ইরাক ও সিরিয়ায় ইউরোপের দোদুল্যমানতা by পিটার কাস্টার্স
এ এক বিরল ক্ষণ, নীতিপ্রণেতারা নিজে থেকেই একটি বড় ভুল শোধরালেন। নাকি এটা একটা ঠান্ডা মাথার স্বার্থপর পিঠটান? ১৫ আগস্ট ব্রাসেলসে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো চাইলে ইরাকের উত্তরাঞ্চলে সুন্নি জঙ্গি আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইরত কুর্দি বিদ্রোহীদের অস্ত্র সরবরাহ করতে পারবে। এমনকি জার্মানিও কুর্দিদের অস্ত্রবাহী গাড়ি ও অন্যান্য হার্ডওয়্যার সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ আগে দেশটি সাধারণত যুদ্ধংদেহী অঞ্চলগুলোয় অস্ত্র সরবরাহ করতে চাইত না।
এ সিদ্ধান্তে অনেকেই হয়তো চমকে যাবেন, কারণ মাত্র ১৬ মাস আগে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সিরিয়ার তেল আমদানিবিষয়ক সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কারণটা ছিল একদম পানির মতো পরিষ্কার, যাতে আইএস অধিকৃত সিরিয়ার উত্তর-পূর্ব এলাকা থেকে তেল সরবরাহ সম্ভব হয়৷ সেখানকার অনেকগুলো তেলক্ষেত্রের ওপর এই সুন্নি জঙ্গি সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ ছিল। সিরিয়ার তেল নিয়ন্ত্রণের দাবিদার শুধু আইএস নয়, আরও অনেক সংগঠনই এর দাবিদার ছিল। তার পরও এ ব্যাপারে একটু সন্দেহ রয়েই যায় যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের এই সিদ্ধান্তের কারণে আইএসের বাড়বাড়ন্ত হয়েছে, ফলে তারা ইরাকের উত্তরাঞ্চলের তেলক্ষেত্রগুলোতেও নিজেদের আধিপত্য স্থাপন করেছে।
ব্রাসেলসে গৃহীত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের এই সিদ্ধান্তটি আগের একটি বিপর্যয়কর সিদ্ধান্ত উল্টে ফেলার মতো। বিষয়টি আরেকটু খোলাসা করতে হলে সুন্নি জঙ্গি আইএস ইরাক ও সিরিয়ার তেলক্ষেত্রগুলোয় কী পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পেরেছে, সেটা বোঝা দরকার। সিরিয়ার তেলক্ষেত্রগুলো অধিকাংশই ডেইয়ার-এজ-জর প্রদেশে অবস্থিত, এটা ইরাকের নিকটবর্তী একটি প্রদেশ। বিশ্ববাজারে সরবরাহের তুলনায় সিরিয়ায় উত্তোলিত তেলের পরিমাণ খুবই কম হওয়ায় দেশটির তেল ও শোধনাগারগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়াটা আইএসের যুদ্ধের অর্থায়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে ইরাকের তেলক্ষেত্রগুলো আবার সিরিয়ার মতো কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ নয়। ইরাকের তেলক্ষেত্রগুলোর বেশির ভাগই দেশটির দক্ষিণে অবস্থিত, আর আইএসের অবস্থান এখনো উত্তরে। বাস্তবে ইরাকের তেলের মাত্র এক-সপ্তমাংশ আইএস ও কুর্দি যোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তথাপি খবর এসেছে, আইএস ইরাকের সাতটি বড় তেলক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করছে। সিরিয়ার তেলক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আইএস ভালোই অভিজ্ঞতা লাভ করেছে, তারা এখন সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই তেল বিক্রি ও চোরাচালান করে বিপুল মুনাফা লাভ করছে। কথা হচ্ছে, ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসের এই তেল থেকে প্রাপ্ত অর্থভিত্তিক যে গৃহযুদ্ধ চলছে, সে কারণে পশ্চিমা বিশ্বের শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের এক ঠান্ডা চোরা স্রোত বয়ে যাচ্ছে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ২০১৩ সালের