঘের এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চল বিষয়ক মুখপাত্র ম্যাথিয়াস লিন্ডারম্যান গতকাল এ প্রতিনিধিকে এক লিখিত বার্তায় বলেন, উল্লিখিত শিডিউল মোতাবেক জাতিসংঘ অধিবেশনের সাইডলাইনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিবের যে সাক্ষাৎটি হয়েছে তা এত অল্প সময়ের জন্য যে এই সাক্ষাতের কোন রিডাউট রেকর্ড আমাদের কাছে নেই। তিনি বলেন, সাধারণত অফিসিয়াল/দ্বিপক্ষীয় বৈঠক না হলে ওই বৈঠকের কোন রিডাউট থাকে না। এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের মুখপাত্র ম্যাথিয়াস লিন্ডারম্যান-এর ওই লিখিত বার্তা পাওয়ার পর এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে তাকে ফোন করা হলে লিন্ডারম্যান এই প্রতিনিধিকে জাতিসংঘ মহাসচিবের ডেপুটি স্পোকসপার্সন ফারহান হকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
পরে জাতিসংঘ মহাসচিবের ডেপুটি স্পোকসপার্সন ফারহান হক-এর নিকট এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল অপরাহ্ণে এ প্রতিনিধির নিকট এক লিখিত বার্তায় তিনি বলেন, ‘দিস ওয়াজ এ ফটো অপর্চুনিটি, দেয়ার ওয়াজ নো রিডাউট।’ অর্থাৎ ওই সাক্ষাৎটি ছিল প্রধানমন্ত্রী ও তার সিনিয়র ডেলিগেটদের সঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিবের একটি ফটোসেশন, এটা কোন অফিসিয়াল দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ছিল না। জাতিসংঘের প্রচলিত প্রথা মোতাবেক অধিবেশনে যোগদানকারী রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে ফটোসেশনের জন্য অনুরোধ জানাতে পারেন।
উল্লেখ্য, নিউ ইয়র্ক স্থানীয় সময় বিগত ২৭শে সেপ্টেম্বর শনিবার অপরাহ্ণে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুনের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সফরকারী মিডিয়া টিমকে ব্রিফ করেন। ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ‘বান কি-মুনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর মিটিং অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে হয়েছে।’ ওই ব্রিফিংয়ে তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের স্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকার প্রশংসা করেছেন বান কি-মুন। এভাবেই বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব বলেও মিডিয়াকে জানান ইকবাল সোবহান চৌধুরী। এই সংবাদ বাংলাদেশের সকল প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশ ও প্রচারের সময় জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও তার ডেলিগেশনের ফটোসেশনের স্টিল ছবি ও ভিডিও ফুটেজ ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া, ওইদিন বিকালে নিউ ইয়র্কের বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এবারের জাতিসংঘ অধিবেশন উপলক্ষে তার নিউ ইয়র্ক সফরে কি কি কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন সে বিষয়ে যে বিস্তর তালিকা মিডিয়ার সামনে তুলে ধরেন সেখানেও জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে তার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে বলে বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেন।
জাতিসংঘ কার্যক্রম গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এমন কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জাতিসংঘ অধিবেশন চলাকালে মহাসচিব স্বাভাবিক কারণেই সর্বোচ্চ ব্যস্ত থাকেন। এছাড়া, এবারের অধিবেশনে জাতিসংঘের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রাষ্ট্র/সরকার প্রধান অংশ নিয়েছেন। তাই মহাসচিবের ব্যস্ত শিডিউলের কারণে কোন একটি সদস্য রাষ্ট্রের সরকার প্রধানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক সম্ভব না-ও হতে পারে। এটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু দ্বিপক্ষীয় বৈঠক না করেই বাংলাদেশের মিডিয়ায় দেশটির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিবের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে বলে সরকারি প্রচারণায় অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন।
এদিকে জাতিসংঘ মহাসচিবের কার্যালয়, জাতিসংঘের মুখপাত্র অফিস, জাতিসংঘের রাজনৈতিক বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারির কার্যালয় এবং তার স্ট্র্যাটেজিক কম্যুনিকেশন বিষয়ক কর্মকর্তা হোসে লুইস দিয়াজের সঙ্গে গত ২৬শে সেপ্টেম্বর শুক্রবারই কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ বছর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিবের কোন দ্বিপক্ষীয় বৈঠক নেই। কিন্তু এরপরও সরকারি তরফে কেন বৈঠক হয়েছে বলে প্রচার করা হলো- এ বিষয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধানে জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের একটি প্রশাসনিক সূত্র জানিয়েছে, পর পর বেশ কয়েকবার বাংলাদেশের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সাক্ষাতে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুন বাংলাদেশে সংসদ ও সংসদের বাইরের বিরোধী দলের সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপের তাগাদা দিয়েছেন সরকারকে। এমনকি এ বছর জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তির ৪০ বছরপূর্তি উপলক্ষে মহাসচিবের প্রদত্ত বাণীতেও রাজনৈতিক সংলাপের আহ্বান রয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এই মুহূর্তে মহাসচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে মহাসচিব যদি আবারও রাজনৈতিক সংলাপের তাগাদা দেন তাহলে বিষয়টি দেশে প্রধান বিরোধী দলের হাতে একটি রাজনৈতিক অস্ত্র তুলে দেয়ার মতো হবে, যা সরকারের জন্য দেশে ও বিদেশে ইমেজ সঙ্কট আরও প্রকট করে তুলবে। আবার মহাসচিবের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ছাড়া দেশে ফিরে গেলে জাতিসংঘের কাছে হাসিনা সরকার পাত্তা পাচ্ছে না বলে বিরোধী দলের সমালোচনার মুখে পড়তে পারে সরকার। এইসব নানা দিক ভেবে উভয় কুল বিবেচনা করে শেষ পর্যন্ত ফটোসেশনের ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দিয়ে কল্পিত হাসিনা-বান কি-মুন দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের গল্প ফেঁদেছে সরকার বলে মনে করছেন অনেকেই।
No comments