পাকিস্তানে রাজনৈতিক সঙ্কট ঘনীভূত
পাকিস্তানে রাজনৈতিক সঙ্কট ঘনীভূত। টান
টান উত্তেজনা রাজধানী ইসলামাবাদে। প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পদত্যাগ
দাবিতে রাজপথ দখলে নিয়েছে ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ (পিটিআই) ও
তাহিরুল কাদরির পাকিস্তান আওয়ামী তেহরিক (পিএটি)। সরকারের আলোচনা প্রস্তাব
প্রত্যাখ্যান করেছেন তারা। গতরাতে রেড জোনে প্রবেশ করার কথা ইমরানের পিটিআই
ও কাদরির পিএটি’র। গতরাতে ইমরান খান তার সমর্থকদের উদ্দেশে বলেছেন, আমি
নেতৃত্বে থাকবো। আপনার আমাকে অনুসরণ করুন। এ ঘোষণার পরই তার রেড জোনে
প্রবেশ করার কথা। এ সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে হুঁশিয়ার করে দেন।
বলেন, নওয়াজ আমি তোমাকে ছাড়বো না। পালিয়ে লন্ডনে গেলেও সেখানে তোমাকে
ধরবো। রেড জোন এলাকায় অবস্থিত পার্লামেন্ট, প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ,
প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ও কূটনৈতিক মিশনগুলো। রেড জোনে দলীয় নেতাদের প্রবেশ
করার ঘোষণা দেয়ার পর পরই তাহিরুল কাদরি ও তার দলের ২৭ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে
জামিন অযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে সন্ত্রাস বিরোধী আদালত।
গুজরানওয়ালায় ৭৩ পুলিশ আহত করার ঘটনায় এ আদেশ দেয়া হয়েছে। গতকাল স্থানীয়
সময় বিকাল ৫টার মধ্যে ‘নতুন আওয়ামী পার্লামেন্ট’ ঘোষণা করার কথা তাহিরুল
কাদরির। এ দু’-নেতা আন্দোলনে নেমেছেন কঠোর অবস্থান নিয়ে। তাদের হুমকিতে
সরকারের ভিতে নাড়া লেগেছে। রেড জোনের নিরাপত্তার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে
সেনাবাহিনীকে। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এবং পয়েন্টে মোতায়েন করা হয়েছে
সেনাসদস্য। চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল রাহিল শরীফের সঙ্গে নিরাপত্তা
পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ। প্রধানমন্ত্রীর
বাসভবনে অনুষ্ঠিত ওই আলোচনায় স্থান পায় পিটিআই ও পিএটি’র আন্দোলন কিভাবে
বানচাল করা যায় তা। তাছাড়া পূর্ব নির্ধারিত পররাষ্ট্র সচিবদের বৈঠক ভারত
সরকার বাতিল করার বিষয়ও আলোচনায় উঠে আসে। নিরাপত্তা জোরদার করতে মোতায়েন
করা হয়েছে ৪০ হাজার নিরাপত্তারক্ষী। ১০ কোরের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট
জেনারেল কামার বাজওয়া বলেছেন, ইসলামাবাদ পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে সরকারি
গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও পার্লামেন্টের নিরাপত্তা কিভাবে নিশ্চিত করা যায়
তা সমন্বয় করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও রেড জোনে প্রবেশ করার ঘোষণা দিয়েছেন
পাকিস্তান তেহরিক-ই- ইনসাফ (পিটিআই) প্রধান ইমরান খান। তিনি একা নন, তার
সঙ্গে যোগ দেয়া হাজার হাজার সমর্থককে নিয়ে গত রাতেই ওই এলাকায় প্রবেশের
হুমকি দিয়েছেন তিনি। ওদিকে খাইবার পখতুনখাওয়া প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পারভেজ
খাত্তাকের বিরুদ্ধে ওই প্রদেশের বিরোধী দল অনাস্থা প্রস্তাব এনেছে। পিটিআই
