দুর্গাপূজায় রাষ্ট্রীয় ভাবনা by স্বামী জ্ঞানপ্রকাশানন্দ
বৈদিক সূত্রে দেবী বলেছেন- “অহং রাষ্ট্রী” অর্থাৎ আমি বিশ্ব সমাজের অধীশ্বরী । এই বিশ্ব সমাজ বলতে কি বোঝায়? আর অধীশ্বরী বলতেই বা কি বোঝায়?
আমরা জানি আধুনিক বিশ্বের মূল স্তম্ভ মানুষ। মানুষ সাধারণত বাস করে গৃহে। পিতা-মাতা, ভ্রাতা-ভগ্নি এদের নিয়ে একটি পরিবার। এরূপ কয়েকটি পরিবার নিয়ে একটি বাড়ি, কতকগুলো বাড়ির সমষ্টিতে একটি পাড়া। কিছু সংখ্যক পাড়া মিলে একটি গ্রাম। কতগুলো গ্রাম নিয়ে একটি ইউনিয়ন। কতগুলো ইউনিয়ন নিয়ে থানা বা উপজেলা। এভাবে কয়েকটি উপজেলার সমষ্টি জেলা। কয়েকটি জেলার সমষ্টি বিভাগ। কয়েকটি বিভাগের সমষ্টি প্রদেশ। কয়েকটি প্রদেশ নিয়ে একটি দেশ। কয়েকটি দেশ মিলে মহাদেশ। বিশ্ব কয়েকটি মহাদেশের সমষ্টি।
সমাজ হলো পরস্পর সহযোগিতা ও সহানুভূতির সঙ্গে বসবাসকারী মানবগোষ্ঠী। যাকে বলা যায় মানব সমাজ। যেখানে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ বাস করে। এদের মধ্যে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র, কালো-ধলো, নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-যুবা-শিশু বিভিন্ন প্রকার মানুষ। এরা সকলেই মানব সমাজের মধ্যে পড়ে। এককথায় যারা সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করে তারাই সমাজিক।
আর বিশ্বসমাজ হলো- বিশ্বের অন্তর্গত জীব-জগৎ-গাছপালা প্রাণী সকল। প্রাণীজগতে পশু, পাখি, কীট-পতঙ্গ, এদেরও আলাদা আলাদা সমাজ রয়েছে। এক পর্যায়ে বৃক্ষরাজি, উদ্ভিদ, জলজ অ-জলজ সবই এক প্রকার প্রাণিসম্পদ বলা যায়। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন গাছেরও প্রাণ আছে।
এবারে দেখবো অধীশ্বরী বলতে কি বোঝায়? ব্যাকরণগতভাবে দেখা যায় অধি+ঈশ্বর এর সাথে স্ত্রী লিঙ্গে ‘ঈ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে হয় অধীশ্বরী। অর্থাৎ মালিক বা অধিপতি বা সম্রাজ্ঞী। এ শুধু আমরা জাগতিক অর্থেই ব্যবহার করি। একটি রাষ্ট্রে যে সব মানুষ বসবাস করে, রাজা যেমন তাদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের নিরাপদ আশ্রয়ের লক্ষ্য রাখেন তেমনি প্রাণিজগৎ, বৃক্ষরাজি, নদ-নদী এসবেরও ভাল-মন্দ লক্ষ্য রাখেন দেশের রাজা বা রাণী। এসব আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন দেশের বা রাষ্ট্রের পরিচালকদের দেখে থাকি। আর বিশ্ব সমাজের অধিপতি অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা তার থেকে জীব-জগৎ উৎপন্ন হয়ে তাতেই লয় হচ্ছে। আমরা অনেক সময় বলি প্রকৃতির খেলা। এই প্রকৃতির নিয়ন্তা তিনি। বিভিন্ন নামে আমরা সম্বোধন করি। ঈশ্বর বা ঈশ্বরী বা দুর্গা বা গড, আল্লাহ ইত্যাদি এসব একই সৃষ্টিকর্তার বিভিন্ন নাম মাত্র। তিনি দেবীরূপে, মাতারূপে, শক্তিরূপে, জ্ঞানরূপে সব কিছুতেই বর্তমান। তাই তিনি বিশ্ব সমাজের অধিষ্ঠাত্রী বা অধীশ্বরী।
আমরা দুর্গা পূজার কাঠামোতে দেখছি মা দুর্গা, তার দু’কন্যা অর্থাৎ লক্ষ্মী-সরস্বতী, দু’পুত্র কার্ত্তিক-গণেশ এদের নিয়ে যেন পিত্রালয়ে বেড়াতে এসেছেন। পুত্র-কন্যা নিয়ে মা তার বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসেন, এটি আমাদের বাঙালির সমাজ জীবনের একটি প্রতিচ্ছবি। তাই দুর্গাপূজা বাঙালিদের মধ্যেই বেশি প্রচলিত। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতি আনন্দে মেতে ওঠে। এ উৎসবে যোগদান করেন হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ খৃস্টান সকলে। এতে থাকে না কোন জাতি-ধর্ম-বর্ণ ভেদ। বর্তমানে এটি বাঙালির জাতীয় উৎসব।