এপ্রিলে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা যদি আইএসের বর্তমান সফলতার কারণ হয়ে থাকে, তাহলে সেটা ঐতিহাসিকভাবে এক অভিনব পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। আমার জানামতে, কোনো বিদ্রোহী গ্রুপ এর আগে তেলের ওপর ভর করে গৃহযুদ্ধ চালায়নি। এটা সত্য যে আফ্রিকায় ৩০ বছর ধরে যে গৃহযুদ্ধ চলছে, সে ক্ষেত্রে বিদ্রোহীদের সফলতার কারণ হচ্ছে তারা সেখানকার কাঁচামালের নিয়ন্ত্রণ নিতে পেরেছিল। অ্যাঙ্গোলা, সিয়েরা লিওন, লাইবেরিয়া, কঙ্গো (ডিআরসি) ও সুদানের দিকে নজর দিন, দেখবেন, সেখানে এই কাঁচামালই প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে। তার পরও সেই সব দেশে তেলের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের হাতেই ছিল। অ্যাঙ্গোলার ডানপন্থী বিদ্রোহী দল ইউনিটার আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে কাঁচা হীরা চোরাচালানের মাধ্যমে। সেখানকার তেলক্ষেত্রগুলো ইউনিটার অধিকৃত এলাকা থেকে অনেক দূরে অবস্থিত ছিল। সুদানের তেলক্ষেত্রগুলো দেশটির দক্ষিণে অবস্থিত, দক্ষিণের বিদ্রোহীদের অধিকৃত এলাকার কাছাকাছি। কিন্তু আল বশিরের সরকার সেখানে এক অমানবিক নীতি গ্রহণ করেছিল, তারা সেখানে আকাশ থেকে বোমাবর্ষণ করে এলাকাটিকে জনশূন্য করে ফেলে—সেখানকার অসহায় মানুষকে কচুকাটা করে এবং জীবিত ব্যক্তিদের এলাকাছাড়া হতে বাধ্য করে। একই প্রক্রিয়ায় বিদ্রোহীরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, আর তেলের নিয়ন্ত্রণ লাভে ব্যর্থ হয়। মানে, সব বিচারেই দেখা যায় যে তেলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কেউই এর আগে গৃহযুদ্ধ চালাতে পারেনি।
হ্যাঁ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন যে আইএসের কার্যত সমর্থক থেকে বিরোধীতে পরিণত হলো, এর পেছনে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত অবস্থান। যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ইরাকের উত্তরে আইএসের ঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ শুরু করেছে। একসময় আইএসের নিরন্তর সংখ্যালঘু নিধনে জোর গলায় সমর্থন দিলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে তার অবস্থান পরিবর্তন করল, সেটা তার নিজের স্বার্থের কারণেই সে করছে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পেন্টাগনের কর্মকর্তাদের মাথায় এখন অস্ত্র ও তেলের যুগলবন্দীর ব্যাপারটিই কাজ করছে। ওবামা প্রশাসন ২০১১ সালের অক্টোবরে ইরাক থেকে সেনা প্রত্যাহার করার পর যুক্তরাষ্ট্র ইরাক সরকারের কাছে ১২ বিলিয়ন ডলারের এফ-১৬ বিমান বিক্রি করেছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় পাঁচটি সমর করপোরেশনের মধ্যে অন্তত চারটি লাভবান হয়েছে। যুগপৎভাবে এই অস্ত্র বিক্রির চুক্তি যখন হয়, তখন ইরাকের দৈনিক অপরিশোধিত তেল উত্তোলনের পরিমাণ আগের জায়গায় চলে যায়, ২০১২ সালে এর পরিমাণ ছিল দৈনিক তিন মিলিয়ন ব্যারেল, চুক্তির সময় এটা সেই সীমাও ছাড়িয়ে যায়। ইরাকি সরকার যখন তেল আহরণ ও রপ্তানি থেকে বিপুল পরিমাণ আয় করছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র ও তার প্রতিদ্বন্দ্বী অস্ত্র উৎপাদক রাশিয়া ইরাকে অস্ত্র সরবরাহের প্রতিযোগিতায় নামে। এই তেল ও অস্ত্রের যুগলবন্দী দীর্ঘস্থায়ী হবে, সেটা নিয়ে ব্যাপক আত্মবিশ্বাসও রয়েছে। পশ্চিমা তেল ক্রেতাদের সংগঠন আইইএর মতে, ভবিষ্যতে দুনিয়ার অপরিশোধিত তেল সরবরাহে ইরাক এগিয়ে থাকবে।
