ইউরোপজুড়ে স্বাধীনতার ডাক by সুমন কায়সার
স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার বিষয়ে
সাম্প্রতিক গণভোট বিশ্বজুড়েই স্বাধীনতাকামীদের মধ্যে সৃষ্টি করেছে ব্যাপক
চিত্তচাঞ্চল্য। কাশ্মীর থেকে কর্সিকা আবার স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর।
এমনকি ‘সুখে থাকতে’ ভূতে কিলাচ্ছে অনেক মার্কিনকেও! তবে ইউরোপজুড়ে যে
আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের আকাঙ্ক্ষার ঢেউ বইছে, তা বোধহয় আর কোথাও নেই।
স্পেন, ইতালি, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, সার্বিয়া, আলবেনিয়া, অস্ট্রিয়া কোথায়
ওঠেনি কমবেশি স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ার!
স্পেনের সমস্যা ‘বাস্ক কান্ট্রি’, কাতালোনিয়া আর ভ্যালেন্সিয়া নিয়ে। উত্তরের তিনটি প্রদেশ একত্রে পরিচিত বাস্ক কান্ট্রি হিসেবে। ষাটের দশক থেকে এ প্রদেশগুলোকে স্পেনের অন্য প্রদেশের চেয়ে বেশি স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছে। বাস্ক ভাষা সরকারিভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়ার পরও ২০ লাখ বাস্ক স্বাধীনতার দাবি ছাড়ছে না। তারা প্রতিবেশী ফ্রান্সের বাস্ক অধ্যুষিত অংশের সঙ্গে মিলে স্বাধীন দেশ গড়তে চায়। অন্যদিকে কাতালোনিয়ার জনসংখ্যা ৭৫ লাখ। তারা স্পেনের সবচেয়ে ধনী স্বশাসিত অঞ্চলগুলোর একটি। তাদেরও আছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। সেখানকার বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আরও বেশি ক্ষমতা চায়। তারা চায় কাতালোনিয়া থেকে তোলা করের আরও বড় ভাগ। ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল আর আধুনিক স্থাপত্যের জন্য ‘স্পেনের ক্যালিফোর্নিয়া’ হিসেবে পরিচিত ভ্যালেন্সিয়াকে ২০০৭ সালে অনেক স্বশাসন দেওয়া হয়। তারাও স্বাধীনতা চাইছে।
জনমত জরিপ বলছে, কাতালান ও বাস্কদের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশই স্বাধীনতার জন্য গণভোট চায়। আর যারা গণভোট চায়, তাদের প্রায় অর্ধেক স্বাধীনতার পক্ষে।
ফ্রান্সও দীর্ঘদিন ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আর চরমপন্থী মনোভাবের মোকাবিলা করে আসছে। এর চরম রূপ দেখা যায় ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ কর্সিকায়। এমনিতেই মূল ভূখণ্ড থেকে বেশ দূরের এ দ্বীপে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ আর আইনকানুনের বালাই কম। বাইরের হস্তক্ষেপ মানতে নারাজ স্বাধীনচেতা কর্সিকানরা। জনমত জরিপে দ্বীপের বেশির ভাগ মানুষ বরাবর ফ্রান্সের অংশ থাকার পক্ষে মত দিলেও উগ্র জাতীয়তাবাদীরা পিছু হটছে না। কর্সিকার জনসংখ্যা দুই লাখ ৬০ হাজার। ২০০১ সালে ফ্রান্সের পার্লামেন্ট স্বশাসন বিল পাস করে কর্সিকাকে দেশের কিছু মূল আইন বদলে নিজেদের প্রয়োজনমতো সংশোধনের সুযোগ দেয়। স্থানীয় সব বিদ্যালয়ের পাঠক্রমে কর্সিকান ভাষা ব্যবহারের ব্যবস্থা রাখা হয়। তবে কর্সিকা নামে কোনো দেশের অস্বিত্ব স্বীকার না করায় সেখানে সহিংসতা আবার বেড়েছে। ফ্রান্সের বক্তব্য, তা করাটা হবে সংবিধান পরিপন্থী।