দুর্গাপূজার কাঠামোতে দেখা যায় দেবী দুর্গা একা নন। তার শক্তি হিসেবে চার শক্তি সঙ্গে নিয়ে আসেন। চারটি বিশেষ শক্তি হলো- জ্ঞান-শক্তি, ধন-শক্তি, বীর্য-শক্তি, জন-শক্তি। একটি রাষ্ট্রেরও এই চারটি শক্তি থাকা প্রয়োজন। না হলে সে রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। তাই শ্রীশ্রী দুর্গাপূজার এই সামগ্রিক রূপটিই প্রকৃত রাষ্ট্রীয় জ্ঞান। বস্তুত দুর্গাপ্রতিমাই জাতীয় প্রতিমা। দুর্গাপূজার চিত্রে আমরা দেখতে পাই দেবী দুর্গা মাতারূপে মধ্যমণি। তার দক্ষিণে লক্ষ্মী দেবী ধনশক্তি বা বৈশ্যশক্তি ও গণেশ অর্থাৎ গণশক্তি ও শ্রমশক্তি বা শূদ্র। আর বামদিকে সরস্বতী দেবী অর্থাৎ জ্ঞানশক্তির বা ব্রাহ্মণ্যশক্তি এবং কার্ত্তিক ক্ষাত্র-বীর্যের অর্থাৎ পরাক্রমশালী শক্তির প্রতীক।
দেবীদুর্গাকে রাষ্ট্র কল্পনায় দেখা যায়। রাষ্ট্র চালাতে জ্ঞানের প্রয়োজন। অর্থের প্রয়োজন । দেশ রক্ষার জন্য সেনাবাহিনীর প্রয়োজন। দেশের উৎপাদনের জন্য শ্রমশক্তি অর্থাৎ জনগণের প্রয়োজন। জনগণ ছাড়া দেশ হয় না।
লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্ত্তিক-গণেশ এ যেন সনাতন ধর্মের চারটি বর্ণের প্রতীক। ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়, বৈশ্য-শূদ্র। ব্রাহ্মণ যিনি জ্ঞান দান করেন অর্থাৎ শিক্ষাপ্রদান করেন। ক্ষত্রিয় দেশ রক্ষা করেন । বৈশ্য যারা ব্যবসা করেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উৎপাদিত দ্রবাদির সরবরাহ এবং যোগান এর সামাঞ্জস্য বিধান করে জনসাধারণের প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অভাব পূরণ করেন। আর এসব খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন করে শ্রমিক বা শূদ্রগণ। এরা মাথার ঘাম পায়ে না ফেললে উৎপাদন বন্ধ। উৎপাদন বন্ধ হলে সমাজের লোকদের না খেয়ে মরতে হবে। এ সব কারণে এরা একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একটি ব্যতীত অপরটি চলতে পারে না। তাই গুণ ও কর্ম অনুসারে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রীয়-বশ্য-শূদ্র এদের সকলের সমান গুরুত্ব।
কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের অজ্ঞতার কারণে আমরা ব্রাহ্মণকে বলি উঁচু বা শ্রেষ্ঠ বর্ণ আর শূদ্রকে বলি নিম্ন বর্ণের বা ছোট জাত। অথচ কেউই ছোট বা অবহেলার নয়। একটি গল্পের মাধ্যমে সহজেই অনুধাবন করা যাবে। একদা একটি কুকুর একটি খরগোশকে তাড়া করছিল। খরগোশ লাফাতে লাফাতে তার বাসস্থান গর্তে প্রবেশ করলো। তারপর নিজে নিজে তার দেহের অঙ্গগুলিকে প্রশ্ন করতে লাগলো। হে কান! আমার বিপদে তুমি কি সাহায্য করছিলে? নিজেই উত্তর দিচ্ছে- হ্যাঁ তুমি শ্রবণে সাহায্য করেছিলে। তোমাকে ধন্যবাদ। হে চোখ, তুমি কি সাহায্য করছিলে? হ্যাঁ তুমি পথ দেখাতে সাহায্য করছিলে। তোমাকেও ধন্যবাদ। পা-তোমরা? হ্যাঁ, তোমরা দৌড়াতে সাহায্য করছিলে নতুবা মরেই যেতাম। এবার লেজ বলো তুমি? না, তুমি তো কোন সাহায্য করোনি। কাজেই তুমি মবঃ ড়ঁঃ । বের হও! বের হও! বলতে বলতে নিজের লেজ নিজেই বাইরে ঠেলে দিলো। আর যায় কোথা? গর্তের মুখে ওত পেতে থাকা কুকুর সঙ্গে সঙ্গে খরগোশের লেজ ধরে খরগোশটিকেই মেরে ফেলেছে। তাই লেজ অকেজো মনে হলেও এটি যে দেহের অঙ্গ তা মনে রাখতে হবে। নতুবা ভুলে গেলেই সর্বনাশ। তদ্রূপ আমাদের সমাজের গুণ ও কর্ম অনুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এদের কেউই ছোট বা অবহেলার নয়। যে কোন একটিকে অবহেলা করলেই পুরো সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সমাজ ধ্বংস হবে।
