কেন জরুরি সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর by মো. নজরুল ইসলাম
ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির পর স্বভাবতই বঙ্গোপসাগরবিধৌত বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিপুল সম্ভাবনা।
উল্লেখ করা যেতে পারে, বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য প্রতিবছর গড়ে ৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতির সঙ্গে তাল মেলাতে স্বভাবতই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আরও বৃদ্ধি পাবে। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের মাধ্যমে প্রতিবছর আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ ৬০ বিলিয়ন ইউএস ডলার। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিবছর জাহাজ আগমন বৃদ্ধির হার ১১ শতাংশেরও বেশি। বাংলাদেশের বর্তমান সমুদ্রবন্দরগুলো দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। ফলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক-ব্যবসায়িক সুবিধা অর্জন করতে পারেনি। অর্থাৎ, ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধা আদায়ে বাংলাদেশ কার্যত ব্যর্থ হয়েছে।
বর্তমানে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের পোতাশ্রয়ে মাদার ভেসেল ও বৃহৎ কনটেইনার নোঙর করতে পারে না। গভীরতা কম হওয়ায় মাত্র ১৮ শতাংশ জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে প্রবেশ করতে পারে। আধুনিকায়ন করা হলেও অবস্থার বিশেষ উন্নতি হবে না। বড় জাহাজগুলো গভীর সমুদ্রে নোঙর করার পর ছোট ছোট জাহাজ বা ট্রলারে মালামাল চট্টগ্রাম বন্দরে আনা-নেওয়া করা হয়। ফলে একদিকে সময় বেশি লাগে, অন্যদিকে ব্যয় কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। দেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্দর দুটিতে জাহাজজটের কথাও প্রায়ই শোনা যায়।
এসব সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেশে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ। প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই দেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে ঐকমত্য পোষণ করে। বেশ কয়েকটি স্থান জরিপ করার পর জাপানি প্রতিষ্ঠান পেসিফিক কনসালট্যান্ট ইন্টারন্যাশনাল কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সুপারিশ করেছে। প্রস্তাবিত সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ জাহাজ প্রবেশ করতে সক্ষম হবে। এক প্রতিবেদনে তারা বলেছে, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে আন্তর্জাতিক নৌপথগুলোর সংযোগ সাধন করে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাবে। সম্ভাব্যতা যাচাই ২০০৯ সালে সম্পন্ন হলেও সামর্থ্যের অভাবে বন্দর নির্মাণের কাজ এখনো শুরু করা সম্ভব হয়নি। বন্দর নির্মাণের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪২ হাজার কোটি টাকা। ২০৫৫ সালের মধ্যে তিন পর্যায়ে বন্দর নির্মাণের কাজ শেষ হবে বলে আশা করা হয়েছিল। বিভিন্ন কারণে বন্দর নির্মাণের কাজ শুরু হয়নি। ফলে সময় আরও বাড়বে, ব্যয়ও সে হারে বৃদ্ধি পাবে।
সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি প্রধান কেন্দ্রে এ অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিণত হবে। বন্দরটি ব্যবহার শুরু হলে পরিবহন ব্যয় আনুমানিক ১৫ শতাংশ হ্রাস পাবে। এ ছাড়া বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক বিনিয়োগ হবে, সারা দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন গতি আসবে। কালক্রমে ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক থেকে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরের মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশে রূপান্তরিত হবে বলে আশা করা যায়। প্রতিবেশী দেশগুলো এ বন্দর ব্যবহার করলে বাংলাদেশ আর্থিকভাবে লাভবান হবে। এ বন্দরকে কেন্দ্র করে নিকটবর্তী এলাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে, অবকাঠামোগত ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হবে। ফলে কর্মসংস্থান বিপুলভাবে বাড়বে। আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধি পেলে রাজস্ব আয়ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে। তেল-গ্যাস ও অন্যান্য সমুদ্রসম্পদ আহরণ ও ব্যবহারের সুযোগ বাড়বে। সার্বিকভাবে বাৎসরিক জিডিপি বৃদ্ধির হার ২ শতাংশ হবে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন। অন্যদিকে, নিরাপত্তার হুমকি দেখা দিলে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য বিকল্প নৌঘাঁটি হিসেবে বন্দরটি ব্যবহার করা যাবে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে যে সনাতন ধারার সমুদ্রবন্দরগুলো বিকাশমান অর্থনীতির ভার বহনে যে আর সক্ষম হবে না, তা প্রতিবেশী দেশগুলো অনেক আগেই উপলব্ধি করে এবং ক্রমবর্ধমান ব্যবসা-বাণিজ্যের চাহিদা মেটানোর জন্য গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ইতিমধ্যে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমার গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। ভারতও বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে বলে জানা যায়। অবশ্য এতে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব কোনোভাবেই কমবে না। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের চাহিদা পূরণে যে সুবিধা দেবে, অন্য কোনো আঞ্চলিক বন্দর ততটা করবে না বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। সোনাদিয়া সমুদ্রবন্দর ব্যবহারকারী দেশের সংখ্যাও বেশি হবে বলে আশা করা যায়।
বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ নিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনা চলছে। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনসহ কয়েকটি দেশ আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে যে দেশের সঙ্গেই বন্দর নির্মাণের চুক্তি হোক, দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। গভীর সমুদ্রবন্দরের নকশা, নির্মাণ ও পরিচালনায় বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত থাকতে হবে। অবশ্যই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণসংক্রান্ত চুক্তি সব ধরনের বিতর্ক বা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে।
দক্ষিণ এশিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। ইতিমধ্যে পাকিস্তানের গোয়ারদার ও শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটায় চীন গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের কুয়াকফুতে চীন গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। এই প্রেক্ষাপটে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাববলয় বিস্তৃত হওয়া নিয়ে কৌশলগত কারণে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্বস্তি আছে। সামরিক ও নিরাপত্তাগত কারণে চীন ও ভারত উভয়েই বঙ্গোপসাগরের নিয়ন্ত্রণ চায়। বাংলাদেশের জন্য ভূকৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রসীমার ওপর বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জন্য খুবই জরুরি।
এ অঞ্চলের সাগর-মহাসাগরে প্রভাব বিস্তারে চীন ও ভারতের নৌবাহিনীর প্রতিযোগিতা বেশ পুরোনো। আবার এ অঞ্চলে চীনের নৌশক্তি বৃদ্ধি পাক, তা যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দ নয়। চীনের সঙ্গে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ চুক্তি হলে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র যাতে বিরোধিতা না করে, সে জন্য কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগ প্রয়োজন। একই সঙ্গে প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দরের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি বাংলাদেশকেই নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, প্রতিবেশী দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও জঙ্গিদের টার্গেট হতে পারে এ বন্দর।
কৌশলগত কারণে চীনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। চীনের আগ্রহের পেছনে কারণ মূলত দুটি: প্রথমত, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের উপস্থিতি জোরদার করা, যার ফলে ভারত মহাসাগর অঞ্চলে দেশটির প্রভাব বৃদ্ধি পাবে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে চীনের আমদানি করা তেলের সিংহভাগ এই পথেই পরিবাহিত হয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের নিকটবর্তী চীনের ভূবেষ্টিত ইউনান প্রদেশের উন্নয়ন জোরদার করা। চীনের কুনমিন প্রদেশও প্রস্তাবিত বন্দরটি ব্যবহার করতে পারবে। ফলে ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে চীনের নৌ ও সড়কপথের দূরত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে।
একইভাবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্য, কলকাতা ও হালদা বন্দর, মিয়ানমার এবং ভূবেষ্টিত নেপাল ও ভুটান তাদের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে এ বন্দর ব্যবহার করবে বলে আশা করা যায়। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর-পূর্ব এশিয়ার কেন্দ্রস্থলে অবস্থানের কারণে আশিয়ান ও উপসাগরীয় দেশগুলোরও এ বন্দর ব্যবহারের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। রাজনৈতিক সমঝোতা ও যোগাযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ এসব দেশের সঙ্গে কার্যকর বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলে সব পক্ষই লাভবান হবে। প্রকৃতপক্ষে, অবস্থানগত কারণে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট সব দেশই পণ্য পরিবহনে ব্যয় ও সময় সাশ্রয়ের সুযোগ পাবে। এ কথা বলা অতিরঞ্জিত হবে না যে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হলে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলো, বিশেষ করে ভারত, চীন, নেপাল ও ভুটানও অর্থনৈতিক দিক থেকে বিপুলভাবে লাভবান হবে।
অতএব, দেশের ক্রমবর্ধমান ব্যবসা-বাণিজ্য এগিয়ে নিতে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে দেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ জরুরি হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক নৌ–চলাচল বর্তমানে খুবই প্রতিযোগিতামূলক। বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর আন্তর্জাতিক নৌপথের নিকটবর্তী এবং সর্বাধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত না হলে আমরা বিশাল সমুদ্র এলাকার ও দেশের ভৌগোলিক অবস্থানের সুবিধা লাভে ব্যর্থ হব। অতএব, কালক্ষেপণ না করে এ বিষয়ে দ্রুত কাজ শুরু করা প্রয়োজন।
