কেন এই আশঙ্কা? by অমিত রহমান
সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে বিতর্ক নেই। বিতর্ক হচ্ছে এর কতিপয় ধারা নিয়ে। এক বাক্যে কেউই প্রশংসা করছেন না। সবাই বলছেন, এমন কিছু ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে যাতে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সন্দেহটা কি? কেউ বলছেন, এতে করে গণমাধ্যমের কণ্ঠ স্তব্ধ করা হবে। আবার অনেকে বলছেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার একটি অস্ত্র। কালো আইন হিসেবেও কেউ কেউ মত দিচ্ছেন। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বিপরীতটাই বলছেন। তার মতে, বাংলাদেশের গণমাধ্যম নাকি এতে করে জবাবদিহি আর শৃঙ্খলার মধ্যে আসবে। এতে গণমাধ্যম ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। নিপীড়নের আশঙ্কা অমূলক তা-ও বলছেন। কিন্তু কেউই আশ্বস্ত হতে পারছেন না। বলাবলি হচ্ছে, নীতিমালার মাধ্যমে সরকার গণমাধ্যমকে কব্জা করতে চায়। অতীত অভিজ্ঞতা যেহেতু সুখকর নয়, সেজন্য এই আশঙ্কা থেকে কেউ মুক্ত হতে পারছেন না। প্রতিক্রিয়া শুধু দেশে নয়। বিদেশেও হয়েছে। পাঠকরা ইতিমধ্যেই জেনে গেছেন বিশ্ববিখ্যাত সার্চ ইঞ্জিন গুগল ঢাকায় অফিস স্থাপনের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে দিয়েছে। তাদেরও আশঙ্কা, সম্প্রচার ও অনলাইন নীতিমালা চালু হয়ে গেলে বাংলাদেশের গণমাধ্যম তার স্বাধীনতা হারাবে। ১৬ সদস্যের সম্প্রচার কমিটির ভূমিকা নিয়ে তথ্যমন্ত্রী নানা যুক্তি হাজির করেছেন। তিনি বলছেন, তারা কোন পর্যায়েই বিরোধিতা করেননি। কেউ কেউ যদিও ঘরোয়া আলোচনায় বলছেন তাদের কোন মতামত গ্রহণ করা হয়নি। এর সত্য-মিথ্যা যাচাই করা এই মুহূর্তে খুব কঠিন। মতামত যদি গ্রাহ্যই হয়নি তাহলে তারা কমিটি থেকে কেন পদত্যাগ করেননি। এই প্রশ্ন ইতিমধ্যেই উঠেছে। টকশোগুলোতে কেউ কেউ তাদের ইন্টিগ্রিটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। যা-ই হোক, এটা আলোচ্য বিষয় নয়। বিষয় হচ্ছে কেন সম্প্রচার নীতিমালার বিরোধিতা করা হচ্ছে। ধরা যাক, উদ্দেশ্য লক্ষ্য বয়ান করতে গিয়ে বলা হয়েছে- সকল সম্প্রচার মাধ্যমকে একটি সমন্বিত ব্যবস্থায় এনে এ সেক্টরে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। প্রশ্ন উঠেছে সমন্বিত না নিয়ন্ত্রিত। শৃঙ্খলা না শৃঙ্খলিত করা- এর কোন ব্যাখ্যা নেই নীতিমালায়। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আদর্শ ও চেতনা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এতে দ্বিমতের কিছু নেই। তবে ইতিহাস চর্চা একটি চলমান অনুসন্ধানী গবেষণা। রাজনীতি নিরপেক্ষ গবেষকরা এ কাজ করে চলেছেন। এটা তারা করে যাবেন। গবেষকদের গবেষণায় নতুন নতুন তথ্য উদঘাটন ও পুনরাবিষ্কার ঘটে। এর ঐতিহাসিক মূল্য থাকা সত্ত্বেও কোন কোন তথ্য বা বিষয় বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে। প্রতিষ্ঠিত তথ্যের স্থলে নতুন প্রামাণিক সত্যও আলোর মুখ দেখতে পারে। তখন কি হবে? তাই ইতিহাসকে ‘বাক্সবন্দি’ করে রাখার সুযোগ খুব কম। নীতিমালায় বলা হয়েছে সম্প্রচারিত তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা, পেশাগত নৈতিকতা ও নিরপেক্ষতা, সমপ্রচারের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতা মানদণ্ডে উল্লেখ থাকবে। প্রশ্ন হচ্ছে বস্তুনিষ্ঠ সত্য নিরপেক্ষ হয় না। কোন না কোন পক্ষে যায়। তাছাড়া আপনার কাছে যেটা বস্তুনিষ্ঠ অন্যের কাছে না-ও হতে