প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা আরও বাড়বে by মইনুল ইসলাম
১৮ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে সংবিধানের প্রস্তাবিত ষোড়শ সংশোধনীর খসড়া অনুমোদিত হয়েছে, যাতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা ১৯৭২ সালের সংবিধানে যেভাবে সংসদের কাছে ন্যস্ত ছিল, সেভাবে সংসদকে ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই ক্ষমতা ১৯৭৫ সালে গৃহীত সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী মোতাবেক সংসদের কাছ থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে হস্তান্তরিত হয়েছিল এবং ১৯৭৮ সালে সংসদ বিলুপ্ত থাকা অবস্থায় জিয়াউর রহমানের সামরিক ফরমানবলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে অর্পণ করা হয়েছিল। পরে তা ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান প্রবর্তিত সংসদে পাস হওয়া সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে পঞ্চম সংশোধনী চূড়ান্তভাবে বাতিল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে সংবিধানের যে পঞ্চদশ সংশোধনী সংসদে পাস হয়েছে, তাতেও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে অর্পিত ক্ষমতাটি বহাল রাখা হয়েছিল। তিন বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতাটি আবার সংসদে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন কেন নতুন করে উপলব্ধি হচ্ছে, তা বোঝা মুশকিল বৈকি! তবে সন্দেহ করার কারণ রয়েছে যে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মাথার ওপর ‘সোর্ড অব ডেমোক্লিস’ বা খড়্গ ঝোলানোর জন্য এই ব্যবস্থাটি মোক্ষম দাওয়াই হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
কিন্তু এতে যে সরকারের তিনটি অঙ্গ—সংসদ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের ওপর প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা আরও পাকাপোক্ত হবে, সে ব্যাপারটি কি বুঝতে পারছি না আমরা? সংবিধানের ৭০ ধারার কারণে সংসদের সরকারি দল বা জোটের সাংসদদের নিরঙ্কুশ আনুগত্য প্রধানমন্ত্রীর করতলগত রয়েছে। এই অবস্থায় দুই-তৃতীয়াংশ সাংসদের সমর্থনের প্রয়োজনীয়তার শর্ত অন্যায়ভাবে কোনো বিচারপতির অভিশংসনের বিরুদ্ধে কোনো অর্থবহ রক্ষাকবচ হতে পারবে না, কারণ সংসদ নেত্রী তথা প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা সরকারি দল বা জোটের সাংসদদের নেই।
এমতাবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর যদি ইচ্ছা হয় যে তিনি কোনো বিচারপতিকে অপসারণ করবেন, তাহলে সংসদের সরকারদলীয় বা জোটভুক্ত সদস্যদের ভোট এবং রাষ্ট্রপতির অনুমোদন দুটোই পাওয়ার পথে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে আমাদের সংবিধান, কারণ মহামান্য রাষ্ট্রপতিরও ক্ষমতা নেই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের বাইরে কিছু করার। তাই প্রকৃত বিচারে প্রধানমন্ত্রীকে সরকারের তিনটি অঙ্গের ওপরেই একক ক্ষমতাধর করে ফেলার এই সাংবিধানিক ব্যবস্থাটি বিচারপতিদের নিরপেক্ষতার জন্য বিপজ্জনক হবে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। স্বীকার করতে বাধা নেই যে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগে দলবাজি চালু হয়ে যাওয়ার কারণে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই ষোড়শ সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে আরও চিন্তাভাবনার প্রয়োজন রয়েছে।
সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং বর্তমানে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি খায়রুল হক শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। কারণ, তাঁর নেতৃত্বে প্রদত্ত ঐতিহাসিক রায়গুলো এই জাতিকে সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর কলঙ্কজনক অধ্যায় থেকে মুক্তি দিয়েছে। সম্প্রতি তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন যে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে দিলে বিচারপতিদের ভয়ের কারণ নেই। আমার অজানা কোনো তথ্যের ভিত্তিতে হয়তো তিনি তাঁর এই অভিমত দিয়েছেন, কিন্তু তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, তাঁর এই আশ্বাসে আমি আশ্বস্ত হতে পারছি না। তাঁকে বিনীতভাবে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে তিনি নিজেই সংবিধানের ৭০ ধারার প্রসঙ্গ টেনে মন্তব্য করেছিলেন, ‘এর ফলে সাংসদেরা নিজেদের দলের কাছে বন্দী হয়ে আছেন’ (প্রিজনারস টু দেয়ার ওন পার্টিজ)।
এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশে সংসদের কাছে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা ন্যস্ত থাকার নজির উল্লেখ করে এ দেশেও তা সংসদে ফিরিয়ে দেওয়ার যে যুক্তি তিনি তুলে ধরেছেন, তা কতখানি যুক্তিসংগত হচ্ছে, বুঝতে পারছি না। বরং এ ব্যাপারে আরেকজন শ্রদ্ধেয় সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তাফা কামালের আশঙ্কাটাই বেশি যৌক্তিক মনে হচ্ছে। কারণ, গত বছর শ্রীলঙ্কায় স্রেফ সংসদের ভোটের জোরে যেভাবে ওই দেশের তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি শিরানী বন্দরনায়েককে প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য অভিশংসনের শিকার হতে হয়েছিল, সেটাই তো আমাদের মতো দেশগুলোর প্রকৃত বাস্তবতার প্রতিফলন!
আমাদের সংবিধানে তো প্রকৃত গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচিত সরকারের তিনটি অঙ্গের ‘ব্যালান্স অব পাওয়ার’ কিংবা ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়নি মূল সংবিধান প্রণয়নের সময় বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখে সব ক্ষমতা তাঁর হাতে পুঞ্জীভূত করার কারণে। ১৯৭৫ সালে পাস হওয়া সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতির কাছে আরও বেশি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯১ সালে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী পাসের সময় রাষ্ট্রপতির এসব ক্ষমতা আবার প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। আরও দুঃখজনক হলো, বিএনপির চাণক্য প্রবরেরা বেগম খালেদা জিয়াকে আরও বেশি সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রদানের উদ্দেশ্যে দ্বাদশ সংশোধনীতে সুচিন্তিতভাবে অধিক ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর কাছে ন্যস্ত করেছিল।
এভাবে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতা পুঞ্জীভূত করা এবং উল্লিখিত ওই সব সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় ‘একনায়কসুলভ’ করে ফেলা হয়েছে, যেটাকে আমাদের সংবিধানের মারাত্মক ত্রুটি বলে মনে করি। সুপ্রিম কোর্টের সব বিচারপতির নিয়োগ ১৯৭২ সাল থেকেই এ দেশে পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রীর বা রাষ্ট্রপতির একক ইচ্ছাধীন বিষয়ে পরিণত হয়েছে, যার ফলে যে দল বা জোট যখন ক্ষমতায় এসেছে, তারা তাদের দল বা জোটের সক্রিয় সমর্থকদের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বানিয়েছে। ১৯৭৫-১৯৯১ পর্বের সামরিক শাসকেরাও এই ভারসাম্যহীন সুবিধাটুকু নিজেদের জন্য বহাল রেখেছেন।