মো. নজরুল ইসলাম: বিশেষ প্রতিনিধি ও বিশ্লেষক, প্রথম আলো।
উল্লেখ করা যেতে পারে, বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য প্রতিবছর গড়ে ৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতির সঙ্গে তাল মেলাতে স্বভাবতই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আরও বৃদ্ধি পাবে। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের মাধ্যমে প্রতিবছর আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ ৬০ বিলিয়ন ইউএস ডলার। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিবছর জাহাজ আগমন বৃদ্ধির হার ১১ শতাংশেরও বেশি। বাংলাদেশের বর্তমান সমুদ্রবন্দরগুলো দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের গতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। ফলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক-ব্যবসায়িক সুবিধা অর্জন করতে পারেনি। অর্থাৎ, ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধা আদায়ে বাংলাদেশ কার্যত ব্যর্থ হয়েছে।
বর্তমানে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের পোতাশ্রয়ে মাদার ভেসেল ও বৃহৎ কনটেইনার নোঙর করতে পারে না। গভীরতা কম হওয়ায় মাত্র ১৮ শতাংশ জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে প্রবেশ করতে পারে। আধুনিকায়ন করা হলেও অবস্থার বিশেষ উন্নতি হবে না। বড় জাহাজগুলো গভীর সমুদ্রে নোঙর করার পর ছোট ছোট জাহাজ বা ট্রলারে মালামাল চট্টগ্রাম বন্দরে আনা-নেওয়া করা হয়। ফলে একদিকে সময় বেশি লাগে, অন্যদিকে ব্যয় কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। দেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্দর দুটিতে জাহাজজটের কথাও প্রায়ই শোনা যায়।
এসব সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেশে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ। প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়েই দেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে ঐকমত্য পোষণ করে। বেশ কয়েকটি স্থান জরিপ করার পর জাপানি প্রতিষ্ঠান পেসিফিক কনসালট্যান্ট ইন্টারন্যাশনাল কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সুপারিশ করেছে। প্রস্তাবিত সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ জাহাজ প্রবেশ করতে সক্ষম হবে। এক প্রতিবেদনে তারা বলেছে, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে আন্তর্জাতিক নৌপথগুলোর সংযোগ সাধন করে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাবে। সম্ভাব্যতা যাচাই ২০০৯ সালে সম্পন্ন হলেও সামর্থ্যের অভাবে বন্দর নির্মাণের কাজ এখনো শুরু করা সম্ভব হয়নি। বন্দর নির্মাণের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪২ হাজার কোটি টাকা। ২০৫৫ সালের মধ্যে তিন পর্যায়ে বন্দর নির্মাণের কাজ শেষ হবে বলে আশা করা হয়েছিল। বিভিন্ন কারণে বন্দর নির্মাণের কাজ শুরু হয়নি। ফলে সময় আরও বাড়বে, ব্যয়ও সে হারে বৃদ্ধি পাবে।
সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি প্রধান কেন্দ্রে এ অঞ্চলের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিণত হবে। বন্দরটি ব্যবহার শুরু হলে পরিবহন ব্যয় আনুমানিক ১৫ শতাংশ হ্রাস পাবে। এ ছাড়া বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক বিনিয়োগ হবে, সারা দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন গতি আসবে। কালক্রমে ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক থেকে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরের মতো গুরুত্বপূর্ণ দেশে রূপান্তরিত হবে বলে আশা করা যায়। প্রতিবেশী দেশগুলো এ বন্দর ব্যবহার করলে বাংলাদেশ আর্থিকভাবে লাভবান হবে। এ বন্দরকে কেন্দ্র করে নিকটবর্তী এলাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে, অবকাঠামোগত ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হবে। ফলে কর্মসংস্থান বিপুলভাবে বাড়বে। আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধি পেলে রাজস্ব আয়ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে। তেল-গ্যাস ও অন্যান্য সমুদ্রসম্পদ আহরণ ও ব্যবহারের সুযোগ বাড়বে। সার্বিকভাবে বাৎসরিক জিডিপি বৃদ্ধির হার ২ শতাংশ হবে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন। অন্যদিকে, নিরাপত্তার হুমকি দেখা দিলে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য বিকল্প নৌঘাঁটি হিসেবে বন্দরটি ব্যবহার করা যাবে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে যে সনাতন ধারার সমুদ্রবন্দরগুলো বিকাশমান অর্থনীতির ভার বহনে যে আর সক্ষম হবে না, তা প্রতিবেশী দেশগুলো অনেক আগেই উপলব্ধি করে এবং ক্রমবর্ধমান ব্যবসা-বাণিজ্যের চাহিদা মেটানোর জন্য গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ইতিমধ্যে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমার গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। ভারতও বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে বলে জানা যায়। অবশ্য এতে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব কোনোভাবেই কমবে না। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের চাহিদা পূরণে যে সুবিধা দেবে, অন্য কোনো আঞ্চলিক বন্দর ততটা করবে না বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। সোনাদিয়া সমুদ্রবন্দর ব্যবহারকারী দেশের সংখ্যাও বেশি হবে বলে আশা করা যায়।
বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ নিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনা চলছে। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনসহ কয়েকটি দেশ আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে যে দেশের সঙ্গেই বন্দর নির্মাণের চুক্তি হোক, দেশের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। গভীর সমুদ্রবন্দরের নকশা, নির্মাণ ও পরিচালনায় বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত থাকতে হবে। অবশ্যই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণসংক্রান্ত চুক্তি সব ধরনের বিতর্ক বা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে।
দক্ষিণ এশিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। ইতিমধ্যে পাকিস্তানের গোয়ারদার ও শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটায় চীন গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের কুয়াকফুতে চীন গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। এই প্রেক্ষাপটে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাববলয় বিস্তৃত হওয়া নিয়ে কৌশলগত কারণে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্বস্তি আছে। সামরিক ও নিরাপত্তাগত কারণে চীন ও ভারত উভয়েই বঙ্গোপসাগরের নিয়ন্ত্রণ চায়। বাংলাদেশের জন্য ভূকৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রসীমার ওপর বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জন্য খুবই জরুরি।
এ অঞ্চলের সাগর-মহাসাগরে প্রভাব বিস্তারে চীন ও ভারতের নৌবাহিনীর প্রতিযোগিতা বেশ পুরোনো। আবার এ অঞ্চলে চীনের নৌশক্তি বৃদ্ধি পাক, তা যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দ নয়। চীনের সঙ্গে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ চুক্তি হলে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র যাতে বিরোধিতা না করে, সে জন্য কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগ প্রয়োজন। একই সঙ্গে প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দরের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি বাংলাদেশকেই নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, প্রতিবেশী দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও জঙ্গিদের টার্গেট হতে পারে এ বন্দর।
কৌশলগত কারণে চীনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। চীনের আগ্রহের পেছনে কারণ মূলত দুটি: প্রথমত, দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের উপস্থিতি জোরদার করা, যার ফলে ভারত মহাসাগর অঞ্চলে দেশটির প্রভাব বৃদ্ধি পাবে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে চীনের আমদানি করা তেলের সিংহভাগ এই পথেই পরিবাহিত হয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের নিকটবর্তী চীনের ভূবেষ্টিত ইউনান প্রদেশের উন্নয়ন জোরদার করা। চীনের কুনমিন প্রদেশও প্রস্তাবিত বন্দরটি ব্যবহার করতে পারবে। ফলে ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে চীনের নৌ ও সড়কপথের দূরত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে।
একইভাবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্য, কলকাতা ও হালদা বন্দর, মিয়ানমার এবং ভূবেষ্টিত নেপাল ও ভুটান তাদের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে এ বন্দর ব্যবহার করবে বলে আশা করা যায়। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর-পূর্ব এশিয়ার কেন্দ্রস্থলে অবস্থানের কারণে আশিয়ান ও উপসাগরীয় দেশগুলোরও এ বন্দর ব্যবহারের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। রাজনৈতিক সমঝোতা ও যোগাযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ এসব দেশের সঙ্গে কার্যকর বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলে সব পক্ষই লাভবান হবে। প্রকৃতপক্ষে, অবস্থানগত কারণে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট সব দেশই পণ্য পরিবহনে ব্যয় ও সময় সাশ্রয়ের সুযোগ পাবে। এ কথা বলা অতিরঞ্জিত হবে না যে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হলে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলো, বিশেষ করে ভারত, চীন, নেপাল ও ভুটানও অর্থনৈতিক দিক থেকে বিপুলভাবে লাভবান হবে।
অতএব, দেশের ক্রমবর্ধমান ব্যবসা-বাণিজ্য এগিয়ে নিতে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে দেশে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ জরুরি হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক নৌ–চলাচল বর্তমানে খুবই প্রতিযোগিতামূলক। বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর আন্তর্জাতিক নৌপথের নিকটবর্তী এবং সর্বাধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত না হলে আমরা বিশাল সমুদ্র এলাকার ও দেশের ভৌগোলিক অবস্থানের সুবিধা লাভে ব্যর্থ হব। অতএব, কালক্ষেপণ না করে এ বিষয়ে দ্রুত কাজ শুরু করা প্রয়োজন।
মো. নজরুল ইসলাম: বিশেষ প্রতিনিধি ও বিশ্লেষক, প্রথম আলো।
No comments