ঢাবির সাবেক ভিসি অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞাকে নিয়ে নানা রহস্য
ভাল নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা। বনানীর বাসায় কার্যত ‘গৃহবন্দি’ অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন তিনি। ভুগছেন অর্থকষ্টে। তার স্বজনদের দাবি বয়সজনিত কারণে তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে কিছুটা ‘অসুস্থ’। স্মৃতিভ্রষ্টতায় ভুগছেন প্রবীণ এই শিক্ষাবিদ। রাস্তায় বেরুলে কখন কি হয়, কোন দুর্ঘটনায় পড়েন, এ কারণে তাকে বেরুতে দেয়া হয় না। তিনি যাতে কারও সঙ্গে কথা বলতে ও যোগাযোগ না করতে পারেন এজন্য বিগত ছ’মাসের বেশি সময় ধরে তার মুঠো ফোন বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এমনকি তিনি যাতে বাইরে বেরুতে না পারেন সেজন্য তার ব্যাক্তিগত গাড়ির চাবিও তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। পরিচিত কারও সঙ্গে তেমন দেখা-সাক্ষাৎও করতে দেয়া হয় না তাকে। বনানীস্থ তার নিজ ফ্ল্যাটেই তাকে রাখা হয় কড়া নজরদারিতে। গতকাল অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়ার বনানীর ২/এ ‘জামান ভিলা’র তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, আমি শারীরিকভাবে ভাল আছি। সুস্থ আছি। কিছুটা সমস্যা হলেও বয়স আমাকে কাবু করতে পারেনি। কিন্তু আমার মন ভাল নেই। আমি রাস্তায় বেরুতে পারি না। পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারি না। এছাড়া অর্থকষ্ট আমাকে ভোগাচ্ছে। তিনি বলেন, আগে প্রেসক্লাব, ডিআরইউ (ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি)’র বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতাম। নিজের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা জীবনের নানান বিষয় অনেকের সঙ্গে শেয়ার করতাম। চলমান রাজনীতি নিয়েও কথা বলতাম। কিন্তু এখন তা পারি না। আমার ব্যাক্তিগত গাড়ির চাবি কেড়ে নেয়া হয়েছে। তবে কেন এমন হচ্ছে, তা বলতে ভয় তার। পাছে কারও বিরাগভাজন হন এই ভয়ে তিনি কারও কাছে মুখ খোলেন না। তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে অধ্যাপক মনিরুজ্জমান মিয়ার ব্যক্তিগত সম্পত্তি দখলের উদ্দেশ্যেই তার অতি ‘নিকটজনরা’ ষড়যন্ত্র করছেন। ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়েছেন। এজন্য তাকে সবার কাছ থেকে আড়াল করে মানসিক চাপ প্রয়োগ করে তার সম্পত্তি দখলের পাঁয়তারা করছেন।
সমপ্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তার এক সাবেক সহকর্মী শিক্ষক মনিরুজ্জামান মিঞার সঙ্গে বনানীর বাসায় দেখা করতে যান। এ সময় বাসায় উপস্থিত স্বজনদের পক্ষ থেকে বলা হয়, তিনি মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ। তাই তার সঙ্গে দেখা করা যাবে না। কিন্তু ওই সহকর্মী শিক্ষক জানতে পারেন, তিনি সুস্থ আছেন, ভাল আছেন। পরে ওই সহকর্মী বিষয়টি আরও কয়েকজনকে জানান। অধ্যাপক মনিরুজ্জমান মিয়া বলেন, আমি শিক্ষক মানুষ। সারাজীবন ছাত্র-ছাত্রীদের পড়িয়েছি। এখনও পড়াতে মন চায়। এজন্য দু’জন ঘনিষ্ঠজনকে চিঠি দিয়েছিলাম। তারা আমাকে কথা দিয়েছিলেন সরকারি বেসরকারি কোন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে অধ্যাপনার সুযোগ করে দেবেন। কিন্তু বাসা থেকে বেরুতে পারি না। তাই অধ্যাপনাও করতে পারছি না। তিনি বলেন, অন্য কোন সমস্যা নেই। শুধু