পশ্চিমা নীতিপ্রণেতারা হন্যে হয়ে শিয়া মুসলিম, খ্রিষ্টান ও ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মানুষের অধিকারের প্রতি সমর্থন দিচ্ছেন। আবার এই আইএস যে এই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ইরাকের উত্তরাঞ্চলে কতল করছে, সেটা নিয়েও কোনো সন্দেহ নেই। সুন্নি চরমপন্থী জঙ্গিরা মুসলিম ও অমুসলিম সব সম্প্রদায়ের মানুষকেই নিপীড়ন করছে। কিন্তু কেউ কি বলতে পারবেন, পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো ধারাবাহিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষা করেছে? যুক্তরাষ্ট্রের অবৈধভাবে ইরাক দখলের পর এ চিন্তাটির উদয় হয়েছে।
কিন্তু ইসরায়েলের মুসলিম ও খ্রিষ্টান আরব, বাহরাইন ও সৌদি আরবের শিয়া ও অন্য গোষ্ঠীগুলো, যারা পশ্চিমের মিত্রদের হাতে নিগৃহীত হয়েছে, তারা কি ইরাকের ইয়াজিদিদের রক্ষায় পশ্চিমের এই সংকল্প দেখে পুলকিত হবে? যা-ই হোক, সময় এসেছে, ব্রাসেলসে নীতিপ্রণেতাদের এই নীতি পরিবর্তন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হবে।
স্মরণ করা যেতে পারে, ইরাক ও সিরিয়ায় চলমান এই দুই গৃহযুদ্ধ নিয়ে এই মতি পরিবর্তন দুবার ঘটেছে। প্রথমত, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিরিয়ার বিনিয়োগ ও দেশটির তেল রপ্তানিতে সাধারণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এতে আসাদের সরকার ও বিরোধী পক্ষ উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর ২০১৩ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কার্যত এই সুন্নি জঙ্গিদের পক্ষে অবস্থান নেয়। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা তাঁদের পাপ বুঝতে পারলেও সংস্থাটির মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক নীতির মৌলিক পরিবর্তন না হলে এ ক্ষতের উপশম হবে না।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
ড. পিটার কাস্টার্স: অস্ত্রবাণিজ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ।
এ সিদ্ধান্তে অনেকেই হয়তো চমকে যাবেন, কারণ মাত্র ১৬ মাস আগে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সিরিয়ার তেল আমদানিবিষয়ক সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার কারণটা ছিল একদম পানির মতো পরিষ্কার, যাতে আইএস অধিকৃত সিরিয়ার উত্তর-পূর্ব এলাকা থেকে তেল সরবরাহ সম্ভব হয়৷ সেখানকার অনেকগুলো তেলক্ষেত্রের ওপর এই সুন্নি জঙ্গি সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ ছিল। সিরিয়ার তেল নিয়ন্ত্রণের দাবিদার শুধু আইএস নয়, আরও অনেক সংগঠনই এর দাবিদার ছিল। তার পরও এ ব্যাপারে একটু সন্দেহ রয়েই যায় যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের এই সিদ্ধান্তের কারণে আইএসের বাড়বাড়ন্ত হয়েছে, ফলে তারা ইরাকের উত্তরাঞ্চলের তেলক্ষেত্রগুলোতেও নিজেদের আধিপত্য স্থাপন করেছে।
