ভারত-পাকিস্তান সংলাপের নতুন কাঠামো by নাজাম শেঠি
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের
ভারত সফর যুদ্ধংদেহী মনোভাবের মানুষদের কিছু খিটখিটে প্রশ্ন তুলতে উসকে
দিয়েছে। শরিফ কেন মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ গ্রহণ
করলেন? গত বছর মনমোহন সিং তো নওয়াজ শরিফের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দেননি!
ভারতীয়রা জনসমক্ষে পাকিস্তানের তরফ থেকে সন্ত্রাসবাদ রপ্তানির অভিযোগ
তুললেও নওয়াজ কেন কাশ্মীর ইস্যু তুললেন না? নওয়াজ কেন সামগ্রিক বিষয়ে
সংলাপের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ না করে একতরফাভাবে মোদির সরকারকে
এমএফএন মর্যাদা একপ্রকার ‘উপহার’ হিসেবে তুলে দিলেন? এ থেকে বোঝা যায়,
নওয়াজের পররাষ্ট্রনীতি ব্যর্থ হয়েছে৷ কারণ ভারত ২৬/১১-এর মুম্বাই হামলার
পর নিজের এই অবস্থান থেকে এক চুলও সরে আসেনি যে, ‘মুম্বাইয়ে হামলার ঘটনায়
জড়িতদের শাস্তি না হলে ও হাফিজ সাঈদের লস্কর-ই-তাইয়েবা ভেঙে না দিলে
কোনো বিমিশ্র সংলাপ হবে না।’ অথচ পাকিস্তান সামগ্রিক সংলাপের মূল ইস্যু
কাশ্মীর একদম খাপছাড়াভাবে ছেড়ে দিয়েছে। উপসংহার হচ্ছে, কূটনীতির খেলায়
পাকিস্তান হেরেছে আর ভারত আবারও জিতেছে। প্রশ্নটা ভালো, কিন্তু উপসংহারগুলো
ভুল। এই হারা-জেতার মানদণ্ডে পাকিস্তান-ভারত সম্পর্ক বিচার করলে বা কে কী
পেল এই চিন্তা করলে পুরো বিষয়টিকে যোগফল-শূন্যর খেলা হিসেবে আখ্যা দেওয়া
যায়। এ ক্ষেত্রে ভারত জিতলে পাকিস্তান হারে, আবার পাকিস্তান জিতলে ভারত
হারে। এই যোগফল-শূন্যর খেলাটিতে দুই পক্ষ জেতে না, বরং এটি তার বিপরীত।
যেমন একটি বাণিজ্য চুক্তিতে উভয় দেশেরই বাণিজ্য বেড়ে যায় ও পারস্পরিক
কল্যাণ সাধিত হয়। ভারতের সঙ্গে আন্তসম্পর্কের ক্ষেত্রে এই যোগফল-শূন্য
মনোভাবের সমস্যা দ্বিমুখী। প্রথমত, এর ফলে পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় অনুগ্রহে
একটি জঙ্গি গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছে, যারা সব সময় ভারতকে আঘাত করার চেষ্টা
করে ও জোর করে কাশ্মীর ছিনিয়ে নিতে চায়। তারা লক্ষ্যে কামিয়াব তো হতেই
পারে না, উল্টো দেশের ভেতরে তারা সন্ত্রাসবাদের জন্ম দেয়। কাশ্মীরিদের
প্রতি বৈরী মনোভাব সৃষ্টি করে ও শেষ বিচারে পাকিস্তানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
দ্বিতীয়ত, এর ফলে ভারত আন্তর্দেশীয় সন্ত্রাসবাদের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের
ওপর নিজের শর্তাদি চাপিয়ে দেয়, আর কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তানের শর্ত এতে
চাপা পড়ে যায়, সংলাপও বন্ধ হয়ে যায়। ভারত বাজপেয়ির নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালে
‘সামগ্রিক সংলাপ’-এর প্রস্তাব দিয়েছিল এবং শরিফের নেতৃত্বে পাকিস্তান
১৯৯৯ সালে তা গ্রহণ করেছিল। মনমোহন ও মোশাররফ তা চালিয়েও নিয়ে গেছেন,
কিন্তু মুম্বাই হামলার পর তা ভেস্তে যায়। পাকিস্তান কী কী কারণে সেটা
লঙ্ঘন করার দিকে গেল, সেগুলোকে বিবেচনায় না এনে শর্তহীনভাবে এই সংলাপ নতুন
করে শুরু করার প্রস্তাব তোলা হলে তা আসলে খুব জোরালো হয় না।