১৯৭৫ সালের নভেম্বরে এ দেশে ঘোষিত সামরিক শাসনব্যবস্থায় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছিলেন দেশের তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি। পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান তাঁকে ওই পদ থেকে বিতাড়িত করেছিলেন। জিয়া জাগদল ও বিএনপির গঠন পর্বে ওই দলের আন্তর্জাতিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকারী যে ব্যক্তিকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বানিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন, তাঁকে ২০০৬ সালে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বানাতে গিয়ে খালেদা জিয়া জাতিকে মহাবিপদে ফেলে দিয়েছিলেন। বিভিন্ন সামরিক শাসক একাধিকবার বিচারপতিদের প্রধান নির্বাচন কমিশনার বানিয়ে ভুয়া নির্বাচনী নাটক মঞ্চস্থ করেছেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাকে যে বিচারপতি আওয়ামী লীগ এবং প্রতিবেশী দেশের ষড়যন্ত্র বলে মনগড়া গল্প ফেঁদেছিলেন, তাঁকে ওই ভুয়া তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পুরস্কার হিসেবে খালেদা জিয়া কিছুদিনের মধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি বানিয়েছিলেন! (তিনি এখনো দাবি করে চলেছেন যে তাঁর প্রতিবেদন ছিল একেবারেই সাচ্চা!!) ২০০৬ সালে বিচারপতি আজিজের কীর্তিকাহিনি নিশ্চয়ই জনগণ বিস্মৃত হননি।
উল্লিখিত গুটি কয়েক নজির তুলে ধরেছি এ কথাটা বলার জন্যই যে এ দেশের সুপ্রিম কোর্টসহ পুরো বিচার বিভাগে ৪৩ বছরের দলীয়করণের ধারাবাহিকতায় দল–অনুগতদের প্রাধান্য পেতে আর বেশি দেরি নেই। জাতির এই সর্বনাশটা আমরা মহাসুখেই মেনে নিচ্ছি মনে হচ্ছে! আমি দৃঢ়ভাবেই বলতে চাই, বিচার বিভাগকে এভাবে প্রধানমন্ত্রীর আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার খেলা আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষমতার প্রতি অন্ধ মোহ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর বিবেকবর্জিত দেউলিয়াত্বেরই ফল, যা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অভীপ্সার অভিপ্রকাশ। বহুদিন জাতিকে এর খেসারত দিতে হবে।
১৯৭২-৭৫ পর্বের বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অভিশংসনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের বছরগুলোতে বিচার বিভাগের আচরণ নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে কোনো দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়নি। ওই সময়ে সংসদে আওয়ামী লীগের প্রায় ৯৭ শতাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার পাশাপাশি তাঁর ব্যক্তিত্বের কারণে সরকারের নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের সংঘাত হওয়ার তেমন অবকাশ ছিল না। আর রাজনৈতিক দলবাজি এখন যেভাবে বিচারক ও বিচারপতি নিয়োগকে কলুষিত করছে, তাও তখন ছিল অচিন্তনীয়। দলীয় আনুগত্যের কারণে আটজন বিচারপতি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শুনানি শুনতে বিব্রত বোধ করেছিলেন বলে অভিযোগ আছে। এর বিপরীতে রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষার অভিযোগ উঠেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক সাঈদীর বিরুদ্ধে প্রদত্ত ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল মামলার রায় বিলম্বিত করার ঘটনায়। এ বিষয়ে সন্দেহটা ক্রমেই পাকাপোক্ত হচ্ছে। সর্বোচ্চ বিচারালয়ের প্রতি আস্থার ক্রমবর্ধমান ঘাটতি জনগণের মধ্যে বিরাজমান রাজনৈতিক বিভাজন যে দিন দিন বাড়িয়ে দিচ্ছে, তাও কি আমরা বুঝতে চাইছি না?