ব্রাসেলসে গৃহীত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের এই সিদ্ধান্তটি আগের একটি বিপর্যয়কর সিদ্ধান্ত উল্টে ফেলার মতো। বিষয়টি আরেকটু খোলাসা করতে হলে সুন্নি জঙ্গি আইএস ইরাক ও সিরিয়ার তেলক্ষেত্রগুলোয় কী পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পেরেছে, সেটা বোঝা দরকার। সিরিয়ার তেলক্ষেত্রগুলো অধিকাংশই ডেইয়ার-এজ-জর প্রদেশে অবস্থিত, এটা ইরাকের নিকটবর্তী একটি প্রদেশ। বিশ্ববাজারে সরবরাহের তুলনায় সিরিয়ায় উত্তোলিত তেলের পরিমাণ খুবই কম হওয়ায় দেশটির তেল ও শোধনাগারগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়াটা আইএসের যুদ্ধের অর্থায়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে ইরাকের তেলক্ষেত্রগুলো আবার সিরিয়ার মতো কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ নয়। ইরাকের তেলক্ষেত্রগুলোর বেশির ভাগই দেশটির দক্ষিণে অবস্থিত, আর আইএসের অবস্থান এখনো উত্তরে। বাস্তবে ইরাকের তেলের মাত্র এক-সপ্তমাংশ আইএস ও কুর্দি যোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তথাপি খবর এসেছে, আইএস ইরাকের সাতটি বড় তেলক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করছে। সিরিয়ার তেলক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আইএস ভালোই অভিজ্ঞতা লাভ করেছে, তারা এখন সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই তেল বিক্রি ও চোরাচালান করে বিপুল মুনাফা লাভ করছে। কথা হচ্ছে, ইরাক ও সিরিয়ায় আইএসের এই তেল থেকে প্রাপ্ত অর্থভিত্তিক যে গৃহযুদ্ধ চলছে, সে কারণে পশ্চিমা বিশ্বের শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের এক ঠান্ডা চোরা স্রোত বয়ে যাচ্ছে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ২০১৩ সালের এপ্রিলে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা যদি আইএসের বর্তমান সফলতার কারণ হয়ে থাকে, তাহলে সেটা ঐতিহাসিকভাবে এক অভিনব পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। আমার জানামতে, কোনো বিদ্রোহী গ্রুপ এর আগে তেলের ওপর ভর করে গৃহযুদ্ধ চালায়নি। এটা সত্য যে আফ্রিকায় ৩০ বছর ধরে যে গৃহযুদ্ধ চলছে, সে ক্ষেত্রে বিদ্রোহীদের সফলতার কারণ হচ্ছে তারা সেখানকার কাঁচামালের নিয়ন্ত্রণ নিতে পেরেছিল। অ্যাঙ্গোলা, সিয়েরা লিওন, লাইবেরিয়া, কঙ্গো (ডিআরসি) ও সুদানের দিকে নজর দিন, দেখবেন, সেখানে এই কাঁচামালই প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে। তার পরও সেই সব দেশে তেলের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের হাতেই ছিল। অ্যাঙ্গোলার ডানপন্থী বিদ্রোহী দল ইউনিটার আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে কাঁচা হীরা চোরাচালানের মাধ্যমে। সেখানকার তেলক্ষেত্রগুলো ইউনিটার অধিকৃত এলাকা থেকে অনেক দূরে অবস্থিত ছিল। সুদানের তেলক্ষেত্রগুলো দেশটির দক্ষিণে অবস্থিত, দক্ষিণের বিদ্রোহীদের অধিকৃত এলাকার কাছাকাছি। কিন্তু আল বশিরের সরকার সেখানে এক অমানবিক নীতি গ্রহণ করেছিল, তারা সেখানে আকাশ থেকে বোমাবর্ষণ করে এলাকাটিকে জনশূন্য করে ফেলে—সেখানকার অসহায় মানুষকে কচুকাটা করে এবং জীবিত ব্যক্তিদের এলাকাছাড়া হতে বাধ্য করে। একই প্রক্রিয়ায় বিদ্রোহীরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, আর তেলের নিয়ন্ত্রণ লাভে ব্যর্থ হয়। মানে, সব বিচারেই দেখা যায় যে তেলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কেউই এর আগে গৃহযুদ্ধ চালাতে পারেনি।
