কালোটাকার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা by মইনুল ইসলাম
বাংলাদেশ সরকারের ২০১৪-১৫ অর্থবছরের
বাজেটে আবারও কালোটাকা সাদা করার ব্যবস্থা বহাল রাখা হয়েছে এবং প্রতিবছরের
মতো এবারও অর্থমন্ত্রী আফসোস করেছেন যে নানাবিধ চাপের কারণে তাঁকে এ
ব্যবস্থাটা রাখতেই হলো। এ ধরনের সাফাই গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ এই অনৈতিক
সিদ্ধান্তটি তাঁর সততার মিথকে শুধু যে ভেঙে দিয়েছে তা নয়, এটা দেশের
অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নকে ক্রমাগতভাবে ছত্রচ্ছায়া দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নকেও
ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে। এ জন্য ইতিহাসের কাঠগড়ায় সরকারের পাশাপাশি একদিন
তাঁকেও দাঁড়াতে হবে। কারণ, দুর্নীতিকে তাঁরা জেনেশুনে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে
চলেছেন। দুর্নীতিবাজ ও দুর্বৃত্তদের পুরস্কার প্রদানের এই অনৈতিক ব্যবস্থা
চালু রেখে নিয়মনিষ্ঠ করদাতাদের শাস্তি দেওয়ার অবস্থান থেকে কোনো সরকারকেই
সরানো যাচ্ছে না! অথচ নৈতিকতার ইস্যুটা বিবেচনায় না নিলেও উন্নয়ন
অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকেও এর যৌক্তিকতা নেই বললেই চলে। দুর্নীতির জন্য
বিশ্বে একদা কুখ্যাতি অর্জনকারী কয়েকটা দেশের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা একেবারেই
ভিন্ন শিক্ষা দিচ্ছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে যেসব দেশ সফল হচ্ছে,
তারাই উন্নয়নের প্রতিযোগিতায়ও জয়ী হয়ে চলেছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জনে সফল যেসব দেশকে সাম্প্রতিক কালে নজির হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে, তার মধ্যে সিঙ্গাপুর, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, কিউবা, গণচীন, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ইরানের নাম এসে যাচ্ছে। এগুলোর মধ্যে সিঙ্গাপুর দুর্নীতির ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অবলম্বনের কারণে এশিয়ার সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশক পর্যন্ত হংকং, ফিলিপাইন, ইরানে (এবং ইন্দোনেশিয়ার ক্ষেত্রে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত) দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন সংকটজনক পর্যায়ে ছিল। তার পর থেকে এই দেশগুলোতে অত্যন্ত বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে। হংকং ব্রিটিশ উপনিবেশ থাকতেই দুর্নীতি দমনের জন্য অত্যন্ত শক্তিশালী ও স্বাধীন দুর্নীতি দমন ব্যবস্থা চালু করে এ ব্যাপারে দৃষ্টান্তমূলক সফলতা অর্জন করেছিল আশির দশকেই। ফলে ওই আশির দশক থেকেই হংকংয়ের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারও নাটকীয়ভাবে বেড়ে গিয়েছিল। ১৯৯৭ সালে গণচীনের অংশ হওয়ার পর এখন হংকং খোদ গণচীনের জন্যই সুশাসনের পথ-প্রদর্শকে পরিণত হয়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক শাসক পার্ক চুং হি অগণতান্ত্রিক সামরিক শাসক হলেও তেমন দুর্নীতিবাজ ছিলেন না। তাই তাঁর শাসনামলে দক্ষিণ কোরিয়া চমকপ্রদ অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জন করেছিল। প্রধানত, তাঁর নজির দেখিয়েই অনেক উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ ফতোয়া দিয়েছিলেন যে উন্নয়নের জন্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রয়োজন নেই। কিন্তু ১৯৮২ সালে তিনি নিহত হওয়ার পর আরও কয়েকজন সামরিক ডিক্টেটর ওই দেশে শাসনক্ষমতা দখল করলেও জনগণের প্রবল আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করে পরবর্তী সময়ে গণতন্ত্র চালু করতে বাধ্য হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট। এর ফলে গণতান্ত্রিক কোরিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন এখন সারা বিশ্বের কাছেই অনন্য নজির হয়ে আছে। দক্ষিণ কোরিয়া উন্নত শিল্পায়িত দেশের কাতারে শামিল হয়ে গেছে। (পার্ক চুং হির দুর্নীতির