আর্থিক সমস্যা ভোগাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। প্রতি মাসে আমারও তো খাওয়া-পরা লাগে। মনিরুজ্জমান মিয়া বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়ে কয়েক বছর আগে বেসরকারি ইবাইস ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করতাম। তখন মাসে প্রায় লাখ টাকা আসতো। এখন অধ্যাপনা করতে পারছি না। তাই অর্থকষ্টে ভুগছি। আমি জমিদার পরিবারের সন্তান। আমাদের জমিজমার কোন অভাব নেই। তারপরও আমি অর্থকষ্টে ভুগছি। তিনি বলেন, আমাকে বাসা থেকে বের হতে দেয়া হচ্ছে না। বের হতে চাইলে মনির নামে একটি ছেলে বলে, নিষেধ আছে। কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলেও অনুমতি দেয়া হয় না। সবাইকে বলা হচ্ছে, আমি মানসিকভাবে অসুস্থ। কিন্তু আমি পুরোপুরি সুস্থ রয়েছি। গাড়িচালককেও নিষেধ করে রাখা হয়েছে, এ কারণে আমি কোথাও যেতে চাইলে সে নিয়ে যেতে রাজি হয় না। ছ’মাসের বেশি সময় ধরে মুঠোফোন ব্যবহার করতে পারছি না। তবে কারা এমন করছে এমন প্রশ্নে নিরুত্তর থাকেন তিনি। পরক্ষণেই বলেন তার কাছের জনরাই এরকম করছে। তারা কারা এমন প্রশ্নেও নিশ্চুপ থাকেন তিনি।
বনানীতে তার মালিকানাধীন জামান ভিলার তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটে একজন গৃহকর্মী ও একজন গাড়িচালক রয়েছেন। তার দেখাশোনা করেন ছোট ভাই বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের গবেষণা পরিচালক ড. এম আসাদুজ্জামান ও তার স্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি আমলা ড. মেহেরুন্নেসা জামান। তাদের বাসা গুলশান। তবে আপাতত তাদের তত্ত্বাবধানেই রয়েছেন অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া, গৃহকর্মী ও গাড়িচালক। তাদের দাবি তারাই বর্তমানে তার দেখাশোনা করেন। তারা এ-ও দাবি করেন মনিরুজ্জামান মিঞা মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ। তাছাড়া তার বয়স হয়েছে। বার্ধক্যজনিত সমস্যার কারণে তাকে বাসায় সময় কাটাতে হয়। তারা বলেন, গত জানুয়ারিতে আমাদের পারিবারিক একটি বিষয় নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। মার্চে তার কিছুটা মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। যেটাকে চিকিৎসকরা আলজেইমার ডিজিস (স্মৃতিশক্তি জনিত সমস্যা) বলে চিহ্নিত করেন। কিছুই মনে রাখতে পারতেন না তিনি। এজন্য তাকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। কিন্তু তিনি কিছুতেই হাসপাতালে থাকতে চাইলেন না। এরপর থেকেই তার মানসিক সমস্যা বেড়েছে। কখন খান, কি করেন, কাকে কি বলেন তার কিছুই মনে রাখতে পারেন না। তিনি অর্থকষ্টে ভুগছেন কেন? এমন প্রশ্নে অধ্যাপক মনিরুজ্জামানের ছোট ভাই ড. এম আসাদুজ্জামান বলেন, ব্যাংকের এফডিআর (ফিক্সড ডিপোজিট রিসিট) থেকে ও নিজেরা প্রতি মাসে তার ওষুধ, খাওয়া ও হাত খরচের জন্য একটি নির্দ্দিষ্ট অঙ্কের টাকা আমরা দিচ্ছি। কিন্তু টাকা তিনি কি করেন তা তিনিই ভাল জানেন। অসুস্থতার বিষয়ে তিনি বলেন, যদি দাদা অসুস্থ নাই হতেন তাহলে প্রতিদিন তাকে এক গাদা ওষুধ খেতে হয় কেন? বাসার বাইরে বেরুতে না দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, বয়স হয়েছে। স্মৃতিভ্রষ্টতার কারণে রাস্তায় বেরুলে হয়তো দেখা যাবে পথ ভুলে বাসার ঠিকানাই ভুলে গেছে। তাছাড়া দুর্ঘটনাজনিত সমস্যা তো আছেই। এজন্য তাকে বাসা থেকে বেরুতে দিই না।
No comments