একটি রাষ্ট্রে শুধুমাত্র মানুষই বাস করে না। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য পশু-পাখি, সরীসৃপ জাতীয় সব ধরনের প্রাণী সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি করেছেন। আজকের যুগে পশু, পাখি নিধন করে বিশ্বের সর্বত্রই একটা না একটা অনাসৃষ্টি চলছে। জাতিসংঘ নিয়ম-কানুন করেও যেন প্রতিরোধ করতে পারছে না।
একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে- শ্রীশ্রী দুর্গাদেবীর বাহন পশুরাজ সিংহ। লক্ষ্মীদেবীর বাহন পেঁচা, সরস্বতী দেবীর বাহন রাজহংস, কার্তিকের ময়ূর এবং গণেশের বাহন ছোট্ট ইঁদুর। আপাত অসামঞ্জস্য পশু-পাখি দেবদেবীর বাহন মানব মনে অনেক খটকা লাগে। তবে একটু বিশ্লেষণ করলে সহজেই বোঝা যাবে। একটি রাষ্ট্রে শুধু মানবই বসবাস করে না। জীব-জন্তুও বাস করে। তাই সিংহ, ইঁদুর এগুলো পশু জগতের প্রতীক। রাজহংস, ময়ূর, পেঁচা এগুলো পাখি জগতের প্রতীক।
দেবী দুর্গার বাহন হিসেবে সিংহকে বাছাই করার একটি বিশেষ কারণ হয়তো অসুর তার রূপ পরিবর্তন করে কখনও পশু রূপে আবির্ভূত হতো। তাই যুদ্ধক্ষেত্রে সে মহিষরূপে অবতীর্ণ। মানবের সঙ্গে মানবের যেমন যুদ্ধ তেমনি পশুর সঙ্গে পশুর যুদ্ধই স্বাভাবিক। এ কারণেই হয়তো মহিষের সঙ্গে যুদ্ধ করতে সিংহের প্রয়োজন। আর সিংহ পশুগণের মধ্যে শক্তিশালী তাই দেবী দুর্গা বাহন হিসেবে সিংহকে বেছে নিয়েছেন। আধুনিক প্রাণীবিদগণ বলেন- সিংহ এতই শক্তিশালী যে, এক থাবাতেই মহিষকে কুপোকাত করতে পারে।
দেবী সরস্বতীর বাহন রাজহংস। রাজহংস জল আর দুধ মিশ্রিত থাকলে তা থেকে দুধটুকু খাবে জল ত্যাগ করবে। সংসারে সার অসার দু’টিই আছে। জ্ঞানী সারটুকু নেবে সংসার থেকে, অসারটুকু পরিত্যাগ করবে। হংস জলে থাকে কিন্তু তার গায়ে জল লাগে না। পরমহংস শ্রেণীর সাধকেরা কিন্তু সাংসারিক কলুষতার মধ্যে প্রবেশ করে না। রাজহংস সংসারের মানবকে সারবস্তু গ্রহণে উদ্বোধিত করে। এজন্য বীণাদেবীর বাহন রাজহংস। সরস্বতীর গায়ের রঙ শুভ্র। হংসও শুভ্র। সরস্বতী দেবী জ্ঞানের দেবী। জ্ঞানও জ্যোতির্ময় কোথাও কালিমা নেই। তাই সরস্বতী বাহন হিসেবে রাজহংসকেই বেছে নিয়েছেন।
দেব সেনাপতি কার্ত্তিক শৌর্য-বীর্যে প্রবল পরাক্রম ক্ষত্রিয় শক্তির প্রতীক। দেবতারা যখন অসুরদের দ্বারা পরাজিত হয়ে স্বর্গরাজ্য ছেড়ে মর্তে এলেন- সেই স্বর্গরাজ্য উদ্ধার করেন কার্ত্তিক তার প্রবল যুদ্ধ পরাক্রম দ্বারা। কার্ত্তিক সেনাপতি, যোদ্ধা। এই কার্ত্তিক অন্যান্য পশু-পাখি বাহন না করে ময়ূরকে কেন বেছে নিলেন? সেক্ষেত্রে মনে হয় ময়ূরের মধ্যে চারটি খুব সুন্দর গুণ যা কাত্তির্কের ক্ষত্রিয় হিসেবে গ্রহণযোগ্য।
যুদ্ধ ক্ষত্রিয়ের প্রধান বৃত্তি। শত্রু জয় তার স্বধর্ম। ময়ূরের যখন সর্পের সঙ্গে যুদ্ধ হয় সে কৌশল দেখার মতো। নখ ও ঠোঁট ময়ূরের অস্ত্র। পুচ্ছ হলো তার ঢাল। পাখা দ্বারা বর্মের ন্যায় শত্রুর আঘাত প্রতিহত করে। নখ ও চঞ্চু দ্বারা তাকে মেরে ফেলে। ২. ময়ূর অনলস। ব্রহ্ম মুহূর্তে সে জনগণকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। সে অতন্দ্র-প্রহরী, সতর্ক। একজন যোদ্ধা সে-ও ব্রাহ্মমুহূর্তে ঘুম থেকে জেগে তার যুদ্ধ বিদ্যা অনুশীলন করে। ৩. ময়ূর বিচরণ করে দল বেঁধে, একাকি নয়। খাবার খাদ্যও সকলকে নিয়ে খায়। সহভোজন। ক্ষত্রিয়রাও সমবণ্টন করে তাদের খাদ্যগুলোকে। সামাজিক ও রাষ্ট্রিক সমঅধিকার দান করে। ৪. ক্ষত্রিয় আপদগতা স্ত্রীকে রক্ষা করে। ময়ূর তার স্ত্রীকে রক্ষা করে। ক্ষত্রিয়ের কর্ম ও ময়ূরের কর্মে অনেক সামাঞ্জস্য দেখা যায়। তাই মনে হয় এসব কারণেই কার্ত্তিকের পছন্দ পাখিদের মধ্যে ময়ূরকে।