হ্যাঁ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন যে আইএসের কার্যত সমর্থক থেকে বিরোধীতে পরিণত হলো, এর পেছনে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিগত অবস্থান। যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ইরাকের উত্তরে আইএসের ঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ শুরু করেছে। একসময় আইএসের নিরন্তর সংখ্যালঘু নিধনে জোর গলায় সমর্থন দিলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে তার অবস্থান পরিবর্তন করল, সেটা তার নিজের স্বার্থের কারণেই সে করছে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পেন্টাগনের কর্মকর্তাদের মাথায় এখন অস্ত্র ও তেলের যুগলবন্দীর ব্যাপারটিই কাজ করছে। ওবামা প্রশাসন ২০১১ সালের অক্টোবরে ইরাক থেকে সেনা প্রত্যাহার করার পর যুক্তরাষ্ট্র ইরাক সরকারের কাছে ১২ বিলিয়ন ডলারের এফ-১৬ বিমান বিক্রি করেছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় পাঁচটি সমর করপোরেশনের মধ্যে অন্তত চারটি লাভবান হয়েছে। যুগপৎভাবে এই অস্ত্র বিক্রির চুক্তি যখন হয়, তখন ইরাকের দৈনিক অপরিশোধিত তেল উত্তোলনের পরিমাণ আগের জায়গায় চলে যায়, ২০১২ সালে এর পরিমাণ ছিল দৈনিক তিন মিলিয়ন ব্যারেল, চুক্তির সময় এটা সেই সীমাও ছাড়িয়ে যায়। ইরাকি সরকার যখন তেল আহরণ ও রপ্তানি থেকে বিপুল পরিমাণ আয় করছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র ও তার প্রতিদ্বন্দ্বী অস্ত্র উৎপাদক রাশিয়া ইরাকে অস্ত্র সরবরাহের প্রতিযোগিতায় নামে। এই তেল ও অস্ত্রের যুগলবন্দী দীর্ঘস্থায়ী হবে, সেটা নিয়ে ব্যাপক আত্মবিশ্বাসও রয়েছে। পশ্চিমা তেল ক্রেতাদের সংগঠন আইইএর মতে, ভবিষ্যতে দুনিয়ার অপরিশোধিত তেল সরবরাহে ইরাক এগিয়ে থাকবে।
পশ্চিমা নীতিপ্রণেতারা হন্যে হয়ে শিয়া মুসলিম, খ্রিষ্টান ও ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মানুষের অধিকারের প্রতি সমর্থন দিচ্ছেন। আবার এই আইএস যে এই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ইরাকের উত্তরাঞ্চলে কতল করছে, সেটা নিয়েও কোনো সন্দেহ নেই। সুন্নি চরমপন্থী জঙ্গিরা মুসলিম ও অমুসলিম সব সম্প্রদায়ের মানুষকেই নিপীড়ন করছে। কিন্তু কেউ কি বলতে পারবেন, পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো ধারাবাহিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষা করেছে? যুক্তরাষ্ট্রের অবৈধভাবে ইরাক দখলের পর এ চিন্তাটির উদয় হয়েছে।
কিন্তু ইসরায়েলের মুসলিম ও খ্রিষ্টান আরব, বাহরাইন ও সৌদি আরবের শিয়া ও অন্য গোষ্ঠীগুলো, যারা পশ্চিমের মিত্রদের হাতে নিগৃহীত হয়েছে, তারা কি ইরাকের ইয়াজিদিদের রক্ষায় পশ্চিমের এই সংকল্প দেখে পুলকিত হবে? যা-ই হোক, সময় এসেছে, ব্রাসেলসে নীতিপ্রণেতাদের এই নীতি পরিবর্তন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হবে।
স্মরণ করা যেতে পারে, ইরাক ও সিরিয়ায় চলমান এই দুই গৃহযুদ্ধ নিয়ে এই মতি পরিবর্তন দুবার ঘটেছে। প্রথমত, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সিরিয়ার বিনিয়োগ ও দেশটির তেল রপ্তানিতে সাধারণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এতে আসাদের সরকার ও বিরোধী পক্ষ উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর ২০১৩ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কার্যত এই সুন্নি জঙ্গিদের পক্ষে অবস্থান নেয়। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা তাঁদের পাপ বুঝতে পারলেও সংস্থাটির মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক নীতির মৌলিক পরিবর্তন না হলে এ ক্ষতের উপশম হবে না।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
ড. পিটার কাস্টার্স: অস্ত্রবাণিজ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ।
No comments