সে কারণে নওয়াজ শরিফ এই যোগফল-শূন্য কর্মকৌশল বাদ দিয়ে তাঁর ভারত নীতিকে উভয় পক্ষের জন্য লাভজনক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। বৈষম্যহীনভাবে দুই দেশের বাজারে উভয় পক্ষের প্রবেশ—এ রকম একটি বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে নওয়াজ এই চেষ্টা করছেন। আসলে তিনি মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে শেষ মুহূর্তে চুক্তিটি স্বাক্ষর না করে ঠিকই করেছেন৷ কারণ তিনি জানতেন, মনমোহনের বিদায় আসন্ন, তাঁর জায়গায় আসছেন মোদি। তা হলে নওয়াজ শরিফের দিল্লি যাত্রার ফল কী? প্রথমত, মোদি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শরিফকে ‘প্রাইমাস ইন্টার পেয়ারস’ মর্যাদা দিয়েছেন (সার্কের সমশ্রেণির নেতাদের মধ্যে তিনিই প্রথম)। দুটি প্রবল করমর্দন, সম্মেলনকক্ষে ঢোকার মুখে ‘পেহেলে আপ’ (মোদির নেতৃত্বেই সবাই ঢোকেন), এলইটির বিরুদ্ধে হামিদ কারজাইয়ের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সত্ত্বেও দক্ষিণ ব্লকের পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য না করা—এসব ইঙ্গিতপূর্ণ। দ্বিতীয়ত, সারতাজ আজিজ যে বললেন ‘সংলাপের নতুন কাঠামো’ প্রস্তুত, দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবদের আগামী বৈঠকে এর বাস্তবায়ন দেখা যাবে, এই মন্তব্যটি তাৎপর্যপূর্ণ। বাস্তবে মনে হচ্ছে, দুই দেশই তাঁদের মূল ইস্যু (পাকিস্তানের ক্ষেত্রে কাশ্মীর ও ভারতের ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদ) দূরে ঠেলে সামগ্রিক সংলাপে বসতে রাজি (সব ইস্যুই কমবেশি একসঙ্গে)। অন্য কথায়, কোনো যোগফল-শূন্য ধাঁচের আর খেলা নয়।
নওয়াজ শরিফ ও সারতাজ আজিজ যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, তাতে এই ধারণা পাওয়া যায় যে ১৯৯৯ সালে যে িভত্তিতে আলোচনা হয়েছে, সেই ভিত্তিতে আবারও আলোচনা হবে। এতে দুই পক্ষই বাণিজ্যক্ষেত্রে জয়ী হওয়ার মতো জায়গায় থাকবে, দুই দেশেই উপকারভোগী শ্রেণি তৈরি হবে, দ্বিপক্ষীয় ক্ষতির আশঙ্কা থাকবে না। এতে বোঝা যায়, দুই পক্ষই তাঁদের মূল ইস্যুকে (ভারতের ক্ষেত্রে আন্তসীমান্ত সন্ত্রাস ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে কাশ্মীর) ঠেলে পেছনে সরিয়ে দেবে। এতে প্রাপ্তিশূন্যতা এড়ানো যাবে ও সিয়াচেন, সার ক্রিক, পানি প্রভৃতি ইস্যুতে যে সংলাপের সম্ভাবনা আছে, সেটাকে দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-ব্যবসা ও জনগণ-জনগণ পর্যায়ে আস্থার জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
দুই প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রেই দুটি শক্তিশালী চালিকাশক্তি আছে: অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্যবিমোচন। বৃহত্তর পরিসরে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে তাঁদের একটি ভীতি আছে: আরেকটি মুম্বাই ধরনের ঘটনা, কাশ্মীরে ইসলামি জিহাদ কার্যক্রম বৃদ্ধি ও নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর যুদ্ধ। এই যে মূল ইস্যুগুলোকে ঠেলে পেছনে সরানোর কথা বলা হলো, এতে হয়তো দুই দেশের মধ্যকার সমস্যার সমাধান ও ভুল বোঝাবুঝির দ্রুত অবসান ঘটানো সম্ভব হবে। নীতিগতভাবে, পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলো কৌশলগত ক্ষেত্রে নওয়াজ শিরফের পথেই আছে, যে পথে তিনি ভারতের সঙ্গে শান্তির খোঁজ করছেন। কীভাবে তা করা হবে, সে নিয়ে হয়তো কিছু মতান্তর থাকবে। কিন্তু একটি মৌলিক প্রশ্ন রয়ে যায়। নওয়াজ শরিফ কি নরেন্দ্র মোদিকে বোঝাতে পেরেছেন যে তিনি সামনের দিকে তাকাতে চান? অতীত নিয়ে আবিষ্ট তিনি নন? দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে ভবিষ্যৎমুখী যাত্রার পথ তৈরি করতে চান?
সত্য হচ্ছে, নওয়াজ শরিফ যদি দেশের ভেতরে সন্ত্রাসবাদের রাশ টেনে না ধরেন, তাহলে তাঁর সব প্রচেষ্টা ভেস্তে যাবে। আবার দুই দেশের মিলিত প্রচেষ্টায় এই সন্ত্রাসবাদ উড়ে যেতে বাধ্য।
পাকিস্তানের ফ্রাইডে টাইমস সাময়িকী থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
নাজাম শেঠি: সম্পাদক, ফ্রাইডে টাইমস।
No comments