গণেশ জনগণের প্রতিনিধি। শ্রমের প্রতীক। শূদ্রের প্রতীক। আমরা দেখেছি গণেশের মাথাটি হাতির। তার বাহন ছোট মুষিক। মনে হয় এতবড় হাতির মাথাওয়ালা গণেশের ছোট মূষিক বাহন হলো কি করে? লক্ষ্য করার বিষয় সমাজের যারা বড়, সকলেই সাধারণ জনগণের ওপর নির্ভর করেই বড় হন। আবার গণেশের মাথাটি হাতির হলেও তার কান, চোখ, মুখাবয়ব ছোট মূষিকের সঙ্গে যেন মিলে যায়। হাতি পশু হিসেবে বড় জাতের হলেও জাতভাই ছোট মূষিককে ত্যাগ করে না। আবার দেখা যায় ইঁদুরের দু’টি দাঁত খুবই ধারালো। এই ধারালো দাঁত দিয়ে মোটা রশির জালও ছেদন করতে পারে। তেমনি মানবের দু’টি দাঁত যেন বিবেক এবং বৈরাগ্য। এই বিবেক বৈরাগ্যরূপ দাঁত দিয়ে সংসার বন্ধন ছেদন করে মানব মুক্তি লাভ করতে পারে। এসব কারণেই গণেশের পছন্দ তার বাহন এই ছোট মূষিক বা ইঁদুর।
লক্ষ্মীদেবীর বাহন পেঁচক। পেঁচক দিনে অন্ধ-রাতে দেখে। সে দিনের আলোতে দেখতে পায় না। কিন্তু রাতের আঁধারে দেখতে পায়। সচরাচর আমরা জাগতিক অনেক ঘটনায় দেখতে পাই অনেকে খুন-খারাবি করে। কিন্তু এর পশ্চাতে যে সূক্ষ্ম কারণ লুকিয়ে থাকে তা কখনো তলিয়ে দেখি না। অদৃশ্য হতে কার নির্দেশে কি কারণে এসব ঘটনা হয়েছে। পেঁচক সাক্ষ্য দেয়- যা দেখছ তা সবই সঠিক নয়। আরও গভীরে প্রবেশ কর। সব কিছুরই কারণে যেতে হয়।
লক্ষ্মীদেবী ধন-সম্পদের মালিক, তার বাহন পেঁচক। দরিদ্র অর্থ সম্পদের জন্য প্রার্থনা করে ধন লাভ করে ধনী হয়ে সে তখন অন্য দরিদ্রের দুঃখের কথা ভুলে যায়। অর্থাৎ দরিদ্রের মধ্যে ধন সম্পদ দেওয়ার ভয়ে সে অন্ধ। কিন্তু এটা ঠিক নয়। আবার অনেক ধনী ব্যক্তির অর্থ সম্পদ আছে তা অনেক সময় পেছন পথে রোজগার করে। পেঁচক এখানে শিক্ষা দেয় অসৎ পথের অর্থ সংগ্রহে অন্ধ হও। অর্থাৎ সৎ ভাবে রোজগার করো। নতুবা মৃত্যুর পর উত্তর কি দেবে? সাধকদের শিক্ষা- রাত জেগে সাধন ভজন করো নতুবা মানব জীবন বৃথা। দিনের কোলাহলে তাকে ডাকা যায় না। এসব কারণে দেবী লক্ষ্মী পেঁচককে বাহন হিসেবে পছন্দ করেন।
দুর্গাপূজার কাঠামোতে দেখা যায় দেব-দেবীদের সঙ্গে তাদের বাহন পশু-পাখি, সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী। এর তাৎপর্য হিসেবে দেখা যায়, ধরায় এগুলো প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার্থে প্রয়োজন। এগুলোর অভাব হলে প্রকৃতির বিপর্যয় দেখা দিয়ে মানুষ বাসের অযোগ্য হয়ে পরে। পশুপাখি রক্ষণাবেক্ষণের আইন করা হয়েছে।
দেবী দুর্গার কাঠামোতে দেখা যায় একটি কলা-বউ সাজানো রয়েছে। একে বলা হয় নবপত্রিকা। নব পত্রিকা বলতে নয়টি চারা গাছকে বুঝায়। এরা মা দুর্গার প্রতিনিধি। সনাতন ধর্মে পূজার আনুষ্ঠানিকতা প্রকৃতিগত। যে প্রকৃতি আমাদের বাঁচায় তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর উপায় হলো তার পূজা বা আরাধনা। নয়টি চারাগাছ হলো- কদলী, কচু, হরিদ্রা, জয়ন্তী, বেল, দাড়িম্ব, অশোক, মান ও ধান। দেবীদুর্গার প্রতিভূস্বরূপ এদের অর্চনা করা হয়। অর্থাৎ এদের মধ্যেও তিনি বর্তমান। এক কথায় গাছপালা ও উদ্ভিদ জগৎ ছাড়া রাষ্ট্র হবে মরুভূমি। তাই উদ্ভিদ রক্ষণাবেক্ষণের আইন আছে প্রতিটি দেশে।
একদিকে মানব সমাজ, অপরদিকে পশু-পাখি-বৃক্ষাদি যা কিছু আমাদের গোচরীভূত সব কিছুর মধ্যে দেবী দূর্গা বর্তমান। অর্থাৎ বিশ্বের যা কিছু সব তার থেকে সৃষ্টি এবং তাতেই লয়। তিনি মাতৃ স্বরূপা। জন্মভূমিও মাতৃসমা। কাজেই দেবী দুর্গার ঘোষণা- “অহং রাষ্ট্রী” অর্থাৎ আমি বিশ্ব সমাজের অধীশ্বরী- এ যথার্থই প্রণিধানযোগ্য।