ওই প্রদেশের পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে পারে- এমন হুমকির জবাবে তারা এমন
পদক্ষেপ নিয়েছে, যাতে মুখ্যমন্ত্রী প্রাদেশিক পরিষদ ভাঙতে না পারেন।
মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে রয়েছেন পাকিস্তান মুসলিম
লীগ-নওয়াজ (পিএমএলএন), পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি), আওয়ামী ন্যাশনাল
পার্টি (এএনপি) ও কওমি ওয়াতান পার্টি (কিউডব্লিউপি)। মুখ্যমন্ত্রীর
বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব জমা দেয়া হয়েছে প্রাদেশিক পরিষদের স্পিকার আসাদ
কাউসার, মুখ্যমন্ত্রী পারভেজ খাত্তাক ও গভর্নর সরদার মাহতাব আহমেদ খানের
কাছে। ইসলামাবাদে আন্দোলনরত পিটিআই ও পিএটির সঙ্গে আলোচনার জন্য সরকার গঠন
করেছে দু’টি কমিটি। কিন্তু সে আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তাহিরুল
কাদরি হুমকি দেন, গতকাল স্থানীয় সময় বিকাল ৫টায় গঠন করার কথা নতুন আওয়ামী
পার্লামেন্ট। তার নেতৃত্বে ইসলামাবাদের আবপাড়া স্কয়ারে অবস্থান করছেন হাজার
হাজার সমর্থক। আওয়ামী পার্লামেন্ট গঠনের ভূমিকা কি ধরনের হবে এবং এর কাজই
বা কি হবে সে সম্পর্কে তিনি কিছু বলেননি। তবে তিনি বলেছেন, এ পার্লামেন্টের
সিদ্ধান্ত মেনে চলা হবে। আওয়ামী পার্লামেন্টই সিদ্ধান্ত নেবে ভবিষ্যৎ
কর্মসূচি কি হবে এবং দেশের ভাগ্য পরিবর্তন হতে চলেছে কিনা। এ সময় তাহিরুল
কাদরি বর্তমান পার্লামেন্টের সমালোচনা করেন। বলেন, যারা কারচুপির
নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছেন তারা লজ্জার। তাহিরুল কাদরি দেশজুড়ে
ধর্মঘট আহ্বান করেছেন। সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে সমর্থকদের নির্দেশ
দিয়েছেন মহাসড়ক ও মোটরওয়েগুলো বন্ধ করে দিতে। জনপ্রিয় নীতি অনুযায়ী তিনি
সমর্থকদের নির্দেশ দেন যেখানে তারা অবস্থান ধর্মঘট করবেন সে এলাকাকে যেন
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখেন। অন্যদিকে তার কাছাকাছি কাশ্মীর হাইওয়ের কাছে
বিক্ষোভ করছিল ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ। তাদের মার্চের নাম
দেয়া হয়েছে আজাদি মার্চ। গতকাল রাতেই রেড জোনে প্রবেশের ঘোষণা দিয়েছেন
তিনি। একই সঙ্গে জাতীয় পরিষদ ও তিনটি প্রাদেশিক পরিষদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা
দিয়েছেন। তার দলের অফিসিয়াল টুইটারে বলা হয়েছে, তার দলের সব এমপিই তাদের
পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। পিটিআইয়ের সব এমপির পদত্যাগপত্র জমা নেয়ার ঘোষণা
দিয়েছেন শাহ মেহমুদ কুরেশি।
গ্রেপ্তার ১৪৭
পাকিস্তানে সরকার পতনের দাবিতে বিক্ষোভ- আন্দোলনের পঞ্চম দিন অতিবাহিত হলো গতকাল। পুলিশ বলছে, পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের বিভিন্ন শহরতলি থেকে অভিযান চালিয়ে বিক্ষোভে নেতৃত্বদানকারী পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ দলের নেতা ইমরান খান ও প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা তাহির-উল-কাদরির ১৪৭ সমর্থককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন এনডিটিভি। জনপ্রিয় ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিবিদে পরিণত হওয়া ইমরান খান দেশজুড়ে গণ-অসহযোগের ডাক দেন। সোমবার প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের সরকারকে ক্ষমতা থেকে অপসারণে বদ্ধপরিকর ইমরান খান সরকারের প্রতি একটি ‘বাউন্সার’ও ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। এক ঘোষণায় তিনি বলেছেন, জাতীয় পরিষদ থেকে তেহরিক-ই-ইনসাফ দলের সব পার্লামেন্ট সদস্য পদত্যাগ করবেন। জাতীয় পরিষদের ৩৪২টি আসনের মধ্যে ৩৪টি আসন নিয়ে দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দল তেহরিক-ই-ইনসাফ। ইমরান ও কাদরির আহ্বানে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার সমর্থক বিক্ষোভ করছেন পাঞ্জাব ও রাজধানী ইসলামাবাদে। এর মধ্যে বহু নারী-শিশুও রয়েছে। ১৫ মাস আগে ক্ষমতায় এসে সরকার বেকারত্বের উচ্চ হার, নৈমিত্তিক লোড-শেডিং ও তালেবান জঙ্গি ইস্যুগুলো নিয়ে চ্যালেঞ্জিং সময় অতিক্রম করছে। এরই মধ্যে বিরোধী দলের বিক্ষোভে নতুন সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এক বক্তৃতায় নওয়াজের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে ইমরান বলেছেন, নওয়াজ শরীফ সব আইনকে পাশ কাটিয়ে যান এবং ভোট-জালিয়াতি ও দুর্নীতির আশ্রয় নেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ২ দিন পর তার সমর্থকরা জোর করে ঢুকে পড়লেও তার করার কিছু থাকবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন ইমরান। রাজধানী ইসলামাবাদে সমর্থকদের সঙ্গে নিয়ে বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছেন ইমরান খান। এবং নওয়াজ শরীফ পদত্যাগ না করলে রেড জোনে প্রবেশেরও হুমকি দিয়েছেন। পাকিস্তানের প্রখ্যাত ধর্মীয় নেতা তাহির-উল-কাদরিও নওয়াজের মাথাব্যথার কারণ। বিক্ষোভের ফলে এবং সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় পাকিস্তানের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এখন প্রশ্নের সম্মুখীন।
বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলায় সরকার ব্যর্থ হয়েছে বলে পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় সিনেটররা সরকারের সমালোচনা করেছেন। একই সঙ্গে তারা ইমরান খানের অসহযোগ আন্দোলনের ডাক প্রত্যাখ্যান করেছেন। আজাদী ও ইনকিলাব নামের আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য পার্লামেন্টে প্রস্তাব আনে পাকিস্তান পিপলস পার্টি ও আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টি। বিরোধীদলীয় নেতা সিনেটর ইজাজ আহসান বলেন, রেলমন্ত্রী ও পরিকল্পনা মন্ত্রী যেভাবে আন্দোলনকে গুরুত্ব দিয়েছেন সরকার সেভাবে দেখেনি। তাই ইমরান খান ও ড. তাহিরুল কাদরি কড়া কড়া কথা বলছেন। তবে ২০১৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছিল বলে ইমরান খানের বক্তব্য সমর্থন করেন তিনি। ১৪টি আসনে কিভাবে নির্বাচনী কারচুপি হয়েছে এ বিষয়ে তিনি একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করছেন। তিনি বলেন, লাহোর হাইকোর্ট তার কাছে পিটিআই ও পিএটির আজাদি ও ইনকিলাব নামের মার্চ সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। এর জবাবে তিনি বলেছেন, আমি তাদেরকে বলেছি আন্দোলন অসাংবিধানিক নয়।
No comments