পারে। সংবাদ ও তথ্যমূলক অনুষ্ঠান নিয়ে যে ধারা সংযোজন করা হয়েছে তা নিয়ে আপত্তি এবং আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। টকশো সরাসরি বলা না হলেও আলোচনামূলক অনুষ্ঠানে কোন প্রকার বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য বা উপাত্ত দেয়া পরিহার করতে হবে। সকল পক্ষের যুক্তিসমূহ যথাযথভাবে উপস্থাপনের সুযোগ থাকতে হবে। কিন্তু কে না জানে আলোচনামূলক অনুষ্ঠানে তাৎক্ষণিক মতামতেরই প্রাধান্য থাকে। এখানে গবেষণা বা ইতিহাস চর্চার সুযোগ নেই বললেই চলে। পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি প্রদর্শনই সার কথা। ‘বিভ্রান্তিকর ও যথাযথভাবে’ কথাটির অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে অনুষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা হতে পারে। এই আশঙ্কা অমূলক নয়। বরং এটাই বাস্তবতা। অতীত ইতিহাস হচ্ছে একটি দরখাস্তের ভিত্তিতে ইটিভি বন্ধ করে দিয়েছিল বিএনপি সরকার। আর বর্তমান সরকার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ না দেখিয়ে চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দিয়েছে। সেনা জমানায় সিএসবি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এখানে কোন নীতিমালার প্রয়োজন হয়নি। তাই অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, সরকার যেখানে নীতিমালা ছাড়াই এ রকম সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সেখানে নীতিমালায় এই ধারাগুলো থাকলে কেউ সাহস করে কিছু বলবে না। কোন টিভি সেটা প্রচারও করবে না। এমনিতেই কোন অতিথিকে আনা যাবে, কোন অতিথিকে আনা যাবে না- তার একটি অলিখিত নির্দেশনা জারি রয়েছে। তথ্য মন্ত্রণালয় এক্ষেত্রে বড় অসহায়। তাদের অজান্তেই অতিথি বর্জনের কালচার চালু রয়েছে দীর্ঘদিন থেকে। টকশো এই মুহূর্তে তৃতীয় শক্তির ভূমিকা পালন করছে। এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে জনগণ অনেক কিছু জানা থেকে বঞ্চিত হবে। মনে রাখতে হবে, এতে সরকারের বা দেশের কোন লাভ হবে না। বরং গুজবের ফ্যাক্টরি চালু হবে। এতে গোটা সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ঢাকায় আমার হাত বেঁধে দিতে পারেন, বাইরে তো আমার হাত খোলা থাকবে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে বসে এমন গুজবই রটবে যা সামাল দেয়া কঠিন হবে। এই বিষয়টিও বিবেচনায় নেয়া দরকার। ক্ষমতায় থাকার জন্য আমাদের শাসকেরা এই বিষয়টির দিকে নজর দেন না। এক পর্যায়ে আমলানির্ভর হয়ে যান। চমৎকার একটি নীতিমালা তৈরি করতে গিয়ে এমন কিছু ধারার জন্ম দেয়া হয়েছে যা অন্য দেশগুলোর নীতিমালা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গেছে। অনেকেই বলছেন, ভবিষ্যতে মোবাইল কোর্ট দিয়ে হরতাল, পিকেটিং, মিছিল-মিটিং ঠেকাতে উদ্যোগী হবে সরকার। সে কারণে মোবাইল কোর্টকে দু’বছর পর্যন্ত শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। অথচ প্রথমে যখন মোবাইল কোর্ট আইন তৈরি হয়, তখন তাদের ক্ষমতা ছিল কেবল অর্থদণ্ড দেয়ার।