লেখক: অধ্যক্ষ, রামকৃষ্ণ আশ্রম ও রামকৃষ্ণ মিশন, যশোর।
আমরা জানি আধুনিক বিশ্বের মূল স্তম্ভ মানুষ। মানুষ সাধারণত বাস করে গৃহে। পিতা-মাতা, ভ্রাতা-ভগ্নি এদের নিয়ে একটি পরিবার। এরূপ কয়েকটি পরিবার নিয়ে একটি বাড়ি, কতকগুলো বাড়ির সমষ্টিতে একটি পাড়া। কিছু সংখ্যক পাড়া মিলে একটি গ্রাম। কতগুলো গ্রাম নিয়ে একটি ইউনিয়ন। কতগুলো ইউনিয়ন নিয়ে থানা বা উপজেলা। এভাবে কয়েকটি উপজেলার সমষ্টি জেলা। কয়েকটি জেলার সমষ্টি বিভাগ। কয়েকটি বিভাগের সমষ্টি প্রদেশ। কয়েকটি প্রদেশ নিয়ে একটি দেশ। কয়েকটি দেশ মিলে মহাদেশ। বিশ্ব কয়েকটি মহাদেশের সমষ্টি।
সমাজ হলো পরস্পর সহযোগিতা ও সহানুভূতির সঙ্গে বসবাসকারী মানবগোষ্ঠী। যাকে বলা যায় মানব সমাজ। যেখানে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ বাস করে। এদের মধ্যে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র, কালো-ধলো, নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-যুবা-শিশু বিভিন্ন প্রকার মানুষ। এরা সকলেই মানব সমাজের মধ্যে পড়ে। এককথায় যারা সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করে তারাই সমাজিক।
আর বিশ্বসমাজ হলো- বিশ্বের অন্তর্গত জীব-জগৎ-গাছপালা প্রাণী সকল। প্রাণীজগতে পশু, পাখি, কীট-পতঙ্গ, এদেরও আলাদা আলাদা সমাজ রয়েছে। এক পর্যায়ে বৃক্ষরাজি, উদ্ভিদ, জলজ অ-জলজ সবই এক প্রকার প্রাণিসম্পদ বলা যায়। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন গাছেরও প্রাণ আছে।
এবারে দেখবো অধীশ্বরী বলতে কি বোঝায়? ব্যাকরণগতভাবে দেখা যায় অধি+ঈশ্বর এর সাথে স্ত্রী লিঙ্গে ‘ঈ’ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে হয় অধীশ্বরী। অর্থাৎ মালিক বা অধিপতি বা সম্রাজ্ঞী। এ শুধু আমরা জাগতিক অর্থেই ব্যবহার করি। একটি রাষ্ট্রে যে সব মানুষ বসবাস করে, রাজা যেমন তাদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের নিরাপদ আশ্রয়ের লক্ষ্য রাখেন তেমনি প্রাণিজগৎ, বৃক্ষরাজি, নদ-নদী এসবেরও ভাল-মন্দ লক্ষ্য রাখেন দেশের রাজা বা রাণী। এসব আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন দেশের বা রাষ্ট্রের পরিচালকদের দেখে থাকি। আর বিশ্ব সমাজের অধিপতি অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা তার থেকে জীব-জগৎ উৎপন্ন হয়ে তাতেই লয় হচ্ছে। আমরা অনেক সময় বলি প্রকৃতির খেলা। এই প্রকৃতির নিয়ন্তা তিনি। বিভিন্ন নামে আমরা সম্বোধন করি। ঈশ্বর বা ঈশ্বরী বা দুর্গা বা গড, আল্লাহ ইত্যাদি এসব একই সৃষ্টিকর্তার বিভিন্ন নাম মাত্র। তিনি দেবীরূপে, মাতারূপে, শক্তিরূপে, জ্ঞানরূপে সব কিছুতেই বর্তমান। তাই তিনি বিশ্ব সমাজের অধিষ্ঠাত্রী বা অধীশ্বরী।
আমরা দুর্গা পূজার কাঠামোতে দেখছি মা দুর্গা, তার দু’কন্যা অর্থাৎ লক্ষ্মী-সরস্বতী, দু’পুত্র কার্ত্তিক-গণেশ এদের নিয়ে যেন পিত্রালয়ে বেড়াতে এসেছেন। পুত্র-কন্যা নিয়ে মা তার বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসেন, এটি আমাদের বাঙালির সমাজ জীবনের একটি প্রতিচ্ছবি। তাই দুর্গাপূজা বাঙালিদের মধ্যেই বেশি প্রচলিত। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতি আনন্দে মেতে ওঠে। এ উৎসবে যোগদান করেন হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ খৃস্টান সকলে। এতে থাকে না কোন জাতি-ধর্ম-বর্ণ ভেদ। বর্তমানে এটি বাঙালির জাতীয় উৎসব।