বদনাম ছিল না বলেই তাঁর কন্যা বর্তমানে জনগণের ভোটে ওই দেশের প্রেসিডেন্ট!) ফিলিপাইনের মার্কোস তাঁর সময়ে দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। তাঁর পতনের পর কোরাজন একুইনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে দুর্নীতিমুক্ত শাসনের নজির সৃষ্টি করা সত্ত্বেও ওই দেশ থেকে দুর্নীতি কমাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে উত্তরসূরিদের কারণে। কিন্তু বেনিগনো একুইনো ও কোরাজন একুইনোর ছেলে একুইনো জুনিয়র প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর চার বছর ধরে আবারও তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ায় বর্তমানে ফিলিপাইন চমকপ্রদ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অর্জন করে চলেছে এবং এ বছর এই প্রবৃদ্ধির হার এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের আগে ইরান ছিল দুর্নীতির আখড়া। গত ৩৫ বছরে ইরান দুর্নীতি অনেকখানি কমাতে সক্ষম হওয়ায় ইরানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন গতিশীল হয়েছে।
১৯৬৫ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ার ক্ষমতার মসনদ জবরদখলকারী ডিক্টেটর সুহার্তো বিশ্বে এক নজিরবিহীন দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিক মডেল গড়ে তুলেছিলেন। এই মডেলে নিজের পরিবার, আত্মীয়স্বজন, তাঁর গোলকার পার্টি এবং খোদ ইন্দোনেশীয় সেনাবাহিনীর প্রতিটি স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির ফায়দাভোগীতে পরিণত করার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। সুহার্তোর পতনের পর এই ব্যবস্থাটিকেই উন্নয়ন তত্ত্বে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ বলে অভিহিত করা হয়েছে, যেটাকে ইন্দোনেশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে প্রধান বাধা হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। তাঁর পতনে ইন্দোনেশিয়ায় গণতন্ত্রের রুদ্ধ দ্বার খুলে যায়। ফলে গত ১৬ বছরে ইন্দোনেশিয়াও প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ইন্দোনেশিয়ার জাতির পিতা সুকর্ণর কন্যা মেঘবতী সুকর্ণপুত্রী একবার গণতান্ত্রিকভাবে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও সুশাসন দিতে ব্যর্থ হওয়ায় দ্বিতীয়বারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। তাঁর সঙ্গে নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় বিজয়ী প্রেসিডেন্ট ইউধোইয়োনো দুর্নীতি কমানোর জন্য তাঁর দুই মেয়াদে যথাসাধ্য চেষ্টা চালানোয় এখন ইন্দোনেশিয়া দুর্নীতির করাল চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে এবং তাতেই ওই দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির পালে হাওয়া লেগেছে।
আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের সাম্প্রতিক নির্বাচনে কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোটের ভরাডুবির জন্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোনিয়া-রাহুল-মনমোহনের কঠোরতার অভাবকেই বিশ্লেষকেরা দায়ী করছেন। এটা টের পেয়ে নরেন্দ্র মোদি প্রথম থেকেই তাঁর দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য প্রাণপাত করে চলেছেন। এই অভিজ্ঞতাগুলো তুলে ধরছি এই কথাটাই আমাদের প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীকে বলার জন্য, কালোটাকা আর কালো অর্থনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় আল্লাহর ওয়াস্তে এবার ক্ষান্ত দিন।