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ক্ষমতাসীন জোট আগামী সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠেয় সংসদের অধিবেশনেই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস করতে বদ্ধপরিকর। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমার আহ্বান, অভিযুক্ত বিচারপতির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগসমূহ তদন্তের দায়িত্বভার অন্ততপক্ষে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপর অর্পণ করা হোক এবং সেখানে তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের পূর্ণ সুযোগ দেওয়া হোক। আরও গুরুত্বপূর্ণ, বিচারপতির অভিশংসনের পক্ষে-বিপক্ষে ভোট প্রদানের ব্যাপারে সাংসদদের ওপর সংবিধানের ৭০ ধারার বিধান কার্যকর হবে না মর্মে আইন প্রণীত হোক। আমিও নির্দ্বিধায় বলছি, জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে দেশের জনগণের নির্বাচিত সংসদ। বিচারপতিরা অভিশংসনের ঊর্ধ্বে থাকবেন, তাও হয়তো যৌক্তিক নয়। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় আমাদের সংবিধান সরকারের অঙ্গসমূহের ‘ব্যালান্স অব পাওয়ার’ যেভাবে বিনষ্ট করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে উল্লিখিত দুটি প্রস্তাব কিছুটা ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ প্রতিষ্ঠা করবে বলেই আমার বিশ্বাস।
মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।
২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে পঞ্চম সংশোধনী চূড়ান্তভাবে বাতিল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে সংবিধানের যে পঞ্চদশ সংশোধনী সংসদে পাস হয়েছে, তাতেও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে অর্পিত ক্ষমতাটি বহাল রাখা হয়েছিল। তিন বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতাটি আবার সংসদে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন কেন নতুন করে উপলব্ধি হচ্ছে, তা বোঝা মুশকিল বৈকি! তবে সন্দেহ করার কারণ রয়েছে যে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের মাথার ওপর ‘সোর্ড অব ডেমোক্লিস’ বা খড়্গ ঝোলানোর জন্য এই ব্যবস্থাটি মোক্ষম দাওয়াই হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
কিন্তু এতে যে সরকারের তিনটি অঙ্গ—সংসদ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের ওপর প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা আরও পাকাপোক্ত হবে, সে ব্যাপারটি কি বুঝতে পারছি না আমরা? সংবিধানের ৭০ ধারার কারণে সংসদের সরকারি দল বা জোটের সাংসদদের নিরঙ্কুশ আনুগত্য প্রধানমন্ত্রীর করতলগত রয়েছে। এই অবস্থায় দুই-তৃতীয়াংশ সাংসদের সমর্থনের প্রয়োজনীয়তার শর্ত অন্যায়ভাবে কোনো বিচারপতির অভিশংসনের বিরুদ্ধে কোনো অর্থবহ রক্ষাকবচ হতে পারবে না, কারণ সংসদ নেত্রী তথা প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা সরকারি দল বা জোটের সাংসদদের নেই।
এমতাবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর যদি ইচ্ছা হয় যে তিনি কোনো বিচারপতিকে অপসারণ করবেন, তাহলে সংসদের সরকারদলীয় বা জোটভুক্ত সদস্যদের ভোট এবং রাষ্ট্রপতির অনুমোদন দুটোই পাওয়ার পথে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে আমাদের সংবিধান, কারণ মহামান্য রাষ্ট্রপতিরও ক্ষমতা নেই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের বাইরে কিছু করার। তাই প্রকৃত বিচারে প্রধানমন্ত্রীকে সরকারের তিনটি অঙ্গের ওপরেই একক ক্ষমতাধর করে ফেলার এই সাংবিধানিক ব্যবস্থাটি বিচারপতিদের নিরপেক্ষতার জন্য বিপজ্জনক হবে বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। স্বীকার করতে বাধা নেই যে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগে দলবাজি চালু হয়ে যাওয়ার কারণে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এই ষোড়শ সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে আরও চিন্তাভাবনার প্রয়োজন রয়েছে।
সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং বর্তমানে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি খায়রুল হক শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। কারণ, তাঁর নেতৃত্বে প্রদত্ত ঐতিহাসিক রায়গুলো এই জাতিকে সংবিধানের পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর কলঙ্কজনক অধ্যায় থেকে মুক্তি দিয়েছে। সম্প্রতি তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন যে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে দিলে বিচারপতিদের ভয়ের কারণ নেই। আমার অজানা কোনো তথ্যের ভিত্তিতে হয়তো তিনি তাঁর এই অভিমত দিয়েছেন, কিন্তু তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, তাঁর এই আশ্বাসে আমি আশ্বস্ত হতে পারছি না। তাঁকে বিনীতভাবে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে তিনি নিজেই সংবিধানের ৭০ ধারার প্রসঙ্গ টেনে মন্তব্য করেছিলেন, ‘এর ফলে সাংসদেরা নিজেদের দলের কাছে বন্দী হয়ে আছেন’ (প্রিজনারস টু দেয়ার ওন পার্টিজ)।
এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশে সংসদের কাছে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা ন্যস্ত থাকার নজির উল্লেখ করে এ দেশেও তা সংসদে ফিরিয়ে দেওয়ার যে যুক্তি তিনি তুলে ধরেছেন, তা কতখানি যুক্তিসংগত হচ্ছে, বুঝতে পারছি না। বরং এ ব্যাপারে আরেকজন শ্রদ্ধেয় সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তাফা কামালের আশঙ্কাটাই বেশি যৌক্তিক মনে হচ্ছে। কারণ, গত বছর শ্রীলঙ্কায় স্রেফ সংসদের ভোটের জোরে যেভাবে ওই দেশের তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি শিরানী বন্দরনায়েককে প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য অভিশংসনের শিকার হতে হয়েছিল, সেটাই তো আমাদের মতো দেশগুলোর প্রকৃত বাস্তবতার প্রতিফলন!