দুর্গাপূজার কাঠামোতে দেখা যায় দেবী দুর্গা একা নন। তার শক্তি হিসেবে চার শক্তি সঙ্গে নিয়ে আসেন। চারটি বিশেষ শক্তি হলো- জ্ঞান-শক্তি, ধন-শক্তি, বীর্য-শক্তি, জন-শক্তি। একটি রাষ্ট্রেরও এই চারটি শক্তি থাকা প্রয়োজন। না হলে সে রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। তাই শ্রীশ্রী দুর্গাপূজার এই সামগ্রিক রূপটিই প্রকৃত রাষ্ট্রীয় জ্ঞান। বস্তুত দুর্গাপ্রতিমাই জাতীয় প্রতিমা। দুর্গাপূজার চিত্রে আমরা দেখতে পাই দেবী দুর্গা মাতারূপে মধ্যমণি। তার দক্ষিণে লক্ষ্মী দেবী ধনশক্তি বা বৈশ্যশক্তি ও গণেশ অর্থাৎ গণশক্তি ও শ্রমশক্তি বা শূদ্র। আর বামদিকে সরস্বতী দেবী অর্থাৎ জ্ঞানশক্তির বা ব্রাহ্মণ্যশক্তি এবং কার্ত্তিক ক্ষাত্র-বীর্যের অর্থাৎ পরাক্রমশালী শক্তির প্রতীক।
দেবীদুর্গাকে রাষ্ট্র কল্পনায় দেখা যায়। রাষ্ট্র চালাতে জ্ঞানের প্রয়োজন। অর্থের প্রয়োজন । দেশ রক্ষার জন্য সেনাবাহিনীর প্রয়োজন। দেশের উৎপাদনের জন্য শ্রমশক্তি অর্থাৎ জনগণের প্রয়োজন। জনগণ ছাড়া দেশ হয় না।
লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্ত্তিক-গণেশ এ যেন সনাতন ধর্মের চারটি বর্ণের প্রতীক। ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়, বৈশ্য-শূদ্র। ব্রাহ্মণ যিনি জ্ঞান দান করেন অর্থাৎ শিক্ষাপ্রদান করেন। ক্ষত্রিয় দেশ রক্ষা করেন । বৈশ্য যারা ব্যবসা করেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উৎপাদিত দ্রবাদির সরবরাহ এবং যোগান এর সামাঞ্জস্য বিধান করে জনসাধারণের প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অভাব পূরণ করেন। আর এসব খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন করে শ্রমিক বা শূদ্রগণ। এরা মাথার ঘাম পায়ে না ফেললে উৎপাদন বন্ধ। উৎপাদন বন্ধ হলে সমাজের লোকদের না খেয়ে মরতে হবে। এ সব কারণে এরা একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একটি ব্যতীত অপরটি চলতে পারে না। তাই গুণ ও কর্ম অনুসারে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রীয়-বশ্য-শূদ্র এদের সকলের সমান গুরুত্ব।
কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের অজ্ঞতার কারণে আমরা ব্রাহ্মণকে বলি উঁচু বা শ্রেষ্ঠ বর্ণ আর শূদ্রকে বলি নিম্ন বর্ণের বা ছোট জাত। অথচ কেউই ছোট বা অবহেলার নয়। একটি গল্পের মাধ্যমে সহজেই অনুধাবন করা যাবে। একদা একটি কুকুর একটি খরগোশকে তাড়া করছিল। খরগোশ লাফাতে লাফাতে তার বাসস্থান গর্তে প্রবেশ করলো। তারপর নিজে নিজে তার দেহের অঙ্গগুলিকে প্রশ্ন করতে লাগলো। হে কান! আমার বিপদে তুমি কি সাহায্য করছিলে? নিজেই উত্তর দিচ্ছে- হ্যাঁ তুমি শ্রবণে সাহায্য করেছিলে। তোমাকে ধন্যবাদ। হে চোখ, তুমি কি সাহায্য করছিলে? হ্যাঁ তুমি পথ দেখাতে সাহায্য করছিলে। তোমাকেও ধন্যবাদ। পা-তোমরা? হ্যাঁ, তোমরা দৌড়াতে সাহায্য করছিলে নতুবা মরেই যেতাম। এবার লেজ বলো তুমি? না, তুমি তো কোন সাহায্য করোনি। কাজেই তুমি মবঃ ড়ঁঃ । বের হও! বের হও! বলতে বলতে নিজের লেজ নিজেই বাইরে ঠেলে দিলো। আর যায় কোথা? গর্তের মুখে ওত পেতে থাকা কুকুর সঙ্গে সঙ্গে খরগোশের লেজ ধরে খরগোশটিকেই মেরে ফেলেছে। তাই লেজ অকেজো মনে হলেও এটি যে দেহের অঙ্গ তা মনে রাখতে হবে। নতুবা ভুলে গেলেই সর্বনাশ। তদ্রূপ আমাদের সমাজের গুণ ও কর্ম অনুসারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এদের কেউই ছোট বা অবহেলার নয়। যে কোন একটিকে অবহেলা করলেই পুরো সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সমাজ ধ্বংস হবে।