ইতালিতে রয়েছে সাউথ তিরল সমস্যা। এ নিয়ে তাদের ঝামেলা অস্ট্রিয়ার সঙ্গে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এলাকাটি নিজের মানচিত্রে যুক্ত করে নেয় ইতালি। ১৯৭০-এর দশকে উত্তর আল্পসের এ সচ্ছল অঞ্চলটিকে বাড়তি স্বশাসন দেওয়া হয়। কিন্তু ওই সিদ্ধান্ত কখনোই মেনে নেয়নি সাউথ তিরেলিওন ফ্রিডম পার্টি। তারা ইতালি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে জুড়তে চায়। এ নিয়ে পারলে আগামী বছরই গণভোট দেওয়ার দাবি তুলছে তারা। সাউথ তিরলের পাঁচ লাখ ১০ হাজার অধিবাসীর দুই-তৃতীয়াংশই জাতিগতভাবে জার্মান। প্রদেশটির গভর্নর অবশ্য মনে করেন, ইতালির মধ্যে স্বশাসন নিয়ে ভালোই আছেন তাঁরা। কিন্তু বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব ক্রমেই জোরদার হচ্ছে। এ রকমই আরেকটি অঞ্চল ভেনেতোয় স্বাধীনতার দাবি করে আসছে লিগা ভেনেতো দলের জাতীয়তাবাদীরা। তারা অনেক আগে একটি রাষ্ট্র ছিলও বটে। গত মার্চে তারা এক অনলাইন গণভোট করে। এতে ৮৯ শতাংশ উত্তরদাতা স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দেয়। স্কটল্যান্ডের আন্দোলনে উৎসাহিত হয়ে গত জুন মাসে ভেনেতোর আঞ্চলিক পরিষদ দুটি বিলও পাস করেছে। এতে গণভোটের পক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
ইতালির মূল ভূখণ্ডের ১২০ মাইল দূরের সার্দিনিয়া দ্বীপেও শোনা যাচ্ছে ভাঙনের শব্দ। সার্দিনিয়া রাজ্যের অংশ হিসেবে দ্বীপটি একধরনের স্বাধীনতা ভোগ করেছে অতীতে। ইতালির ১৯৪৮ সালের সংবিধানে একে বিশেষ মর্যাদাও দেওয়া হয়েছিল। বছর দুয়েক আগে সেখানে আঞ্চলিক পরিষদে গণভোটের পক্ষে প্রস্তাব উঠলে মাত্র এক ভোটে হেরে যায় তা। এই ধাক্কার পর তিনটি নতুন স্বাধীনতাপন্থী দল দ্বীপটির বিশেষ মর্যাদা নতুন করে পর্যালোচনার দাবি তুলেছে। যদিও ধারণা করা হয়, দ্বীপের ৮০ শতাংশ মানুষই বর্তমান আঞ্চলিক স্বশাসনে খুশি আছে।
তুলনামূলক ছোট দেশ বেলজিয়ামে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা। সেখানেও স্বাধীনতার দাবি। উত্তর ফ্ল্যান্ডার্সের মানুষ ডাচ্ ভাষায় কথা বলে। নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে যোগ দিতে চায় তারা। দক্ষিণের ফরাসিভাষীরা চায় স্বাধীন ওয়ালোনিয়া। বেলজিয়ামের স্বাধীনতার ইতিহাসের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে এ দুই ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব। ওয়ালুন আর ফ্লেমিশ জনগণ নেদারল্যান্ডের বিরুদ্ধে জোট গড়েছিল তখন। স্বাধীনতার জন্য হাত মেলালেও দুই শতাব্দী ধরে বিচ্ছিন্ন হতে চাইছে তারা। কারণটা মূলত অর্থনৈতিক। এমনকি ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে একটি টিভি চ্যানেল ভুয়া খবর প্রচার করে যে ফ্ল্যান্ডার্সরা স্বাধীনতা ঘোষণা করে ফেলেছে। ব্রাসেলসে নিযুক্ত বেশ কয়েকজন রাষ্ট্রদূত নিজেদের দেশে ফোন করেন করণীয় জানতে! পরে জানা যায়, ব্যাপারটা নিছক ধাপ্পা। কিন্তু আট বছর পর আজ বিষয়টা আর রগড়ের পর্যায়ে নেই। এ অঞ্চলের প্রধান জাতীয়তাবাদী দল নিউ ফ্লেমিশ অ্যালায়েন্স এখনই স্বাধীনতা চায় না বটে, তবে তারা একটি শিথিল যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা চাইছে, যাতে সর্বোচ্চ স্বশাসন পাওয়া যাবে। তবে বেলজিয়াম ভেঙে দুই ভাগ করাটা সহজ হবে না। ফরাসিভাষী রাজধানী ব্রাসেলেস কার ভাগে পড়বে তা একটা বড় প্রশ্ন। কোনো পক্ষই এর দখল ছাড়তে চাইবে না। রাজধানী শহরের চারদিকে ফ্ল্যান্ডার্সদের বসবাস! আবার ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দা জাতীয় নেতারা যেভাবে সামাল দিয়েছেন, তাতে আঞ্চলিক নেতারা বুঝেছেন অন্তত আপাতত স্বাধীনতার দাবি নিয়ে বেশি উচ্চবাচ্য না করাই ভালো হবে।
বিচ্ছিন্নতাবাদের আওয়াজ উঠেছে অস্ট্রিয়া, আলবেনিয়া এবং নিজেরাই সাম্প্রতিক ভাঙনের ফসল সার্বিয়াতেও। রোমানিয়ার ট্রান্সসিলভানিয়াতে তৎপর হয়ে উঠেছে স্বশাসনের দাবি তোলা হাঙ্গেরিয়ান ট্রান্সসিলভানিয়ানরা। তারা কোনো এক সোনালি সকালে হাঙ্গেরিতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন দেখছে।
No comments