আমাদের সংবিধানে তো প্রকৃত গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচিত সরকারের তিনটি অঙ্গের ‘ব্যালান্স অব পাওয়ার’ কিংবা ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়নি মূল সংবিধান প্রণয়নের সময় বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখে সব ক্ষমতা তাঁর হাতে পুঞ্জীভূত করার কারণে। ১৯৭৫ সালে পাস হওয়া সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতির কাছে আরও বেশি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯১ সালে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী পাসের সময় রাষ্ট্রপতির এসব ক্ষমতা আবার প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। আরও দুঃখজনক হলো, বিএনপির চাণক্য প্রবরেরা বেগম খালেদা জিয়াকে আরও বেশি সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রদানের উদ্দেশ্যে দ্বাদশ সংশোধনীতে সুচিন্তিতভাবে অধিক ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর কাছে ন্যস্ত করেছিল।
এভাবে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতা পুঞ্জীভূত করা এবং উল্লিখিত ওই সব সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় ‘একনায়কসুলভ’ করে ফেলা হয়েছে, যেটাকে আমাদের সংবিধানের মারাত্মক ত্রুটি বলে মনে করি। সুপ্রিম কোর্টের সব বিচারপতির নিয়োগ ১৯৭২ সাল থেকেই এ দেশে পুরোপুরি প্রধানমন্ত্রীর বা রাষ্ট্রপতির একক ইচ্ছাধীন বিষয়ে পরিণত হয়েছে, যার ফলে যে দল বা জোট যখন ক্ষমতায় এসেছে, তারা তাদের দল বা জোটের সক্রিয় সমর্থকদের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বানিয়েছে। ১৯৭৫-১৯৯১ পর্বের সামরিক শাসকেরাও এই ভারসাম্যহীন সুবিধাটুকু নিজেদের জন্য বহাল রেখেছেন।
১৯৭৫ সালের নভেম্বরে এ দেশে ঘোষিত সামরিক শাসনব্যবস্থায় প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছিলেন দেশের তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি। পরবর্তী সময়ে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান তাঁকে ওই পদ থেকে বিতাড়িত করেছিলেন। জিয়া জাগদল ও বিএনপির গঠন পর্বে ওই দলের আন্তর্জাতিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকারী যে ব্যক্তিকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বানিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন, তাঁকে ২০০৬ সালে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বানাতে গিয়ে খালেদা জিয়া জাতিকে মহাবিপদে ফেলে দিয়েছিলেন। বিভিন্ন সামরিক শাসক একাধিকবার বিচারপতিদের প্রধান নির্বাচন কমিশনার বানিয়ে ভুয়া নির্বাচনী নাটক মঞ্চস্থ করেছেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাকে যে বিচারপতি আওয়ামী লীগ এবং প্রতিবেশী দেশের ষড়যন্ত্র বলে মনগড়া গল্প ফেঁদেছিলেন, তাঁকে ওই ভুয়া তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পুরস্কার হিসেবে খালেদা জিয়া কিছুদিনের মধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি বানিয়েছিলেন! (তিনি এখনো দাবি করে চলেছেন যে তাঁর প্রতিবেদন ছিল একেবারেই সাচ্চা!!) ২০০৬ সালে বিচারপতি আজিজের কীর্তিকাহিনি নিশ্চয়ই জনগণ বিস্মৃত হননি।