একটি রাষ্ট্রে শুধুমাত্র মানুষই বাস করে না। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য পশু-পাখি, সরীসৃপ জাতীয় সব ধরনের প্রাণী সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি করেছেন। আজকের যুগে পশু, পাখি নিধন করে বিশ্বের সর্বত্রই একটা না একটা অনাসৃষ্টি চলছে। জাতিসংঘ নিয়ম-কানুন করেও যেন প্রতিরোধ করতে পারছে না।
একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে- শ্রীশ্রী দুর্গাদেবীর বাহন পশুরাজ সিংহ। লক্ষ্মীদেবীর বাহন পেঁচা, সরস্বতী দেবীর বাহন রাজহংস, কার্তিকের ময়ূর এবং গণেশের বাহন ছোট্ট ইঁদুর। আপাত অসামঞ্জস্য পশু-পাখি দেবদেবীর বাহন মানব মনে অনেক খটকা লাগে। তবে একটু বিশ্লেষণ করলে সহজেই বোঝা যাবে। একটি রাষ্ট্রে শুধু মানবই বসবাস করে না। জীব-জন্তুও বাস করে। তাই সিংহ, ইঁদুর এগুলো পশু জগতের প্রতীক। রাজহংস, ময়ূর, পেঁচা এগুলো পাখি জগতের প্রতীক।
দেবী দুর্গার বাহন হিসেবে সিংহকে বাছাই করার একটি বিশেষ কারণ হয়তো অসুর তার রূপ পরিবর্তন করে কখনও পশু রূপে আবির্ভূত হতো। তাই যুদ্ধক্ষেত্রে সে মহিষরূপে অবতীর্ণ। মানবের সঙ্গে মানবের যেমন যুদ্ধ তেমনি পশুর সঙ্গে পশুর যুদ্ধই স্বাভাবিক। এ কারণেই হয়তো মহিষের সঙ্গে যুদ্ধ করতে সিংহের প্রয়োজন। আর সিংহ পশুগণের মধ্যে শক্তিশালী তাই দেবী দুর্গা বাহন হিসেবে সিংহকে বেছে নিয়েছেন। আধুনিক প্রাণীবিদগণ বলেন- সিংহ এতই শক্তিশালী যে, এক থাবাতেই মহিষকে কুপোকাত করতে পারে।
দেবী সরস্বতীর বাহন রাজহংস। রাজহংস জল আর দুধ মিশ্রিত থাকলে তা থেকে দুধটুকু খাবে জল ত্যাগ করবে। সংসারে সার অসার দু’টিই আছে। জ্ঞানী সারটুকু নেবে সংসার থেকে, অসারটুকু পরিত্যাগ করবে। হংস জলে থাকে কিন্তু তার গায়ে জল লাগে না। পরমহংস শ্রেণীর সাধকেরা কিন্তু সাংসারিক কলুষতার মধ্যে প্রবেশ করে না। রাজহংস সংসারের মানবকে সারবস্তু গ্রহণে উদ্বোধিত করে। এজন্য বীণাদেবীর বাহন রাজহংস। সরস্বতীর গায়ের রঙ শুভ্র। হংসও শুভ্র। সরস্বতী দেবী জ্ঞানের দেবী। জ্ঞানও জ্যোতির্ময় কোথাও কালিমা নেই। তাই সরস্বতী বাহন হিসেবে রাজহংসকেই বেছে নিয়েছেন।
দেব সেনাপতি কার্ত্তিক শৌর্য-বীর্যে প্রবল পরাক্রম ক্ষত্রিয় শক্তির প্রতীক। দেবতারা যখন অসুরদের দ্বারা পরাজিত হয়ে স্বর্গরাজ্য ছেড়ে মর্তে এলেন- সেই স্বর্গরাজ্য উদ্ধার করেন কার্ত্তিক তার প্রবল যুদ্ধ পরাক্রম দ্বারা। কার্ত্তিক সেনাপতি, যোদ্ধা। এই কার্ত্তিক অন্যান্য পশু-পাখি বাহন না করে ময়ূরকে কেন বেছে নিলেন? সেক্ষেত্রে মনে হয় ময়ূরের মধ্যে চারটি খুব সুন্দর গুণ যা কাত্তির্কের ক্ষত্রিয় হিসেবে গ্রহণযোগ্য।
যুদ্ধ ক্ষত্রিয়ের প্রধান বৃত্তি। শত্রু জয় তার স্বধর্ম। ময়ূরের যখন সর্পের সঙ্গে যুদ্ধ হয় সে কৌশল দেখার মতো। নখ ও ঠোঁট ময়ূরের অস্ত্র। পুচ্ছ হলো তার ঢাল। পাখা দ্বারা বর্মের ন্যায় শত্রুর আঘাত প্রতিহত করে। নখ ও চঞ্চু দ্বারা তাকে মেরে ফেলে। ২. ময়ূর অনলস। ব্রহ্ম মুহূর্তে সে জনগণকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। সে অতন্দ্র-প্রহরী, সতর্ক। একজন যোদ্ধা সে-ও ব্রাহ্মমুহূর্তে ঘুম থেকে জেগে তার যুদ্ধ বিদ্যা অনুশীলন করে। ৩. ময়ূর বিচরণ করে দল বেঁধে, একাকি নয়। খাবার খাদ্যও সকলকে নিয়ে খায়। সহভোজন। ক্ষত্রিয়রাও সমবণ্টন করে তাদের খাদ্যগুলোকে। সামাজিক ও রাষ্ট্রিক সমঅধিকার দান করে। ৪. ক্ষত্রিয় আপদগতা স্ত্রীকে রক্ষা করে। ময়ূর তার স্ত্রীকে রক্ষা করে। ক্ষত্রিয়ের কর্ম ও ময়ূরের কর্মে অনেক সামাঞ্জস্য দেখা যায়। তাই মনে হয় এসব কারণেই কার্ত্তিকের পছন্দ পাখিদের মধ্যে ময়ূরকে।
