ঈদ-পূজাকে সামনে রেখে বাজারে জাল নোটের ছড়াছড়ি
কোরবানির ঈদ ও দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে
রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ছে জাল নোট। বিশেষ করে
বিভিন্ন মার্কেট, শপিংমল এবং গরুর হাটে এসব জাল নোট ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা
করেছে জালিয়াতচক্র। জাল নোট কারবারিরা বিশেষ কায়দায় এক শ’ টাকার নোটকে পাঁচ
শ’ ও এক হাজার টাকার নোট বানিয়ে বাজারে ছাড়ছে। এছাড়া নতুন নোটও ছাড়া হচ্ছে
বাজারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক অন্তত ১২টি গ্রুপ সারা
দেশে জাল নোট ছড়িয়ে দেয়ার মূল কাজটি করছে। সারা দেশে তাদের কয়েক শ’ এজেন্ট
রয়েছে। তারা ২০ হাজার টাকায় এক লাখ টাকা কিনে নিয়ে নিজের এলাকায় ছড়িয়ে
দিচ্ছে। ঈদ ও পূজাকে কেন্দ্র করে অন্তত ৫০ কোটি টাকার জাল নোট বাজারে ছাড়া
হয়েছে বলে গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার
(ডিবি) মনিরুল ইসলাম বলেন, জাল নোট চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে
পাঠানোর পরপরই তারা জামিনে বেরিয়ে আসে। ঈদকে কেন্দ্র করে জাল নোট
কারবারিরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এ কারণে জামিনে বেরিয়ে আসা জাল নোট কারবারিদের
গোয়েন্দা নজরদারি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, জাল নোট শনাক্ত মেশিন ব্যবহার ও
একটু সচেতনতা অবলম্বন করলেই এ ধরনের প্রতারণার হাত থেকে বাঁচা যায়।
এদিকে শুধু দুই ঈদকে কেন্দ্র করে প্রায় ২২ লাখ টাকার জাল নোট শনাক্ত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত জুন, জুলাই ও আগস্টে এ সব টাকা শনাক্ত করা হয়। এছাড়া গত এক বছরে জাল নোট শনাক্তের পরিমাণ ৯ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। তবে এবারের ঈদে জাল নোট শনাক্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। সারা দেশে প্রায় ১০০০ জাল নোট শনাক্তকরণ মেশিন দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এগুলো দেশে কার্যরত ৫৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হবে।
সূত্র জানায়, জাল নোট তৈরি করতে দুটি পদ্ধতি ব্যবহার করছে জাল নোট তৈরির কারিগররা। সিকিউরিটি থ্রেড ও ওয়াশ পদ্ধতিতে তারা জাল নোট তৈরি করছে। জাল নোট তৈরির কারিগররা টাকার সাইজে কাগজ কেটে তাতে আঠা ও সিকিউরিটি থ্রেড বসিয়ে তার ওপর স্ক্যানার ও প্রিন্টিং মেশিনের সহায়তায় সূক্ষ্মভাবে যে কোন মূল্যমানের টাকার ছাপ বসিয়ে দেয়। এছাড়াও ওয়াশ পদ্ধতিতেও জাল নোট তৈরি করা হয়। এ ক্ষেত্রে আসল টাকার নোট ওয়াশ করে শুকানো হয়। পরে ওই নোটের ওপর টাকার অঙ্ক বসিয়ে ছাপ দেয়া হয়। এরা ১০০ টাকার নোট ওয়াশ করে সাদা করে তার ওপর ৫০০ ও ১০০০ টাকার অঙ্ক বসিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে সিকিউরিটি সুতা আসল থাকায় সহজেই কেউ ধরতে পারে না।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, সাধারণত কয়েক ধাপে জাল টাকা বাজারে ছাড়া হয়। প্রথম ধাপে পাইকারি হিসেবে এক লাখ জাল টাকার একটি বান্ডিল ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। দ্বিতীয় ধাপে পাইকারি কারবারিরা আবার এসব টাকা খুচরা কারবারির কাছে ৩০-৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে। তৃতীয় ধাপে খুচরা কারবারিরা এ সব টাকা নিজস্ব লোকজনের মাধ্যমে তা সরাসরি সুকৌশলে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়। বিশেষ করে বাজার বা শপিং মলে এসব টাকা ছাড়া হয়। যে সব দোকানে