হংকং থেকে প্রকাশিত বিশ্বখ্যাত পত্রিকা ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশকে অভিহিত করেছিল ‘স্মাগলারস প্যারাডাইস’ বলে। এরপর ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর একাদিক্রমে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ঘোষিত হয়েছিল বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দ্বারা। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির অচিন্তনীয় নির্বাচনী বিপর্যয়ের পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল দুর্নীতি ও লুটপাট। ২০১৪ সালে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আবারও একই কারণে আওয়ামী লীগ লজ্জাজনকভাবে পরাজয় বরণ করত বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস। খালেদা জিয়া এবং তাঁর পণ্ডিতপ্রবর পুত্রধনের মারাত্মক চালের ভুলে শেখ হাসিনার ভাগ্যে আবারও শিকে ছিঁড়েছে বলা চলে। কিন্তু, চাণক্য কৌশলের খেলায় জয়ী হয়ে তৃতীয়বার ক্ষমতা লাভের পর যেখানে তাঁর দলের হারানো জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধারের জন্য তিনি সর্বশক্তি নিয়ে কাজে নেমে পড়বেন বলে আশা করেছিলাম আমরা, তার পরিবর্তে তাঁকে আবারও পুরোনো চক্রে ঘুরপাক খেতে দেখে প্রবল আশঙ্কা জাগছে যে তিনি আদতেই ভুল থেকে শিক্ষা নেবেন কি না? দুর্নীতি ও লুটপাট যে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে ‘এক নম্বর প্রতিবন্ধক’, এ কথাও কি তিনি মানতে নারাজ? গত পাঁচটি বছর তিনি দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) প্রায় পুরোপুরি অকেজো করে রেখেছেন। এই পাঁচ বছরেও দুদকের একটি মামলার রায়ে কোনো দুর্নীতিবাজকে জেল খাটতে হয়েছে, এ রকম কোনো নজির কি সৃষ্টি হয়েছে? কোনো চিহ্নিত ব্যাংক ঋণখেলাপির বা কোনো রাঘববোয়াল ব্যাংক লুটেরা গ্রুপের কি শাস্তি হয়েছে? পুঁজি পাচার নিয়ে দেশে-বিদেশে এত হইচই হচ্ছে, এই বিষয়ে কি একটা শক্তিশালী তদন্ত কমিশন গঠন করা যেত না? টরন্টোর ‘বেগম পাড়ায়’ কাদের বেগম সাহেবানরা পলাতক পুঁজির ফায়দাভোগী হয়ে সপরিবার রয়েছেন, তার হদিস জানার কোনো প্রয়াস কি নেওয়া যেত না? মালয়েশিয়ার ‘সেকেন্ড হোমের’ বাংলাদেশি মালিকদের নাম জানা কি খুবই কঠিন কাজ?
এ কথা মানতেই হবে যে দুর্নীতি ও লুটপাট সত্ত্বেও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন খুবই আশাপ্রদ। কিন্তু তা নিয়ে আত্মপ্রসাদে ভোগার কোনো অবকাশ নেই। ওপরে উল্লেখিত ব্যাধিগুলো নিরাময়ের জন্য নিষ্ঠাবান প্রয়াস নিলে ক্ষমতাসীনদের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে তা সহায়ক হতো বলেই আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পালেও তা নিঃসন্দেহে হাওয়া জোগাবে।
এ পর্যায়ে বিভ্রান্তি নিরসনে বলা প্রয়োজন, রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান বৈধ-অবৈধ যেভাবেই অর্থ উপার্জিত হোক, কর ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যে ‘অপ্রদর্শিত অর্থই’ কালোটাকা বলে যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, তা প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক হলেও অনুন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি কালোটাকা এবং কালো অর্থনীতির আওতায় অবৈধভাবে অর্জিত আয় ও সম্পদকেই বিশ্লেষণের কেন্দ্রে নিয়ে আসে। অতএব, কালোটাকা এবং কালো অর্থনীতিকে দুর্নীতির অর্থনীতির আওতাভুক্ত বিষয় বিবেচনা করে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে রাষ্ট্রকে তা দমনে যত্নবান হতে হবে, শুধু সরকারের আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান মিলবে না। কারণ, আমলারা কালোটাকা এবং কালো অর্থনীতির অন্যতম জন্মদাতা ও ফায়দাভোগী। রাজনীতিবিদ, আমলা এবং ব্যবসায়ী-পুঁজিপতিদের সফল আঁতাতের ফলেই দুর্নীতির সিস্টেম প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জনে সক্ষম হয়। তাই সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সুস্পষ্ট সদিচ্ছা ও আন্তরিক প্রয়াস ব্যতিরেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম কোনো দেশেই সফল হয়নি।
আমার দৃঢ়বিশ্বাস, আগের দুই মেয়াদে দুর্নীতি দমনে লোক দেখানো তৎপরতা দেখিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব জনপ্রিয়তা হারিয়েছিল, এবারের তৃতীয় মেয়াদে সর্বশক্তি দিয়ে দুর্নীতি দমনের কঠিন সাধনা প্রকৃত সদিচ্ছা নিয়ে শুরু করলে হারানো জনপ্রিয়তা ফিরে আসতে দেরি হবে না।
মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।
No comments