নীতিমালার অনেক বিষয় নিয়েই কথা তোলা যায়। ধরুন আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত কর্মকর্তাদের প্রতি কটাক্ষ বা বিদ্রূপ কিংবা তাদের পেশাগত ভাবমূর্তি বিনষ্ট করতে পারে এমন কোন দৃশ্য প্রদর্শন বা বক্তব্য প্রচার করা যাবে না। কি ভয়ঙ্কর সংযোজন? এই ধারা যদি মানা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে কি হবে? নারায়ণগঞ্জে ৭ খুনের ঘটনা চাপাই থেকে যেতো। দশ ট্রাক অস্ত্র নিয়ে যে হইচই হচ্ছে তা-ও করা যেতো না। বর্তমানকে চিন্তা না করে ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে নীতিমালা করলে তা দেশের কাজে আসতে পারে। নীতিমালা করছেন দেশের টিভি স্টেশনগুলোকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনার জন্য। ভারতীয় টেলিভিশনগুলো যে বাংলাদেশের বাজার দখল করে বসে আছে সে ব্যাপারে নীতিমালায় কিছু নেই কেন? শুধু দর্শক নয়, ভারতীয় টিভিতে বাংলাদেশের পণ্যের বিজ্ঞাপনও চলে গেছে। নীতিমালা কি তাহলে দু’টো হবে! স্বাধীন কমিশন গঠনের কথা বলা হচ্ছে? কাদের নিয়ে এই কমিশন গঠন করা হবে? মানবাধিকার কমিশনের মতো কোন কমিশন গঠন করা হলে ফল কি হবে তা এখনই বলে দেয়া যায় অনায়াসে। নির্বাচন কমিশনের কথা না-ই বা বললাম। মার্কিন প্রেসিডেন্ট কিংবা বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে যে হাস্যরস বা ব্যঙ্গ করা হয় তার কোন সুযোগ কি আছে এই দেশে? একজন অধ্যাপক অস্ট্রেলিয়ায় বসে কি যেন লিখেছিলেন প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে। এতে তার শাস্তি হয়ে গেল। যে কেউ আদালতে গেলেই শাস্তি হয়ে যাচ্ছে। দুনিয়া বদলাচ্ছে- বাংলাদেশ পেছনে যাচ্ছে বা যাবে- তা কি মেনে নেয়া ঠিক হবে। আসলে বাংলাদেশের বিপদ হচ্ছে টু-থার্ডের। দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন পেলে আমাদের সরকারগুলোর চেহারা পাল্টে যায়। ইন্দিরা গান্ধী থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত। বঙ্গবন্ধু ’৭৩ সালের নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন না পেলে হয় তো বা বাংলাদেশের ইতিহাস অন্য হতে পারতো। বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম শাসন ছিল চমৎকার। দ্বিতীয়বার যখন দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে ক্ষমতায় এলেন তখন একের পর এক ভুল করতে থাকলেন। দুর্নীতি আর অপশাসনে কাবু হয়ে পড়লো দেশ। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার বিকৃত মানসিকতাও কাজ করতে থাকলো। পরিণতিতে ওয়ান-ইলেভেন। এর পরের ইতিহাস সবার জানা। শেখ হাসিনার প্রথম শাসন ছিল অনুকরণীয়। কিছু গডফাদারের তাণ্ডব না থাকলে হয়তো দ্বিতীয় দফায়ও ক্ষমতায় আসতেন। ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা একের পর এক সিদ্ধান্ত নিলেন- যা তার চরিত্রের সঙ্গে মানায় না। ভোটের জন্য লড়াই করলেন দশকের পর দশক। অথচ তিনিই ভোটকে বিদায় দিলেন। জনগণ ভোটের বাক্স কি জিনিস তা ভুলে গেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য রক্ত দিলো এ দেশের মানুষ। খালেদা চাপের মুখে রাজি হলেন। ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা বাতিল করে দিলেন নিজের স্বার্থে। ক্ষমতা চিরস্থায়ী হয় না- এই বাস্তবতা মানলে হয় তো এই আত্মঘাতী পথে পা বাড়াতেন না। পৃথিবীর নানা অঞ্চলে নৈরাজ্য থেকেই জন্ম হয় একনায়কতন্ত্রের। আখেরে একনায়কতন্ত্র হেরে যায়। জয়ী হয় মানুষ। জয়ী হয় মানব সভ্যতা। গণতন্ত্রের জয় তো হয়-ই। পৃথিবীব্যাপী যেখানেই গণতন্ত্র শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সেখানেই মানুষ স্বৈরাচারী ও উদ্ধত শাসককে প্রত্যাখ্যান করে। কে না জানে সুশাসনের প্রতিশ্রুতি যখন কুশাসনে পরিণত হয়, বিনয়ের মুখ যখন বদলে যায় ঔদ্ধত্যের রক্তচক্ষুতে- তখনই জনপ্রিয় শাসকেরা মানুষের আস্থা হারায়।
No comments