গণেশ জনগণের প্রতিনিধি। শ্রমের প্রতীক। শূদ্রের প্রতীক। আমরা দেখেছি গণেশের মাথাটি হাতির। তার বাহন ছোট মুষিক। মনে হয় এতবড় হাতির মাথাওয়ালা গণেশের ছোট মূষিক বাহন হলো কি করে? লক্ষ্য করার বিষয় সমাজের যারা বড়, সকলেই সাধারণ জনগণের ওপর নির্ভর করেই বড় হন। আবার গণেশের মাথাটি হাতির হলেও তার কান, চোখ, মুখাবয়ব ছোট মূষিকের সঙ্গে যেন মিলে যায়। হাতি পশু হিসেবে বড় জাতের হলেও জাতভাই ছোট মূষিককে ত্যাগ করে না। আবার দেখা যায় ইঁদুরের দু’টি দাঁত খুবই ধারালো। এই ধারালো দাঁত দিয়ে মোটা রশির জালও ছেদন করতে পারে। তেমনি মানবের দু’টি দাঁত যেন বিবেক এবং বৈরাগ্য। এই বিবেক বৈরাগ্যরূপ দাঁত দিয়ে সংসার বন্ধন ছেদন করে মানব মুক্তি লাভ করতে পারে। এসব কারণেই গণেশের পছন্দ তার বাহন এই ছোট মূষিক বা ইঁদুর।
লক্ষ্মীদেবীর বাহন পেঁচক। পেঁচক দিনে অন্ধ-রাতে দেখে। সে দিনের আলোতে দেখতে পায় না। কিন্তু রাতের আঁধারে দেখতে পায়। সচরাচর আমরা জাগতিক অনেক ঘটনায় দেখতে পাই অনেকে খুন-খারাবি করে। কিন্তু এর পশ্চাতে যে সূক্ষ্ম কারণ লুকিয়ে থাকে তা কখনো তলিয়ে দেখি না। অদৃশ্য হতে কার নির্দেশে কি কারণে এসব ঘটনা হয়েছে। পেঁচক সাক্ষ্য দেয়- যা দেখছ তা সবই সঠিক নয়। আরও গভীরে প্রবেশ কর। সব কিছুরই কারণে যেতে হয়।
লক্ষ্মীদেবী ধন-সম্পদের মালিক, তার বাহন পেঁচক। দরিদ্র অর্থ সম্পদের জন্য প্রার্থনা করে ধন লাভ করে ধনী হয়ে সে তখন অন্য দরিদ্রের দুঃখের কথা ভুলে যায়। অর্থাৎ দরিদ্রের মধ্যে ধন সম্পদ দেওয়ার ভয়ে সে অন্ধ। কিন্তু এটা ঠিক নয়। আবার অনেক ধনী ব্যক্তির অর্থ সম্পদ আছে তা অনেক সময় পেছন পথে রোজগার করে। পেঁচক এখানে শিক্ষা দেয় অসৎ পথের অর্থ সংগ্রহে অন্ধ হও। অর্থাৎ সৎ ভাবে রোজগার করো। নতুবা মৃত্যুর পর উত্তর কি দেবে? সাধকদের শিক্ষা- রাত জেগে সাধন ভজন করো নতুবা মানব জীবন বৃথা। দিনের কোলাহলে তাকে ডাকা যায় না। এসব কারণে দেবী লক্ষ্মী পেঁচককে বাহন হিসেবে পছন্দ করেন।
দুর্গাপূজার কাঠামোতে দেখা যায় দেব-দেবীদের সঙ্গে তাদের বাহন পশু-পাখি, সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী। এর তাৎপর্য হিসেবে দেখা যায়, ধরায় এগুলো প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার্থে প্রয়োজন। এগুলোর অভাব হলে প্রকৃতির বিপর্যয় দেখা দিয়ে মানুষ বাসের অযোগ্য হয়ে পরে। পশুপাখি রক্ষণাবেক্ষণের আইন করা হয়েছে।
দেবী দুর্গার কাঠামোতে দেখা যায় একটি কলা-বউ সাজানো রয়েছে। একে বলা হয় নবপত্রিকা। নব পত্রিকা বলতে নয়টি চারা গাছকে বুঝায়। এরা মা দুর্গার প্রতিনিধি। সনাতন ধর্মে পূজার আনুষ্ঠানিকতা প্রকৃতিগত। যে প্রকৃতি আমাদের বাঁচায় তার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর উপায় হলো তার পূজা বা আরাধনা। নয়টি চারাগাছ হলো- কদলী, কচু, হরিদ্রা, জয়ন্তী, বেল, দাড়িম্ব, অশোক, মান ও ধান। দেবীদুর্গার প্রতিভূস্বরূপ এদের অর্চনা করা হয়। অর্থাৎ এদের মধ্যেও তিনি বর্তমান। এক কথায় গাছপালা ও উদ্ভিদ জগৎ ছাড়া রাষ্ট্র হবে মরুভূমি। তাই উদ্ভিদ রক্ষণাবেক্ষণের আইন আছে প্রতিটি দেশে।
একদিকে মানব সমাজ, অপরদিকে পশু-পাখি-বৃক্ষাদি যা কিছু আমাদের গোচরীভূত সব কিছুর মধ্যে দেবী দূর্গা বর্তমান। অর্থাৎ বিশ্বের যা কিছু সব তার থেকে সৃষ্টি এবং তাতেই লয়। তিনি মাতৃ স্বরূপা। জন্মভূমিও মাতৃসমা। কাজেই দেবী দুর্গার ঘোষণা- “অহং রাষ্ট্রী” অর্থাৎ আমি বিশ্ব সমাজের অধীশ্বরী- এ যথার্থই প্রণিধানযোগ্য।
লেখক: অধ্যক্ষ, রামকৃষ্ণ আশ্রম ও রামকৃষ্ণ মিশন, যশোর।
No comments