উল্লিখিত গুটি কয়েক নজির তুলে ধরেছি এ কথাটা বলার জন্যই যে এ দেশের সুপ্রিম কোর্টসহ পুরো বিচার বিভাগে ৪৩ বছরের দলীয়করণের ধারাবাহিকতায় দল–অনুগতদের প্রাধান্য পেতে আর বেশি দেরি নেই। জাতির এই সর্বনাশটা আমরা মহাসুখেই মেনে নিচ্ছি মনে হচ্ছে! আমি দৃঢ়ভাবেই বলতে চাই, বিচার বিভাগকে এভাবে প্রধানমন্ত্রীর আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার খেলা আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষমতার প্রতি অন্ধ মোহ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর বিবেকবর্জিত দেউলিয়াত্বেরই ফল, যা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অভীপ্সার অভিপ্রকাশ। বহুদিন জাতিকে এর খেসারত দিতে হবে।
১৯৭২-৭৫ পর্বের বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অভিশংসনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের বছরগুলোতে বিচার বিভাগের আচরণ নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে কোনো দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়নি। ওই সময়ে সংসদে আওয়ামী লীগের প্রায় ৯৭ শতাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার পাশাপাশি তাঁর ব্যক্তিত্বের কারণে সরকারের নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের সংঘাত হওয়ার তেমন অবকাশ ছিল না। আর রাজনৈতিক দলবাজি এখন যেভাবে বিচারক ও বিচারপতি নিয়োগকে কলুষিত করছে, তাও তখন ছিল অচিন্তনীয়। দলীয় আনুগত্যের কারণে আটজন বিচারপতি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শুনানি শুনতে বিব্রত বোধ করেছিলেন বলে অভিযোগ আছে। এর বিপরীতে রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষার অভিযোগ উঠেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক সাঈদীর বিরুদ্ধে প্রদত্ত ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল মামলার রায় বিলম্বিত করার ঘটনায়। এ বিষয়ে সন্দেহটা ক্রমেই পাকাপোক্ত হচ্ছে। সর্বোচ্চ বিচারালয়ের প্রতি আস্থার ক্রমবর্ধমান ঘাটতি জনগণের মধ্যে বিরাজমান রাজনৈতিক বিভাজন যে দিন দিন বাড়িয়ে দিচ্ছে, তাও কি আমরা বুঝতে চাইছি না?
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ক্ষমতাসীন জোট আগামী সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠেয় সংসদের অধিবেশনেই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস করতে বদ্ধপরিকর। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমার আহ্বান, অভিযুক্ত বিচারপতির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগসমূহ তদন্তের দায়িত্বভার অন্ততপক্ষে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপর অর্পণ করা হোক এবং সেখানে তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের পূর্ণ সুযোগ দেওয়া হোক। আরও গুরুত্বপূর্ণ, বিচারপতির অভিশংসনের পক্ষে-বিপক্ষে ভোট প্রদানের ব্যাপারে সাংসদদের ওপর সংবিধানের ৭০ ধারার বিধান কার্যকর হবে না মর্মে আইন প্রণীত হোক। আমিও নির্দ্বিধায় বলছি, জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে দেশের জনগণের নির্বাচিত সংসদ। বিচারপতিরা অভিশংসনের ঊর্ধ্বে থাকবেন, তাও হয়তো যৌক্তিক নয়। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় আমাদের সংবিধান সরকারের অঙ্গসমূহের ‘ব্যালান্স অব পাওয়ার’ যেভাবে বিনষ্ট করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে উল্লিখিত দুটি প্রস্তাব কিছুটা ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ প্রতিষ্ঠা করবে বলেই আমার বিশ্বাস।
মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।
No comments