সবসময় ভিড় থাকে জাল টাকার কারবারিরা তাদের টার্গেট করে। এছাড়া কোরবানির পশুর এক হাট থেকে জাল টাকা দিয়ে পশু ক্রয় করে আরেক হাটে বিক্রি করে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, রাজধানী কেন্দ্রিক অন্তত ১২টি জালিয়াত চক্রের প্রত্যেকের কাছেই জাল নোট তৈরির সরঞ্জাম রয়েছে। এরা বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে জাল টাকা তৈরির মেশিন স্থাপন করে। তাদের কাছ থেকে সিন্ডিকেটের সদস্যরা জাল নোট নিয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়। জাল টাকার অন্যতম দুই গুরু হলো ছগীর মাস্টার ও দুরুজ্জামান ওরফে নুরুজ্জামান ওরফে জামান বিশ্বাস। তাদের হাত ধরেই জাল টাকার অনেক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও জামিনে বেরিয়ে এসে তারা আবারও আগের ব্যবসায় যুক্ত হয়। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, জাল নোটের শীর্ষ কারবারিদের মধ্যে অন্যরা হলো মোস্তফা চিশতীর গ্রুপ, মাহবুবের গ্রুপ, জালাল গ্রুপ, মিরপুর এলাকার জাকিরের গ্রুপ, খিলগাঁও-সবুজবাগ ও বাসাবো এলাকায় লোকমানের গ্রুপ, ধানমন্ডি-মোহাম্মদপুর এলাকার কাওসারের গ্রুপ উল্লেখযোগ্য। তাদের সঙ্গে কাজ করে আবদুর রহমান, খালিদুজ্জামান, বাবু মিয়া, সুজন ও মঞ্জুরুল কামাল, শাহ আলম, হুমায়ুন কবির, পলাশ, সাইফুল ইসলাম, সুমন, আলাউদ্দীন, হামিদ ও রাশিদুল। এদের অনেকেই বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার হলেও জামিনে বেরিয়ে আগের ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, জাল টাকার কারাবারিরা প্রথমে একটি গ্রুপের সঙ্গে কাজ করে। পরে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার জন্য নিজেই গ্রুপ তৈরি করে। এসব চক্রের সঙ্গে অনেক নারীও কাজ করে। কারণ মহিলাদের সহজেই কেউ অবিশ্বাস করতে চায় না। ফলে সহজেই জাল টাকা ছড়িয়ে দেয়া যায়।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত তিন মাসে ১০০০ টাকা মূল্যমানের ১৬২৩টি নোট ১৬২৩০০০ টাকা, ৫০০ টাকা মূল্যমানের ১১১২টি নোট ৫৫৬০০০ টাকা ও ১০০ টাকা মূল্যমানের ৫৫টি নোট ৫৫০০ টাকা। সব মিলিয়ে জাল নোট হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে ২১ লাখ ৮৪ হাজার ৫০০ টাকা। এর মধ্যে রমজানের চেয়ে কোরবানির ঈদে সব চেয়ে বেশি জাল নোটের আয়োজন চলছে। সে কারণে কোরবানিকে ঘিরে আগস্টে ব্যাপক জালনোটের ছড়াছড়ি দেখা যাচ্ছে। পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায়, শুধু আগস্টে ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকা মূল্যমানের ১৫৪০টি জাল নোট শনাক্ত করা হয়েছে। যা রমজানে অর্থাৎ জুনে ছিল ১০৬৭টি নোট। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, কয়েক স্তরে জাল নোট শনাক্ত করা হয়। ৫৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংক, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাংলাদেশ পুলিশ জাল নোট শনাক্ত করে। এর মধ্যে জাল নোট বেশি ধরে পুলিশ। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে জাল নোট উৎপাদন কেন্দ্র, জাল নোট ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কিংবা চক্রকে ধরে পুলিশ মামলা দেয়। তার আগে অবশ্যই উদ্ধার করা নোট প্রকৃত বিচারে জাল কিনা তা খতিয়ে দেখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জাল নোট শনাক্তকরণ মেশিনের মাধ্যমে যাছাই-বাছাই শেষে সিল মেরে দেয়। তখন থেকে ওই নোট জাল হিসেবে বিবেচিত হয়। আর বাণিজ্যিক ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকে লেনদেনের সময় কিছু টাকা জাল হিসেবে চিহ্নিত হয়। অবশ্য এর পরিমাণ বেশি নয়। বেশি আসে পুলিশের মাধ্যমে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত এক বছরে ১৪৩টি কেস কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা পড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ১১ হাজার ৪১৩টি নোট। যার মূল্য দাঁড়িয়েছে ৯ কোটি ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৪৫০ টাকা। খুচরা পর্যায়ের পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায়, জাল নোট হিসেবে শনাক্ত হওয়া নোটের মধ্যে রয়েছে-৫০ টাকার ১৮৭টি নোট ৯ হাজার ৩৫০ টাকা, ১০০ টাকার ৭৫১টি নোট ৭৫ হাজার ১০০ টাকা, ৫০০ টাকার ২ হাজার ৮৪৬টি নোট এক কোটি ৪২ লাখ ৩ হাজার টাকা ও ১০০০ টাকার ৭ হাজার ৬২৯টি নোট ৭ কোটি ৬২ লাখ ৯ হাজার টাকা। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মানবজমিনকে জানান, ঈদকে সামনে রেখে জাল নোট তৈরি ও সরবরাহ চক্রগুলো খুবই সক্রিয়। যার প্রমাণ ঈদ শুরুর আগের মাসে জাল নোটের কেস অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। নিয়মিত মাসে যেখানে কেস থাকত ১০টি। এখন সেখানে কেস সংখ্যা গিয়ে ঠেকেছে ৩০টিতে। তিনি বলেন, এ সংক্রান্ত কোন কেসের সঠিক বিচার কিংবা নিষ্পত্তি হয় না। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বছরের পর বছর এ ধরনের কেস ঝুলে থাকে। প্রকৃত বিচার না হওয়ায় অপরাধীর সংখ্যা বাড়ছে। সঙ্গে বাড়ছে জাল নোটের পরিমাণও।
এদিকে উৎসব এলেই চাহিদা বাড়ে নতুন নোটের। এবারও ঈদুল আজহা ও হিন্দু ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা পাশাপাশি সময়ে থাকায় নতুন টাকার চাহিদা একটু বেশি। উৎসবের বাড়তি চাহিদা মেটাতে সাড়ে ২৪ কোটি টাকার নতুন নোট বাজারে ছাড়ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ পরিস্থিতিতে নতুন নোটকে পুঁজি করে যাতে জাল নোট কারবারিরা সক্রিয় হতে না পারে, সে জন্যও প্রস্তুতি নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিশেষ করে কোরবানি ঈদের পশুর হাটকে কেন্দ্র করে বাড়ে তাদের তৎপরতা। এটি ঠেকাতে সারা দেশের পশুর-হাটগুলোয় এবার এক হাজারের বেশি জাল নোট শনাক্তকারী মেশিন নিয়ে সক্রিয় থাকবে ব্যাংক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কারেন্সি অফিসার (মহাব্যবস্থাপক) জোয়ার্দার ইসরাইল হোসেন মানবজমিনকে জানান, জাল নোট শনাক্তকারী মেশিনের চাহিদা চাওয়া হয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী চলতি সপ্তাহে দেয়া হতে পারে বলে জানান তিনি। এছাড়া আসছে ঈদে জাল নোটের তেমন কোন খবর নেই বলে জানান তিনি। তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বাইরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চাহিদা অনুযায়ী পশুরহাটগুলোর জন্য নতুন করে ২৭৮টি জাল নোট শনাক্তকারী মেশিন দেয়া হচ্ছে। গত বছরের কোরবানি ঈদ পর্যন্ত রাজধানীসহ সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দেয়া ৪৯৫টি মেশিন কাজে লাগানো হবে। তারা এসব মেশিন নিয়ে কোরবানির পশুর হাটে বিশেষ টহল দেবে। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে ঢাকার ১৯টি পশুর হাটে অন্তত দু’টি করে এবং ঢাকার বাইরে গুরুত্ব বিবেচনায় বড় পশুর হাটগুলোতে একটি করে ব্যাংকের বুথ থাকবে। প্রতিটি বুথে দু’টি করে জাল নোট শনাক্তকারী মেশিন নিয়ে বিনামূল্যে সেবা দেবে ব্যাংকগুলো। সব মিলিয়ে সারাদেশে এবার এক হাজারের বেশি জাল নোট শনাক্তকারী মেশিন ব্যবহার করা হবে।
No comments